পুরাণে গণেশ

পুরাণে গণেশ-সংক্রান্ত অনেক কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায়। গণেশের মাথা হাতির মতো হওয়ায়, তাঁকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়।[1] তাঁকে কার্যারম্ভ ও বিঘ্ন অপসারণকারী দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়।[2] গণেশ শিল্প ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক এবং জ্ঞান ও বুদ্ধির দেবতা।[3] সংস্কৃত সাহিত্যে গণেশ কীভাবে একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হয়ে উঠলেন, সেই বিষয়ে সমীক্ষা করতে গিয়ে লুডো রোচার লিখেছেন:

সর্বোপরি, সবাই এটা খেয়াল করবেন যে, গণেশ-সংক্রান্ত যে অসংখ্য গল্প প্রচলিত আছে, তা দানা বেঁধেছে অল্প কয়েকটি ঘটনাকে ঘিরে। এই ঘটনাগুলির সংখ্যা প্রধানত তিন: তাঁর জন্ম ও পিতামাতার কথা, তাঁর হাতির মাথা এবং তাঁর একটি মাত্র দাঁত থাকার কথা। অন্যান্য ঘটনাগুলিও ধর্মগ্রন্থগুলি ছুঁয়ে গিয়েছে, তবে সেগুলির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।[4]

বাশোলি মিনিয়েচার, ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ

গণেশ-সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনিগুলি পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় ৬০০ অব্দের পরে লেখা আধুনিক পুরাণ গ্রন্থগুলিতে। খ্রিস্টীয় ৬০০ অব্দের আগে লেখা বায়ু পুরাণব্রহ্মাণ্ড পুরাণ-এ গণেশের যে গল্প পাওয়া যায়, তা সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ওই দুই পুরাণে প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল। [5]

জন্ম ও শৈশব

শিশু গণেশের সঙ্গে খেলা করছেন পার্বতী।

লোকবিশ্বাস অনুসারে, গণেশ হলেন শিবপার্বতীর পুত্র। তবে পুরাণে তাঁর জন্ম সম্পর্কে বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়।[6][7] একটি মতে শিব তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন।[8] অন্যমতে তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন পার্বতী।[9] আরেকটি মতে, শিব ও পার্বতী দুজনে মিলে তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন।[10] আবার অন্য একটি মতে, শিব ও পার্বতী এক রহস্যময় উপায়ে তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন।[11]

গণেশের ভ্রাতা হলেন কার্তিক[12] তবে দুজনের মধ্যে কে বড়ো তা নিয়েও মতভেদ আছে। উত্তর ভারতে সাধারণত কার্তিককে বড়ো ও গণেশকে ছোটো ভাই মনে করা হয়। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে গণেশই জ্যেষ্ঠভ্রাতা।[13] দেবতা হিসেবে গণেশের গুরুত্ব অর্জনের আগে, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যুদ্ধদেবতা হিসেবে কার্তিক বিশেষ জনপ্রিয় ছিলেন। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে উত্তর ভারতে কার্তিক পূজার গুরুত্ব কমে যায়। কার্তিক জনপ্রিয়তা হ্রাস ও গণেশের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি প্রায় সমসাময়িক ঘটনা। গণেশ ও কার্তিকের মধ্যে ভ্রাতৃসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনেক গল্পও পুরাণে পাওয়া যায়।[14] সম্ভবত সুদূর অতীতে গণেশ ও কার্তিক-পূজক সম্প্রদায় দুটির সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব এই সব গল্পগুলির জন্ম দিয়েছিল।[15]

একবার গণেশ ও কার্তিকের মধ্যে ত্রিভুবন পরিক্রমার একটি প্রতিযোগিতা হয়েছিল। বিজয়ীর পুরস্কার ধার্য হয়েছিল জ্ঞানফল। কার্তিক তিন ভুবন পর্যটনে বেড়িয়ে পড়েন। কিন্তু গণেশ শুধু তাঁর বাবা-মাকেই প্রদক্ষিণ করেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে গণেশ জানান, তাঁর পিতামাতা শিব ও পার্বতীই ত্রিভুবন। সেই জন্য গণেশকেই জ্ঞানফল দেওয়া হয়।

হাতির মাথা

গণেশের হাতির মাথা

গণেশের মাথাটি হাতির মতো কেন, তার ব্যাখ্যা একাধিক পুরাণের নানা গল্পে দেওয়া হয়েছে। সাধারণত, এই ব্যাখ্যা গণেশের জন্ম-সংক্রান্ত একটি বিষয়। এই সব গল্পে গণেশ-উপাসনাকারী সম্প্রদায়ের বিপুল জনপ্রিয়তার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। ভক্তেরা সাধারণত তাঁর ‘গজমুণ্ড’টিকে বুদ্ধি, অতুলনীয় শক্তি, বিশ্বস্ততা এবং হাতির অন্যান্য চারিত্রিক গুণের প্রতীক হিসেবে দেখেন। তাঁর বিশাল কানদুটি জ্ঞান ও সাহায্যপ্রার্থীর প্রার্থনা শ্রবণের ক্ষমতার প্রতীক।

