রেবন্ত
রেবন্ত বা রাইভত (সংস্কৃত: रेवन्त, আক্ষরিক অর্থ "উজ্জ্বল") হলেন একজন হিন্দু দেবতা। ঋগ্বেদ অনুযায়ী, রেবন্ত হলেন প্রধান সৌর দেবতা সূর্য এবং তার স্ত্রী সরণ্যুর কনিষ্ঠ সন্তান। রেবন্ত হলেন যক্ষ প্রভৃতি উপদেবতা এবং দানবীয় শ্রেণীর সত্ত্বা, গুহ্যকদের (गुह्यक) শাসক। হিন্দু বিশ্বাস মতে, এটি মনে করা হয় যে গুহ্যকগণ হিমালয়ের বনাঞ্চলের বনবাসী।[1][2] রেবন্তের প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্যে প্রায়শই তাকে ধনুর্বানধারী অশ্বারোহী ঘোড়ার উপর চড়া অবস্থায় এক শিকারী পুরুষের রূপে দেখা যায়।
রেবন্ত | |
---|---|
অশ্বের দেবতা | |
![]() অশ্বের ঐশ্বরিক প্রভু | |
অন্তর্ভুক্তি | গুহ্যক |
আবাস | হিমালয় |
অস্ত্র | তলোয়াড় |
বাহন | ঘোড়া |
সঙ্গী | অরণ্যানী |
মাতাপিতা | সূর্য (পিতা) এবং সরণ্যু (মাতা) |
উৎস
রেবন্ত হলেন অশ্বিনীকুমারদের ভ্রাতা, যারা হলেন আরোগ্য, দৃষ্টি এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের যমজ দেবতা।
কিংবদন্তি
রেবন্তের জন্মের উপাখ্যান বিষ্ণু পুরাণ এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণের মতো ধর্মগ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে। একদা, ভগবান সূর্যের আবেগ প্রাপ্ত না করতে পেরে, স্বর্গীয় স্থপতি বিশ্বকর্মার কন্যা এবং সূর্য দেবতার স্ত্রী, সংজ্ঞা বনে গমন করে অশ্বার রূপ ধারণ করে তপস্যায় ধ্যানমগ্ন হন। সংজ্ঞা তার পরিবর্তে তার প্রতিচ্ছায়া ছায়াকে উপস্থিত রাখেন, যিনি সংজ্ঞার ছব্দবেশে সূর্যদেবের স্ত্রী হিসেবে কিছু সময়ের জন্য বসবাস করেন। যখন সূর্যদেব বুঝতে পারেন যে ছায়া তার স্ত্রী সংজ্ঞা নয়, তখন তিনি সংজ্ঞার খোঁজে বের হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত উত্তর কুরুতে তাকে খুঁজে পান। সেখানে সূর্যদেব সংজ্ঞার কাছে অশ্বের ছদ্মবেশ ধরে অগ্রসর হন। তাদের মিলনের ফলে যমজ অশ্বিনীকুমার এবং রেবন্তের জন্ম হয়।[3] কূর্মপুরাণ এবং মৎস্যপুরাণে, রেবন্তের মাতার নাম হলো রাত্রি, যিনি হলেন সূর্যদেবের আরেক স্ত্রী। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্য একটি অধ্যায়ে, তিনি হলেন ছায়ার পুত্র এবং তার ভ্রাতারা হলেন শনিদেব, তপতী এবং ভদ্র।[4][5]
মার্কণ্ডেয় পুরাণে আরও লেখা আছে যে সূর্যদেব দ্বারা তাকে গুহ্যকদের শাসক এবং "শত্রু ও লুটেরাদের থেকে, প্রকান্ড অগ্নিকাণ্ড থেকে বন-জঙ্গল এবং অন্যান্য নির্জন ভূমির আতঙ্ক অভান্তরকে" রক্ষার দায়িত্বে অর্পণ করা হয়। কখনো কখনো, রেবন্তকে পরিত্রাণের জন্য লুটেরাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অবস্থায় বর্ণনা করা হয়।[6]
