ইসলামি পরকালবিদ্যা

ইসলামী পরকালবিদ্যা হল ইসলামী বিদ্যার একটি শাখা, যেখানে ইয়াওমাল ক্বিয়ামাহ (আরবি: ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﺎﻣﺔ "‏বাংলা: পুনুরুত্থান দিবস") বা ইয়াওমিদ-দ্বীন (আরবি:‎‏ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﺪﻳﻦ‎ বাংলা: বিচার দিবস") সম্পর্কে অধ্যয়ন করা হয়। মুসলমানগণ বিশ্বাস করেন যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বিশ্বজগৎ ধ্বংস করবেন, মানব ও জ্বিন দেহের পুনুরুত্থান ঘটাবেন, তাদের বিচার করবেন এবং চিরস্থায়ীভাবে কর্মফল প্রদান করবেন।

ইমান বা বিশ্বাসের ছয়টি বিষয়

বিচার অথবা পুনুরুত্থান দিবস, "আল-ক্বিয়ামাহ" হল ইসলামের ছয়টি বিশ্বাসের মধ্যে একটি। কুর'আন ও হাদীসে, এবং আল-গাজ্জালি, ইবনে কাসীর, ইবনে মাজাহ, ইমাম বুখারী, এবং ইবনে খুযাইমাহ'[1][2][3][4][5][6] ইসলামী তাফসীরবিদগণের তাফসীরসমূহে (ধারাবর্ননা) সে সময়ের অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি কথা বলা হয়েছে। কিয়ামত বা বিচার দিবসকে বিবেচনা দিবস (the Day of reckoning), প্রতীক্ষিত ঘন্টা (the Hour) ও শেষ দিবসও (the Last Day) বলা হয়ে থাকে। বিচার বা পুনুরুত্থান দিবস, আল-ক্বিয়ামাহ হল ইসলামের ছয়টি (সুন্নি) বা সাতটি (শিয়া) আকিদার (মূলনীতির) একটি অংশ।

কুরআনে শেষ বিচার

কুরআনে শেষ বিচারের বর্ননা রয়েছে , এবং এ সম্পর্কিত আয়াতসমূহের বহুসংখ্যক তাফসির বা ব্যাখ্যা রয়েছে। এ সকল আয়াতসমূহের সারকথা নিম্নরুপ:

  1. এই নির্দিষ্ট সময়টি শুধু আল্লাহ পাক'ই জানেন।[7]
  2. নবী হজরত মুহাম্মদ একে এগিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন না।[8]
  3. যারা মারা গিয়েছিল তারা মনে করবে যে, জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যকার একটি স্বল্প সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।[9] তখন আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।[10]
  4. আল্লাহ সকলকে পুনুরুত্থিত করবেন, এমনকি তারা যদি পাথর এবং লোহায় রুপান্তরিত হয় তবুও।[11]
  5. যারা মিথ্যা দেবদেবীকে উপাস্যরুপে গ্রহণ করেছিল তারা পরকালে শাস্তি ভোগ করবে।[12]

তিনটি পর্যায়

শেষ বিচারে আগে তিনটি ধাপ বা পর্যায় আছে।[13][14]

বড় লক্ষণসমূহ

  • মিথ্যা মসীহ বা মসীহ দজ্জাল; একচোখ অন্ধ, একচোখ সুস্থ এবং বিশাল ক্ষমতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে এবং নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করবে।
  • ইমাম মাহদীর আত্মপ্রকাশ।[15][16][17]
  • মানুষ মদীনা ত্যাগ করবে, খাঁটি মুমিনগণ মাহদীকে অণুসরণ করবে এবং কাফিররা করবে দাজ্জালকে।
  • দাজ্জালকে হত্যা এবং ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দ্বিতীয় আসমান থেকে ঈসা (আঃ) এর প্রত্যাবর্তন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পৃথিবী শাসন করবেন।
  • ইয়া'জুজ এবং মা'জুজ নামক অবাধ্য প্রাণীর দুটি গোত্র , যারা যুলকারণাইনের সাহায্যে বন্দী হয়েছিল তারা বেরিয়ে আসবে।
  • মক্কায় আক্রমণ করা হবে এবং কাবাঘর[18] ধ্বংস করা হবে।
  • দক্ষিণ দিক থেকে এক সুখকর বাতাসের আগমণ যার স্পর্শে সকল মুমিনের প্রশান্তিময় মৃত্যু ঘটবে।
  • মানুষ কুরআন ভুলে যাবে এবং কেউ এর আয়াত স্মরণ করবে না।
  • ইসলামী জ্ঞান লোপ পাবে যেখানে কেউ কালেমা "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" পাঠ করবে না, কিন্তু তার পরিবর্তে বৃদ্ধ লোকেরা না বুঝে "আল্লাহ, আল্লাহ" বলে বিড়বিড় করবে।
  • দাব্বাতুল আরদ নামক পশু মানুষের সাথে কথা বলার জন্য ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসবে।
  • মানুষ রাস্তাঘাটে 'গাধাদের মত' ব্যভিচার করবে।
  • একটি বিশাল কালো ধোঁয়ার মেঘ পৃথিবীকে ঢেকে ফেলবে।[19]
  • পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উঠবে।[20][21]
  • ইস্রাফিল (আঃ) এর প্রথম শিঙ্গার ফুকে আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু ছাড়া সবকিছু ধ্বংস হবে ও চল্লিশ দিন নীরবতা থাকবে।
  • দ্বিতীয় ফুকে সকল মৃত মানুষ পুনরুত্থিত হবে এবং একটি অগ্নিকুন্ড তাদের বিচারের জন্য হাশরের মাঠে একত্রিত করবে।


    • == ছোট লক্ষণসমূহ ==

    কেয়ামতের ৭৭টি ছোট লক্ষণ:

    1. সময় খুব দ্রুত বয়ে যাবে। [বুখারী, মুসলিম, ও আহমাদ]
    2. ভাল কাজ হ্রাস পাবে। [বুখারী]
    3. মানুষ কৃপণ হয়ে যাবে। [বুখারী]
    4. খুন এবং হত্যা বেড়ে যাবে। [বুখারী, মুসলিম, ইবন মাজাহ, ও আহমাদ]
    5. ভুল ব্যক্তিকে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেওয়া হবে। [বুখারী]
    6. সততা হারিয়ে যাবে। [বুখারী]
    7. জ্ঞানের বিলোপ ও অজ্ঞতার বৃদ্ধি। [বুখারী, মুসলিম, ইবন মাজাহ, ও আহমাদ]
    8. ফোরাত নদীর তল থেকে একটি স্বর্ণের পাহাড় সিলগালা করে দেয়া হবে, কেউ তা থেকে কিছু নেবে না।
    9. ৩০ জন ভন্ড নবীর আগমণ। [বুখারী]
    10. একই ধর্মের দুটি বৃহত্তর ধর্মীয় দল একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটাবে। [বুখারী ও মুসলিম]
    11. ভুমিকম্প বৃদ্ধি পাবে। [বুখারী ও মুসলিম]
    12. সম্পদের প্রাচুর্য এতটাই বৃদ্ধি পাবে যে যাকাত নেয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। [বুখারী]
    13. যখন লোকেরা বড় বড় দালান তৈরি করতে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লেগে যাবে। [বুখারী]
    14. কোন এক লোক কবরের পাশে দিয়ে হেটে যাবে আর আশা করবে যদি সে নিজে সেখানে থাকতে পারতো। [বুখারী]
    15. মুসলিমদের দ্বারা কনস্টানটিনোপল বিজয়। [আহমাদ, মুসলিম]
    16. গাছ ও পাথর ইহুদির বিরুদ্ধে লড়তে মুসলিমদের সাহায্য করবে।
    17. মাদকদ্রব্য গ্রহণ ব্যাপক বিস্তার লাভ করবে। [বুখারী ও মুসলিম]
    18. ব্যভিচার ও অবৈধ যৌন সম্পর্ক সহজ হয়ে যাবে। [বুখারী, মুসলিম, ইবন মাজাহ]
    19. নারীদের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেড়ে যাবে, এমনকি একজন পুরুষের বিপরীতে হবে পঞ্চাশজন মহিলা হবে। [বুখারী, মুসলিম, ও আহমদ]
    20. মানুষ মসজিদের ক্ষমতার জন্য কঠোর সংগ্রাম করবে।
    21. ভাল মানুষেরা প্রতারিত হবে। [ইবন মাজাহ]
    22. যাকাত প্রদানকে সবাই বোঝা মনে করবে এবং কৃপণতা বেড়ে যাবে; দান করা হবে অনিচ্ছুকভাবে। [তিরমিযী, ইবন মাজাহ]
    23. নেতাগণ আল্লাহর বিধান অণুযায়ী শাসন করবেন না।
    24. শুধু ধনীরাই লাভের ভাগ পাবে, গরিবেরা পাবে না। [তিরমিযী]
    25. নিকৃষ্টতম লোকেরা জনগণের নেতা হবে।

