কোষ (জীববিজ্ঞান)

কোষ (ইংরেজি: Cell) হল সকল জীবদেহের গঠন, বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপ ও বংশগতিমূলক তথ্য বহনকারী একক। এটি জীবের ক্ষুদ্রতম একক জীবিত একক, অর্থাৎ একটি কোষকে পৃথকভাবে জীবিত বলা যেতে পারে। এজন্যই একে জীবের নির্মাণ একক নামে আখ্যায়িত করা হয়।[1]) ব্যাক্টেরিয়া এবং এ ধরনের কিছু জীব এককোষী। কিন্তু মানুষসহ পৃথিবীর অধিকাংশ জীবই বহুকোষী। মানবদেহে প্রায় ৩৭ লক্ষ কোটি কোষ রয়েছে[2]; একটি কোষের আদর্শ আকার হচ্ছে ১০ মাইক্রোমিটার এবং ভর হচ্ছে ১ ন্যানোগ্রাম। জানামতে বৃহত্তম কোষ হচ্ছে উটপাখির ডিম। চূড়ান্ত কোষ তত্ত্ব আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে ১৮৩৭ সালে চেক বিজ্ঞানী Jan Evangelista Purkyňe অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে উদ্ভিদ কোষ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ছোট ছোট দানা লক্ষ্য করেন। ১৮৩৯ সালে বিজ্ঞানী Matthias Jakob Schleiden এবং Theodor Schwann কোষ তত্ত্ব আবিষ্কার করেন এবং তাদের তত্ত্বে বলা হয়, সকল জীবিত বস্তুই এক বা একাধিক কোষ দ্বারা গঠিত এবং সব কোষই পূর্বে অস্তিত্বশীল অন্য কোন কোষ থেকে উৎপত্তি লাভ করে। জীবের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ সব ক্রিয়াই কোষের অভ্যন্তরে সংঘটিত হয়। সকল কোষের মধ্যে কার্যক্রিয়া সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বংশগতীয় তথ্য এবং পরবর্তী বংশধরে স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকে।

কোষ
Onion (Allium) cells in different phases of the cell cycle
একটি ইউকারিয়োটিক কোষ (বামে) এবং একটি প্রোকারিয়োটিক কোষ (ডানে)
শনাক্তকারী
টিএইচH1.00.01.0.00001
এফএমএFMA:68646
শারীরস্থান পরিভাষা
একটি প্রাণীকোষের গঠন
রবার্ট হুকের মাইক্রোগ্রাফিয়া গ্রন্থে উল্লেখিত কর্ক কোষের চিত্র। এই বইয়েই প্রথম কোষ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

কোষ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ সেল (cell)। সেল শব্দটি লাতিন শব্দ সেলুলা থেকে এসেছে যার অর্থ একটি ছোট্ট কক্ষ। এই নামটি প্রথম ব্যবহার করেন বিজ্ঞানী রবার্ট হুক১৬৬৫ সালে তার প্রকাশিত একটি গ্রন্থে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পর্যবেক্ষণকৃত কর্ক কোষের কথা উল্লেখ করেন। এই কোষের সাথে তিনি ধর্মীয় সাধু-সন্ন্যাসীদের ঘরের তুলনা করেছিলেন। এ থেকেই জীবের ক্ষুদ্রতম গাঠনিক ও কার্যকরি এককের নাম দিয়ে দেন সেল।

কোষ তত্ত্ব

বিভিন্ন কোষের নানান প্রকার বৈশিষ্ট্য থাকা সত্বেও সব কোষে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। এই ভাবে কোষের গঠন ও কাজের উপর ভিত্তি করে কোষ সম্বধে যে মতবাদ বা তত্ব তৈরী হয় তাকে কোষ তত্ত্ব বলে। কোষ সম্পর্কে জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানী শ্নাইডেন, প্রাণিবিজ্ঞানী থিওডোর শভান এবং পরে রুডলফ ভির্শভ (Rudolf. Virchow) ১৮৮৫ সালে কোষ তত্ত্ব প্রদান করেন, যাতে বলা হয়েছে,