শিব-কর্তৃক শিরোশ্ছেদ

গণেশের সাধারণ চতুর্ভূজ মূর্তি, নাগপুর চিত্রশৈলী, ১৮১০; চণ্ডীগড় সংগ্রহালয়ে সংরক্ষিত।

সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি সম্ভবত শিব পুরাণ থেকে গৃহীত হয়েছে। এক দিন দেবী পার্বতী কৈলাসে স্নান করছিলেন। স্নানাগারের বাইরে তিনি নন্দীকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, যাতে তাঁর স্নানের সময় কেউ ভিতরে ঢুকতে না পারে। এই সময় শিব এসে ভিতরে প্রবেশ করতে চান। নন্দী শিবের বাহন। তাই প্রভুকে তিনি বাধা দিতে পারলেন না। পার্বতী রেগে গেলেন। তিনি ভাবলেন, নন্দী যেমন শিবের অনুগত, তেমনই তাঁর অনুগত কোনো গণ নেই। তাই তিনি তাঁর প্রসাধনের হলুদমাখা কিছুটা নিয়ে গণেশকে সৃষ্টি করলেন এবং গণেশকে নিজের অনুগত পুত্র রূপে ঘোষণা করলেন।

এরপর থেকে পার্বতী স্নানাগারের বাইরে গণেশকে দাঁড় করাতেন। একবার শিব এলেন। তিনি ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলেন। কিন্তু গণেশ তাঁকে বাধা দিলেন। শিব রেগে গিয়ে তাঁর বাহিনীকে আদেশ দিলেন গণেশকে হত্যা করার। কিন্তু তারা গণেশের সামান্য ক্ষতি করতেও সক্ষম হল না।

এতে শিব অবাক হলেন। তিনি বুঝলেন, গণেশ সামান্য ছেলে নয়। তাই তিনি নিজে গণেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এলেন। শিব গণেশের মুণ্ডটি কেটে তাকে হত্যা করলেন। একথা জানতে পেরে পার্বতীও রেগে সমগ্র সৃষ্টি ধ্বংস করে ফেলতে উদ্যোগী হলেন। তখন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাঁর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। পার্বতী দুটি শর্ত দিলেন। প্রথমত, গণেশের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে এবং সকল দেবতার পূজার আগে তাঁর পূজার বিধি প্রবর্তন করতে হবে।

এই সময় শিবেরও রাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি পার্বতীর শর্ত মেনে নিলেন। তিনি ব্রহ্মাকে উত্তর দিকে পাঠিয়ে বললেন, যে প্রাণীটিকে প্রথমে দেখতে পাওয়া যাবে, তারই মাথাটি কেটে আনবে। কিছুক্ষণ পরে ব্রহ্মা এক শক্তিশালী হাতির মাথা নিয়ে ফিরে এলেন। শিব সেই মাথাটি গণেশের দেহে স্থাপন করলেন। তারপর তাঁর মধ্যে প্রাণের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হল। শিব গণেশকে নিজ পুত্র ঘোষণা করলেন এবং সকল দেবতার পূজার আগে তাঁর পূজার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই সঙ্গে তাঁকে সকল গণের অধিপতি নিযুক্ত করা হল।

শিব ও গজাসুর

গণেশের উৎপত্তি ও তাঁর হাতির মাথা নিয়ে আরেকটি গল্প প্রচলিত আছে: পুরাকালে হাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক অসুরের অস্তিত্ব ছিল। তার নাম ছিল গজাসুর। সে একবার প্রচণ্ড তপস্যা করেছিল। শিব তার তপস্যার তুষ্ট হয়ে তাকে মনোমত বর দিতে ইচ্ছা করেন। অসুর চাইল, তার শরীর থেকে যেন সব সময় আগুন বেরিয়ে আসতে থাকে, যাতে কেউ তার কাছে ঘেঁষতে সাহস না পায়। শিব তাকে সেই বর দেন। কিন্তু গজাসুর তার তপস্যা চালিয়ে গেল। শিব আরেকবার তার সামনে এসে তাকে বর দিতে চাইলেন। অসুর বলল, “আমি চাই আপনি আমার পাকস্থলীতে বাস করুন।”

অল্পে তুষ্ট শিব গজাসুরকে মনোমত বর দিয়ে দেন। কিন্তু এই বর অন্য সমস্যার সৃষ্টি করে। পার্বতী তাঁকে খুঁজতে বের হন। শেষে তিনি নিজের ভাই বিষ্ণুর সাহায্যে শিবকে খুঁজে পান। বিষ্ণু তখন শিবের বাহন নন্দীকে এক নৃত্যকারী ষাঁড় বানিয়ে নিজে বাঁশিওয়ালার ছদ্মবেশ নেন। এরপর উভয় আসেন গজাসুরের কাছে বাঁশি বাজাতে। বিষ্ণুর বাঁশি শুনে গজাসুর খুশি হয়ে তাঁকে কিছু দিতে চাইল। বিষ্ণু বললেন, তাঁর গজাসুরের পাকস্থলীতে বন্দী শিবের মুক্তি চাই। সে বিষ্ণুকে চিনতে পেরে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল শিব মুক্তি পেলেন। তখন গজাসুর শেষ বরটি চাইল। সে বলল, “আমি চাই, আমি মরে যাবার পরও যেন লোকে আমার মাথাটিকে পূজা করে।” শিব তখন নিজের পুত্রকে সেখানে এনে গজাসুরের সঙ্গে নিজ পুত্রের মুণ্ডবদল করালেন। সেই থেকে সকল দেবতার পূজার আগে গণেশের পূজা চালু হল।