    মাহাদি

    ইবন-আল-আরাবী অঙ্কিত হাশরের ময়দানের মানচিত্র

    ইমাম মাহদী (আরবী: مهدي‎,পথ প্রদর্শক) হচ্ছে কেয়ামতের পুর্বে আগমনকারী মুসলমানদেরকে নেতৃত্ব দানকরী শাসক,[১] যিনি পৃথিবীতে সাত অথবা নয় বছর শাসন করবেন। তার কথা হাদিসের (ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদের বাণী) বহু জায়গায় বলা হয়েছে। তিনি মদিনায় জন্মগ্রহণ করবেন এবং তাকে দেখতে ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদ-এর মত লাগবে। যখন তার আগমনের সময় হবে তখন পৃথিবীতে অনেক নামধারী ইমাম মাহদির ছড়াছড়ি থাকবে। তার আগমন কিয়ামতের অন্যতম বড় আলামত।[২][৩][৪]

    ঈসা (আঃ)

    দাজ্জাল

    দাজ্জালের পরিচয়

    নবী (স) দাজ্জালকে স্বপ্নে দেখে তার শারীরিক গঠনের বর্ণনা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন,

    দাজ্জাল হবে স্থুলকায় লাল বর্ণের, কোঁকড়ানো চুল, এক চোখ কানা, চোখটি যেন ফোলা আঙ্গুরের মত।

    সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১২৮)[22]
    দাজ্জাল নির্বংশ হবে। তার কোন সন্তান থাকবে না। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)[23]

    দাজ্জালকে চেনার সবচেয়ে বড় আলামত হল তার কপালে কাফির (كافر) লেখা থাকবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১৩১)[24] অপর বর্ণনায় আছে তার কপালে (ك ف ر) এই তিনটি বর্ণ লেখা থাকবে। প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তিই তা পড়তে পারবে। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)[25][26]

    দাজ্জালের বর্তমান অবস্থান

    ফাতেমা বিনতে কায়েস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

    আমি মসজিদে গমন করে নবী (স) এর সাথে নামায আদায় করলাম। আমি মহিলাদের কাতারে ছিলাম। তিনি নামায শেষে হাসতে হাসতে মিম্বারে উঠে বসলেন। প্রথমেই তিনি বললেন, ‘প্রত্যেকেই যেন আপন আপন জায়গায় বসে থাকে’। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তোমরা কি জান আমি কেন তোমাদেরকে একত্রিত করেছি?’ তাঁরা বললেন, ‘আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন’। অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে এ সংবাদ দেয়ার জন্য একত্রিত করেছি যে তামীমদারী ছিল একজন খ্রীস্টান লোক। সে আমার কাছে আগমন করে ইসলাম গ্রহণ করেছে। অতঃপর সে মিথ্যুক দাজ্জাল সম্পর্কে এমন ঘটনা বলেছে যা আমি তোমাদের কাছে বর্ণনা করতাম। লাখ্‌ম ও জুযাম গোত্রের ত্রিশ জন লোকের সাথে সে সাগর পথে ভ্রমণে গিয়েছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার শিকার হয়ে এক মাস পর্যন্ত তারা সাগরেই ছিল। অবশেষে তারা সাগরের মাঝখানে একটি দ্বীপে অবতরণ করলো। দ্বীপের ভিতরে প্রবেশ করে তারা মোটা মোটা এবং প্রচুর চুল বিশিষ্ট একটি অদ্ভুত প্রাণীর সন্ধান পেল। চুল দ্বারা সমস্ত শরীর আবৃত থাকার কারণে প্রাণীটির অগ্রপশ্চাৎ নির্ধারণ করতে সক্ষম হল না। তারা বলল, ‘অকল্যাণ হোক তোমার! কে তুমি?’ সে বলল, ‘আমি সংবাদ সংগ্রহকারী গোয়েন্দা’। তারা বলল, ‘কিসের সংবাদ সংগ্রহকারী?’ অতঃপর প্রাণীটি দ্বীপের মধ্যে একটি ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘হে লোক সকল! তোমরা এই ঘরের ভিতরে অবস্থানরত লোকটির কাছে যাও। সে তোমাদের কাছ থেকে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে’। তামিমদারী বলেন, ‘প্রাণীটি যখন একজন লোকের কথা বলল, তখন আমাদের ভয় হল যে হতে পারে সে একটি শয়তান। তথাপিও আমরা ভীত হয়ে দ্রুত অগ্রসর হয়ে ঘরটির ভিতরে প্রবেশ করলাম। সেখানে প্রবেশ করে আমরা বৃহদাকার একটি মানুষ দেখতে পেলাম। এত বড় আকৃতির মানুষ আমরা ইতিপূর্বে আর কখনও দেখিনি। তার হাত দু’টিকে ঘাড়ের সাথে একত্রিত করে হাঁটু এবং গোড়ালীর মধ্যবর্তী স্থানে লোহার শিকল দ্বারা বেঁধে রাখা হয়েছে’। আমরা বললাম, ‘মরণ হোক তোমার! কে তুমি?’ সে বলল, ‘তোমরা আমার কাছে আসতে সক্ষম হয়েছ। তাই আগে তোমাদের পরিচয় দাও’। আমরা বললাম, ‘আমরা একদল আরব মানুষ নৌকায় আরোহন করলাম। সাগরের প্রচণ্ড ঢেউ আমাদেরকে নিয়ে একমাস পর্যন্ত খেলা করল। অবশেষে তোমার দ্বীপে উঠতে বাধ্য হলাম। দ্বীপে প্রবেশ করেই প্রচুর পশম বিশিষ্ট এমন একটি জন্তুর সাক্ষাৎ পেলাম, প্রচুর পশমের কারণে যার অগ্রপশ্চাৎ চেনা যাচ্ছিলনা’। আমরা বললাম, ‘অকল্যাণ হোক তোমার! কে তুমি?’ সে বলল, ‘আমি সংবাদ সংগ্রহকারী গোয়েন্দা’। আমরা বললাম, ‘কিসের সংবাদ সংগ্রহকারী?’ অতঃপর প্রাণীটি দ্বীপের মধ্যে এই ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘হে লোক সকল! তোমরা এই ঘরের ভিতরে অবস্থানরত লোকটির কাছে যাও। সে তোমাদের নিকট থেকে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে’। তাই আমরা তার ভয়ে তোমার কাছে দ্রুত আগমন করলাম। হতে পার তুমি একজন শয়তান – এ ভয় থেকেও আমরা নিরাপদ নই’। সে বলল, ‘আমাকে তোমরা ‘বাইসান’ সম্পর্কে সংবাদ দাও’। আমরা তাকে বললাম, ‘বাইসানের কী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ?’ সে বলল, ‘আমি তথাকার খেজুরের বাগান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি। সেখানের গাছগুলো এখনও ফল দেয়?’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ’। সে বলল, ‘সে দিন বেশি দূরে নয় যে দিন গাছগুলোতে কোন ফল ধরবেনা’। অতঃপর সে বলল, ‘আমাকে বুহাইরাতুত্‌ তাবারীয়া সম্পর্কে সংবাদ দাও’। আমরা বললাম, ‘বুহাইরাতুত্‌ তাবারীয়ার কী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছ?’ সে বলল, ‘আমি জানতে চাই, সেখানে কি এখনও পানি আছে?’ আমরা বললাম, ‘তথায় প্রচুর পানি আছে’। সে বলল, ‘অচিরেই তথাকার পানি শেষ হয়ে যাবে’। সে পুনরায় বলল, ‘আমাকে যুগার নামক ঝর্ণা সম্পর্কে সংবাদ দাও’। আমরা তাকে বললাম, ‘সেখানকার কী সম্পর্কে তুমি জানতে চাও?’ সে বলল, ‘আমি জানতে চাই, সেখানে কি এখনও পানি আছে? লোকেরা কি এখনও সে পানি দিয়ে চাষাবাদ করছে?’ আমরা বললাম, ‘তথায় প্রচুর পানি রয়েছে। লোকেরা সে পানি দিয়ে চাষাবাদ করছে’। সে আবার বলল, ‘আমাকে উম্মীদের নবী সম্পর্কে জানাও’। আমরা বললাম, ‘সে মক্কায় আগমন করে বর্তমানে মদীনায় হিজরত করেছে’। সে বলল, ‘আরবরা কি তার সাথে যুদ্ধ করেছে?’ বললাম, ‘হ্যাঁ’। সে বলল, ‘ফলাফল কি হয়েছে?’ আমরা তাকে সংবাদ দিলাম যে, পার্শ্ববর্তী আরবদের উপর তিনি জয়লাভ করেছেন। ফলে তারা তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে’। সে বলল, ‘তাই নাকি?’ আমরা বললাম, ‘তাই’। সে বলল, ‘তার আনুগত্য করাই তাদের জন্য ভাল। এখন আমার কথা শুন। আমি হলাম দাজ্জাল। অচিরেই আমাকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। আমি বের হয়ে চল্লিশ দিনের ভিতরে পৃথিবীর সমস্ত দেশ ভ্রমণ করব। তবে মক্কা-মদীনায় প্রবেশ করা আমার জন্য নিষিদ্ধ থাকবে। যখনই আমি মক্কা বা মদীনায় প্রবেশ করতে চাইব, তখনই ফেরেশতাগণ কোষমুক্ত তলোয়ার হাতে নিয়ে আমাকে তাড়া করবে। মক্কা-মদীনার প্রতিটি প্রবেশ পথে ফেরেশতাগণ পাহাড়া দিবে’। হাদীসের বর্ণনাকারী ফাতেমা বিনতে কায়েস বলেন, ‘নবী (স) হাতের লাঠি দিয়ে মিম্বারে আঘাত করতে করতে বললেন, ‘এটাই মদীনা, এটাই মদীনা, এটাই মদীনা’। অর্থাৎ এখানে দাজ্জাল আসতে পারবে না। অতঃপর নবী (স) মানুষকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তামীমদারীর হাদীসটি আমার কাছে খুবই ভাল লেগেছে। তার বর্ণনা আমার বর্ণনার অনুরূপ হয়েছে। বিশেষ করে মক্কা ও মদীনা সম্পর্কে। শুনে রাখ! সে আছে সাম দেশের সাগরে (ভূমধ্য সাগরে) অথবা আরব সাগরে। তা নয় সে আছে পূর্ব দিকে। সে আছে পূর্ব দিকে। সে আছে পূর্ব দিকে’। এই বলে তিনি পূর্ব দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন’। ফাতেমা বিনতে কায়েস বলেন, ‘আমি এই হাদীসটি নবী (স) এর নিকট থেকে মুখস্থ করে রেখেছি’। (সহীহ মুসলিম – কিতাবুল ফিতান)[27]