  1. কোষ হলো জীবন্ত সত্তার গাঠনিক, শারীরিক ও সাংগাঠনিক একক।
  2. কোষ হলো জীবনের মৌলিক একক।
  3. কোষ বংশগতির একক।
  4. সকল জীব এক বা একাধিক কোষ দ্বারা গঠিত এবং পূর্বসৃষ্ট কোষ থেকেই নতুন কোষের সৃষ্টি হয় ।

কোষের গঠন

সকল কোষেই কিছু সাধারণ উপাদান বা অংশ থাকে, যেমন - কোষকেন্দ্র (নিউক্লিয়াস), কোষপঙ্ক (সাইটোপ্লাজম) এবং কোষঝিল্লি বা কোষপ্রাচীর। কিছু কিছু ব্যতিক্রমী কোষের ক্ষেত্রে কোনও কোনও অংশ অনুপস্থিত থাকতে পারে। যেমন লোহিত রক্তকণিকা কোষে কোষকেন্দ্র থাকে না। কিন্তু আদর্শ কোষ বলে আসলে কিছু নেই। মানুষের দেহ কয়েক শত ধরনের কোষ নিয়ে গঠিত। যেমন স্নায়ু কোষ, রক্তকণিকা কোষ, ত্বকের কোষ বা যকৃৎ কোষ। আদর্শ কোষ বলতে এমন একটি প্রতীকী ও কাল্পনিক কোষকে বোঝায় যাতে অধিকাংশ কোষে প্রাপ্ত সমস্ত উপাদানগুলি বিদ্যমান থাকে। যেমন একটি তথাকথিত আদর্শ প্রাণীকোষে চারটি উপাদান থাকে: কোষকেন্দ্র, কোষঝিল্লি বা কোষপর্দা, মাইটোকন্ড্রিয়া এবং কোষপঙ্ক (সাইটোপ্লাজম)। অন্যদিকে একটি আদর্শ উদ্ভিদকোষের উপাদানগুলি হল কোষকেন্দ্র, কোষপ্রাচীর, কোষঝিল্লি বা কোষপর্দা, কোষগহ্বর, কোষপঙ্ক, মাইটোকন্ড্রিয়া ও হরিৎ কণিকা (ক্লোরোপ্লাস্ট)।

কোষ যে সজীব, প্রাণবাহী মাতৃপদার্থ নিয়ে গঠিত, তাকে প্রাণপঙ্ক (প্রোটোপ্লাজম) বলে। এটি খানিকটা পিচ্ছিল থকথকে পদার্থের মত, অর্থাৎ কঠিন ও তরলের মাঝামাঝি কিছু। প্রাণপঙ্ককে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—কোষকেন্দ্র এবং কোষপঙ্ক। কোষপর্দার ভেতরে কিন্তু কোষকেন্দ্রের বাইরে অবস্থিত প্রাণপঙ্ক অংশটিকে কোষপঙ্ক (সাইটোপ্লাজম) বলে। কোষপঙ্কের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের জটিল অতিক্ষুদ্র সব কাঠামো আছে, যেগুলি সাধারণ আলোকীয় আণুবীক্ষণিক যন্ত্রে ধরা পড়ে না, কিন্তু বৈদ্যুতিক আণুবীক্ষণিক যন্ত্রে এগুলির খুঁটিনাটি বিশদ আকারে দেখতে পাওয়া যায়। এই অতিক্ষুদ্র কাঠামোগুলিকে কোষীয় অঙ্গাণু বলে।

