অনসূয়া
অনসূয়া (সংস্কৃত লিপ্যন্তরের আন্তর্জাতিক বর্ণমালা: অনসূয়া, अनसूया "দ্বেষ ও ঈর্ষা মুক্ত "), অনুসূয়া নামেও পরিচিত, হিন্দু কিংবদন্তিতে অত্রি নামে এক প্রাচীন ঋষির স্ত্রী ছিলেন। রামায়ণে, তিনি তার স্বামীর সাথে চিত্রকূট বনের দক্ষিণ পরিধিতে একটি আশ্রমে তার স্বামীর সাথে বসবাস করতেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন এবং সর্বদা অনাড়ম্বরতা এবং নিষ্ঠার অনুশীলন করতেন। এগুলি তাকে অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন করতে সাহায্য করেছিল।
অনসূয়া | |
---|---|
![]() | |
তথ্য | |
দাম্পত্য সঙ্গী | অত্রি |
সন্তান | দুর্বাসা চন্দ্র দত্তাত্রেয় শুভাত্রেয়ী |
সীতা এবং রাম যখন তাদের বনবাসের নির্বাসনের সময় তাকে দেখতে গিয়েছিলেন, অনসূয়া তাদের প্রতি খুবই অভিনিবিষ্ট ছিলেন এবং সীতাকে এমন উপলেপ দিয়েছিলেন যা চিরকাল তার সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য উপযোগী ছিল।[1] তিনি ত্রিমূর্তি - ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবের ঋষি অবতার দত্তাত্রেয়, শিবের অবতার একরোখা রাগান্ধ ঋষি দুর্বাসা এবং ব্রহ্মার অবতার চন্দ্রাত্রির মাতা ছিলেন। তিনি দেবতা চন্দ্রের মা ও ছিলেন। তিনি ঋষি কর্দম এবং তার স্ত্রী দেবাহুতির কন্যা ছিলেন। ঋষি কপিল ছিলেন তার ভাই এবং শিক্ষক। তিনি সতী অনসূয়া অর্থাৎ পবিত্র স্ত্রী অনসূয়া হিসাবে পূজিত হন।
শব্দতত্ত্ব
অনসূয়া দুটি অংশ নিয়ে গঠিত: অন এবং অসূয়া । অন একটি নেতিবাচক উপসর্গ এবং অসূয়া অর্থ ঈর্ষা। সুতরাং, অনসূয়ার অর্থ হয় ঈর্ষা বা হিংসা থেকে মুক্ত।
অনসূয়া এবং অত্রির গল্প
অনসূয়ার পরিবারের গল্পটি ভাগবত পুরাণের তৃতীয় স্কন্দ-এ উল্লিখিত হয়েছে। ঋষি কর্দম, স্বয়ম্ভু মনুর কন্যা দেবাহুতিকে বিবাহ করেছিলেন। তাদের দশটি সন্তান ছিল। এক পুত্র এবং নয়টি কন্যা। পুত্রের নাম মহর্ষি কপিল (ভগবান বিষ্ণুর অবতার)। মাতা অনসূয়া সেই নয় কন্যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন। প্রতিটি কন্যার বিবাহ হয়েছিল ঋষির সাথে আর মাতা অনসূয়ার বিবাহ হয়েছিল মহর্ষি অত্রির সাথে।[2]
ঐশ্বরিক ত্রয়ীর কাছে অনসূয়ার পরীক্ষা
ঋষি নারদ তার স্তোত্র এবং শ্লোকে অনসূয়ার প্রশংসা করেছিলেন। সেই জন্য লক্ষ্মী পার্বতী এবং সরস্বতী মাতা অনসূয়ার কাছ থেকে পাতিব্রত্য শিখতে চেয়েছিলেন। তারা তাদের পতিদের অনুরোধ করেছিলেন অনসূয়ার কাছে গিয়ে তার অনুমতি নিয়ে আসতে, যাতে তারা মানবী রূপে তার কাছে যেতে পারেন। ত্রিদেব ঋষির ছদ্মবেশে অনুসুয়ার কাছে গেলেন এবং সেখানে ভিক্ষার মাধ্যমে পত্নীদের জন্য অনুমতি চাইলেন। অনসূয়া যখন তাদের পরিচর্যা করতে গেলেন, তখন তার চোখের মাতৃসুলভ ভালবাসা দেবতাদের ছোট শিশুতে পরিণত করল। তিন দেবী পতিদের ফিরে আসার অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু যখন তারা ফিরলেননা, তারা অনসূয়ার কুটিরে গিয়ে দেখেন দেবতারা শিশুতে রূপান্তরিত। দেবীগণ অনসূয়াকে অনুরোধ করেছিলেন, তাদের স্বাভাবিক করে তোলার জন্য। একটি কথন অনুযায়ী, দেবতারা মিশে গিয়ে অনসূয়ার ত্রিমস্তকধারী পুত্রে রূপান্তরিত হলেন।