    দাজ্জালের ক্ষমতা

    • এক স্থান হতে অন্য স্থানে দ্রুত পরিভ্রমণ

    নাওয়াস বিন সামআন থেকে বর্ণিত। নবী (স) কে দাজ্জালের চলার গতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,

    “মেঘের গতি যাকে প্রবল বাতাস পেছন থেকে হাঁকিয়ে নিয়ে যায়, দাজ্জালের চলার গতিও সে রকম হবে”। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)[28]

    • দাজ্জালের সাথে থাকবে জান্নাত-জাহান্নাম

    নবী (স) বলেন,

    “দাজ্জালের সাথে যা থাকবে তা আমি অবগত আছি। তার সাথে দু’টি নদী প্রবাহিত থাকবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে একটিতে সুন্দর পরিষ্কার পানি দেখা যাবে। অন্যটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা যাবে। যার সাথে দাজ্জালের সাক্ষাৎ হবে সে যেন দাজ্জালের আগুনে ঝাপ দিয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে পান করে। কারণ উহা সুমিষ্ট পানি। তার চোখের উপরে মোটা আবরণ থাকবে। কপালে কাফের লেখা থাকবে। মূর্খ ও শিক্ষিত সকল ঈমানদার লোকই তা পড়তে সক্ষম হবে”। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)[29][30]

    • জড় পদার্থ দাজ্জালের ডাকে সাড়া দেবে

    নবী (স) বলেন

    “দাজ্জাল এক জনসমাজে গিয়ে মানুষকে তার প্রতি ঈমান আনয়নের আহবান জানাবে। এতে তারা ঈমান আনবে। দাজ্জাল তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করার জন্য আকাশকে আদেশ দিবে। আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে, যমিন ফসল উৎপন্ন করবে এবং তাদের পশুপাল ও চতুষ্পদ জন্তুগুলো অধিক মোটা-তাজা হবে এবং পূর্বের তুলনায় বেশি দুধ প্রদান করবে। অতঃপর অন্য একটি জনসমাজে গিয়ে মানুষকে তার প্রতি ঈমান আনয়নের আহবান জানাবে। লোকেরা তার কথা প্রত্যাখান করবে। দাজ্জাল তাদের নিকট থেকে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসবে। এতে তারা চরম অভাবে পড়বে। তাদের ক্ষেত-খামারে চরম ফসলহানি দেখা দিবে। দাজ্জাল পরিত্যক্ত ভূমিকে তার নিচে লুকায়িত গুপ্তধন বের করতে বলবে। গুপ্তধনগুলো বের হয়ে মৌমাছির দলের ন্যায় তার পিছে পিছে চলতে থাকবে”। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)[28]

    • মু’মিন যুবককে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করা

    নবী (স) বলেন,

    “দাজ্জাল বের হলে একজন (বিশিষ্ট) ঈমানদার ব্যক্তি তার দিকে রওয়ানা হয়ে যাবে। খবর পেয়ে দাজ্জালের পক্ষ থেকে তার অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা গিয়ে তাঁর সাথে মিলিত হবে। তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি কোথায় যাওয়ার সংকল্প করেছে?’ তিনি বলবেন, ‘ঐ ব্যক্তির কাছে যে আবির্ভূত হয়েছে’। তখন তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি কি আমাদের প্রভুর প্রতি ঈমান আনবে না?’ তিনি বলবেন, ‘আমাদের প্রভু সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই’। এরপর তারা পরস্পর বলবে, ‘একে হত্যা কর’। তারপর একে অপরকে বলবে, ‘তোমাদের প্রভু যে নিষেধ করেছেন যে, তোমরা তাকে না দেখিয়ে কাউকে হত্যা করবে না?’ রাবী বলেন, ‘অতঃপর তারা তাঁকে দাজ্জালের নিকট নিয়ে যাবে। যখন মুমিন ব্যক্তি দাজ্জালকে দেখতে পাবেন, বলবেন, ‘হে জনগণ! এ তো সেই দাজ্জাল যার কথা রাসূলুল্লাহ (স) আলোচনা করেছেন’। এরপর দাজ্জালের আদেশে তাঁর চেহারাকে ক্ষত-বিক্ষত করা হবে। বলা হবে, একে ধরে চেহারা ক্ষত-বিক্ষত করে দাও। এরপর তাঁর পেট ও পিঠকে পিটিয়ে বিছিয়ে ফেলা হবে। তারপর দাজ্জাল জিজ্ঞেস করবে, ‘আমার প্রতি ঈমান আনবে না?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি তো মিথ্যাবাদী মসীহ দাজ্জাল’। এ কথা শুনে তাঁকে কুড়াল দিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলার জন্য আদেশে করা হবে। তার আদেশে তাঁকে প্রথমে দু’পা আলগা করে খণ্ড করা হবে। অতঃপর দাজ্জাল খণ্ডিত টুকরাদ্বয়ের মাঝখানে এসে তাঁকে লক্ষ্য করে বলবে, ‘উঠ!’ তৎক্ষণাৎ তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াবেন। তারপর আবার দাজ্জাল তাঁকে জিজ্ঞেস করবে, ‘এবার আমার প্রতি ঈমান আনবে কি?’ তখন তিনি বলবেন, ‘আমি তো তোমার সম্পর্কে আরও অধিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছি’। অতঃপর তিনি উপস্থিত জনতাকে লক্ষ্য করে বলবেন, ‘হে লোক সকল! মনে রেখ, দাজ্জাল আমার পরে আর কোন মানুষের উপর কর্তৃত্ব চালাতে পারবে না’। রাবী বলেন, ‘এরপর দাজ্জাল তাঁকে জবাই করার জন্য ধরবে এবং তাঁর গলা ও ঘাড়ে তামা জড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবে। কিন্তু এ পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হবে না। অতঃপর তাঁর হাত পা ধরে তাকে নিক্ষেপ করবে। মানুষ ধারণা করবে বুঝি আগুনে ফেলে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তাঁকে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছে’। রাসূল (স) বলেন, “রাব্বুল আলামীনের নিকট এ ব্যক্তি সবচেয়ে বড় শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবেন”। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)[31]