কোষের সবচেয়ে বড় অঙ্গাণুটিকে কোষকেন্দ্র (নিউক্লিয়াস) বলে। স্বল্পসংখ্যক কিছু ব্যতিক্রমী কোষ বাদে সমস্ত কোষে কোষকেন্দ্র থাকে। যেসব কোষে কোষকেন্দ্র থাকে না, সেগুলি সাধারণত মৃত হয়, যেমন উদ্ভিদের জাইলেম কলার কোষসমূহ। অথবা এগুলি বেশিদিন বাঁচে না, যেমন লোহিত রক্তকণিকা। কোষকেন্দ্র কোষের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। কোষকেন্দ্রের ভেতরে ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়িক অ্যাসিড) নামক রাসায়নিক পদার্থের অণু নিয়ে গঠিত সুতার মত দেখতে কিছু উপাদান থাকে, যাদেরকে বর্ণসূত্র বা বংশসূত্র (ক্রোমোজোম) বলে। মানুষের কোষের কোষকেন্দ্রে এরকম ২৩ জোড়া অর্থাৎ ৪৬টি বংশসূত্র থাকে। প্রতিটি বংশসূত্রে একটি করে ডিএনএ অণুর দীর্ঘ শৃঙ্খল থাকে, যে শৃঙ্খলটি স্থান সঙ্কুলান করার জন্য ভাঁজ হয়ে ও হিস্টোন নামের কিছু প্রোটিনকে ঘিরে সর্পিলাকারে পেঁচিয়ে বিন্যস্ত হয়ে থাকে। ডিএনএ অণুর একেকটি অংশ একেকটি বংশগতীয় বৈশিষ্ট্য বহন করে, যে অংশগুলিকে বংশাণু (জিন) বলে। বংশাণুগুলি কোষের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোষ কোন্‌ ধরনের দেহসার বা প্রোটিন তৈরি বা সংশ্লেষণ করবে, তা নির্ধারণ করে। বংশাণুবাহী ডিএনএগুলি কোষকেন্দ্রে অবস্থান করে, কিন্তু প্রোটিন উৎপাদন করার নির্দেশগুলি কোষকেন্দ্রের বাইরে কোষপঙ্কতে পরিবাহিত হয় এবং রাইবোজোম নামক নামের ক্ষুদ্র কিছু কাঠামোতে প্রোটিন উৎপাদিত বা সংশ্লেষিত হয়।

কোষের ভেতরে প্রাপ্ত প্রোটিনগুলির মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ধরনের প্রোটিন হল উৎসেচক (এনজাইম)। কোষপঙ্কতে যে রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলি ঘটে, উৎসেচকগুলি সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

সব কোষের পৃষ্ঠতল একটি অত্যন্ত পাতলা পর্দার ন্যায় কোষঝিল্লি বা কোষপর্দা দ্বারা আবৃত থাকে। এটি বহিঃস্থ পরিবেশ থেকে কোষের কোষপঙ্ককে পৃথক করে রাখে। তবে কোষঝিল্লি সম্পূর্ণ অভেদ্য একটি প্রতিবন্ধক নয়, বরং আংশিকভাবে ভেদ্য। কিছু কিছু রাসায়নিক পদার্থ কোষঝিল্লির ভেতর দিয়ে কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে, আবার কতগুলি রাসায়নিক পদার্থ কোষ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। কোষঝিল্লি এই প্রবেশ ও বহির্গমন প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বলা হয় কোষপর্দা শুধু আংশিকভাবে ভেদ্যই নয়, বরং নৈর্বাচনিকভাবে বা বিভেদকভাবে ভেদ্য।

কোষের ভেতরে অন্যান্য আরও ঝিল্লি জাতীয় পদার্থ আছে। কোষপঙ্কর প্রায় সর্বত্র জুড়ে কিছু ঝিল্লির ন্যায় জালিকা উপস্থিত থাকে, যাদেরকে অন্তঃকোষীয় জালক (এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম) বলে। কিছু কিছু অন্তঃকোষীয় জালক খুবই ক্ষুদ্র কিছু দানাদার উপাদান দিয়ে আবৃত থাকে, যাদেরকে রাইবোজোম বলে। রাইবোজোম নামের অঙ্গাণুগুলিতেই প্রোটিনগুলি সংযোজিত বা সংশ্লেষিত হয়। কোষের ভেতরে এরকম হাজার হাজার রাইবোজোম থাকে।