পৈঠান থেকে কৌশিক নামে এক পুরুষ, ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও এবং ঘরে একনিষ্ঠ স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও, এক পতিতার কাছে আসতেন। পরে যখন তিনি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন, পতিতাটি তাকে ছেড়ে চলে যায়। তিনি নিজের স্ত্রীর কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হন, তার স্ত্রী তখনও তার প্রতি যত্নশীল এবং নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। কৌশিকের তখনও সেই পতিতার কথা মনে পড়ছিল এবং একদিন তিনি তার পত্নীকে তার কাছে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। সেই শহরে, ঋষি মান্ডব্যকে একজন অপরাধীর পরিবর্তে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং বনে একটি সূচ্যগ্র বস্তুর উপর তিনি শুয়ে ছিলেন। রাতে পত্নীর সঙ্গে গভীর বনের মধ্য দিয়ে যাবার সময় কৌশিক ঋষির গায়ে হোঁচট খেয়ে পড়েন। ঋষি তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে সূর্যোদয়ের আগেই তার মৃত্যু ঘটবে। অভিশাপকে আটকাতে, কৌশিকের পত্নী নিজের ভালবাসার শক্তিতে সূর্যোদয় হতে দেননি, এর ফলে স্বর্গে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। দেবতারা সাহায্য প্রার্থনা করে ব্রহ্মার কাছে গিয়েছিলেন। ব্রহ্মা তখন অনসূয়ার কাছে গিয়েছিলেন এবং কৌশিকের স্ত্রীকে বোঝাতে বলেছিলেন, যাতে তিনি সূর্যোদয়ের অনুমতি দেন। অনসূয়া কেবলমাত্র কৌশিকের স্ত্রীকে বুঝিয়ে সূর্যোদয় ঘটিয়েছিলেন তাই নয়, ঋষির অভিশাপ অনুযায়ী কৌশিকের মৃত্যুর পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। ব্রহ্মা অনসূয়ার প্রতি খুব খুশি হয়েছিলেন এবং পরে তার গর্ভে চন্দ্রাত্রী হয়ে জন্ম নেন।
কিছু সময় পরে, রাহু সূর্যকে গলাধঃকরণ করে, এর ফলে সারা পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে যায়। বহু বছরের কঠোর তপস্যার ফলে অত্রি এক বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন, সেই ক্ষমতার বলে তিনি রাহুর কবল থেকে সূর্যকে মুক্ত করেছিলেন। যার পরে সারা বিশ্ব আবার আলোর মুখ দেখেছিল। দেবতারা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং শিব এবং বিষ্ণু, দুর্বাসা এবং দত্তাত্রেয় রূপে অত্রি এবং অনুসূয়ার সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন।
অন্য এক কিংবদন্তি অনুসারে, অত্রি কুলা পর্বতমালায় একটি ভয়ংকর তপস্যা করেছিলেন। যার ফলে পুরো বিশ্বে আগুন ধরে গিয়েছিল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব তার এই সাধনায় মুগ্ধ হয়ে তাকে বর প্রদান করতে চেয়েছিলেন। অত্রি বরদান হিসেবে তাদের অনুরোধ করেন তার সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করতে। ব্রহ্ম পুরাণ অনুসারে, অত্রি তিন পুত্র এবং এক কন্যা, শুভাত্রেয়ীর জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
সতী অনসূয়ার আশ্রম

