খালিদ বিন ওয়ালিদ

আবু সুলাইমান খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ ইবনে আল-মুগিরা আল-মাখজুমি (আরবি: أبو سليمان خالد بن الوليد بن المغيرة المخزومي; ৫৮৫–৬৪২) ছিলেন মুহাম্মাদ (সা.) এর একজন সাহাবি। তিনি তার উপাধি সাইফুল্লাহ আল-মাসলুল (আরবি: سيف الله المسلول) দ্বারাও পরিচিত। মুহাম্মাদ (সা.) এবং তার উত্তরসূরি খলিফা আবু বকরউমরের অধীনে সামরিক নেতৃত্বদান এবং নিজস্ব রণকৌশলের জন্য তিনি খ্যাত।[1] খিলাফতের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে থাকাবস্থায় খালিদ একশটিরও বেশি যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছেন। এসকল যুদ্ধ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, সাসানীয় সাম্রাজ্য, তাদের মিত্র এবং অন্যান্য আরব গোত্রসমূহের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে। তার কৌশলগত অর্জনের মধ্যে রয়েছে রিদ্দার যুদ্ধের সময় আরব উপদ্বীপকে ঐক্যবদ্ধকরণ এবং ৬৩২ থেকে ৬৩৬ সালের মধ্যে পার্সিয়ান মেসোপটেমিয়া এবং রোমান সিরিয়া বিজয়। ইয়ামামা, উলাইস, ফিরাজে তার ফলাফল নির্ধারণী বিজয় এবং ওয়ালাজাইয়ারমুকে তার কৌশলগত সাফল্যের জন্যও তাকে স্মরণ করা হয়।[2]

খালিদ বিন ওয়ালিদ
خالد بن الوليد
ডাকনামসাইফুল্লাহ (আল্লাহর তলোয়ার)
জন্ম৫৯২
মক্কা, আরব উপদ্বীপ
মৃত্যু৬৪২
হিমস, সিরিয়া
সমাধি অবস্থিতখালিদ বিন ওয়ালিদ মসজিদ
আনুগত্যরাশিদুন খিলাফত
সার্ভিস/শাখারাশিদুন সেনাবাহিনী
কার্যকাল৬৩২–৬৩৮
ইউনিটমোবাইল গার্ড
নেতৃত্বসমূহকমান্ডার-ইন-চিফ (৬৩২–৬৩৪)
ফিল্ড কমান্ডার (৬৩৪–৬৩৮)
মোবাইল গার্ডের কমান্ডার (৬৩৪–৬৩৮)
ইরাকের সামরিক গভর্নর (৬৩৩–৬৩৪)
চেলসিসের গভর্নর (৬৩৭–৬৩৮)

মক্কার কুরাইশ বংশের বনু মাখজুম গোত্রে খালিদ বিন ওয়ালিদের জন্ম হয়। উহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের বিরুদ্ধে মক্কার জয়ে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদিনায় হিজরত করেন। মুতার যুদ্ধসহ বেশ কিছু যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। রোমানদের বিপক্ষে এটি মুসলিমদের প্রথম লড়াই ছিল। এই যুদ্ধের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে খালিদের নয়টি তলোয়ার ভেঙে গিয়েছিল। যুদ্ধে সেনাপতি জায়িদ ইবনে হারেসা, জাফর ইবনে আবি তালিবআবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ক্রমান্বয়ে নিহত হওয়ার পর খালিদ সেনাপতি হিসেবে ভার নিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ (সা.) এর মৃত্যুর পর বিদ্রোহী ও ইসলামত্যাগী আরবদের বিরুদ্ধে রিদ্দার যুদ্ধে তিনি মুসলিমদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাসানীয় আরব মিত্ররাজ্য আল-হিরা তিনি জয় করেছিলেন। ইরাক (মেসোপটেমিয়া) জয়ের সময় তিনি সাসানীয় পার্সিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করেছেন। পরে রোমান সিরিয়া এবং বাইজেন্টাইনদের আরব মিত্ররাজ্য গাসানিদের জয় করার জন্য তাকে পশ্চিম রণাঙ্গনে পাঠানো হয়।