আরেকটি অঙ্গাণু যা প্রায় সব কোষের কোষপঙ্কতে দেখতে পাওয়া যায়, তা হল মাইটোকন্ড্রিয়ন (বহুবচনে মাইটোকন্ড্রিয়া)। যেসব কোষের কর্মকাণ্ডে অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়, যেমন পেশী কোষ বা স্নায়ুকোষ, সেগুলিতে বহুসংখ্যক মাইটোকন্ড্রিয়ন থাকে। মাইটোকন্ড্রিয়নের ভেতরে কোষীয় শ্বসন প্রক্রিয়ার কিছু বিক্রিয়া সংঘটিত হয়, যার ফলে কোষের জন্য ব্যবহারোপযোগী শক্তি নির্গত হয়।

উদ্ভিদকোষের ক্ষেত্রে উপরের অঙ্গাণুগুলি ছাড়াও আরও তিনটি প্রধান উপাদান থাকে। এগুলি হল কোষপ্রাচীর, কোষগহ্বরহরিৎ কণিকা (ক্লোরোপ্লাস্ট)।

কোষপ্রাচীর হল প্রাণহীন পদার্থ দিয়ে তৈরি একটি স্তর যা উদ্ভিদকোষের কোষঝিল্লির বাইরে অবস্থান করে। এটি মূলত সেলুলোজ নামের এক ধরনের শর্করা দিয়ে গঠিত হয়। সেলুলোজ একটি শক্ত উপাদান নিয়ে গঠিত যা কোষকে তার আকৃতি ধরে রাখতে সাহায্য করে। এ কারণে উদ্ভিদকোষগুলি মোটামুটি একই আকৃতির হয়। অন্যদিকে প্রাণীকোষে কোনও কোষপ্রাচীর নেই বলে এদের আকৃতিগুলিও পরিবর্তনশীল হয়।

প্রায়শই উদ্ভিদকোষগুলির অভ্যন্তরে কেন্দ্রস্থলে ঝিল্লি দ্বারা আবৃত একটি বৃহৎ গহ্বরের ন্যায় এলাকা থাকে, যাকে কোষগহ্বর (ভ্যাকুওল) বলে। এটি শূন্য নয়, বরং কোষরস নামের এক ধরনের জলীয় পদার্থে পূর্ণ থাকে, যা দ্রবীভূত চিনি, খনিজ আধান ও অন্যান্য দ্রাব্যের একটি ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। প্রাণীকোষে কোষগহ্বর থাকলেও সেগুলি ক্ষুদ্র আকারের ও ক্ষণস্থায়ী হয়।

উদ্ভিদের সবুজ অংশে, বিশেষ করে পাতায়, আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণু থাকে, যার নাম হরিৎ কণিকা (ক্লোরোপ্লাস্ট)। হরিৎ কণিকাগুলি সূর্যের আলো শোষণ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াতে খাদ্য উৎপাদন করে। হরিৎ কণিকাগুলিতে এক ধরনের সবুজ রঙের রঞ্জক পদার্থ থাকে, যাদেরকে পত্রহরিৎ (ক্লোরোফিল) বলে।

প্রকারভেদ

কোষকেন্দ্রের ধরনের উপর ভিত্তি করে কোষ প্রধানত দুই প্রকার: আদি কোষ এবং প্রকৃত কোষ। আদি কোষ অনেকটা স্বাধীন, কিন্তু প্রকৃত কোষ বহুকোষী জীবের মধ্যে থেকে অন্যের সাথে মিলে কাজ করে।