দেবীভাগবত পুরাণ থেকে আরেকটি উপাখ্যানে রেবন্তের একটি ক্ষণস্থায়ী উল্লেখ পাওয়া যায়। একদা যখন রেবন্ত সাতটি মস্তকবিশিষ্ট ঘোড়া উচ্চৈঃশ্রবার উপর চড়ে বৈকুন্ঠে যাত্রা করেন, বিষ্ণুদেবের স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী ঘোড়াটিকে দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যান এবং রেবন্তের দ্বারা জিজ্ঞেসিত প্রশ্নকে উপেক্ষা করেন। এই কারণে, লক্ষ্মীদেবী তার স্বামীর দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে অশ্বায় পরিণত হন।[7]
মূর্তিতত্ত্ব
মার্কণ্ডেয় পুরাণে রেবন্তকে "একটি তলোয়ার ও ধনুকের সাথে, একটি কবচে সজ্জিত, গোড়ার পিঠে চড়ে এবং তীর ও একটি তূণীর বহন করা" অবস্থায় বর্ণনা করা হয়।[8] কালিকা পুরাণে একটি সাদা ঘোড়ার ওপর চড়ে তাকে তার ডান হাতে একটি তলোয়ার এবং তার বাম হাতে একটি চাবুক বহন করা অবস্থায় ব্যাখ্যা করা হয়। এই কারণে, তিনি হয়া-বাহণ (তিনি যিনি একটি ঘোড়ার ওপর চড়েন) নামেও অভিহিত হন। বরাহমিহিরে তিনি শিকারের জন্য সেবকদের সাথে বের হন বলে বর্ণনা করা হয়।[8]
ভাস্কর্যগুলিতে, রেবন্তকে প্রায়ই গুহ্যকদের সাথে শিকার করার দৃশ্যে চিত্রিত করা হয়, যাদের শাসক হলেন তিনি। গ্রন্থে বিবৃত তীর-ধনুকের মতো অস্ত্র ছাড়াও, তিনি মাঝে মাঝে হাতে একটি মদ্যের পাত্রও বহন করেন। সূর্যদেব (তাকে খালি পায়ে বর্ণনা করা হয়) ছাড়া অন্যান্য দেবতাদের থেকে ভিন্ন, রেবন্তকে প্রায়শ পায়ের গোছ পর্যন্ত পৌঁছানো বড়জুতার পরিধনকৃত অবস্থায় তুলে ধরা হয়।[9][10] রেবন্তকে একটি ঘোড়ার ওপর চড়া এবং একটি শিকারি কুকুর দ্বারা দলবদ্ধ অবস্থায়ও বিবৃত করা হয়। রেবন্তের সেবকদের বল্লম ও তলোয়ারের মতো বিভিন্ন শিকার অস্ত্রের সাথে ব্যাখ্যা করা হয়। তাদের মধ্যে কিছুদের ক্ষুদ্রাকার শঙ্খ বা চকচক করা ঢোল বা তাদের প্রভুর মাথার উপর একটি ছাতা ধরা অবস্থায় প্রদর্শন করা হয়, যেখানে ছাতাটি হলো রাজপদের একটি চিহ্ন।[11] এছাড়াও, তাদের মধ্যে কিছুদের উল্লেখ করা হয় উড়ন্ত এবং মদ্য বা জলের ঘড়া হাতে ধরা মুহূর্তে। কখনও কখনও, একজন সেবক একটি মৃত বরাহ বহন করবে বা কুকুরটি একটি বরাহকে ধাওয়া করবে।[12]
পূজা
রেবন্তকে যোদ্ধা ও অশ্বদের রক্ষক দেবতা, অরণ্যের বিপদের সময় রক্ষক এবং শিকারের অনুগ্রহকারী ভগবান হিসেবে পূজা করা হতো।[11] রেবন্তের পূজা ঘনিষ্ঠভাবে সূর্যদেবের পূজারী, সৌর-এর সাথে সংযুক্ত। প্রায়শ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ ও কালিকা পুরাণের মতো গ্রন্থে সূর্যদেব বা সূর্যপূজার অনুষ্ঠানের সাথে রেবন্তের পূজার পরামর্শ দেওয়া হয়।[8] যোদ্ধাদের দ্বারা হিন্দু মাস আশ্বিনে, সূর্যদেবের পূজার পর সভা-কল্প-দ্রুম রেবন্তের পূজার রেকর্ড গড়ে তুলে।[13] চতুর্থ পাণ্ডব, নকুল ঘোড়াদের ওপর অশ্বশাস্ত্রম্ লিখেছেন বলে মনে করা হয়। প্রেতাত্মাদের থেকে ঘোড়াদের রক্ষা করার জন্য তিনি রেবন্তের পূজার পরামর্শ দেন।[13]
