টিনের তলোয়ার

টিনের তলোয়ার বিখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা উৎপল দত্ত কর্তৃক রচিত ও পরিচালিত একটি বাংলা নাটক। নাটকটি প্রযোজনা করে পিপলস্‌ লিটল থিয়েটার।

টিনের তলোয়ার
লেখকউৎপল দত্ত
দেশভারত
ভাষাবাংলা
ধরননাটক
মিডিয়া ধরননাটক

নাটকের ইতিহাস

টিনের তলোয়ার নাটকটি উৎপল দত্তের পরিচালনায় ১২ই আগষ্ট, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পিপলস্‌ লিটল থিয়েটারের প্রযোজনায় কলকাতা শহরে ,রবীন্দ্রসদন মঞ্চে প্রথম অভিনীত হয়।পিপলস্‌ লিটল থিয়েটারের এটি প্রথম প্রযোজনা । জাতীয় সাহিত্য পরিষদ ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে এই নাটকটি প্রথম প্রকাশ করেন। এই নাটকটি হিন্দী ভাষায় টীন কি তলবার নামে অনামিকা বিমল্পাঠ ও পরে দেবকান্ত শুক্লা প্রযোজনা করে মঞ্চস্থ করেন। ঊনবিংশ শতকে , অপরিসীম আত্মত্যাগে যাঁরা বাংলা পেশাদার রঙ্গমঞ্চে গড়ে তুলেছিলেন - এই নাটক তাদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি । এই নাটকের মুখবন্ধে, উৎপল দত্ত লিখেছেনঃ 'বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের শতবার্ষিকীতে প্রণাম করি সেই আশ্চর্য মানুষগুলিকে- যাহারা কুষ্ঠগ্রস্থ সমাজের কোন নিয়ম মানেন নাই, সমাজও যাহাদের দিয়াছিল অপমান ও লাঞ্ছনা । যাহারা মুৎসুদ্দীদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকিয়াও ধনীদের মুখোশ টানিয়া খুলিয়া দিতে ছাড়েন নাই । যাহারা পশুশক্তির ব্যাদিত মুখগহবরের সম্মুখে টিনের তলোয়ার নাড়িয়া পরাধীন জাতির হৃদয়বেদনাকে দিয়াছিল বিদ্রোহ-মূর্তি।যাহারা বহু বাচষ্পতি-শিরোমণি, বহু রাজা মহারাজার শত পদাঘাতে জর্জরিত, যাহারা অপাংক্তেয় ছোটলোকের আশীর্বাদধন্য, যাহারা ভালবাসার বিশাল আলিঙ্গন উন্মুক্ত করিয়া জনগনের গভীরে ঘুরিয়া বেড়াইতেন । যাহারা সৃষ্টিছাড়া, বেপরোয়া,বাঁধনহারা । যাহারা মাতাল, উদ্দাম, সৃষ্টির নেশায় উন্মাদ। যাহাদের মদ্যাসিক্ত অঙ্গুলিস্পর্শে ছিল বিশ্বকর্মার জাদু। যাহাদের উল্লসিত প্রতিভায় সৃষ্টি হইল বাঙালীর নাট্যশালা,জাতির দর্পণ,বিদ্রোহের মুখপত্র।যাহারা আমাদের শৈলেন্দ্রসদৃশ পূর্বসূরী। '

নাটকের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

নাটকের ঘটনা স্থান- কলকাতা, কাল- ঊনবিংশ শতক

নাটকের মুখ্য চরিত্র -

  • অভিনেতা ও পরিচালক বেণীমাধব চাটুজ্যে ওরফে কাপ্তেনবাবু
  • 'দি গ্রেট বেঙ্গল' অপেরার সত্ত্বাধিকারী বেণিয়া বীরকৃষ্ণ দাঁ
  • তরুণ ডিরোজিয়ান বুদ্ধজীবী প্রিয়নাথ মল্লিক
  • আলুবিক্রেতা ময়না - যে কাপ্তেনবাবুর সাধনায় পরিণত হয় অভিনেত্রী শংকরীতে
  • বসুন্ধরা