উমর খলিফা হওয়ার পর খালিদকে সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করেন। তবে এরপরও খালিদ আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে একজন কার্যকর নেতা হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।[1] তার নেতৃত্বে মুসলিমরা ৬৩৪ সালে দামেস্ক জয় করে। ৬৩৬ সালে ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করে।[1] এর ফলে বিলাদ আল-শাম (লেভান্ট) জয়ের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। ৬৩৮ সালে খালিদ তার সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান।

মূল যুদ্ধ, ক্ষুদ্র খণ্ডযুদ্ধ, একক দ্বন্দ্বযুদ্ধসহ একশটিরও বেশি যুদ্ধে খালিদ বিন ওয়ালিদ লড়াই করেছেন বলে জানা যায়। আজীবন তিনি অপরাজেয় যোদ্ধা ছিলেন। একারণে তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সেনাপতিদের অন্যতম বলা হয়।[3]

প্রারম্ভিক জীবন

খালিদ বিন ওয়ালিদ আনুমানিক ৫৯২ সালে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা ছিলেন কুরাইশ বংশের বনু মাখজুম গোত্রের শেখ। ওয়ালিদকে মক্কায় আল-ওয়াহিদএকক বলে ডাকা হত।[4] খালিদের মা লুবাবা আল সুগরা বিনতে আল হারিস ছিলেন মায়মুনা বিনতে আল-হারিসের চাচাত বোন।[5]

জন্মের পর কুরাইশদের ঐতিহ্য অনুযায়ী খালিদকে মরুভূমির বেদুইনদের কাছে পাঠানো হয়। এখানে মরুভূমির শুষ্ক, বিশুদ্ধ আলোবাতাসে পালক মায়ের কাছে তিনি লালিতপালিত হয়েছেন। পাঁচ বা ছয় বছর বয়সে তিনি মক্কায় নিজের বাবা মায়ের কাছে ফিরে আসেন। বাল্যকালে তিনি গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার জীবন রক্ষা পেলেও তার মুখে বসন্তের চিহ্ন রয়ে গিয়েছিল।[6]

এই সময় কুরাইশের শাখা বনু হাশিম, বনু আবদ আদ-দারবনু মাখজুম ছিল মক্কার নেতৃত্বস্থানীয় গোত্র। বনু মাখজুম যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ের জন্য দায়িত্ব বহন করত। তারা আরবের শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহীদের অন্যতম ছিল। খালিদ অশ্বারোহণ, বর্শা নিক্ষেপ, তীরধনুক ব্যবহার, তলোয়ার চালনা শিক্ষা করেছেন। বর্শা তার পছন্দের অস্ত্র ছিল বলা হয়। তরুণ বয়সে তিনি যোদ্ধা ও কুস্তিগির হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।[7] ব্যক্তিগত জীবনে খালিদ ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা উমরের মামাত ভাই।[8]

মুহাম্মাদ (সা.) এর যুগ (৬১০-৬৩২)

মুহাম্মাদ (সা.) এর ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্নে খালিদের কর্মকাণ্ড বেশি জানা যায় না। মুহাম্মাদ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর মদিনার মুসলিমদের সাথে মক্কার কুরাইশ জোটের কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।[9] বদরের যুদ্ধে খালিদ অংশ নেন নি। তার ভাই ওয়ালিদ বিন ওয়ালিদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং যুদ্ধে বন্দী হন। তাকে মুক্ত করার জন্য খালিদ ও তার বড় ভাই হাশাম বিন ওয়ালিদ মদিনায় মুক্তিপণ দিতে গিয়েছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পর মক্কায় ফেরার পথে ওয়ালিদ পুনরায় মদিনায় ফিরে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।[10] উহুদের যুদ্ধে মক্কার বিজয়ে খালিদের কৌশল প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।[11] ৬২৭ সালে তিনি খন্দকের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এটি মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার শেষ লড়াই ছিল।[12]