আদি কোষ(prokaryotic cell)

একটি আদর্শ আদি কোষের চিত্র।

নিউক্লিয়াসের গঠনের উপর ভিত্তি করে আদি কোষের সাথে প্রকৃত কোষের পার্থক্য করা হয়, বিশেষত নিউক্লীয় ঝিল্লি আছে কি নেই তার উপর ভিত্তি করে। প্রকৃত কোষে উপস্থিত অধিকাংশ অঙ্গাণুই আদি কোষে নেই, কেবল ব্যতিক্রম হল রাইবোজোম যা উভয় ধরনের কোষেই উপস্থিত। মাইটোকন্ড্রিয়া, ক্লোরোপ্লাস্ট বা গলগি বস্তু ইত্যাদির কাজের অধিকাংশই আদি কোষের ক্ষেত্রে প্লাজমা ঝিল্লি সম্পন্ন করে। আদি কোষের মধ্যে তিনটি প্রধান ভিত্তি স্থাপনকারী অংশ রয়েছে: ১। ফ্লাজেলা এবং পিলি নামে পরিচিত উপাঙ্গ যারা কোষ তলের সাথে লেগে থাকা প্রোটিন হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। ২। একটি ক্যাপসুল, একটি কোষ প্রাচীর এবং একটি কোষ তল সমৃদ্ধ কোষ এনভেলপ। এবং ৩। একটি সাইটোপ্লাজমীয় অঞ্চল যেখানে কোষ জিনোম (ডিএনএ), রাইবোজোম এবং বিভিন্ন অনুপ্রবেশকারী থাকে।[3] এছাড়া এ ধরনের কোষে পরীলক্ষিত পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ:

  • প্লাজমা ঝিল্লি (ফসফোলিপিড দ্বিস্তর) কোষের অভ্যন্তরভাগকে এর পরিবেশ থেকে রক্ষা করে এবং এর মধ্যে একটি যোগাযোগ মাধ্যম ও ফিল্টার হিসেবে কাজ করে।
  • অধিকাংশ আদি কোষেরই একটি কোষ প্রাচীর রয়েছে; ব্যতিক্রম হল মাইকোপ্লাজমা (এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া) এবং থার্মোপ্লাজমা (একটি আর্কিয়ন)। ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে কোষ প্রাচীরের মধ্যে পেপটিডোগ্লাইক্যান নামক পদার্থ থাকে যা বাইরের যেকোন শক্তি বিরুদ্ধে একটি বাঁধা হিসেবে কাজ করে। কোষ প্রাচীর কোষকে হাইপোটনিক পরিবেশে অসমোটিক চাপের কারণে বিস্ফোরিত হওয়া (সাইটোলাইসিস) থেকে রক্ষা করে। প্রকৃত কোষেও ক্ষেত্রবিশেষে কোষ প্রাচীর থাকতে দেখা যায় (উদ্ভিদ কোষের সেলুলোজ, ছত্রাক), কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রাচীরের রাসায়নিক গঠন ভিন্ন।
  • আদি কোষের ক্রোমোসোম একটি বৃত্তাকার অণু। অবশ্য লাইম রোগ সৃষ্টিকারী Borrelia burgdorferi নামক ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটে। আদি কোষে প্রকৃত নিউক্লিয়াস না থাকলেও ডিএনএ অণু একটি নিউক্লিঅয়েডের মধ্যে ঘনীভূত থাকে। এরা প্লাজমিড নামক এক্সট্রাক্রোমোসোমাল ডিএনএ মৌল বহন করে যারা সাধারণত বৃত্তাকার। প্লাজমিড কিছু সহযোগী পদার্থ বহন করতে পারে, যেমন এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স
একটি আদর্শ প্রকৃত কোষের চিত্রে এর অঙ্গাণুসমূহ দেখা যাচ্ছে: (1) নিউক্লিওলাস (2) নিউক্লিয়াস (3) রাইবোজোম (4) ভেসিক্‌ল (5) অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমীয় জালিকা (6) গলগি বস্তু (7) সাইটোস্কেলিটন (8) মসৃণ এন্ডোপ্লাজমীয় জালিকা (9) মাইটোকন্ড্রিয়া (10) কোষ গহ্বর (11) সাইটোপ্লাজম (12) লাইসোজোম (13) সেন্ট্রোজোম-এর মধ্যস্থিত সেন্ট্রিওল

