বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি

বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বা বাংলা প্রেসিডেন্সি ছিল ব্রিটিশ ভারতের একটি ঔপনিবেশিক অঞ্চল। এই অঞ্চলের ক্ষেত্রভুক্ত ছিল পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা নিয়ে গঠিত অবিভক্ত বাংলা যা বর্তমানে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরামেঘালয় ইত্যাদি রাজ্যসমূহে বিভক্ত। পরবর্তীকালে ভারতের উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, অবিভক্ত পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ও ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশমহারাষ্ট্রের অংশবিশেষ এবং পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং বর্মা (অধুনা মায়ানমার) অঞ্চলের বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৬৭ সালে স্ট্রেইট সেটলমেন্টের ক্রাউন কলোনির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে পেনাং এবং সিঙ্গাপুরও প্রেসিডেন্সির প্রশাসনিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হিসাবে গণ্য হত। ১৬৯৯ সালে কলকাতা নগরীকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্সি নগর ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ১৭৬৫ সালকেই বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রকৃত সূচনাকাল হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। এই বছরই কোম্পানি, মুঘল সম্রাট ও অযোধ্যার নবাবের মধ্যে যে চুক্তি সাক্ষরিত হয়, তার ফলে অবিভক্ত বাংলা, অবিভক্ত বিহার, ওড়িশামেঘালয় কোম্পানির শাসনাধীনে আসে। বোম্বাই প্রেসিডেন্সিমাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির বিপরীতে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি উত্তর ও মধ্য ভারতের সকল ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। এই প্রেসিডেন্সির বিস্তার ছিল পূর্বে গঙ্গাব্রহ্মপুত্রের মোহনা থেকে উত্তরে হিমালয় ও পশ্চিমে পাঞ্জাব ও সীমান্ত অঞ্চল পর্যন্ত। ১৮৩১ সালে উত্তরপশ্চিমের প্রদেশগুলি স্থাপিত হয়। এই সময় অযোধ্যা যুক্তপ্রদেশের (বর্তমানে উত্তর প্রদেশ) অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্বে সমগ্র উত্তর ভারত চারটি লেফটানেন্ট-গভর্নরশাসিত প্রদেশ, যথা – পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ, বঙ্গপ্রদেশ, পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে এবং কমিশনার শাসিত উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে বিভক্ত হয়ে যায়।

বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি
ব্রিটিশ ভারত প্রেসিডেন্সি

 

২২ অক্টোবর ১৭৭৫–১৪ অগাস্ট ১৯৪৭
 

পতাকা প্রতীক
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অবস্থান
সমন্বয় সম্প্রসারণের সর্বোচ্চ মাত্রায় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মানচিত্র
রাজধানী কলকাতা
ঐতিহাসিক যুগ নতুন সাম্রাজ্যবাদ
  বক্সারের যুদ্ধ ২২ অক্টোবর ১৭৭৫
  মন্টাগুয়ে-চেমসফোর্ড রিফর্মস ১৯১৬ - ২১
  ভারত বিভাজন ১৪ অগাস্ট ১৯৪৭
বর্তমানে  ভারত,  বাংলাদেশ,  বার্মা,  মালয়েশিয়া এবং  সিঙ্গাপুর অংশ
ব্রিটিশ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ১৮৫৭ সালের মানচিত্র

নামকরণ

বাংলা বা বেঙ্গল শব্দগুলির আদি উৎস অজ্ঞাত, কিন্তু বিশ্বাস করা হয় যে শব্দটি বং অথবা বাং নামক একটি দ্রাবিড়ীয়-ভাষী উপজাতি বা গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বং জাতিগোষ্ঠী ১০০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন।[1]