ইসলাম গ্রহণ

৬২৮ সালে হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে দশ বছরের শান্তি স্থাপিত হয়। এসময় খালিদ ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার বাল্যবন্ধু ইকরিমা ইবনে আবি জাহলের সাথে এই বিষয়ে আলাপ করেন। ইকরিমা খালিদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। সিদ্ধান্তের ফলে খালিদ আবু সুফিয়ানের রোষের সম্মুখীন হন। কিন্তু ইকরিমা তাকে নিরস্ত করেছিলেন। ইকরিমা আবু সুফিয়ানকে হুমকি দেন যে তার ক্রোধের কারণে ইকরিমা নিজেও ইসলাম গ্রহণের দিকে ধাবিত হতে পারেন এবং খালিদ তার নিজ ইচ্ছানুযায়ী ধর্ম গ্রহণের স্বাধীনতা রাখে।[13] ৬২৯ সালের মে মাসে খালিদ মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে আমর ইবনুল আসের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনিও ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে মদিনায় যাচ্ছিলেন। তারা একত্রে মদিনায় পৌঁছান এবং মুহাম্মাদ (সা.) এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন।

মুহাম্মাদ (সা.) এর যুগে সামরিক অভিযান

গাসানিদের বিরুদ্ধে অভিযানে মুহাম্মাদ (সা.) জায়িদ ইবনে হারেসাকে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার মৃত্যু হলে জাফর ইবনে আবি তালিব এবং তারও মৃত্যু হলে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা সেনাপতি হবেন এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারা সবাই নিহত হলে নিজেদের মধ্য থেকে যে কোনো একজনকে সেনাপতি নির্বাচন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। [14]

যুদ্ধে জায়েদ, জাফর ও আবদুল্লাহ তিনজনই নিহত হন। এরপর খালিদকে সেনাপতি নির্বাচন করা হয়। এসময় তার অধীনে মাত্র ৩,০০০ সৈনিক ছিল। অন্যদিকে বাইজেন্টাইন ও তাদের মিত্র গাসানি আরবদের ছিল ১০,০০০ সৈনিক। এই কঠিন পরিস্থিতিতে খালিদ মুসলিম সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কৌশল প্রয়োগ করে তিনি ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পরিস্থিতি থেকে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন।[15]

রাতের বেলা খালিদ সৈনিকদের কিছু দলকে মূল বাহিনীর পেছনে পাঠিয়ে দেন। পরের দিন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে একের পর এক মুসলিমদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর ফলে শত্রুদের মনে বাড়তি সৈনিক আসছে এমন ধারণা তৈরি হয় এবং মনোবল হ্রাস পায়। সেদিন খালিদ যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হন। রাতের বেলা সৈনিকরা প্রত্যাবর্তন করে। বাইজেন্টাইনরা একে ফাঁদ ভেবে আর সামনে অগ্রসর হয় নি।[16] এই যুদ্ধে খালিদের নয়টি তলোয়ার ভেঙে গিয়েছিল। এই যুদ্ধের কারণে তিনি আল্লাহর তলোয়ার উপাধিতে ভূষিত হন।[17][18]

পরবর্তী সামরিক অভিযান

হুদাইবিয়ার সন্ধি বাতিল হওয়ার পর ৬৩০ সালে মুসলিমরা মক্কা বিজয়ের জন্য অগ্রসর হন। এই অভিযানে খালিদ মুসলিম বাহিনীর চারটি ভাগের একটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এই চারটি বাহিনী চারটি ভিন্ন পথ দিয়ে মক্কা প্রবেশ করে। সেই বছরে তিনি হুনাইনের যুদ্ধতাইফ অবরোধে অংশ নেন।

তাবুক অভিযানে তিনি মুহাম্মাদ (সা.) এর অধীনে অংশ নিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাকে দাওমাতুল জান্দালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তিনি দাওমাতুল জান্দালের যুদ্ধে লড়াই করেন এবং সেখানকার আরব শাসককে বন্দী করেন।[19]

৬৩১ সালে তিনি বিদায় হজ্জে অংশ নিয়েছেন।

সেনাপতি হিসেবে সামরিক অভিযান

৬৩০ সালের জানুয়ারিতে (শাবান ৮ হিজরি)[20] খালিদকে দেবী আল-উজ্জার মূর্তি ধ্বংস করার জন্য প্রেরণ করা হয়। তিনি এই দায়িত্ব সম্পন্ন করেন।[21][22]

