উচ্ছিষ্টগণেশ

উচ্ছিষ্টগণেশ বা উচ্ছিষ্টগণপতি (সংস্কৃত: उच्छिष्ट-गणपति, Ucchiṣṭa Gaṇapati) হলেন হিন্দু দেবতা গণেশের (গণপতি) একটি তান্ত্রিক রূপ। গাণপত্য সম্প্রদায়ের ছয়টি প্রধান শাখার অন্যতম উচ্ছিষ্টগাণপত্য শাখায় ইনি প্রধান দেবতা। মূলত বামাচার প্রথায় তার পূজা প্রচলিত আছে। উচ্ছিষ্টগণেশের মূর্তিতত্ত্বটি আদিরসাত্মক। তার মূর্তিতে একটি নগ্ন দেবীর উপস্থিতি লক্ষিত হয়। ভক্তিশাস্ত্রে উল্লিখিত গণেশের ৩২টি রূপের অন্যতম হলেন উচ্ছিষ্টগণেশ। উচ্ছিষ্টগাণপত্য শাখার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন হেরম্বসূত

উচ্ছিষ্টগণেশ, নঞ্জনগুড

নামকরণ

‘উচ্ছিষ্ট’ (আহারের পর খাদ্যের পরিত্যক্ত অবশিষ্টাংশ) শব্দটি থেকে ‘উচ্ছিষ্টগণেশ’ নামটি এসেছে। এই শব্দটি এখানে তান্ত্রিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্ত হয়েছে। মুখে থেকে যাওয়া খাবারকে উচ্ছিষ্ট বলা হয়। এই খাবারে মুখের লালারস লেগে থাকে বলে হিন্দুধর্মে এটিকে অশুদ্ধ মনে করা হয়।[1]

মূর্তিতত্ত্ব

গণেশের অন্যান্য রূপের মতো উচ্ছিষ্টগণেশও গজানন। মন্ত্রমহার্ণব অনুসারে, তার গাত্রবর্ণ রক্তাভ। কিন্তু উত্তরকামিকাগম অনুসারে, তার গাত্রবর্ণ কৃষ্ণ।[2] আরেকটি বর্ণনা অনুসারে, তার গাত্রবর্ণ নীল।[3] বিভিন্ন বিবরণ অনুসারে, উচ্ছিষ্টগণেশ চতুর্ভূজ বা ষড়ভূজ। তিনি উপবিষ্ট অবস্থায় থাকেন। কোথাও কোথাও তার মূর্তি পদ্মের আসনে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যায়। উত্তরকামিকাগম অনুসারে, তার মস্তকে থাকে একটি রত্নমুকুট এবং তার ললাটে থাকে একটি তৃতীয় নয়ন।[2]

ক্রিয়াকর্মদ্যোতি গ্রন্থের বিবরণ অনুসারে, উচ্ছিষ্টগণেশের ছয় হাতে থাকে পদ্ম (কোনো কোনো বর্ণনা অনুসারে নীল পদ্ম),[3] একটি দাড়িম্ব ফল, একটি বীণা, একটি অক্ষমালা ও একটি ধান্যশীর্ষ।[2] মন্ত্রমহার্ণব গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে, তার হাতে থাকে একটি তির, একটি ধনুক, একটি পাশ ও একটি অঙ্কুশ[2] উত্তরকামিকাগম গ্রন্থে রয়েছে, উচ্ছিষ্টগণেশের চারটি হাত এবং তার মধ্যে তিনটি হাতে রয়েছে একটি পাশ, একটি অঙ্কুশ ও একটি ইক্ষুদণ্ড।[2]

উচ্ছিষ্টগণেশ, নাগেশ্বরস্বামী মন্দির, কুম্বকোনাম। দেবতারা একে অপরের গোপন অঙ্গ স্পর্শ করে আছেন।

রাও উচ্ছিষ্টগণেশকে পাঁচটি শক্তি-গণেশ মূর্তির অন্যতম বলে বর্ণনা করেছেন। এই মূর্তিতে গণেশের একজন শক্তি বা স্ত্রী রয়েছেন।[4] গণেশের বিরাট মূর্তির সঙ্গে একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার স্ত্রীমূর্তি থাকে।[1] একজন নগ্ন দেবী তার কোলে উপবিষ্ট অবস্থায় থাকেন। এই দেবীর দুটি হাত। তিনি নানাপ্রকার অলংকার পরিধান করে থাকেন। উত্তরকামিকাগম গ্রন্থে এই দেবীর নাম বিঘ্নেশ্বরী। এই গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে, এই দেবী সুন্দরী ও যুবতী। উচ্ছিষ্টগণেশের চতুর্থ হাতটি এই নগ্ন দেবীর গোপন অঙ্গ স্পর্শ করে থাকে। মন্ত্রমহার্ণব অনুসারে, উচ্ছিষ্টগণেশের মূর্তি এমন হওয়া উচিত, যা দেখে মনে হয় তিনি যৌনসংগমে উদ্যত হয়েছেন।[2]