বঙ্গ ও আল এ দু’টি শব্দ সমন্বয়ে বাংলা শব্দটির উদ্ভব। ১৩৫২ সালে সুলতান ইল্‌ইয়াস শাহ্‌ প্রথম বাংলা নামের প্রচলন করেন।[2] বাংলা থেকেই মুলত বেঙ্গল শব্দটি আসে। ফ্রান্সিস ফার্নান্দেজের বর্ণনা অনুসারে পূর্বে চট্টগ্রাম থেকে পশ্চিমে উড়িষ্যার পয়েন্ট পামিরাস পর্যন্ত গঙ্গাবিধৌত ও পারচাসের মতে ৬০০ মাইল তটরেখাবিশিষ্ট দেশটি ‘বেঙ্গল’ নামে অভিহিত। বিহার ও উড়িষ্যার কিছু অংশ সহ মুসলমানি প্রদেশ সুবা বাঙ্গালা নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মহাফেজখানায় পুরনো নাবিকদের এই অল্পবিদ্যাপ্রসূত ধারণাই প্রচলিত হয়ে যায়। উড়িষ্যা উপকূলের বালেশ্বর থেকে অবিভক্ত বিহারের কেন্দ্রে পটনা পর্যন্ত কোম্পানির সকল কুঠি ‘বেঙ্গল এসট্যাবলিশমেন্ট’ বা বঙ্গীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশরা গঙ্গার যত উজানে যেতে লাগলেন, ততই সমগ্র উত্তর ভারত এই নামে অভিহিত হতে থাকল।

ইতিহাস

পূর্ব ইতিহাস

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় প্রথম বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। এই কুঠিগুলির চরিত্র তখন পুরোপুরিই ছিল অর্থনৈতিক। ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে পটনায় কোম্পানি তাদের একটি কুঠি স্থাপন করে; ১৬২৪-৩৬ সময়কালে উড়িষ্যার উত্তরে পিপ্পলির পুরনো পর্তুগিজ কুঠির ধ্বংসাবশেষের উপর সম্রাটের অনুগ্রহে কোম্পানির আধিপত্য স্থাপিত হয়; ১৬৪০-৪২ সময়কালে উড়িষ্যার বালেশ্বর ও হুগলি নদীর তীরে কলকাতার অদূরে এক স্থানে ইংরেজ সার্জন গ্যাব্রিয়েল বঘটন একটি বসতি স্থাপনা করেন। কলকাতার নিকটস্থ এই স্থানটিতে তখন একটি পর্তুগাল বসতিও ছিল। কিন্তু কোম্পানির এজেন্টরা প্রথম যুগে যে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন, তাতে ব্যবসা চালানো একসময় প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৬৭৭-৭৮ সালে তারা হুমকি দেয় যে, বাংলা থেকে ব্যবসা প্রত্যাহার করে নেবেন। ১৬৮৫ সালে আওরঙ্গজেবের পৌত্রের কাছ থেকে তারা তাদের ব্যবসার জন্য আরও নিরাপত্তা ক্রয় করেন। ১৬৯৬ সালে ডিহি কলিকাতা, গোবিন্দপুরসূতানুটি গ্রাম তিনটি কলকাতা শহরের রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করে। এই শহরই আধুনিক ভারতের প্রথম মেট্রোপলিস বা মহানগরী। সম্রাট ফারুকশিয়র ১৭১৭ সালে কোম্পানিকে বাংলায় করদান থেকে অব্যহতি দেন। পরবর্তী চল্লিশ বছর সুবার মুঘল শাসনকর্তা ও মারাঠা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের এক দীর্ঘ জটিল যুদ্ধে অতিবাহিত হয়। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজদ্দৌলার হাতে কলকাতার পতন ঘটে। পরের বছর কলকাতা অধিকার পলাশীর যুদ্ধে নবাবকে পরাস্ত করে বাংলায় ব্রিটিশ আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেন রবার্ট ক্লাইভবক্সারের যুদ্ধ বাংলায় ব্রিটিশ সামরিক আধিপত্য স্থাপনের পথ সুগম করে। ১৭৬৫ সালের চুক্তির বলে অবিভক্ত বাংলা, অবিভক্ত বিহার ও উড়িষ্যা ব্রিটিশ প্রশাসনের হস্তগত হয়। এই সময় প্রতিষ্ঠিত হয় তিনটি প্রেসিডেন্সি সামরিক বাহিনীর মধ্যে বৃহত্তম বেঙ্গল আর্মি১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের আগে এই বাহিনীতে রাজপুত ও পূর্বাঞ্চলের ভূমিহার ব্রাহ্মণদেরই নেওয়া হত।