বনু জাজিমা গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য খালিদকে প্রেরণ করা হয়েছিল। তারা “আমরা সাবিয়ান হয়ে গিয়েছি” বলে ঘোষণা করে। এরপর খালিদ তাদেরকে বন্দী করেন এবং পূর্বের শত্রুতার কারণে কয়েকজনকে হত্যা করেন। এরপর আবদুর রহমান ইবনে আউফ তাকে বিরত করেন। গোত্রের কিছু সদস্য পূর্বে খালিদের চাচা ফাকিহ ইবনুল মুগিরা আল-মাখজুমি এবং আবদুর রহমান বিন আউফের বাবা আউফ ইবনে আবদ-আউফকে হত্যা করেছিল।[21][22][23][24][25] খালিদের আচরণ শুনে মুহাম্মাদ (সা.) রাগান্বিত হন। তিনি নিহতদের আত্মীয়দের ক্ষতিপূরণ দেন; সম্পদের ক্ষতির স্বীকার হওয়া ব্যক্তিদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এই ঘটনার কারণে তিনি বলেছিলেন: "হে আল্লাহ, খালিদ যা করেছে সে ব্যাপারে আমি নির্দোষ!"[26][27][28]

দুমাতুল জান্দালের দুর্গে অবসস্থানরত খ্রিষ্টান শাসক উকাইদিরকে আক্রমণের জন্য খালিদকে অভিযানে পাঠানো হয়। ৬৩১ সালের মার্চে (জিলকদ, ৯ হিজরি) এই অভিযান সংঘটিত হয়। এই অভিযানে খালিদ উকাইদিরকে বন্দী করেন। পরে মুহাম্মাদ (সা.) তাকে মুক্তি দেন। মুক্তিপণ হিসেবে উকাইদিরকে ২০০০ উট, ৮০০ ভেড়া, ৪০০ বর্ম ও ৪০০ বর্শা প্রদান করতে হয়েছিল। এছাড়াও জিজিয়া প্রদানের শর্ত আরোপ করা হয়।[29][30][31][32]

৬৩১ সালের এপ্রিলে পৌত্তলিক দেবতা ওয়াদের মূর্তি ধ্বংস করার জন্য খালিদকে দুমাতুল জান্দালের দ্বিতীয় অভিযানে প্রেরণ করা হয়। খালিদ মূর্তি ধ্বংস করেন।[29][30][31][33]

আবু বকরের যুগ (৬৩২–৬৩৪)

আরব উপদ্বীপ বিজয়

মানচিত্রে প্রদর্শিত খালিদ বিন ওয়ালিদের আরব উপদ্বীপ জয়ের পথের অভিমুখ।

মুহাম্মাদ (সা.) এর মৃত্যুর পর অনেক আরব গোত্র ইসলাম ত্যাগ করে এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে। খলিফা আবু বকর এসকল ইসলামত্যাগী ও বিদ্রোহীদের দমনের জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।[34] খালিদ এসময় আবু বকরের উপদেষ্টা ছিলেন। রিদ্দার যুদ্ধের কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। মুসলিম সেনাবাহিনীর শক্তিশালী অংশের নেতৃত্ব তাকে প্রদান করা হয়। তাকে মধ্য আরবে অভিযানে পাঠানো হয়েছিল। এটি ছিল কৌশলগত দিক থেকে সবচেয়ে স্পর্শকাতর অঞ্চল এবং শক্তিশালী বিদ্রোহীরা এখানে অবস্থান করছিল। এই অঞ্চল মদিনার কাছে ছিল তাই শহরের জন্যও হুমকি বিবেচিত হয়েছিল। খালিদ প্রথমে তায়ি ও জালিদার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। সাহাবি ও তায়ি গোত্রের একজন প্রধান আদি ইবনে হাতিম এখানে মধ্যস্থতা করেন। ফলে এই গোত্র খিলাফতের কর্তৃত্ব মেনে নেয়।[35]

৬৩২ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগে খালিদ বুজাখার যুদ্ধে তুলাইহাকে পরাজিত করেন।[36] তুলাইহা নিজেকে নবী দাবি করেছিলেন এবং বিদ্রোহীদের একজন প্রধান নেতা ছিলেন। গামরার যুদ্ধে তার অনুসারীরা পরাজিত হওয়ার পর তুলাইহার শক্তি খর্ব হয়।[34] এরপর খালিদ নাকরার দিকে অগ্রসর হন এবং নাকরার যুদ্ধে বনু সালিম গোত্রকে পরাজিত করেন। ৬৩২ সালের অক্টোবরে জাফরের যুদ্ধে গোত্রীয় নেত্রী সালমার পরাজয়ের পর এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে আসে।[37]

মদিনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সুরক্ষিত হওয়ার পর খালিদ নজদের দিকে অগ্রসর হন। এখানে বনু তামিম গোত্রের শক্তঘাটি ছিল। এই গোত্র খিলাফতের কর্তৃত্ব মেনে নেয়। অনেক গোত্র খালিদের মুখোমুখী হতে এবং খিলাফতের কর্তৃত্ব মেনে সহজে মেনে নেয় নি। কিন্তু বনু ইয়ারবু গোত্র ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। গোত্রের শেখ মালিক ইবনে নুয়াইরা খালিদের বাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘর্ষে যান নি। তিনি নিজ অনুসারীদের বিভিন্ন দলে ভাগ হওয়ার নির্দেশ দেন এবং নিজ পরিবারসহ মরুভূমির দিকে চলে যান।[38] তিনি কর সংগ্রহ করে মদিনায় প্রেরণ করেন। তবে মালিককে বিদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং স্বঘোষিত নবী সাজ্জাহর মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।[39] মালিককে তার গোত্রের সদস্যদের সাথে গ্রেপ্তার করা হয়।[40] খালিদ তাকে তার অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মালিক এসময় “আপনার নেতা এটা বলেছেন, আপনার নেতা সেটা বলেছেন” এভাবে উত্তর দেন। নেতা দ্বারা আবু বকরকে বোঝানো হয়েছিল। উত্তরের ধরন শুনে খালিদ তাকে ইসলামত্যাগী ঘোষণা করে তার মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেন।[41]

সাহাবি আবু কাতাদা আনসারী মদিনা থেকেই খালিদের সঙ্গী ছিলেন। মালিকের মৃত্যুদণ্ডের সংবাদে তিনি ব্যথিত হন এবং মদিনায় গিয়ে আবু বকরের কাছে অভিযোগ করে বলেন যে একজন মুসলিমের হত্যাকারীর অধীনে তিনি কাজ করবেন না।[42] মালিকের মৃত্যু এবং খালিদ কর্তৃক মালিকের স্ত্রী লায়লাকে গ্রহণের ফলে বিতর্ক তৈরি হয়। আবু বকর ঘটনা ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য খালিদকে মদিনায় তলব করেন।[43] খালিদ মালিককে ইসলামত্যাগী ঘোষণা করলেও উমর তাতে সন্তুষ্ট হননি।

খালিদ এরপর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ও স্বঘোষিত নবী মুসাইলিমাকে উৎখাত করেন। ৬৩২ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ইয়ামামার যুদ্ধে খালিদ মুসাইলিমার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেন। মুসাইলিমা যুদ্ধে নিহত হন।[34]

পারস্য সাম্রাজ্যে অভিযান

মানচিত্রে প্রদর্শিত খালিদ বিন ওয়ালিদের নিম্ন মেসোপটেমিয়া জয়ের অভিযানের পথ

বিদ্রোহ দমনের পর সমগ্র আরব উপদ্বীপ খিলাফতের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়। এরপর আবু বকর খিলাফতের সীমানা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেন। খালিদকে ১৮,০০০ সৈনিকসহ পারস্য সাম্রাজ্যে প্রেরণ করা হয়। তাকে পারস্য সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চল তথা নিম্ন মেসোপটেমিয়ার ইউফ্রেটিস অঞ্চল (বর্তমান ইরাক) জয়ের জন্য পাঠানো হয়। খালিদ তার বাহিনী নিয়ে নিম্ন মেসোপটেমিয়া প্রবেশ করেন।[44] যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে খালিদ প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন :

ইসলামে প্রবেশ কর এবং নিরাপদ থাক। অথবা জিজিয়া দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হও, এবং তোমরা ও তোমাদের জনগণ আমাদের নিরাপত্তা লাভ করবে, অন্যথা ফলাফল নিয়ে তোমরা নিজেদেরকেই দায়ী করবে, তোমরা জীবনকে যেভাবে আকাঙ্ক্ষা কর আমি মৃত্যুকে সেভাবে আকাঙ্ক্ষা করি।[45]