নাটকটি ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি বাস্তব চিত্র। ১৮৭৬ সালে, ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত নাট্য নিয়ন্ত্রন আইন [1] প্রণয়ন করেছিল। ব্রিটিশ সরকার , নাটকের মাধ্যমে সরকার বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠতে দেখে - শঙ্কিত হয়ে এই আইনটি করে । এই আইনের পটভূমিকায়, বাংলা নাটকের ফেলে আসা ইতিহাসের মধ্যে তৎকালীন সমাজের নিপীড়ন নিষ্পেষণের ছবি এই নাটকে আঁকা হয়েছে। রাজদ্রোহমূলক নাটকগুলিকে ব্রিটিশ সরকার অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল ও নাটকের উপর সরাসরি আক্রমনও চালান হচ্ছিল। এছাড়া, কিছু স্বল্প শিক্ষিত ধনপতির ব্যভিচারের ফণাও নাটকের উপর থাকত। সেই যুগপরিবেশকে এই নাটকে ধরা হয়েছে।
নাটকে, বীরকৃষ্ণ দাঁ মুৎসুদ্দী ধনপতি। তার কাছে নাট্যশিল্প এবং মঞ্চের পণ্যমূল্য ছাড়া আর কোন মুল্য নেই। সে সময় ,এই বীরকৃষ্ণদের মত একধরনের ত্রিশঙ্কু সম্প্রদায় তৈরী হয়েছিল, যারা একদিকে ইংরেজদের স্বার্থ অটুট রাখত অন্যদিকে মেকি আভিজাত্যবোধে আর টাকার গরিমায় সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, নাটকে মাতব্বরি করত।
বেণীমাধব ওরফে কাপ্তেনবাবু এ নাটকের সর্বপ্রধান চরিত্র। বেণীমাধব কোন একক অস্তিত্ব নন - তিনি যেন সেই যুগের অসামান্য নাট্য ব্যক্তিত্ব গিরিশচন্দ্র ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ দাস, দীনবন্ধু মিত্র ,অমৃতলাল বসুদের মত মানুষের সমবায় উপস্থিতি। তিনি 'বাংলা থিয়েটারের গ্যারিক'। বেণীমাধবের কাছে সবার উপর শিল্প সত্য। শিল্পীর স্বাধীনতা তার কাম্য, সে স্বাধীনতা যে কোন মূল্যে লাভ করতে তিনি কুন্ঠিত নন। বেণীমাধবের মত মানুষকে আপোস করতে হয় বীরকৃষ্ণের মত কদর্য, নারীমাংসলোভী বাবুদের সাথে।
প্রিয়নাথ একজন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ। সে বাবু-সংস্কৃতির উত্তারাধীকার ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে ক্রমশ শ্রেণীচ্যূত অবস্থানে পৌঁছায়। ময়নাকে ভালবেসেও বীরকৃষ্ণের খপ্পর থেকে তাকে বাঁচাতে পারেনা। প্রিয়নাথ নিরুপায় ক্ষোভে ও ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে - '...আমি অমৃতবাজার পত্রিকায় পত্র লিখবো। ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনে বক্তৃতা দেবো। বলব - ব্রিটিশ জলদস্যুর অত্যাচারে যখন দেশ গোরস্থানে পরিণত, তখন বাবুগণ হিন্দুয়ানি ,মদ ,পতিতা ,বুলবুলি ও ময়ূরবাহন নাটক লইয়া কালাতিপাত করিতেছেন।' - প্রিয়নাথ তাই নাটক লেখে 'তিতুমীর'। লেখাপড়া না জানা গরীব মেথর মথুর ও প্রিয়নাথ - দুজন দুরকম ভাবে বেণীমাধবের সাংস্কৃতিক দুর্গে কামান দাগে।