    দাজ্জালের বের হবার স্থান

    নবী (স) বলেন,

    পূর্বের কোন একটি দেশ থেকে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে যার বর্তমান নাম খোরাসান।

    (তিরমিজী- কিতাবুল ফিতান)[32]

    হাদীসটি হাসান।

    দাজ্জালের পৃথিবীতে অবস্থান

    সাহাবীগণ রাসূল (স) কে জিজ্ঞেস করেছেন দাজ্জাল পৃথিবীতে কত দিন অবস্থান করবে। উত্তরে তিনি বলেছেন, “সে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। প্রথম দিনটি হবে এক বছরের মত লম্বা। দ্বিতীয় দিনটি হবে এক মাসের মত। তৃতীয় দিনটি হবে এক সপ্তাহের মত। আর বাকী দিনগুলো দুনিয়ার স্বাভাবিক দিনের মতই হবে”। আমরা বললাম, “যে দিনটি এক বছরের মত দীর্ঘ হবে সে দিন কি এক দিনের নামাযই যথেষ্ট হবে?” উত্তরে তিনি বললেন, “না, বরং তোমরা অনুমান করে সময় নির্ধারণ করে নামায পড়বে”। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)[28]

    দাজ্জাল মক্কা-মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না

    সহীহ হাদীসের বিবরণ অনুযায়ী, দাজ্জালের জন্যে মক্কা ও মদীনাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। মক্কা ও মদীনা ব্যতীত পৃথিবীর সকল স্থানেই সে প্রবেশ করবে। [বিস্তারিত দেখুন দাজ্জালের বর্তমান অবস্থান শীর্ষক অনুচ্ছেদটিতে] অন্য একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবী (স) বলেন, “দাজ্জাল আসবে। অবশেষে মদীনার এক পার্শ্বে অবতরণ করবে। (এ সময় মদীনা) তিনবার কেঁপে উঠবে। তখন সকল কাফির ও মুনাফিক বের হয়ে তার নিকট চলে আসবে”। (সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১২৪)[33]

    দাজ্জালের অনুসারীগণ

    নবী (স) বলেন, “ইস্পাহানের সত্তর হাজার ইহুদী দাজ্জালের অনুসরণ করবে। তাদের সবার পরনে থাকবে সেলাই বিহীন চাদর”। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)[34]

    দাজ্জালের শেষ পরিণতি

    সহীহ হাদীসের বিবরণ অনুযায়ী, ঈসা ইবনে মারইয়াম (আ) এর হাতে দাজ্জাল নিহত হবে। বিস্তারিত বিবরণ এই যে, মক্কা-মদীনা ব্যতীত পৃথিবীর সকল দেশেই সে প্রবেশ করে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। সামান্য সংখ্যক মুমিনই তার এই বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে। ঠিক সে সময় দামেস্ক শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এক মসজিদের সাদা মিনারের উপর ঈসা (আ) আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। মুসলমানগণ তার পার্শ্বে একত্রিত হবে। তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি দাজ্জালের দিকে রওনা দিবেন। দাজ্জাল সে সময় বায়তুল মাকদিসের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। অতঃপর ঈসা (আ) ফিলিস্তিনের লুদ্দ শহরের দ্বারপ্রান্তে দাজ্জালকে পাকড়াও করবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ফিতান)[28]

    দাজ্জাল সম্পর্কিত অন্যান্য হাদীস

    নাওয়াস বিন সামআন (রা) বলেন, “একদা রাসূল (স) সকাল বেলা আমাদের কাছে দাজ্জালের বর্ণনা করলেন। তিনি তার ফিতনাকে খুব বড় করে তুলে ধরলেন। বর্ণনা শুনে আমরা মনে করলাম নিকটস্থ খেজুরের বাগানের পাশেই সে হয়ত অবস্থান করছে। আমরা রাসূল (স) এর নিকট থেকে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা আবার তাঁর কাছে গেলাম। এবার তিনি আমাদের অবস্থা বুঝে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কি হল?” আমরা বললাম, “হে আল্লাহ্‌র রসূল! আপনি যেভাবে দাজ্জালের আলোচনা করেছেন তা শুনে আমরা ভাবলাম হতে পারে সে খেজুরের বাগানের ভিতরেই রয়েছে”। নবী (স) বললেন, “দাজ্জাল ছাড়া তোমাদের উপর আমার আরো ভয় রয়েছে। আমি তোমাদের মাঝে জীবিত থাকতেই যদি দাজ্জাল আগমন করে তাহলে তোমাদেরকে ছাড়া আমি একাই তার বিরুদ্ধে ঝগড়া করব। আর আমি চলে যাওয়ার পর যদি সে আগমন করে তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজেকে হেফাযত করবে। আর আমি চলে গেলে আল্লাহই প্রতিটি মুসলিমকে হেফাযতকারী হিসেবে যথেষ্ট”। (তিরমিজী- কিতাবুল ফিতান)[35] হাদীসটি সহীহ।

    আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন, “নবী (স) লোক সমাবেশে দাঁড়ালেন এবং মহান আল্লাহ্‌র প্রশংসা করলেন। এরপর তিনি দাজ্জাল প্রসঙ্গে বললেন, “তার সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি। এমন কোন নবী নেই যিনি তাঁর কওমকে এ বিষয়ে সতর্ক করেননি। তবে তার সম্পর্কে আমি তোমাদের এমন একটি কথা বলব যা কোন নবীই তাঁরা জাতিকে বলেননি। তা হল যে, সে কানা হবে আর আল্লাহ্‌ অবশ্যই কানা নন”। (সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১২৭)[36]

    আয়িশাহ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, “আমি রসূলুল্লাহ (স) কে নামাযের ভিতরে দাজ্জালের ফিত্‌না থেকে আশ্রয় চাইতে শুনেছি”। (সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১২৯)[37] তিনি নামাযের শেষ তাশাহুদে বলতেন, “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব, জাহান্নামের আযাব, জীবন-মরণের ফিতনা এবং মিথ্যুক দাজ্জালের ফিতনা থেকে আশ্রয় চাই”। (সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ১৩৭৭)[38]

    ইয়াজুজ মাজুজ

    ইয়াজুজ মাজুজের পরিচয়

    সহীহ হাদীস থেকে জানা যায়, তারা আদম (আ) এর বংশধর। প্রমাণ স্বরূপ সহীহ বুখারীর হাদীসটি উল্লেখযোগ্য। নবী (স) বলেন,

    “রোজ হাশরে আল্লাহ্‌ তা’আলা আদমকে বলবেন, ‘হে আদম’! আদম বলবেন, ‘আমি আপনার দরবারে উপস্থিত আছি। সমস্ত কল্যাণ আপনার হাতে’। আল্লাহ্‌ বলবেন, ‘জাহান্নামের বাহিনীকে আলাদা কর’। আদম বলবেন, ‘কারা জাহান্নামের অধিবাসী’? আল্লাহ্‌ বলবেন, ‘প্রতি হাজারের মধ্যে নয়শত নিরানব্বই জন’। ‘এ সময় শিশু সন্তান বৃদ্ধ হয়ে যাবে, গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভের সন্তান পড়ে যাবে এবং মানুষদেরকে আপনি মাতাল অবস্থায় দেখতে পাবেন। অথচ তারা মাতাল নয়। আল্লাহ্‌র শাস্তির ভয়াবহতা অবলোকন করার কারণেই তাদেরকে মাতালের মত দেখা যাবে’। (সূরা হাজ্জঃ ২)