উচ্ছিষ্টগণেশের শাস্ত্রসম্মত রূপটি সাধারণত ভাস্কর্যগুলিতে ফুটিয়ে তোলা হয়নি। তার মূর্তিতে তার বাঁ কোলে একজন নগ্ন স্ত্রী বসে থাকেন। সাধারণত উচ্ছিষ্টগণেশকে চতুর্ভূজ মূর্তিতেই দেখানো হয়েছে। তার তিনটি হাতে থাকে পাশ, অঙ্কুশ ও একটি লাড্ডু বা মোদক। চতুর্থ বাহুটি সেই নগ্ন দেবীর নিতম্ব আলিঙ্গণ করে থাকে। দেবী বাঁ হাতে একটি পদ্ম বা অন্য কোনো ফুল ধরে থাকেন।[2][5] হাতের বদলে, গণেশের শুঁড়ের ডগাটি নগ্ন দেবীর যোনি স্পর্শ করে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেবীমূর্তিটিকে ডান হাতে উচ্ছিষ্টগণেশের লিঙ্গ স্পর্শ করে থাকতে দেখা যায়।[2][6] এই ধরনের আদিরসাত্মক মূর্তি কেবল উচ্ছিষ্টগণেশের চতুর্ভূজ মূর্তিতেই সীমাবদ্ধ।[6]

কোহেন বলেছেন যে, অনেক গণেশ মূর্তির সঙ্গেই একটি শক্তি মূর্তিকে তার বাঁ কোলে বসে থাকতে দেখা যায়। এই শক্তি কোলে একটি মোদকের থালা ধরে থাকেন এবং গণেশের শুঁড় সেই থালা স্পর্শ করে থাকে সেই মোদক ভক্ষণ করার জন্য। শুঁড়টি গণেশ ও সেই দেবীর মধ্যে ‘আদিরসাত্মক বন্ধনে’র প্রতীক। উচ্ছিষ্টগণেশ মূর্তিতে এই ধারণাটি আরও এক ধাপ উপরের। মোদকের বাটির পরিবর্তে তাঁর শুঁড় এখানে দেবীর যোনি স্পর্শ করে থাকে। এই ধরনের আদিরসাত্মক মূর্তিতত্ত্ব তান্ত্রিক গাণপত্য শাখাগুলির প্রভাবকে প্রতিফলিত করে। দাড়িম্ব ফলটিও প্রজননের প্রতীক। গাণপত্য সম্প্রদায়ের নানান মূর্তিতে এটি দেখা যায়।[7]

পূজা

উচ্ছিষ্টগণেশ, শ্রীতত্ত্বনিধি গ্রন্থের পুথিচিত্র (১৯শ শতাব্দী)। এই ছবিতে উচ্ছিষ্টগণেশের সঙ্গে একটি বস্ত্রপরিহিত দেবীকে দেখা যায়। উচ্ছিষ্টগণেশের বস্ত্রপরিহিত সঙ্গিনীর চিত্রণ অন্যত্র দুর্লভ।

ক্রিয়াকর্মদ্যোতি অনুসারে, উচ্ছিষ্টগণেশের পূজা করা হয় শ্রেষ্ঠ বর লাভের জন্য। রাও বলেছেন যে, ‘অনেকে’ কামনাপূরণের জন্য উচ্ছিষ্টগণেশের পূজা করেন।[2] তাকে দেশের রক্ষাকর্তা মনে করা হয়। কথিত আছে, তার ধ্যান করলে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রাপ্ত হওয়া যায়।[8] তিরুনেলভেলিতে উচ্ছিষ্টগণেশের একটি মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরে সন্তানকামনায় উচ্ছিষ্টগণেশের পূজা করা হয়।[9]

