মাইটোকন্ড্রিয়া

মাইটোকন্ড্রিয়া (ইংরেজি: Mitochondria) এক প্রকার কোষীয় অঙ্গানু, যা সুকেন্দ্রিক কোষে পাওয়া যায়। মাই‌টোক‌ন্ড্রিয়াকে কোষের শ‌ক্তি উৎপাদন কেন্দ্র বা পাওয়ার হাউস বলা হয়।[1]

Two mitochondria from mammalian lung tissue displaying their matrix and membranes as shown by electron microscopy


মানুষের মাইটোকন্ড্রিয়া

Test জেনাস গ্রীন।

আবিষ্কার

মাইটোকন্ড্রিয়ার আবিস্কার নিয়ে মতভেদ আছে। একটি মতে, বিজ্ঞানী অল্টম্যান ১৮৯৪ সালে ইহা আবিষ্কার করেন। আবার কারও মতে, গ্রিক বিজ্ঞানী সি. বেন্ডা ১৮৯৮ সালে মাইটোকন্ড্রিয়া আবিস্কার করেন। এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরী অনুযায়ী মাইটোকন্ড্রিয়া, প্লাস্টিড বহু আগে মুক্তজীবি ব্যাক্টেরিয়া ছিল। যারা এন্ডোসিম্বায়োন্ট হিসেবে অন্য কোষের মধ্যে ঢুকে পরে এবং একসময় কোষেরই অংশ হয়ে যায়। বিজ্ঞানীদের ধারনা, মাইটোকন্ড্রিয়া এসেছে প্রোটিওব্যাক্টেরিয়া থেকে এবং প্লাস্টিড এসেছে সায়ানোব্যাক্টেরিয়া থেকে! এর জন্য বিজ্ঞানীরা অনেক প্রমাণ দাড় করিয়েছেন। এগুলো থেকে বুঝা যায় বুঝা যায় যে মাইটোকন্ড্রিয়া এবং প্লাস্টিড ব্যাক্টেরিয়া থেকে এসেছে। এর মধ্যে কয়েকটা এরকমঃ

  • ১) ব্যাক্টেরিয়ার মেমব্রেনের সাথে এই অঙ্গানুগুলোর মেমব্রেনের অনেক মিল রয়েছে।
  • ২) নতুন মাইটোকন্ড্রিয়া অথবা প্লাস্টিড যেই প্রকৃয়ায় আসে, ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রেও এমন ঘটে যাকে বলে বাইনারি ফিশন। এটা এক ধরনের অযৌন প্রজনন।
  • ৩) এরা যে ধরনের রাইবোজম(70S) বহন করে, ব্যাক্টেরিয়াতেও তা রয়েছে।
  • ৪) ব্যাক্টেরিয়ার বাহিরের মেমব্রেনে ‘পোরিন’ নামের এক ধরনের ট্রান্সপোর্ট প্রোটিন পাওয়া যায়, যা মাইটোকন্ড্রিয়া এবং প্লাস্টিডের বাহিরের মেমব্রেনেও রয়েছে।
  • ৫) যদি কোষের থেকে মাইটোকন্ড্রিয়া অথবা ক্লোরোপ্লাস্ট সরিয়ে ফেলা হয়, কোষের ভেতর তারা আবার তৈরি হয়না।
  • ৬) তবে সবচেয়ে আকর্ষনীয় যেটা তা হল ডিএনএ। মাইটোকন্ড্রিয়া এবং প্লাস্টিড উভয়েরই নিজস্ব ডিএনএ রয়েছে যা সংস্লিষ্ট ব্যাক্টেরিয়ার সাথে তুলনা করলে বিশাল মিল পাওয়া যায়।

অবস্থান

লোহিতরক্তকণিকা এবং সীভনল ব্যতীত সকল প্রকার শক্তিউৎপাদী কোষেই মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে।