প্রশাসনিক সংস্কার ও চিরস্থায়ী বন্দ্যোবস্ত

ওয়ারেন হেস্টিংসের (ব্রিটিশ গভর্নর ১৭৭২-৮৫) আমলে বাংলায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সুসংহত হয়। তাদের কাছে শুধুমাত্র একটি বাণিজ্য অঞ্চল থেকে একটি সামরিক সহায়তাপ্রাপ্ত অসামরিক সরকারের অধীনে বাংলা পরিণত হয় একটি সামগ্রিকভাবে সেনাবিজিত অঞ্চলে। সিভিল সার্ভিস সদস্য জন শোর ও তার পরে লর্ড টিনমাউথের পরিকল্পনায় বাংলায় একটি নিয়মিত আইনবিভাগ স্থাপিত হয়। তাদের সাহায্যে তদনীন্তন গভর্নর-জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস জমিদারদের জমির উপর অধিকার সুরক্ষিত করেন। পূর্বের ব্যবস্থা অনুযায়ী এই জমিদাররা ছিলেন কর-আদায়কারী মাত্র। কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় তারা সরকার প্রদত্ত জমির ছদ্ম-মালিকানার অধিকার পান। ১৭৯৩ সালে এই ছদ্মমালিক জমিদারদের জমির উপর স্বত্ত্ব লর্ড কর্নওয়ালিসের ঘোষণা বলে চিরস্থায়ী হয়ে যায় নির্দিষ্ট ভূমিকরের পরিবর্তে। এই আইনটি ভূমি করব্যবস্থার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। ভারতে সম্পত্তির অধিকার ধারণাটি “পরিচিত” করানোর উদ্দেশ্যে এবং একটি ভূমিকেন্দ্রিক বাজার গঠনের জন্য এই ব্যবস্থা চালু হয়। প্রথমটি ভারতের ভূম্যধিকার সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দেয় এবং দ্বিতীয়টি সর্বোতভাবে ব্যর্থ হয়। কর্নওয়ালিস কোড, যা অধিকারীর অধিকার সংক্রান্ত বিষয়টি নির্ধারণ করেছিল, তা প্রজা ও কৃষকদের স্বার্থের কথা আদৌ ভাবেনি। বাংলা প্রেসিডেন্সিতে সমগ্র ব্রিটিশশাসনেই এটি একটি অভিশাপ হিসাবেই রয়ে যায়। ‘রায়ত’রা (কৃষক) জমিদারদের হাতে নির্যাতিত হতে থাকে। জমিদাররাও নিজেদের লাভের জন্য সরকারি খাজনার উপরেও চড়া হারে রাজস্ব আদায় করতে থাকেন; নিংড়ে নিতে থাকেন তাদের প্রজাদের। তদুপরি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেও মূল্যবৃদ্ধি আটকানো যায়নি। ফলে সরকারের রাজস্বে বছর বছর ঘাটতি হতে থাকে। কৃষকদের ভারি বোঝা বইতে হয়। অবস্থা আরও সঙ্গিন হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে। এই সময়ে প্রথমে সরকার ও পরে ব্রিটিশ উৎপাদকরা ভারতীয় চাষিদের দিয়ে আফিম ও নীলের বাধ্যতামূলক চাষ করাতে থাকেন। কৃষকদের দিয়ে জোর করে জমির একটি অংশে এই চাষ করানো হত এবং বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে তা কিনে নেওয়া হত রফতানির জন্য। ফলে গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিহারের তিরহুত জেলায় এর সর্বাধিক কুপ্রভাব পড়েছিল।