খালিদ বিন ওয়ালিদ

ধারাবাহিক চারটি যুদ্ধে খালিদ দ্রুত বিজয় অর্জন করেন। এগুলো হল শেকলের যুদ্ধ (এপ্রিল ৬৩৩), নদীর যুদ্ধ (তৃতীয় সপ্তাহ, এপ্রিল ৬৩৩), ওয়ালাজার যুদ্ধ (মে ৬৩৩) এবং উলাইসের যুদ্ধ (মধ্য মে ৬৩৩)। [46] ৬৩৩ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে নিম্ন মেসোপটেমিয়ার আঞ্চলিক রাজধানী আল-হিরার পতন ঘটে। অধিবাসীরা জিজিয়া প্রদান করতে রাজি হয় এবং মুসলিমদের সহায়তা দিতে সম্মত হয়।[47] ৬৩৩ সালের জুনে খালিদ আনবার অবরোধ করেন। ৬৩৩ সালে আনবারের যুদ্ধের পর শহর আত্মসমর্পণ করে।[48] খালিদ এরপর দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হন এবং জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে আইনুল তামির জয় করেন।[49]

এসময় নাগাদ প্রায় সমগ্র নিম্ন মেসোপটেমিয়া (উত্তরাঞ্চলীয় ইউফ্রেটিস অঞ্চল) খালিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইতিমধ্যে খালিদ উত্তর আরবের দাওমাতুল জান্দালে সহায়তার জন্য বার্তা পান। এখানে আরেক মুসলিম সেনাপতি আয়াজ বিন গানাম প্রতিপক্ষ কর্তৃক বেষ্টিত হয়ে পড়েছিলেন। ৬৩৩ সালের আগস্টে খালিদ দাওমাতুল জান্দালে পৌঁছান এবং দাওমাতুল জান্দালের যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেন। শহরের দুর্গও অধিকার করা হয়।[46]

আরব থেকে ফেরার পর খালিদ পারস্যের সেনাবাহিনী ও তাদের মিত্র আরব খ্রিষ্টানদের সেনা সমাবেশের খবর পান।[46] এসব বাহিনী ইউফ্রেটিস অঞ্চলের চারটি ভিন্ন ক্যাম্পে ঘাটি করেছিল। এগুলো হল হানাফিজ, জুমাইল, সানিই, এবং মুজাইয়া। শেষোক্তটি সর্ববৃহৎ ছিল। খালিদ তাদের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে লড়াই না করে বরং তিনদিক থেকে পৃথক রাত্রিকালীন আক্রমণের মাধ্যমে তাদের ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন।[50] তিনি তার বাহিনীকে তিনভাগে ভাগ করেন এবং রাতের বেলা সমন্বিত আক্রমণ চালানো হয়। এর মাধ্যমে ৬৩৩ সালের নভেম্বরে মুজাইয়ার যুদ্ধ, এরপর সানিইর যুদ্ধ এবং জুমাইলের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।[51]

মুসলিমদের এসকল বিজয়ের ফলে নিম্ন মেসোপটেমিয়া জয়ের জন্য পার্সিয়ানদের প্রচেষ্টা হ্রাস পায় এবং পার্সিয়ান রাজধানী তিসফুন অরক্ষিত হয়ে পড়ে। রাজধানীর উপর হামলা চালানোর পূর্বে খালিদ দক্ষিণ ও পশ্চিমের সকল পার্সিয়ান শক্তিকে উৎখাতের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর সীমান্ত শহর ফিরাজের দিকে অগ্রসর হন সাসানীয়, বাইজেন্টাইন ও খ্রিষ্টান আরবদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। ৬৩৩ সালের ডিসেম্বরে সংঘটিত ফিরাজের যুদ্ধে শহরের দুর্গ অধিকার করা হয়।[52] তার নিম্ন মেসোপটেমিয়া জয়ের অভিযানে এটা ছিল শেষ যুদ্ধ। এরপর কাদিসিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় তিনি আবু বকরের নির্দেশ সংবলিত চিঠি পান। চিঠিতে তাকে সিরিয়ায় গিয়ে মুসলিমদের কমান্ড গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ইরাকে অবস্থানকালীন সময়ে খালিদ বিজিত অঞ্চলের সামরিক গভর্নর হিসেবেও দায়িত্বপালন করেছেন।[53]