মধ্যযুগীয় সময়ের প্রথম দিকে রেবন্তের পূজা অনেক জনপ্রিয় ছিল, বিশেষভাবে রাজস্থানে। তাকে অধিকাংশই বৈষ্ণবধর্ম এবং সূর্য মন্দিরে লক্ষ্য করা যায়।[14] রেবন্তের একটি মন্দিরের সম্পর্কে তুলে ধরা একটি শিলালিপি রয়েছে, যা বিকর্ণপুরে (বর্তমানে কোটগাফ, মধ্যপ্রদেশ) কলচুরির রাজা দ্বিতীয় রত্নদেব দ্বারা নির্মিত এবং এই মন্দিরের প্রধান দেবতা হলেন রেবন্ত।[15]
পাদটীকা
- Monier-Williams Dictionary: Revanta
- Monier-Williams Dictionary:Guhyaka
- Singh 1997, পৃ. 2605–6
- Danielou, Alain (১৯৯১), The Myths and Gods of India: The Classic Work on Hindu Polytheism, Inner Traditions / Bear & Company, পৃষ্ঠা 96, আইএসবিএন 0-89281-354-7 .
- A Talaqdar of Oudh (২০০৮), "XI", The Matsya Puranam: Part I, The Sacred books of the Hindus, 18, Cosmo Publications, পৃষ্ঠা 32, আইএসবিএন 81-307-0532-X
- Vibhuti Bhushan Mishra (১৯৭৩), Religious Beliefs and Practices of North India During the Early Mediaeval Period, BRILL, পৃষ্ঠা 37, আইএসবিএন 90-04-03610-5 .
- Doniger O'Flaherty, Wendy (১৯৮০), Women, androgynes, and other mythical beasts, University of Chicago Press, পৃষ্ঠা 218, আইএসবিএন 0-226-61850-1 .
- Singh 1997, পৃ. 2606
- Singh 1997, পৃ. 2611, 2613
- Kalia, Asha (১৯৮২), Art of Osian Temples: Socio-Economic and Religious Life in India, 8th-12th Centuries A.D., Abhinav Publications, পৃষ্ঠা 119–120, আইএসবিএন 0-391-02558-9 .
- A History of Zoroastrianism by Mary Boyce, Frantz Grenet, Roger Beck pp.485-6
- Singh 1997, পৃ. 2606–14
- Singh 1997, পৃ. 2607
- Singh 1997, পৃ. 2609
- Singh 1997, পৃ. 2615–16
তথ্যসূত্র
- Singh, Nagendra Kumar (১৯৯৭), "Revanta in Puranic Literature and Art", Encyclopaedia of Hinduism, 44, Anmol Publications, পৃষ্ঠা 2605–19, আইএসবিএন 81-7488-168-9 .
আরও পড়ুন
- বিজেন্দ্র নাথ শর্মা কর্তৃক আইকনোগ্রাফি অব রেবন্ত, ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত, অভিনব প্রকাশনা, ৮৬টি পাতা, আইএসবিএন ০-৭১২৮-০১১৬-২.
- এম. এল. কার্টার (১৯৮৮), রেবন্ত, অ্যান ইন্ডিয়ান ক্যাভালিয়ার গড, আন্নালি ডেল'ইস্তিতুতো ওরিয়েন্তালে দি নাপোলি, ভলিয়ম ৪৮, গুচ্ছ ২ (১৯৮৮)