    সাহাবীগণ বললেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমাদের মধ্যে সেই একজন কে”? তিনি বললেন,

    “তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা তোমাদের মধ্য হতে একজন আর এক হাজারের অবশিষ্ট ইয়াজুজ মাজুজ হবে”। অতঃপর তিনি বললেন, “যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম। আমি আশা করি, তোমরা জান্নাতীদের চারভাগের এক ভাগ হবে”। [আবূ সা’ঈদ (রা) বলেন] আমরা এটা শুনে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীর পাঠ করলাম। তারপর নবী (স) বললেন, “আমি আশা করি, তোমরা সমস্ত জান্নাতবাসীর এক তৃতীয়াংশ হবে”। আমরা এ সংবাদ শুনে আবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীর দিলাম। তিনি আবার বললেন, “আমি আশা করি তোমরা সমস্ত জান্নাতীদের অর্ধেক হবে”। এ কথা শুনে আমরা আবারও ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীর দিলাম। তিনি বললেন, “তোমরা তো অন্যান্য মানুষের তুলনায় এমন, যেমন সাদা ষাঁড়ের দেহে কয়েকটি কাল পশম অথবা কালো ষাঁড়ের শরীরে কয়েকটি সাদা পশম”। (সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৩৩৪৮)[39]

    ইয়াজুজ মাজুজের আগমন

    কুরআন ও সহীহ হাদীসের বর্ণনা থেকে যা জানা যায়, তাহলো কিয়ামতের পূর্বমুহূর্তে তারা মানব সমাজে চলে এসে ব্যাপক অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। রাসূল (স) বলেন,

    “ইয়াজুজ মাজুজ প্রাচীরের ভিতর থেকে বের হওয়ার জন্য প্রতিদিন খনন কাজে লিপ্ত রয়েছে। খনন করতে করতে যখন তারা বের হওয়ার কাছাঁকাছি এসে যায় এবং সূর্যের আলো দেখতে পায় তখন তাদের নেতা বলেঃ ফিরে চলে যাও, আগামীকাল এসে খনন কাজ শেষ করে সকাল সকাল বের হয়ে যাব। আল্লাহ্‌ তা’আলা রাত্রিতে প্রাচীরকে আগের চেয়ে আরো শক্তভাবে বন্ধ করে দেন। প্রতিদিন এভাবেই তাদের কাজ চলতে থাকে। অতঃপর আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্ধারিত মেয়াদ যখন শেষ হবে এবং তিনি তাদেরকে বের করতে চাইবেন তখন তারা খনন করবে এবং খনন করতে করতে যখন সূর্যের আলো দেখতে পাবে তখন তাদের নেতা বলবেঃ ফিরে চলে যাও। ইনশা-আল্লাহ্‌ (যদি আল্লাহ্‌ চান) আগামীকাল এসে খনন কাজ শেষ করে সকাল সকাল বের হয়ে যাব। এবার তারা ইনশা-আল্লাহ্‌ বলবে। অথচ এর আগে কখনও তা বলেনি। তাই পরের দিন এসে দেখবে যেভাবে রেখে গিয়েছিল সেভাবেই রয়ে গেছে। অতি সহজেই তা খনন করে মানব সমাজে বের হয়ে আসবে। তারা পৃথিবীর নদী-নালার সমস্ত পানি পান করে ফেলবে। এমনকি তাদের প্রথম দল কোন একটি নদীর পাশে গিয়ে নদীর সমস্ত পানি পান করে শুকিয়ে ফেলবে। পরবর্তী দলটি সেখানে এসে কোন পানি দেখতে না পেয়ে বলবেঃ এখানে তো এক সময় পানি ছিল। তাদের ভয়ে লোকেরা নিজ নিজ সহায়-সম্পদ নিয়ে অবরুদ্ধ শহর অথবা দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করবে। ইয়াজুজ মাজুজের দল যখন পৃথিবীতে কোন মানুষ দেখতে পাবেনা তখন তাদের একজন বলবে যমিনের সকল অধিবাসীকে খতম করেছি। আকাশের অধিবাসীরা বাকী রয়েছে। এই বলে তারা আকাশের দিকে তীর নিক্ষেপ করবে। রক্ত মিশ্রিত হয়ে তীর ফেরত আসবে। তখন তারা বলবে যমিনের অধিবাসীকে পরাজিত করেছি এবং আকাশের অধিবাসী পর্যন্ত পৌঁছে গেছি। অতঃপর আল্লাহ্‌ তাদের ঘাড়ে ‘নাগাফ’ নামক এক শ্রেণীর পোঁকা প্রেরণ করবেন। এতে এক সময়ে একটি প্রাণী মৃত্যু বরণ করার মতই তারা সকলেই হালাক হয়ে যাবে”। নবী (স) বলেন, “আল্লাহ্‌র শপথ! তাদের মরা দেহ এবং চর্বি ভক্ষণ করে যমিনের জীব-জন্তু ও কীটপতঙ্গ মোটা হয়ে যাবে এবং আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করবে”। (ইবনে মাজাহ্‌, হাদীস সংখ্যা- ৪০৮০)[40]

    তবে নির্দিষ্টভাবে তাদের আগমন হবে ঈসা (আ) এর আগমন এবং দাজ্জালকে পরাজিত করার পর। নবী (স) বলেন,

    “অতঃপর ঈসা (আ) এর নিকট এমন কিছু লোক আসবেন, যাদেরকে আল্লাহ্‌ তা’আলা দাজ্জালের ফিতনা হতে হেফাযত করেছেন। তিনি তাদের চেহারায় হাত বুলাবেন এবং জান্নাতের মধ্যে তাদের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে সংবাদ দিবেন। ঈসা (আ) যখন এ অবস্থায় থাকবেন তখন আল্লাহ্‌ তা’আলা তাকে জানাবেন যে, আমি এমন একটি জাতি বের করেছি, যাদের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা কারো নেই। কাজেই আপনি আমার বান্দাদেরকে নিয়ে তুর পাহাড়ে উঠে যান। এ সময় আল্লাহ্‌ তা’আলা ইয়াজুজ মাজুজের বাহিনী প্রেরণ করবেন। তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে বের হয়ে আসবে। তাদের প্রথম দলটি ফিলিস্তিনের তাবারীয়া জলাশয়ের সমস্ত পানি পান করে ফেলবে। তাদের শেষ দলটি সেখানে এসে কোন পানি না পেয়ে বলবেঃ এক সময় এখানে পানি ছিল। তারা আল্লাহ্‌র নবী ও তার সাথীদেরকে অবরোধ করে রাখবে। ঈসা (আ) ও তাঁর সাথীগণ প্রচণ্ড খাদ্যাভাবে পড়বেন। এমনকি বর্তমানে তোমাদের কাছে একশত স্বর্ণ মুদ্রার চেয়ে তাদের কাছে একটি গরুর মাথা তখন বেশি প্রিয় হবে। আল্লাহ্‌র নবী ঈসা (আ) ও তাঁর সাথীগণ এই ফিতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দু’আ করবেন। আল্লাহ্‌ তাদের দু’আ কবুল করে ইয়াজুজ মাজুজের ঘাড়ে ‘নাগাফ’ নামক একশ্রেণীর পোঁকা প্রেরণ করবেন। এতে এক সময়ে একটি প্রাণী মৃত্যু বরণ করার মতই তারা সকলেই হালাক হয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ্‌র নবী ঈসা ও তার সাহাবীগণ যমিনে নেমে এসে দেখবেন ইয়াজুজ মাজুজের মরা-পচা লাশ ও তাদের শরীরের চর্বিতে সমগ্র যমিন ভরপুর হয়ে গেছে। কোথাও অর্ধহাত জায়গাও খালি নেই। আল্লাহ্‌র নবী ঈসা (আ) তাঁর সাথীগণ আল্লাহ্‌র কাছে আবার দু’আ করবেন। আল্লাহ্‌ তাদের দু’আ কবুল করে উটের গর্দানের মত লম্বা লম্বা একদল পাখি পাঠাবেন। আল্লাহ্‌র আদেশে পাখিগুলো তাদেরকে অন্যত্র নিক্ষেপ করে পৃথিবীকে পরিষ্কার করবে। অতঃপর আল্লাহ্‌ তা’আলা প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। এতে পৃথিবী একেবারে আয়নার মত পরিষ্কার হয়ে যাবে”। (সহীহ মুসলিম)[41]