লর্ড লেকআর্থার ওয়েলেসলি মারাঠাদের বিরুদ্ধে অভিযান করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দখল করে নেন। ১৮৩১ সালের পর সেখানেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সমান ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ হয় ১৮৪৯ সালের বিজিত পাঞ্জাব১৮৫৬ সালে অধিগৃহীত অযোধ্যা রাজ্যেও। এই অঞ্চলগুলি সাধারণভাবে বাংলা প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত হলেও, প্রশাসনিকভাবে পৃথক ছিল। সরকারিভাবে পাঞ্জাব, এলাহাবাদআগ্রা ছিল কলকাতায় বাংলার গভর্নরের অধীনস্থ এক লেফট্যানেন্ট-গভর্নরের শাসনাধীনে। কিন্তু তার ভূমিকাটি ছিল কার্যত স্বাধীন। একমাত্র বেঙ্গল আর্মি ও সিভিল সার্ভিসই ছিল সার্বিক প্রেসিডেন্সির সংস্থা। কমান্ডার-ইন-চিফ লর্ড কিচেনার ও ভাইসরয় লর্ড কার্জনের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদের পর সংস্কার সাধিত হলে ১৯০৪-০৪ সালে স্থাপিত ইন্ডিয়ান আর্মির সঙ্গে বেঙ্গল আর্মির সংযুক্তি ঘটে।

বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫

লর্ড কার্জনের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে বাংলার সুবৃহৎ প্রদেশটি দ্বিখণ্ডিত করা হয় ১৯০৫ সালের অক্টোবর মাসে। চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা বিভাগরাজশাহী বিভাগ সহ মালদহ জেলা, পার্বত্য ত্রিপুরা, সিলেটকুমিল্লা বঙ্গপ্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশেছোটনাগপুর অঞ্চলের পাঁচটি হিন্দিভাষী রাজ্য চং ভাকর, কোরিয়া, সিরগুজা, উদয়পুর ও যশপুর বঙ্গপ্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মধ্যপ্রদেশে যুক্ত করা হয়। আবার সম্বলপুর ও পাঁচ ওড়িয়া রাজ্য বামরা, রাইরাখোল, সোনপুর, পাটনা ও কালাহান্ডি মধ্যপ্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বঙ্গপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। বঙ্গপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয় ৩৩টি জেলা। এগুলি হল – বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা, হুগলি, হাওড়া, অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলা, কলকাতা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, অবিভক্ত যশোর জেলা, অবিভক্ত খুলনা জেলা; বিহারের পটনা, গয়া, সাহাবাদ, সরন, চম্পারণ, মজঃফরপুর, দারভাঙ্গা, মুঙ্গের, ভাগলপুর, পুর্ণিয়া, সাঁওতাল পরগনা, পান, হাজারিবাগ, রাঁচি, পালামৌ, মানভূম, সিংভূম; উড়িষ্যার কটক, বালেশ্বর, অঙ্গুল, সম্বলপুর ও কন্ধমল জেলাসমূহ। এছাড়া দেশীয় রাজ্য সিক্কিম এবং উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুরের সহরাজ্যগুলিও বঙ্গপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়।

এই বিভাজনের সিদ্ধান্তটি ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। কারণ এর ফলে হিন্দুরা বঙ্গপ্রদেশে ও মুসলমানেরা পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হয়। কেউ কেউ এটিকে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ বা বিভাজন ও শাসননীতির ঘৃণ্য প্রয়োগ মনে করেন। আবার কলকাতা-কেন্দ্রিক বাঙালি সম্প্রদায়, যাঁরা বাংলাকে দুটি সরকারে বিভক্ত করার বিরোধী ছিলেন এবং অখণ্ড বাংলার শক্তি, সমৃদ্ধি ও ঐক্যে বিশ্বাস করতেন তারাও এর তীব্র বিরোধিতা করেন। আন্দোলন ১৯০৬-০৯ সময়কালে এতটাই তীব্র আকার নেয় যে ভারত ও প্রাদেশিক শাসকদের দৃষ্টি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। ১৯১২ সালে এই বিভাজনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহৃত হয়। এই বছরেই বাংলা থেকে বিহার ও উড়িষ্যা বিচ্ছিন্ন হয় এবং পরে বিহার প্রদেশ ও উড়িষ্যা প্রদেশ স্থাপিত হয়। প্রথমটির রাজধানী হয় পটনা ও দ্বিতীয়টির কটক। এই বিভাজনটিই স্থায়ী হয়েছিল।

এই সর্বশেষ বিভাজনের ফলে নাম ব্যতীত বাংলা প্রেসিডেন্সির আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ১৯১৯ সালে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার সাধিত হলে ভারতে যে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু হয়, তার ফলে এই নামটিও অবলুপ্ত হয়।