প্রকৃত কোষ(eukariyotic cell)

Structure of a typical animal cell
একটি আদর্শ উদ্ভিদ কোষের গঠন
একটি প্রকৃত প্রাণী কোষের ভিতরের গঠন

প্রকৃত কোষগুলো আকারে একটি আদর্শ আদি কোষের ন্যূনতম ১০ গুণ বড় এবং এর আয়তন আদি কোষের তুলনায় সর্বোচ্চ ১০০০ গুণ পর্যন্ত বেশি হতে পারে। আদি এবং প্রকৃত কোষের মধ্য মূল পার্থক্য হচ্ছে, আদি কোষের মধ্যে ঝিল্লি দ্বারা আবৃত কক্ষ থাকে যার মধ্যে নির্দিষ্ট বিপাকীয় কার্যাবলী সম্পাদিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কোষ নিউক্লিয়াস যার মধ্যে প্রকৃত কোষের ডিএনএ অবস্থান করে। নিউক্লিয়াস একটি ঝিল্লি দ্বারা বেষ্টিত কক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এই নিউক্লিয়াসের কারণেই প্রকৃত কোষ তার ইংরেজি নামটি পেয়েছে। ইরেজি নাম "ইউক্যারিয়টিক"-এর অর্থ "প্রকৃত নিউক্লিয়াস"। অন্যান্য পার্থক্যের মধ্যে রয়েছে:

  • প্লাজমা ঝিল্লি অনেকটা আদি কোষের মতই, তবে কার্যাবলী এবং গঠনে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। কোষ প্রাচীর থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে।
  • প্রকৃত কোষের ডিএনএ এক বা একাধিক রৈখিক অণুতে বিন্যস্ত থাকে যাদেরকে ক্রোমোসোম বলা হয়। ক্রোমোসোম হিস্টোন প্রোটিনের সাথে সম্পর্কিত। সকল কোমোসোমাল ডিএনএ কোষের নিউক্লিয়াসে সজ্জিত থাকে যা একটি ঝিল্লির মাধ্যমে সাইটোপ্লাজম থেকে পৃথকীকৃত থাকে। প্রকৃত কোসের কিছু অঙ্গাণুরও নিজস্ব ডিএনএ রয়েছে।
  • এরা সিলিয়া বা ফ্লাজেলা ব্যবহার করে চলাচল করতে পারে। এদের ফ্লাজেলা আদি কোষের তুলনায় জটিল।[4]
ছক ১: আদি ও প্রকৃত কোষের বৈশিষ্ট্যসমূহের তুলনা
  আদি কোষ প্রকৃত কোষ
আদর্শ কোষের অংশসমূহ ব্যাক্টেরিয়া, আর্কিয়া প্রোটিস্টা,ছত্রাক, উদ্ভিদ, প্রাণী
আদর্শ আকার ~ ১-১০ মাইক্রোমিটার ~ ১০-১০০ মাইক্রোমিটার (লেজ বাদ দিলে শুক্রাণু এর চেয়ে ছোট)
নিউক্লিয়াসের প্রকৃতি নিউক্লিঅয়েড অঞ্চল; কোন প্রকৃত নিউক্লিয়াস নেই দ্বিস্তর বিশিষ্ট ঝিল্লি সহ প্রকৃত নিউক্লিয়াস আছে।
ডিএনএ সাধারণত বৃত্তাকার হিস্টোন প্রোটিনবিশিষ্ট রৈখিক অণু।
আরএনএ/প্রোটিন সংশ্লেষণ সাইটোপ্লাজমের মধ্যে সংযুক্ত নিউক্লিয়াসের ভিতরে আরএনএ সংশ্লেষ ঘটে।
সাইটোপ্লাজমে প্রোটিন সংশ্লেষ ঘটে।
রাইবোজোম ৫০এস+৩০এস ৬০এস+৪০এস
সাইটোপ্লাজমীয় গঠন খুব অল্প সংখ্যাক গঠন অন্তঃঝিল্লি এবং সাইটোকঙ্কাল দ্বারা ভালোভাবে গঠিত
কোষের চলাচল ফ্লাজেলিন দ্বারা গঠিত ফ্লাজেলা টিউবিউলিন এবং ল্যামেলিপোডিয়া দ্বারা গঠিত ফ্লাজেলা ও সিলিয়া
মাইটোকন্ড্রিয়া নেই এক থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত হতে পারে। কয়েকটির অবশ্য একেবারেই থাকেনা।
ক্লোরোপ্লাস্ট নেই শৈবাল এবং উদ্ভিদ-এ থাকে।
সংগঠন সাধারণত একক কোষ একক কোষ, কলোনি, বিশেষ কোষ দ্বারা গঠিত উচ্চতর বহুকোষী জীব
কোষ বিভাজন দ্বি-বিভাজন (সাধারণ বিভাজন) মাইটোসিস (বিভাজন বা বাডিং)
মিয়োসিস
ছক ২: উদ্ভিদ কোষ এবং প্রাণী কোষের গঠনের পার্থক্য
আদর্শ প্রাণী কোষ আদর্শ উদ্ভিদ কোষ
অঙ্গাণু
সহযোগী গঠনসমূহ