সতী অনসুয়ার আশ্রমটি চিত্রকূটে আছে। এটি মন্দাকিনী নদীর আরও উজানে, শহর থেকে ১৬ কিমি দূরে, ঘন অরণ্যের মাঝে অবস্থিত। এখানে সারাদিন পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকে। এখানেই ঋষি অত্রি, তার স্ত্রী অনসূয়া এবং তাদের তিন পুত্র (যাঁরা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবের তিন অবতার ছিলেন) বাস করতেন এবং কথনে, বলা হয়, তপস্যা করেছেন ।
আদিকবি বাল্মীকি তার রামায়ণে লিখেছেন যে, এক সময় চিত্রকূটে দশ বৎসর যাবৎ বৃষ্টি হয়নি। সেখানে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, এবং প্রাণী ও পাখিদের খাওয়া বা পান করার মত কিছুই আর অবশিষ্ট ছিলনা। সতী অনসূয়া কঠোর ও নিবিড় তপস্যা করেন এবং মন্দাকিনী নদীকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনেন। মন্দাকিনীর জলধারায় সবুজ এবং বনভূমি পুনর্জীবিত হয়েছিল, এবং সব ঋষি ও প্রাণীজগতের দুর্গতি নিবারণ হয়েছিল।[3]
সতী অনসূয়ার আশ্রমটি, বর্তমানে এক অত্যন্ত শান্ত জায়গায় অবস্থিত। এখানে পাহাড়ের বিভিন্ন স্রোত একত্রিত হয়ে মন্দাকিনী নদী গঠন করেছে। কথিত আছে যে রাম এবং সীতা মহর্ষি অত্রি এবং সতী অনসূয়ার সাথে দেখা করতে এই জায়গাটি পরিদর্শন করেছিলেন। এখানেই সতী অনসূয়া সীতাকে সতীত্ব র মহিমা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন। ঘন দন্ডক অরণ্য এই জায়গা থেকেই শুরু হয়। এই অঞ্চল রাবণের শাসনাধীন ছিল। রাবণ খর এবং বিরাধের মতো শক্তিশালী রাক্ষসকে এর শাসক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। রাক্ষসদের অত্যাচারে স্থানটি সন্ত্রাসিত ছিল।[4]
জনপ্রিয় সংস্কৃতি
অনসূয়ার গল্পটি নিয়ে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। সতী অনসূয়া শিরোনামে দুটি চলচ্চিত্র তেলুগু ভাষায় তৈরী হয়েছিল। সে দুটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৭ এবং ১৯৭১ সালে। ১৯৫৭ সালের চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন কাদেরু নাগভূষণম[5] এটিতে অঞ্জলি দেবী এবং গুম্মাদি ভেঙ্কটেশ্বর রাও অভিনয় করেছিলেন। একাত্তরের চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন বি. এ. সুব্বা রাও।[6] যমুনা রামনারাও অনসূয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, শারদা সুমতির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এবং তাদপল্লী লক্ষ্মী কান্ত রাও মহর্ষি অত্রির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এর সঙ্গীতের দায়িত্বে ছিলেন পি. আদিনারায়ণ রাও।
তথ্যসূত্র
- Gopal, Madan (১৯৯০)। K.S. Gautam, সম্পাদক। India through the ages। Publication Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India। পৃষ্ঠা 66।
- Purnendu Narayana Sinha (১৯৫০)। A Study of the Bhagavata Purana: Or, Esoteric Hinduism। Library of Alexandria। পৃষ্ঠা 96–। আইএসবিএন 978-1-4655-2506-2।
- Ramayana, Ayodhya kanda – sarga 117 shloka 9, 10.
- Ramayana, Ayodhya kanda – sarga 116 shloka 11, 12.
- Sati Ansuya (1957)। IMDb
- Sati Ansuya (1971). IMDb
- জন ডাওসনএর এ ডিকশনারি অফ হিন্দু মাইথোলজি অ্যান্ড রিলিজিয়ন