বাংলার পুনর্গঠন, ১৯১২ সাল

পুনরায় সংগঠনের পর বাংলা প্রদেশের প্রশাসনিক বিভাগসমূহ

দিল্লি দরবারে ১২ ই ডিসেম্বর, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে রাজা জর্জ পঞ্চম ভারত সরকারের সদরদপ্তর তথা ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের কথা ঘোষণা করেন। এছাড়া একজন গভর্নরের অধীনে মূলত পাঁচটি বাঙালি ভাষাভাষী বিভাগ একত্রীত করে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি (বা প্রদেশ) এর পুনর্গঠন, একজন লেফটেন্যান্ট-গভর্নর অধীন একটি নতুন প্রদেশ বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশ সৃষ্টি এবং আসাম প্রদেশের একটি প্রধান কমিশনারের অধীনে পুনর্গঠন করার কথা ঘোষণা করা হয়। ২১ শে মার্চ, ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে থমাস গিবসন-কারমাইকে বাংলার গভর্নর হিসাবে নিযুক্ত করা হয়; সেই তারিখের পূর্বে ভারতের গভর্নর-জেনারেল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিরও গভর্নর ছিলেন। ওই বছর ২২ মার্চ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা ও আসাম প্রদেশের গঠিত হয়।[3]

১৯১৯ সালের ভারত সরকার আইন (দি গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট১৯১৯) পরিষদের মনোনীত ও নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ৫০ থেকে ১২৫ পর্যন্ত বাড়িয়েছিল এবং ভোটাধিকার সম্প্রসারণ করা হয়েছিল।[4]

বিহার ও উড়িষ্যা ১৯৩৬ সালে আলাদা প্রদেশ হয়ে যায়। বাংলা ১৯১২ সালে পর থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে পর্যন্ত আবিভক্ত ছিল, তবে স্বাধীনতা লাভের পরে আবার ভারত ও পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার মধ্যে বিভাজিত হয় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি তথা বাংলা।

দ্বৈত শাসন (১৯২০-৩৭)

ব্রিটিশ ভারতের ১৯১৯ সালের মন্টাগু-চেমসফোর্ড রিফর্মস ১৯২১ সালে গঠিত হয়, যা বঙ্গীয় আইন পরিষদে ১৪০ জন সদস্য নির্বাচিত করে এবং আরও নির্বাচিত ভারতীয় সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে। সংস্কারগুলিও দ্বৈত শাসন চালু করে, যার ফলে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্থানীয় সরকার হিসাবে নির্দিষ্ট দায়িত্বগুলি নির্বাচিত মন্ত্রীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে, অর্থ, পুলিশ ও সেচ মত গুরুত্বপূর্ণ দফতরের সঙ্গে গভর্নরের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদ পদ সংরক্ষিত ছিল। কিছু বিশিষ্ট মন্ত্রীরা যেমন- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (স্থানীয় স্বশাসিত ও গণস্বাস্থ্য ১৯২১-১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ), স্যার প্রভাশ চন্দ্র মিত্র (শিক্ষা ১৯২১-১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ, স্থানীয় স্বশাসন, জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও গণপূর্তক ১৯২৭-১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দ), নবাব সাইয়িদ নওয়াব আলী চৌধুরী (কৃষি ও গণপূর্ত) এবং এ কে ফজলুল হক (শিক্ষা ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ), ভুপেন্দ্রনাথ বসু এবং সভার আব্দুর রহিম গভর্নর কাউন্সিলের নির্বাহী সদস্য ছিলেন।[5]

প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন

১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে একটি প্রদেশে পরিণত করে, নির্বাচিত প্রাদেশিক আইনসভার বর্ধিত করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি প্রাদেশিক স্বশাসন প্রতিষ্ঠিতা করে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সর্বাধিক ৫৪ টি আসন লাভ করে, কিন্তু সরকার গঠন করতে অস্বীকার করে। এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি (36 টি আসন সহ), সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ সহ একটি জোট সরকার গঠন করতে সমর্থ হয।[6][7]