বসুন্ধরা ,একজনের প্রতারণায় বেশ্যা হয়েছিল। তারপর থিয়েটারে সে তার আশ্রয় পেয়েছিল। থিয়েটারে সে পেয়েছিল বাঁচবার পথ। ময়নার মধ্যে দিয়ে, সে তার নিজের সম্পূর্ণতা পেতে চায় - সে চায় ময়না প্রিয়ব্রতকে নিয়ে ঘর বাঁধুক। কিন্তু ময়না, কপট মায়াকাননে থাকতে চায়। রঙ্গমঞ্চে অভিনয়-সাফল্য ময়নাকে বদলে দেয় - সে বীরকৃষ্ণ দাঁ এর রক্ষিতা হয়েও থাকতে রাজী , কিন্তু থিয়েটার ছাড়া সে বাঁচবে না । সে বলে - '...দারিদ্রকে আমি ঘৃণা করি । সোপান বেয়ে ধীরে উঠেছি এখানে, গায়ে উঠেছে গয়নাত, পায়ের কাছে হাতজোড় করে ধন্না দিয়ে পড়ে আছে কলকাতার বড়লোকের দল। আবার ধাপে ধাপে নেমে গিয়ে গেরস্ত ঘরে ঝি-গিরি আমি করতে পারবো না ।' ময়না যাকে স্বাধীনতা ভাবছে, তা যে আসলে একটা রুচিহীন ব্যাধিগ্রস্থ মুৎসুদ্দির শয্যায় দেহদান, সেটা প্রিয়নাথ তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন । ময়নার ট্রাডেজী সেকালের অধিকাংশ অভিনেত্রী জীবনের ট্রাজেডি।
'দি গ্রেট বেঙ্গলের' প্রতিদ্বন্দী দল 'গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার'। ম্যাম্বার্ট সাহেব 'গ্রেট ন্যাশানাল' এর অভিনেতাদের পীড়ন করেছেন। কাপ্তেনবাবু তার দল নিয়ে মঞ্চে 'সধবার একাদশী' অভিনয় করছিলেন। সেখানে ল্যাম্বার্ট সাহেবকে বসে থাকতে দেখে বেণীমাধবের ভেতরে অগ্নুৎপাত হয় - তিনি তিতুমীরের ভূমিকা নিয়ে সংলাপ বলতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে , সহ অভিনেতারাও তাদের ভূমিকা পালটে নেন ও বদলে দেন মঞ্চসজ্জা। বেণীমাধবের সত্ত্বার ভেতরের সুপ্ত দেশপ্রেম বেরিয়ে আসে। সামাজিক অচলায়তনের আলো-আঁধারিতে জন্ম নেওয়া নিমচাঁদের রূপসজ্জা ও অনুষঙ্গকে নিমেষে পেরিয়ে বেণীমাধব পরিবর্তিত হয়ে যান বিপ্লবী চেতনায় সমৃদ্ধ তিতুমীরে। তিতুমীরবেশী বেণীমাধব তখন দেশপ্রেমিক বীরের কন্ঠে বলেন- 'যতক্ষণ একটা ফিরিঙ্গি শয়তান দেশের পবিত্র বুকে পা রেইখে দাঁড়গে থাকবে, ততক্ষণ এই ওয়াহাবি তিতুমীরের তলোয়ার কষাবদ্ধ হবে না কখনও।' এভাবে সময়ের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা, মালিন্য, কুশ্রীতাকে মেনে নিয়েও চরম মূহুর্তে বেণীমাধব কালোত্তীর্ণ কৃষ্টি নায়ক হয়ে ওঠেন। তবে শুধু বেণীমাধব নন, বসুন্ধরা, কামিনী, জলদ, ময়না সমস্ত নাট্যকর্মী জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হন। তাদের সমবেত গানে কেঁপে ওঠে প্রেক্ষাগৃহ -
'শুন গো ভারত ভূমি
কত নিদ্রা যাবে তুমি
উঠ ত্যজ ঘুমঘোর
হইল হইল ভোর
দিনকর প্রাচীতে উদয় '

নাটকের গান

বিদেশী দস্যুর তীরে হৃদয় রিধির ধার
কোথ সে গরিমা ! মহিমা কোথায় ?
গগনবিহারী পক্ষী ভূমিতে মুটায়
বন্দিগণ বিরচিত গীত উপহার দুখের কাহিনী বিনা কিবা আছে আর ?'

স্বদেশ আমার , কিবা জ্যোতির্মন্ডলী !
ভূষিত ললাট তব, অস্তে গেছে চল
সে দিন তোমার[2]

তথ্যসূত্র

  1. Dramatic Performances Act 1876
  2. ডাঃ অপূর্ব দে (সম্পাদক) - টিনের তলোয়ার ইস্পাতের তলোয়ার ' দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.