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে অভিযান

মানচিত্রে প্রদর্শিত লেভান্টে রাশিদুন খিলাফতের অভিযানের পথ।

সাসানীয়দের বিরুদ্ধে সফল অভিযানের পর খলিফা আবু বকর খালিদকে রোমান সিরিয়ায় প্রেরণ করেন। চারটি সেনাদলের মাধ্যমে অভিযান চালানো হয়। এদের পৃথক লক্ষ্যবস্তু ছিল। বাইজেন্টাইনরা বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে তাদের ইউনিটগুলি আজনাদয়ানে একত্রিত করে।[54] এই পদক্ষেপের ফলে মুসলিম সেনারা সীমান্ত অঞ্চলে আটকা পড়ে এবং তাদের পেছনে এই বৃহৎ বাহিনী গ্রহণ করায় মুসলিম বাহিনীর পক্ষে মধ্য বা উত্তর সিরিয়ায় যাওয়া সম্ভব ছিল না।[55] বাইজেন্টাইনদের তুলনায় মুসলিমদের সেনা সংখ্যা অপ্রতুল ছিল। সিরিয়ান রণাঙ্গনের মুসলিম প্রধান সেনাপতি আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ খলিফা আবু বকরের কাছে সহায়তা চেয়ে বার্তা পাঠান। এরপর আবু বকর খালিদের নেতৃত্বে অতিরিক্ত সৈনিক প্রেরণ করেন।[55]

ইরাক থেকে সিরিয়া যাওয়ার দুইটি পথ ছিল। একটি দাওমাতুল জান্দালের মধ্য দিয়ে এবং অন্যটি মেসোপটেমিয়া হয়ে আর-রাকার মধ্য দিয়ে। দাওমাতুল জান্দালের পথ দীর্ঘ ছিল এবং এই পথে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেত। সিরিয়ায় মুসলিমদের তাৎক্ষণিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল বিধায় খালিদ এই পথ পরিহার করেন। উত্তর সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ায় রোমান ঘাটির কারণে তিনি মেসোপটেমিয়ার পথও এড়িয়ে যান।[56] এসবের পরিবর্তে সিরিয়ান মরুভূমির মধ্য দিয়ে একটি অপ্রচলিত পথকে বেছে নেন।[55] তিনি মরুভূমির মধ্য দিয়ে নিজ বাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যান। কথিত আছে যে পূর্ব নির্ধারিত একটি মরূদ্যানের পানির উৎসে পৌছানোর পূর্ব পর্যন্ত দুই দিন যাবত তার সৈনিকরা এক ফোটা পানিও পান করেনি।[54] খালিদ একটি বেদুইন প্রক্রিয়ায় পানীয় জলের স্বল্পতা দূর করেছিলেন বলে জানা যায়। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উটগুলিকে পানি পান করতে দেয়া হয় যাতে উট একবারে বেশি পানি পান করে। উটের পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকায় প্রয়োজনের মুহূর্তে উট জবাই করে পানি সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। এই ব্যবস্থা কার্যকর প্রমাণিত হয়।[55]

মানচিত্রে প্রদর্শিত সিরিয়ায় খালিদ বিন ওয়ালিদের অভিযানের পথ

৬৩৪ সালের জুন মাসে খালিদ সিরিয়ায় প্রবেশ করেন। শীঘ্রই তিনি সীমান্তের সাওয়া, আরাক, পালমিরা, সুখনা, কারিয়াতাইন ও হাওয়ারিনের দুর্গ দখল করে নেন। শেষের দুইটি দুর্গ কারতিনের যুদ্ধ ও হাওয়ারিনের যুদ্ধের পর অধিকৃত হয়। এসকল দুর্গের নিয়ন্ত্রণ লাভের পর খালিদের বাহিনী সিরিয়া-আরব সীমান্তের বুসরা শহরের দিকে অগ্রসর হন। এই শহর ছিল বাইজেন্টাইনদের মিত্র গাসানি আরব খ্রিষ্টান রাজ্যের রাজধানী। উকাব গিরিপথ অতিক্রমের মাধ্যমে তিনি দামেস্ক এড়িয়ে যান। মারাজ-আল-রাহাতে খালিদ গাসানি বাহিনীকে পরাজিত করেন।[57]