কোষের উপাদানসমূহ

আদি বা প্রকৃত সকল কোষেই একটি আবরণ থাকে যার মাধ্যমে এটি বাইরের পরিবেশ থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং এই আবরণটি কোষের বাইরের পদার্থের সাথে ভিতরের পদার্থের আদান প্রদানের ভারসাম্য রক্ষা করে। এছাড়াও এই আবরণটির মাধ্যমে কোষের তড়িৎ বিভব বজায় থাকে। ঝিল্লি বা আবরণটির ভিতরে একটি লবণাক্ত সাইটোপ্লাজম অধিকাংশ আয়তন দখল করে থাকে। সকল কোষেই জিনের বংশগতিক পদার্থগুলো বহনের জন্য ডিএনএ এবং এনজাইমসহ অন্যান্য প্রোটিন সংশ্লেষের জন্য আরএনএ উপস্থিত থাকে। এ দুটিই কোষের প্রাথমিক যন্ত্রপাতি। এছাড়াও কোষে অন্যান্য ধরনের জৈব অণু থাকে। এখানে এই উপাদানগুলোর তালিকা তৈরি করা হবে।[5]

কোষ গবেষণার ইতিহাস

  • ১৬৩২ - ১৭২৩ : Anton van Leeuwenhoek নিজে নিজে লেন্স ঘষে নির্দিষ্ট আকারে আনতে শিখেন, তৈরি করেন অণুবীক্ষণ যন্ত্র। এর মাধ্যমে বৃষ্টির পানিতে ভোর্টিসেলা এবং এরকম কিছু প্রোটোজোয়া আবিষ্কার করেন। এছাড়া নিজের মুখে ব্যাক্টেরিয়া আবিষ্কার করেন।
  • ১৬৬৫ : আদি প্রকৃতির একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে রবার্ট হুক প্রথমে কর্ক কোষ আবিষ্কার করেন এবং পরে আরও কিছু জীবন্ত উদ্ভিদ কোষ আবিষ্কার করেন।[6]
  • ১৮৩৯ : জার্মান জীববিজ্ঞানী থিওডোর সোয়ান এবং মাথিয়াস জ্যাকব শ্লেইডেন সকল প্রাণী এবং উদ্ভিদ কোষ দ্বারা গঠিত বলে একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তারা বলেন কোষ হল গঠন এবং উন্নয়নের একক। এভাবেই কোষ তত্ত্বের জন্ম হয়।
  • লুই পাস্তুর (১৮২২ - ১৮৯৫) মত প্রকাশ করেন যে, জীবন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গঠিত হতে পারে। এই তত্ত্বকে generatio spontanea বলে। অবশ্য ১৬৬৮ সালে ফ্রানসেস্কো রেডি একটি পরীক্ষা করেছিলেন যা থেকে একই তত্ত্ব প্রমাণিত হয়।
  • Rudolph Virchow বলেন, কোষ সব সময়ই কোষ বিভাজনের মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করে। (omnis cellula ex cellula)
  • ১৯৩১ : জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে সর্বপ্রথম ডিএনএ অণুর দ্বি-হেলিক্স গঠন আবিষ্কার করেন।
  • ১৯৮১ : লিন মার্গুলিস Symbiosis in Cell Evolution নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বইয়ে এন্ডোসিমবায়োটিক তত্ত্বের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।

তথ্যসূত্র

  1. "Cell"। Online Etymology Dictionary। সংগ্রহের তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ২০১২
  2. Eveleth, Rose। "There are 37.2 Trillion Cells in Your Body"Smithsonian (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০২-০৮