শনির দৃষ্টি

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এর কাহিনি অনুসারে, গণেশের জন্ম হয়েছিল অন্যভাবে। শিব ও পার্বতী পুত্রলাভের আশায় বর্ষব্যাপী পুণ্যক ব্রত ও বিষ্ণুপূজা করেছিলেন। এই ব্রতে তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু বলেছিলেন, তিনি প্রতি কল্পে পার্বতীর পুত্ররূপে অবতীর্ণ হবেন। এরপর পার্বতীর গর্ভে এক পুত্রের জন্ম হয়। সকল দেবদেবী তাঁর জন্ম উপলক্ষে উৎসবে মেতে ওঠেন। যদিও সূর্যের পুত্র শনি শিশুটির দিকে তাকাতে ইতস্তত করেন। কারণ শনির দৃষ্টি অমঙ্গলজনক। কিন্তু পার্বতীর পীড়াপীড়িতে শনি শিশুটির দিকে তাকাতে বাধ্য হন। মুহুর্তের মধ্যে শিশুর মস্তক ছিন্ন হয়ে গোলোকে চলে যায়। শিব ও পার্বতী এতে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লে বিষ্ণু গরুড়ের পিঠে চড়ে পুষ্পভদ্র নদীর তীরে এসে উপস্থিত হন। সেখান থেকে তিনি একটি হস্তিশিশুর মাথা নিয়ে ফিরে আসেন। এরপর পার্বতীর শিশুর মুণ্ডহীন দেহে সেই হাতির মাথাটি বসিয়ে তার প্রাণ ফিরিয়ে আনা হয়। এই শিশুর নাম রাখা হয় গণেশ এবং দেবতারা তাঁকে আশীর্বাদ করেন।

পাদটীকা

  1. Martin-Dubost, p. 2.
  2. These ideas are so common that Courtright uses them in the title of his book, Gaṇeśa: Lord of Obstacles, Lord of Beginnings.
  3. Heras, p. 58.
  4. Brown, p. 73.
  5. Krishan, p. 103.
  6. For a summary of Puranic variants of birth stories, see Nagar, pp. 7-14.
  7. Martin-Dubost, pp. 41-82.
  8. Linga Purana.
  9. Shiva Purana IV. 17.47-57 and Matsya Purana 154.547.
  10. Varāha Purana 23.18-59.
  11. Brahmavaivarta Purana, Ganesha Khanda, 10.8-37.
  12. For a summary of variant names for Skanda, see Thapan, p. 300 and Brown, p. 355.
  13. Khokar and Saraswati, p.4.
  14. Brown, pp. 4, 79.
  15. Gupta, p. 38.

তথ্যসূত্র

  • Apte, Vaman Shivram (১৯৬৫)। The Practical Sanskrit Dictionary। Delhi: Motilal Banarsidass Publishers। আইএসবিএন 81-208-0567-4। (fourth revised & enlarged edition).
  • Brown, Robert L. (১৯৯১)। Ganesh: Studies of an Asian God। Albany: State University of New York। আইএসবিএন 0-7914-0657-1।
  • Courtright, Paul B. (১৯৮৫)। Gaṇeśa: Lord of Obstacles, Lord of Beginnings। New York: Oxford University Press। আইএসবিএন ISBN 0-19-505742-2 |আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: invalid character (সাহায্য)
  • Gupta, Shakti M. (১৯৮৮)। Karttikeya: The Son of Shiva। Bombay: Somaiya Publications Pvt. Ltd.। আইএসবিএন 81-7039-186-5।
  • Heras, H. (১৯৭২)। The Problem of Ganapati। Delhi: Indological Book House।
  • Krishan, Yuvraj (১৯৯৯)। Gaņeśa: Unravelling An Enigma। Delhi: Motilal Banarsidass Publishers। আইএসবিএন 81-208-1413-4।
  • Martin-Dubost, Paul (১৯৯৭)। Gaņeśa: The Enchanter of the Three Worlds। Mumbai: Project for Indian Cultural Studies। আইএসবিএন 81-900184-3-4।
  • Nagar, Shanti Lal (১৯৯২)। The Cult of Vinayaka। New Delhi: Intellectual Publishing House। আইএসবিএন 81-7076-043-9।
  • Saraswati, S. (২০০৫)। Ganesha-Karttikeya। New Delhi: Rupa and Co.। আইএসবিএন 81-291-0776-7। অজানা প্যারামিটার |coauthors= উপেক্ষা করা হয়েছে (|author= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য)
  • Thapan, Anita Raina (১৯৯৭)। Understanding Gaņapati: Insights into the Dynamics of a Cult। New Delhi: Manohar Publishers। আইএসবিএন 81-7304-195-4।


This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.