    [বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ মূল হাদীসের যে অংশে ইয়াজুজ মাজুজ প্রসঙ্গ এসেছে শুধুমাত্র ততটুকুই উল্লেখিত হয়েছে।]

    কুরআন ও সহীহ হাদীসে ইয়াজুজ মাজুজ

    কুরআন মাজীদের সূরাহ আল-কাহ্‌ফে ইয়াজুজ মাজুজের বিবরণ এসেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

    কিয়ামতের পূর্বে পাহাড় ভেদ করে ইয়াজুজ মাজুজের আগমন সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তা’আলা অন্যত্র বলেন,

    যায়নাব বিনতে জাহাশ (রা) হতে বর্ণিত।

    একবার নবী (স) ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় তাঁর নিকট আসলেন এবং বলতে লাগলেন, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌। আরবের লোকদের জন্য সেই অনিষ্টের কারণে ধ্বংস অনিবার্য যা নিকটবর্তী হয়েছে। আজ ইয়াজুজ মাজুজের প্রাচীর এ পরিমাণ খুলে গেছে”। এ কথা বলার সময় তিনি তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলির অগ্রভাগকে তার সঙ্গের শাহাদাত আঙ্গুলের অগ্রভাগের সঙ্গে মিলিয়ে গোলাকার করে ছিদ্রের পরিমাণ দেখান। যায়নাব বিনতে জাহাশ (রা) বলেন, তখন আমি বললাম, “হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমাদের মধ্যে পুণ্যবান লোকজন থাকা সত্ত্বেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাব?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, যখন পাপকাজ অতি মাত্রায় বেড়ে যাবে”। (সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৩৩৪৬)[42]

    প্রধান ঘটনা সমূহ

    সহীহ হাদীস বলছে দাজ্জাল একজন মানুষ হবে, যে কিনা ঘন কোঁকড়ানো চুলওয়ালা এবং এক চোখের মনি উল্টানো এবং অন্য চোখ কানা বিশিষ্ট কুতসিৎ চেহারার। যাকে ঈসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে মেরে ফেলবেন।আশাকরি সহীহ হাদিস ছাড়া অন্য কোন গল্পের বই পড়ে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না, কারণ এতে করে ইসলামের ভাব মূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।

    ইয়াজূজ-মাজূজ সম্পর্কে ইসরাঈলী রিওয়ায়াতে ও ঐতিহাসিক কিসসা-কাহিনীতে অনেক ভিত্তিহীন কথাবার্তা প্রচলিত রয়েছে। কোন কোন তাফসীর বিদও এগুলো ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন, কিন্তু স্বয়ং তাঁদের কাছেও এগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। কুরআন তাদের সংক্ষিপ্ত অবস্থা বর্ণনা করেছে এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সম্পর্কে উম্মাতকে অবহিত করেছেন। ঈমান ও বিশ্বাস স্থাপনের বিষয় ততটুকুই, যতটুকু কুরআনও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তাফসীর, হাদীস ও ইতিহাসবিদগণ এর অতিরিক্ত যেসব ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অবস্থা বর্ণনা করেছেন, সেগুলি বিশুদ্ধও হতে পারে এবং অশুদ্ধও হতে পারে। ঐতিহাসিকগণের বিভিন্নমুখী উক্তিগুলো নিছক ইঙ্গিত ও অণুমানের উপর নির্ভরশীল। এগুলো শুদ্ধ কিংবা অশুদ্ধ হলেও তার কোন প্রভাব কুরআনের বক্তব্যের উপর পড়ে না।

    সহীহ হাদিস দুটি নিন্মে পেশ করা হলোঃ

    রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর এক ভাষণের কম বেশি অংশ দাজ্জালের ঘটনার বর্ণনায় এবং সে দাজ্জাল হতে ভয় প্রদর্শনেই কাটিয়ে দেন। সে ভাষণে তিনি একথাও বলেনঃ দুনিয়ার প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত এর অপেক্ষা বড় হাঙ্গামা আর নেই। সমস্ত নবী (আঃ) নিজ নিজ উম্মাতকে সতর্ক করে গেছেন। আমি সর্বশেষ নবী এবং তোমরা সর্বশেষ উম্মাত। সে নিশ্চিতরূপে তোমাদের মধ্যেই আসবে। যদি আমার জীবদ্দশায় সে এসে পড়ে তবে তো আমি তাকে বাধা দান করব। আর যদি আমার পরে আসে তবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার আক্রমণ হতে নিজেকে বাঁচাতে হবে। আমি আল্লাহ তা'আলাকেই প্রত্যেক মুসলমানের অভিভাবক করে যাচ্ছি। সে সিরিয়া ও ইরাকের মথ্যবর্তী স্থানে বের হবে। সে ডানে ও বামে খুব ঘুরা ফেরা করবে। হে জনমন্ডলী ওহে আল্লাহর বান্দাগণ! দেখ, তোমরা অটল থাকবে। জেনে রেখো, আমি তোমাদেরকে তার এমন পরিচয় জানিয়ে দিচ্ছি যা অন্য কোন নবী স্বীয় উম্মাতকে জানিয়ে যাননি। সে প্রথমত দাবী করবে- "আমি নবী।" সুতারাং তোমরা স্মরণ রেখো আমার পরে আর কোন নবী নেই। অতঃপর এচেয়ে বেড়ে গিয়ে বলবেঃ "আমি আল্লাহ।" অতএব তোমরা জেনে রেখো, আল্লাহকে এই চোখে কেউ দেখতে পারে না। মৃত্যুর পর তখায় তাঁর দর্শন লাভ ঘটতে পারে। আরও স্মরণ রেখো যে, সে এক চক্ষুবিশিষ্ট হবে এবং তোমাদের প্রভু এক চক্ষুবিশিষ্ট নন। তার চক্ষুর মধ্যবর্তী স্থানে "কাফির" লিখিত থাকবে যা প্রত্যেক শিক্ষিত অশিক্ষিত মোটকথা প্রত্যেক ঈমানদারই পড়তে পারবে। তার সাথে আগুন থাকবে ও বাগান থাকবে। তার আগুন হবে আসলে জান্নাত এবং বাগানটি হবে প্রকৃত পক্ষে জাহান্নাম। তোমাদের মধ্যে যাকে সে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে সে যেন আল্লাহ তা'আলার নিকট সাহায্য প্রার্থণা করে এবং সূরা কাহাফের প্রাথমিক আয়াতগুলো পাঠ করে। যেমন ইবরাহীম (আঃ)- এর উপর নমরূদের আগুন শান্তিদায়ক হয়েছিল। তার এক হাঙ্গামা এও হবে যে, সে এক বেদুঈনকে বলবে - "আমি যদি তোমার মৃত পিতা-মসাতাকে জীবিত করতে পারি তবে কি তুমি আমাকে প্রভূ বলে স্বীকার করবে।" এমন সময় দু'জন শয়তান তার পিতা-মাতার আকারে প্রকাশিত হবে এবং তাকে বলবে- "বৎস! এটাই তোমার প্রভূ! সুতরাং তাকে মেনে নাও।"

    তার আর একটা ফিৎনা এও হবে যে, তাকে একটি লোকের উপর জয়যুক্ত করা হবে। সে তাকে করাত দ্বারা ফেড়ে দু'টুকরো করে দেবে। তারপর সে জনগণকে বলবেঃ আমার এ বান্দাকে তোমরা দেখ, এখন আমি তাকে জীবিত করব। কিন্তু সে পুনরায় এ কথাই বলবে যে, তার প্রভূ আমি ছাড়া অন্য কেউ। অতঃপর এ দুর্বৃত্ত তাকে উঠা-বসা করাবে এবং বলবেঃ "তোমার প্রভূ কে?" সে উত্তরে বলবেঃ "আমার প্রভূ আল্লাহ এবং তুমি তার শত্রু দাজ্জাল। আল্লাহর শপথ! এখন তো আমার পূর্বাপেক্ষাও বেশি বিশ্বাস হয়েছে। (ইবনু মাজাহ)