আয়তন ও সংখ্যা

আকারভেদে মাইটোকন্ড্রিয়ার আয়তন বিভিন্ন রকম।বৃত্তাকার মাইট্রোকন্ড্রিয়ার ব্যাস ০.২ µm থেকে ২ µm। সূত্রাকার মাইটোকন্ড্রিয়ার দৈর্ঘ্য ৪০ µm থেকে ৭০ µm।দন্ডাকার মাইটোকন্ড্রিয়ার দৈর্ঘ্য ৯ µm থেকে এবং প্রস্থ ০.৫ µm হতে পারে।[2]""|||

সাধারণত প্রতি কোষে এর সংখ্যা ২০০-৩০০'র মত থাকে। যকৃৎ কোষে ১০০০ বা ততোধিক থাকে।[3] ""|||

বৃদ্ধি

বিভাজনের মাধ্যমে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মাইটোকন্ড্রিয়াতে তার ব্যাকটেরিয়া পূর্বপুরুষের মত ডিএনএ রক্ষনাবেক্ষনের যন্ত্রপাতি থাকেনা। যার ফলে এতে খুব দ্রুত মিউটেশন ঘটে। একটা মাইটোকন্ড্রিয়াতে একই জিনোমের কয়েকশ কপি থাকে, আবার একটি কোষে কয়েকশ মাইটোকন্ড্রিয়া থাকতে পারে। প্রতি মুহুর্তেই এই মিউটেশনের ফলে মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএর বৈচিত্র্য পরিবর্তিত হচ্ছে। আমরা একাধিক মাইটোকন্ড্রিয়াল ভেরিয়েশন নিয়ে জন্মাই, যেই ভেরিয়েশন নিষেকের সময় ডিম্বকে তৈরি হয়। বিভিন্ন মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম মৌলিক কোষীয় ক্রিয়া গুলোকে প্রভাবিত করে বিভিন্ন পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। স্কট উইলিয়াম এবং তার দল কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবকের দশ ধরনের টিস্যু থেকে মাইটোকন্ড্রিয়া সংগ্রহ করে দেখেন যে প্রতি টিস্যুতে মাইটোকন্ড্রিয়ার জিনোমে নির্দিষ্ট কিছু মিউটেশন ঘটেছে যা ব্যাক্তিভেদে খুব একটা পার্থক্য দেখায়নি। বিভিন্ন ধরনের কোষের ব্যাতিক্রমি চাহিদা পূরনের জন্য এই মিউটেশনগুলো ঘটেছে।[4]

গঠন

মাইটোকন্ড্রিয়া দুটি এককপর্দা দিয়ে গঠিত,যাদের প্রত্যেকটির বেধ ৬০Å। ভিতরেরটিকে অন্তঃআবরণী(Inner Membrane)এবং বাইরেরটিকে বহিরাবরণী(Outer Membrane)বলা হয়। দুটি এককপর্দার মধ্যবর্তী স্থানকে পেরিমাইটোকন্ড্রিয়াল স্পেস (৬০-৯০Å) বলে। প্রতিটি এককপর্দা লাইপোপ্রোটিন(P-L-P)নির্মিত। অন্তঃপর্দা ভিতরের দিকে ভাঁজ হয়ে যে বিভেদক প্রাচীর সৃষ্টি করে তাকে ক্রিস্টি(Cristae) বলে। অন্তঃপর্দার ভিতরে অর্ধতরল ধাত্র বা ম্যাট্রিক্স বর্তমান।এই ধাত্রে বিভিন্ন প্রকার উৎসেচক বর্তমান। বহিঃপর্দার বহিঃগাত্রকে C-তল (Cytoplasmic Surface)এবং অভ্যন্তরীণ তলকে M-তল(Matrix surface)বলে। ক্রিস্টির গাত্রে অসংখ্য সবৃন্তক কণা বর্তমান,একে অক্সিজোম বা F1 বা ফার্নান্ডেজ-মোরান অধঃএকক বলে। বর্তমানে জানা গেছে,অক্সিজোম ৫টি অধঃএককের সমন্বয়ে গঠিত।এদের 3α,3β,1γ,1Δ ও 1ε দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এই অধঃএককগুলি শ্বাস উৎসেচকে পূর্ণ। অক্সিজোমের গোলাকার মস্তকের ব্যাস ৭৫-১০০Å,বৃন্তটি লম্বাকার অংশ ৫০Å দীর্ঘ এবং চওড়ায় ৩৫-৪০Å। আয়তাকার বেস(Base বা F0 subunit)১১৫Å*৪৫Å আয়তনের বেস।প্রতিটি মাইটোকন্ড্রিয়ায় অক্সিজোমের সংখ্যা ১০০০০-১০০০০০।