উচ্ছিষ্টগণেশ হলেন গাণপত্য সম্প্রদায়ের ছয়টি প্রধান শাখার অন্যতম উচ্ছিষ্টগাণপত্য শাখার প্রধান দেবতা।[1] এই শাখার অনুগামীরা তান্ত্রিক বামাচারী। এই শাখাটি সম্ভবত শাক্তধর্মের কৌল পূজার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।[10] উচ্ছিষ্টগণেশের মূর্তিকল্পটিও কৌল তান্ত্রিক প্রকৃতির।[11] এই আদিরসাত্মক মূর্তিকল্পটি গণেশ ও মহাশক্তির একত্বের দ্যোতক রূপে প্রতিভাত হয়।[7] মূলধারার হিন্দুধর্মে মদ নিষিদ্ধ হলেও, এই শাখার অনুগামীদের কাছে উচ্ছিষ্টগণেশ মদ্যপানরত এবং তার পূজাতেও মদ ব্যবহৃত হয়।[1][10] এই শাখার অনুগামীরা তাদের কপালে লাল টীকা অঙ্কন করেন।[10][11] এই শাখার অনুগামীরা জাতি ও বর্ণভেদ প্রথা মানেন না, মূলধারা হিন্দুধর্মের যৌনতা ও বিবাহ-সংক্রান্ত ধারণাকে অস্বীকার করেন এবং মূলধারার হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানগুলির পালন অনুগামীদের নিজস্ব ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেন।[1][7][10]

বামাচারী প্রথা অনুসারে, উচ্ছিষ্টগণেশকে পূজার সময় পূজককে ‘উচ্ছিষ্ট’ অবস্থায় (অর্থাৎ নগ্ন বা মুখে খাদ্যদ্রব্য নিয়ে) পূজা করতে হয়।[12]

উচ্ছিষ্টগণেশ ছয়টি অভিচার ক্রিয়ার (অশুভ উদ্দেশ্যে মন্ত্রের প্রয়োগ) সঙ্গে যুক্ত। মনে করা হয়, তার মন্ত্রের মাধ্যমে মন্ত্র-উচ্চারণকারী তার শত্রুকে মোহগ্রস্থ করতে পারে, আকর্ষিত করতে পারেন, ঈর্ষান্বিত করতে পারেন, বশ করতে পারেন, অসার করতে পারেন বা হত্যা করতে পারেন।[12]

আরও দেখুন

  • পঞ্চমকার

তথ্যসূত্র

  1. Sanford, James H.. "Literary Aspects of Japan's Dual-Ganeśa Cult", in Brown, pp. 313–15.
  2. Rao pp. 53-5
  3. Satguru Sivaya Subramuniyaswami। Loving Ganesha। Himalayan Academy Publications। পৃষ্ঠা 66। আইএসবিএন 978-1-934145-17-3।
  4. Rao p. 53
  5. Rao pp. 64-5
  6. Thomas E. Donaldson (২০০২)। Tantra and Śākta Art of Orissa। D.K. Printworld। পৃষ্ঠা 804–5। আইএসবিএন 978-81-246-0198-3।
  7. Cohen, Lawrence in Brown pp. 120–1
  8. T.K.Jagannathan। Sri Ganesha। Pustak Mahal। পৃষ্ঠা 103। আইএসবিএন 978-81-223-1054-2।
  9. "Sri Uchishta Ganapathi temple"। Dinamalar। সংগ্রহের তারিখ ৩০ জানুয়ারি ২০১৬
  10. Bhandarkar p. 213
  11. Nagar p. 59
  12. Grewal pp. 122–3

গ্রন্থপঞ্জি

  • Brown, Robert, সম্পাদক (১৯৯১)। Ganesh: Studies of an Asian God। Albany: State University of New York। আইএসবিএন 0-7914-0657-1।
  • T. A. Gopinatha Rao (১৯৯৩)। Elements of Hindu iconography। Motilal Banarsidass Publisher। পৃষ্ঠা 53–55। আইএসবিএন 978-81-208-0878-2।
  • Royina Grewal (২০০৯)। Book of Ganesha। Penguin Books Limited। পৃষ্ঠা 122–3। আইএসবিএন 978-93-5118-091-3।
  • Ramkrishna Gopal Bhandarkar (১৯৯৫) [1913]। Vaisnavism, Saivism and Minor Religious Systems। Asian Educational Services। আইএসবিএন 978-81-206-0122-2।
  • Shanti Lal Nagar (১৯৯২)। The Cult of Vinayaka। Intellectual Pub. House। আইএসবিএন 978-81-7076-043-6।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.