    দাজ্জালের আবির্ভাব ও ধ্বংস

    নাওয়াস ইবনু-সামআন (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন ভোর বেলা দাজ্জালের আলোচনা করলেন। আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি তার সম্পর্কে এমন কিছু কথা বললেন, যার দ্বারা মনে হচ্ছিল যে, সে নেহায়াতই তুচ্ছ ও নগণ্য (উদাহরণতঃ সে কানা হবে।) পক্ষান্তরে কিছু কথা এমন বললেন, যার দ্বারা মনে হচ্ছিল, তার ফিৎনা অত্যন্ত ভয়াবহ ও কঠোর হবে।(উদাহরণতঃ জান্নাত ও দোযখ তার সাথে থাকবে এবং অন্যান্য আরও অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ঘটবে।) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বর্ণনার ফলে (আমরা এমন ভীত হয়ে পড়লাম), যেন দাজ্জাল খেজুর গাছের ঝাড়ের মধ্যেই রয়েছে।(অর্থৎ, অদূরেই বিরাজমান রয়েছে।) বিকালে যখন আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দরবারে উপস্থিত হলাম, তখন তিনি আমাদের মনের অবস্থা আঁচ করে নিলেন এবং জিজ্ঞেসা করলেনঃ তোমরা কি বুঝেছ? আমরা আরয করলামঃ আপনি দাজ্জালের আলোচনা প্রসঙ্গে এমন কিছু কথা বলেছেন, যাতে বোঝাযায়, তার ব্যপারটি যেহেতু তুচ্ছ এবং আরও কিছু কথা বলেছেন, যাতে মনে হয় সে খুব শক্তিসম্পন্ন হবে এবং তার ফিৎনা হবে খুব গুরুতর। এখন আমাদের মনে হয়েছে যে, যেন সে আমাদের নিকটেই খেজুর গাছের ঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ তোমাদের সম্পর্কে আমি যেসব ফিৎনার আশঙ্কা করি, তন্মধ্যে দাজ্জালের তুলনায় অন্যান্য ফিৎনা অধিক ভয়ের যোগ্য। যদি আমার জীবদ্দশায় সে আবির্ভূত হয়, তবে আমি নিজে তার মুকাবিলা করব। পক্ষান্তরে সে যদি আমার পরে আসে, তবে প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামর্থ্য অণুযায়ী তাকে পরাভূত করার চেষ্টা করবে। আমার অণুপস্থিতিতে আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক মুসলমানের সাহায্যকারী। (তার লক্ষন এই যে) সে যুবক, ঘন কোঁকড়ানো চুলওয়ালা হবে। তার একটি চক্ষু উপরের দিকে উথিত হবে। (এবং অপর চক্ষু হবে কানা।) যদি আমি (কুৎসিত চেহারার) কোন ব্যক্তিকে তার সাথে তুলনা করি, তবে সে হচ্ছে আবদুল উযযা উবনু কুতনা। (জাহিলিয়াত যুগে কুৎসিত চেহারার 'বনু-খুযাআ' গোত্রের এ লোকটির তুলনা ছিল না।) যদি কোন মুসলমান দাজ্জালের সম্মুখীন হয়ে যায়, তবে সূরা কাহাফের প্রথম আয়াতগুলো পড়ে নেয়া উচিত। দাজ্জাল সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থা থেকে বের হয়ে চতুর্দিকে হাঙ্গামা সৃষ্টি করবে। হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা তার মুকাবিলায় সুদৃঢ় থাক। আমরা আরয করলামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ), সে কতদিন থাকবে। তিনি বললেনঃ সে চল্লিশ দিন থাকবে, কিন্তু প্রথম একদিন এক বছরের সমান হবে। দ্বিতীয় দিন এক মাসের এবং তৃতীয় দিন এক সপ্তাহের সমান হবে। অবশিষ্ট দিনগুলো সাধারণ দিনের মতই হবে। আমরা আরয করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ), যে দিনটি এক বছরের সমান হবে, আমরা কি তাতে শুধু এক দিনের (পাঁচ ওয়াক্ত) নামাযই পড়ব? তিনি বললেনঃ না; বরং সময়ের অণুমান করে এক বছরের নামায পড়তে হবে। আমরা আরয করলামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সে কেমন দ্রুত গতিতে সফর করবে? তিনি বললেনঃ সে মেঘ খন্ডের মত দ্রুত চলবে, যার পিছনে অণুকূল বাতাস থাকে। দাজ্জাল কোন সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে তাকে মিথ্যা ধর্মবিশ্বাসের প্রতি দাওয়াত দেবে। তারা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করলে সে মেঘমালাকে বর্ষণের আদেশ দেবে। ফলে, বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং মাটিকে আদেশ দেবে; ফলে শস্য-শ্যামলা হয়ে যাবে। তাদের চুষ্পদ জন্তু তাতে চরবে। সন্ধ্যায় যখন জন্তুগুলো ফিরে আসবে, তখন তাদের কুঁজ পূর্বের তুলনায় উঁচু হবে এবং স্তন দুধে পরিপূর্ণ থাকবে। এরপর দাজ্জাল অন্য সম্প্রদায়ের কাছে যাবে এবং তাদেরকেও কুফরের দাওয়াত দেবে। কিন্তু তারা তার দাওয়াত প্রত্যাখ্যা করবে। সে নিরাশ হয়ে ফিরে গেলে সেখানকার মুসলমানরা দুর্ভিক্ষে পতিত হবে।তাদের কাছে কোন অর্থ-কড়ি থাকবে না। সে শস্যবিহীন অণুর্বর ভূমিকে সম্বোধন করে বলবে। তোর গুপ্তধন বাইরে নিয়ে আয়। সেমতে ভূমির গুপ্তধন তার পেছনে পেছনে চলবে- যেমন মৌমাছিরা তাদের সরদারের পেছনে পেছনে চলে। অতঃপর দাজ্জাল একজন ভরপুর যুবক ব্যক্তিকে ডাকবে এবং তাকে তরবারির আঘাতে দিখন্ডিত করে দেবে। তার উভয় খন্ড এতটুকু দূরত্বে রাখা হবে; যেমন তীর নিক্ষেপকারী ও তার লক্ষবস্তুর মাঝখানে থাকে। অতঃপর সে তাকে ডাক দিবে। সে (জীবিত হয়ে) দাজ্জালের কাছে আনন্দ চিত্তে চলে আসবে।

    ইতি মধ্যে আল্লাহ তা'আলা ঈসা (আঃ) কে নামিয়ে দিবেন তিনি দু'টি রঙিন চাদর পরে দামিস্ক মাসজিদের পূর্ব দিককার সাদা মিনারে ফেরেশতাদের পাখার উপর পা রেখে অবতরণ করবেন। তিনি যখন ম্তক অবনত করবেন, তখন তা থেকে পানির ফোঁটা পড়বে। (মনে হবে যেন এখনই গোসল করে এসেছেন।) তিনি যখন মস্তক উঁচু করবেন, তখনও মোমবাতির মত স্বচ্ছ পানির ফোঁটা পড়বে। তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস তাঁর দৃষ্টির সমান দূরত্বে পৌঁছাবে। ঈসা (আঃ) দাজ্জালকে খুঁজতে খুঁজতে বাবুল্লুদ্দে গিয়ে তাকে ধরে ফেলবেন। (এই জনপদটি এখনও বাইতুল মুকাদ্দাসের অদূরে এ নামেই বিদ্যমান) সেখানে তাকে হত্যা করা হবে। এরপর তিনি জনসমক্ষে আসবেন, স্নেহভরে মানুষের চেহারায় হাত বুলাবেন এবং তাদেরকে জান্নাতের সুউচ্চ মর্যাদার সুসংবাদ শোনাবেন।