প্রতিটি অক্সিজোম পরস্পর থেকে ১০০Å দূরে থাকে। বহিঃপর্দার বহিঃগাত্রে কিছু অবৃন্তক কণা বর্তমান,এদের পারসনের অধঃএকক বলে। মাইটোকন্ড্রিয়ার ম্যাট্রিক্সে ৩-৫টি চক্রাকার DNA বর্তমান,একে মাইটোকন্ড্রিয়াল DNA বলে। ম্যাট্রিক্সে মাঝেমাঝে গুচ্ছাকারে ৫৫S প্রকৃতির রাইবোজোম বর্তমান,এদের মিটোরাইবোজোম বলে।[5]

কাজ

  • সবাত শ্বসনের দ্বিতীয় পর্যায় ক্রেবস চক্র ও ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইনের বিক্রিয়া সমূহ মাইটোকন্ড্রিয়াতে সংঘটিত হয়। এর মাধ্যমে ATP(Adenosine Triphosphate)অণু সংশ্লেষ করে যা সকল শক্তির উৎস বলে মাইটোকন্ড্রিয়াকে Powerhouse of Cell বা কোষের শক্তিঘর বলে।
  • ইহা লেসিথিন এবং ফসফাটাইডাইল-ইথানলামিন নামক দুটি ফ্যাট সংশ্লেষে সহায়তা করে। ইহা ফ্যাটি অ্যাসিড বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে।
  • ইহা জীবদেহে জৈবদ্যুতি (Bio luminescence)ঘটায়। অর্থাৎ মাইটোকন্ড্রিয়া জোনাকির দেহে লুসিফেরন নামক প্রোটিনকে লুসিফেরেজ নামক উৎসেচক দ্বারা জারিত করে ফসফরাসের বিয়োজন ঘটায় যা আলোক সৃষ্টি করে। এখানে হিমোগ্লোবিন এবং মায়োগ্লোবিনের হিম (Haem)অংশ সংশ্লেষিত হয়।
  • কিছু পরিমাণ RNA ও DNA উৎপন্ন করতে পারে।
  • কোষের প্রয়োজনে সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়ে কাজে সহায়তা করে।
  • প্রাণিকোষে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
  • মাইটোকন্ড্রিয়া স্মৃতিশক্তিকে প্রভাবিত করে।
  • মাইটকন্ড্রিয়া আমাদের কোষের জন্য শক্তি তৈরির সাথে সাথে এক ধরনের আয়নিত অণুর সৃষ্ট করে যাকে ফ্রী রেডিকেল বলে। তারা স্টেম সেল-এর পরিনত হওয়া এবং ভাইরাসের আক্রমণে নিরাপত্তা প্রতিক্রিয়া তৈরিতেও কাজ করে।

তথ্যসূত্র

  1. ক্যাটরিন হেঞ্জেল ও উইলিয়াম মার্টিন (১৩ নভেম্বর ২০০৩)। "Evolutionary biology: Essence of mitochondria"
  2. গাজী আজমল,সফিউর রহমান। উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান(প্রথম পত্র)। গাজী পাবলিশার্স। পৃষ্ঠা ১৪।
  3. আবুল হাসান। উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান (১ম পত্র)। হাসান বুক হাউস। পৃষ্ঠা ৯১।
  4. The powerful aliens that lurk within you by Garry Hamilton, New Scientist
  5. "Mitochondrion – much more than an energy converter"। British Society for Cell Biology। সংগ্রহের তারিখ ১৯ আগস্ট ২০১৩

বহিঃসংযোগ

টেমপ্লেট:Organelles টেমপ্লেট:Mitochondrial enzymes

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.