  3. Microbiology : Principles and Explorations By Jacquelyn G. Black
  4. Satir, Peter; Christensen, ST; Søren T. Christensen (২০০৮-০৩-২৬)। "Structure and function of mammalian cilia"Histochemistry and Cell Biology। Springer Berlin/Heidelberg। 129 (6): 687–693। doi:10.1007/s00418-008-0416-9। PMID 18365235পিএমসি 2386530। 1432-119X। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-১২
  5. Cell Movements and the Shaping of the Vertebrate Body in Chapter 21 of Molecular Biology of the Cell fourth edition, edited by Bruce Alberts (2002) published by Garland Science.
    The Alberts text discusses how the "cellular building blocks" move to shape developing embryos. It is also common to describe small molecules such as amino acids as "molecular building blocks".
  6. "... I could exceedingly plainly perceive it to be all perforated and porous, much like a Honey-comb, but that the pores of it were not regular [..] these pores, or cells, [..] were indeed the first microscopical pores I ever saw, and perhaps, that were ever seen, for I had not met with any Writer or Person, that had made any mention of them before this. . ." – Hooke describing his observations on a thin slice of cork. Robert Hooke
  • টেমপ্লেট:NCBI-scienceprimer

বহিঃসংযোগ

অনলাইন পাঠ্যপুস্তক

  • Alberts B, Johnson A, Lewis J, Raff M, Roberts K, Walter P (২০০২)। Molecular Biology of the Cell (4th ed. সংস্করণ)। Garland। আইএসবিএন 0815332181।
  • Lodish H, Berk A, Matsudaira P, Kaiser CA, Krieger M, Scott MP, Zipurksy SL, Darnell J (২০০৪)। Molecular Cell Biology (5th ed. সংস্করণ)। WH Freeman: New York, NY। আইএসবিএন 978-0716743668।
  • Cooper GM (২০০০)। The cell: a molecular approach (2nd ed. সংস্করণ)। Washington, D.C: ASM Press। আইএসবিএন 0-87893-102-3।
  • Gall JG, McIntosh JR, eds (2001).Landmark Papers in Cell Biology. Bethesda, MD and Cold Spring Harbor, NY: The American Society for Cell Biology and Cold Spring Harbor Laboratory Press; 2001. Commentaries and links to original research papers published in the ASCB Image & Video Library

টেমপ্লেট:Cellular structures

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.