    এমতাবস্থায় আল্লাহ তা'আলা ঘোষণা করবেনঃ আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে এমন লোক বের করব, যাদের মুকাবিলা করার শক্তি কারও নেই। কাজেই আপনি মুসলমানদেরকে সমবেত করে তূর পর্বতে চলে যান। (সে মতে তিনি তাই করবেন।) অতঃপর আল্লাহ তা'আলা ইয়াজূজ-মাজূজের রাস্তা খুলে দেবেন। তাদের দ্রুত চলার কারণে মনে হবে যেন উপর থেকে পিছলে নীচে এসে পড়ছে। তাদের প্রথম দলটি তাবরিয়া উপসাগরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা পানি পান করে এমন অবস্থা করে দেবে যে, দ্বিতীয় দলটি এসে সেখানে কোন দিন পানি ছিল, একথা বিশ্বাস করতে পারবে না। ঈসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীরা তূর পর্বতে আশ্রয় নেবেন। অন্য মুসলমানরা নিজ নিজ দুর্গে ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবে। পানাহারের বস্তুসামগ্রী সাথে থাকবে, কিন্তু তাতে ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে একটি গরুর মাথাকে একশ' দীনারের চাইতে উত্তম মনে করা হবে। ঈসা (আঃ) ও অন্যান্য মুসলমানরা কষ্ট লাঘবের জন্য আল্লাহর কাছে দু'আ করবেন। (আল্লাহ দু'আ কবুল করবেন।) তিনি মহামারী আকারে রোগ-ব্যধি পাঠাবেন। ফলে, অল্প সময়ের মধ্যেই ইয়াজূজ-মাজূজের গোষ্ঠী সবাই মরে যাবে। অতঃপর ঈসা (আঃ) সঙ্গীদেরকে নিয়ে তূর পর্বত থেকে নীচে নেমে এসে দেখবেন পৃথিবীতে তাদের মৃতদেহ থেকে অর্ধ হাত পরিমিত স্থানও খালি নেই এবং মৃতদেহ পঁচে অসহ্য দুর্গণ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। (এ অবস্থা দেখে পুনরায়) ঈসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীরা আল্লাহর দরবারে দু'আ করবেন (যেন এই বিপদও দূর করে দেয়া হয়।) আল্লাহ তা'আলা এ দু'আও ক্ববুল করবেন এবং বিরাট আকৃতির পাখি প্রেরণ করবেন, যাদের ঘাড় উটের ঘাড়ের মত। তারা (মৃতদেহগুলো উঠিয়ে যেখানে আল্লাহ ইচ্ছা করবেন, সেখানে ফেলে দেবে।) কোন কোন রিওয়াতে রয়েছে মৃতদেহগুলো সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে। এরপর বৃষ্টি বষিত হবে। কোন নগর ও বন্র এ বৃষ্টি থেকে বাদ থাকবে না। ফলে সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠ ধৌত হয়ে কাচের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা ভূপৃষ্ঠকে আদেশ করবেনঃ তোমার পেটের সমূদয় ফল-ফুল উদগীরণ করে দাও এবং নতুনভাবে তোমার বারকাতসমূহ প্রকাশকর। ফলে তাই হবে এবং এমন বারকাত প্রকাশিত হবে যে, একটি ডালিম একদল লোকের আহারের জন্য যথেষ্ট হবে এবং মানুষ তার ছাল দ্বারা ছাতা তৈরী করে ছায়া লাভ করবে। দুধে এতো বারকাত হবে যে, একটি উষ্ট্রির দুধ একদল লোকের জন্য, একি গাভীর দুধ এক গোত্রের জন্য এবং একটি ছাগলের দুধ একটি পরিবারর জন্য যথেষ্ট হবে। চল্লিশ বছর যাবত এই অসাধারণ বারকাত ও শান্তি-শৃঙ্খলা অব্যাহত থাকার পর যখন কিয়ামাতের সময় সমাগত হবে; তখন) আল্লাহ তা'আলা একটি মনোরম বায়ু প্রবাহিত করবেন। এর পরশে সব মুসলমানের বগলের নিচে বিশেষ এক প্রকার রোগ দেখা দেবে এবং সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হবে; শুধু কাফির ও দোষ্ট লোকেরাই অবশিষ্ট থেকে যাবে। তারা ভূ-পৃষ্ঠে জন্তু-জানোয়ারের মত খোলাখুলি অপকর্ম করবে। তাদের উপরই কিয়ামাত আসবে। (মুসলিম)

    মদীনা পরিত্যাগ/মক্কা ধ্বংস/পৃথিবীতে পশু

    কিয়ামতে সৎ ও অসৎ ব্যক্তিদের পৃথকীকরণ

    মৃতদের পুনুরুত্থান

    খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে তুলনা

    সাহিত্যে ইসলামী পরকালবিদ্যা

    ইবনে আন নাফীস পরকালবিদ্যা সম্পর্কে তার Theologus Autodidactus গ্রন্থে (১২৭০ সালে ) বিজ্ঞান এবং ইসলামিক দর্শন থেকে ব্যাখ্যা করেন কিভাবে কিয়ামতে বিশ্বাস করতে হয়।[43]

    আরও দেখুন

    তথ্যসূত্র

    1. Gardet, L.। QiyamaEncyclopaedia of the Qurʾān
    2. কুরআন 74:38
    3. কুরআন 71:18
    4. কুরআন 31:34
    5. কুরআন 74:47
    6. কুরআন 2:8
    7. কুরআন 33:63
    8. কুরআন 6:57
    9. কুরআন 10:45
    10. কুরআন 28:88
    11. কুরআন 17:49
    12. Quran 11:17
    13. Hooper, Rev. Richard (২০ এপ্রিল ২০১১)। End of Days: Predictions of the End From Ancient Sources। Sedona, AZ। পৃষ্ঠা 156।
    14. Yahya, Harun (১ জানুয়ারি ২০০৮)। Clarity Amidst Confusion: Imam Mahdi and the End of Time। Global Publishing. Kindle Edition.। পৃষ্ঠা 64।
    15. Jon R. Stone। Expecting Armageddon: Essential Readings in Failed Prophecy
    16. "Hadith – Book of Tribulations – Sunan Ibn Majah – Sunnah.com – Sayings and Teachings of Prophet Muhammad (صلى الله عليه و سلم)"sunnah.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-০৩
    17. "Hadith – Book of Tribulations – Sunan Ibn Majah – Sunnah.com – Sayings and Teachings of Prophet Muhammad (صلى الله عليه و سلم)"sunnah.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৩-০৩
    18. সহীহ মুসলিম, ৪১:৬৯৫১ (ইংরেজি)
    19. কুরআন 44:10
    20. "ar:طلوع الشمس من مغربها" [Rising of the sun from the west] (Arabic ভাষায়)।
    21. Alwi Shihab। Examining Islam in the West। পৃষ্ঠা 16।
    22. সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১২৮
    23. দাজ্জালের পরিচয়
    24. সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১৩১
    25. দাজ্জালের কপালের চিহ্ন ১
    26. দাজ্জালের কপালের চিহ্ন ২
    27. দাজ্জালের বর্তমান অবস্থান
    28. দাজ্জালের বর্ণনা
    29. দাজ্জালের জান্নাত-জাহান্নাম
    30. সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা-৭১৩০
    31. মু’মিন যুবককে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করা
    32. দাজ্জালের বের হবার স্থান
    33. সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১২৪
    34. দাজ্জালের অনুসারীগণ
    35. দাজ্জালের হাদীস
    36. সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১২৭
    37. সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৭১২৯
    38. সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ১৩৭৭
    39. সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৩৩৪৮
    40. “ইবনে মাজাহ্‌, হাদীস সংখ্যা- ৪০৮০”
    41. “ইয়াজুজ মাজুজের আগমন”
    42. সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা- ৩৩৪৬
    43. Dr. Abu Shadi Al-Roubi (1982), "Ibn Al-Nafis as a philosopher", Symposium on Ibn al-Nafis, Second International Conference on Islamic Medicine: Islamic Medical Organization, Kuwait (cf. Ibn al-Nafis As a Philosopher, Encyclopedia of Islamic World)

    উৎস্য

    • "Fath al-bârî fî sharh sahîh al-bukhârî" (from Sahih al-Bukhari by Ibn Hajr al-Asqalani).
    • Esposito, John, The Oxford Dictionary of Islam, Oxford University Press, 2003, আইএসবিএন ০-১৯-৫১২৫৫৮-৪.
    • Richard C. Martin, Said Amir Arjomand, Marcia Hermansen, Abdulkader Tayob, Rochelle Davis, John Obert Voll, Encyclopedia of Islam and the Muslim World, MacMillan Reference Books, 2003, আইএসবিএন ৯৭৮-০০২৮৬৫৬০৩৮.

    বহিঃসংযোগ

    This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.