মন্ত্রী দফতর
এ কে ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষা
খাজা নাজিমুদ্দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
নলিনি রঞ্জন সরকার মূলধন যোগান
বিজয় প্রাসাদ সিং রায় রাজস্ব
হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাণিজ্য ও শ্রম
খাজা হাবিবুল্লাহ কৃষি এবং শিল্প
শ্রীশচন্দ্র নন্দী সেচ, যোগাযোগ এবং কাজ
প্রসন্ন দেব রায়কুট বন এবং আবগারি
মুকুন্দ বিহারী মল্লিক সমবায়, আমানত এবং গ্রামীণ ঋণ
নওয়াব মোশাররফ হোসেন বিচার বিভাগীয় এবং বিধানসভা
সৈয়দ নওশের আলী জনস্বাস্থ্য এবং স্থানীয় স্বশাসিত সরকার

১৯৪৩ সালে হক সরকারের পতন ঘটে এবং স্যার খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৪৬ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে মুসলিম লীগ ২৫০ টির মধ্যে ১১৩ টি আসনে জয়লাভ করে এবং হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অধীনে সরকার গঠিত হয়। [10][8]

মন্ত্রী দফতর
হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রধানমন্ত্রী, হোম
মোহাম্মদ আলী বগুড়া অর্থ, স্বাস্থ্য, স্থানীয় স্বশাসন
সৈয়দ মুয়াজ্জেমউদ্দিন হোসেন শিক্ষা
আহমেদ হোসেন কৃষি, বন ও মৎস্য
নাজিেন্দ্র নাথ রায় বিচার বিভাগীয় এবং আইন বিভাগ
আবুল ফজল মুহাম্মদ আবদুর রহমান সমবায় ও সেচ
শামসুদ্দিন আহমেদ বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প
আবদুল গফরান সিভিল সরবরাহ
তারাক নাথ মুখার্জী সেচ এবং জলপথ
ফজলুর রহমান ভূমি, ভূমি রাজস্ব এবং কারাগার
দ্বারকনাথ ব্যারারি নির্মাণ এবং বিল্ডিং

তথ্যসূত্র

  1. জেমস হাইট্‌স্‌ম্যান ও, রবার্ট এল. ওয়ার্ডেন (১৯৮৯)। "Early History, 1000 B. C.-A. D. 1202"Bangladesh: A country study (ইংরেজি ভাষায়)। লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস
  2. সিয়ার-উল-মুতাখ্‌খীরিন, ৩য় খন্ড। ক্যামব্রের পুনঃমুদ্রণ। পৃষ্ঠা ৩৮৬।
  3. Ilbert, Sir Courtenay Peregrine (1922). The Government of India, Third Edition, revised and updated. Clarendon Press. pp. 117-118.
  4. Ilbert, Sir Courtenay Peregrine (1922). The Government of India, Third Edition, revised and updated. Clarendon Press. p. 129.
  5. The Working Of Dyarchy In India 1919 1928। D.B.Taraporevala Sons And Company.।
  6. Jalal, Ayesha (১৯৯৪)। The Sole Spokesman: Jinnah, the Muslim League and the Demand for Pakistan। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 26–27। আইএসবিএন 978-0-521-45850-4।
  7. Sanaullah, Muhammad (১৯৯৫)। A.K. Fazlul Huq: Portrait of a Leader। Homeland Press and Publications। পৃষ্ঠা 104। আইএসবিএন 9789848171004।
  8. Nalanda Year-book & Who's who in India। ১৯৪৬।

রচনা উদ্ধৃত

  • C.A. Bayly Indian Society and the Making of the British Empire (Cambridge) 1988
  • C. E. Buckland Bengal under the Lieutenant-Governors (London) 1901
  • Sir James Bourdillon The Partition of Bengal (London: Society of Arts) 1905
  • Susil Chaudhury From Prosperity to Decline. Eighteenth Century Bengal (Delhi) 1995
  • Sir William Wilson Hunter Annals of Rural Bengal (London) 1868, and Orissa (London) 1872
  • P.J. Marshall Bengal, the British Bridgehead 1740-1828 (Cambridge) 1987
  • John R. McLane Land and Local Kingship in eighteenth-century Bengal (Cambridge) 1993

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.