খালিদের আসার খবর পেয়ে আবু উবাইদা চারটি সেনাদলের কমান্ডারদের অন্যতম শুরাহবিল ইবনে হাসানাকে বুসরা আক্রমণের নির্দেশ দেন। শুরাহবিল তার ৪,০০০ সৈনিক নিয়ে বুসরা অবরোধ করেন। বাইজেন্টাইনদের সেনাসংখ্যা শুরাহবিলের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তারা মুসলিমদের উপর আক্রমণ করে প্রায় পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল। এসময় খালিদের অশ্বারোহীরা উপস্থিত হয় এবং বাইজেন্টাইনদের উপর আক্রমণ করে।[58] বাইজেন্টাইনরা নগর দুর্গে আশ্রয় নেয়। আবু উবাইদাহ বুসরায় এসে খালিদের সাথে যোগ দেন এবং খলিফার নির্দেশ মোতাবেক খালিদ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। ৬৩৪ সালের জুলাই মাসের মধ্যভাগে বুসরার দুর্গ আত্মসমর্পণ করে। [59] বুসরা অধিকার করার পর খালিদ সকল মুসলিম সেনাদলকে আজনাদায়নে তার সাথে যোগ দিতে বলেন। ৩০ জুলাই এখানে সংঘটিত আজনাদায়নের যুদ্ধে বাইজেন্টাইনরা পরাজিত হয়। আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে সিরিয়ায় বাইজেন্টাইনদের ক্ষমতা চূর্ণ করার ক্ষেত্রে এই যুদ্ধের ফলাফল চাবিকাঠি ছিল।[60]

এই যুদ্ধে জয়ের ফলে সিরিয়া অনেকটাই মুসলিমদের হাতে এসে পড়ে। খালিদ বাইজেন্টাইনদের শক্ত ঘাটি দামেস্ক দখলের সিদ্ধান্ত নেন। এখানে বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াসের জামাতা থমাস শহরের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন।[61] খালিদের অগ্রযাত্রার খবর পেয়ে তিনি শহরের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন। এসময় হেরাক্লিয়াস এমেসায় ছিলেন। থমাস তার কাছে অতিরিক্ত সৈনিক চেয়ে চিঠি পাঠান। এছাড়াও খালিদের অগ্রযাত্রার গতি হ্রাস এবং আসন্ন অবরোধের প্রস্তুতির জন্য থমাস নিজ বাহিনীকে প্রেরণ করেছিলেন। তার দুইটি সেনাদলের প্রথমটি আগস্টের মধ্যভাগে ইয়াকুসায় এবং দ্বিতীয়টি ১৯ আগস্ট মারাজ আস-সাফফারে ধ্বংস হয়। [62] ইতিমধ্যে হেরাক্লিয়াসের কয়েকটি সেনাদলের পূর্বে প্রেরিত সহায়তা এসে পৌছায়। দামেস্ককে বাকি অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য খালিদ দক্ষিণে ফিলিস্তিনের রুটে, উত্তরে দামেস্ক-এমেসা রুটে এবং দামেস্কের দিকের রুটসমূহে কিছু সেনাদল প্রেরণ করেন। হেরাক্লিয়াসের প্রেরিত সেনাদলগুলিকে দামেস্ক থেকে ৩০ কিমি দূরে সানিতা-আল-উকাবের যুদ্ধে খালিদ বিতাড়িত করেন।[63]

মানচিত্রে প্রদর্শিত খালিদ বিন ওয়ালিদের সিরিয়া অভিযানের পথ।

৩০ দিন অবরোধের পর ৬৩৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর খালিদ দামেস্ক জয় করেন। দামেস্কের পতনের খবর পেয়ে সম্রাট হেরাক্লিয়াস এমেসা থেকে এন্টিওকের দিকে রওয়ানা হন। খালিদের অশ্বারোহী বাহিনী অজ্ঞাত এক পথের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে দামেস্ক থেকে ১৫০ কিমি উত্তরে এন্টিওকের দিকে রওয়ানা হওয়া দামেস্কের বাইজেন্টাইন গেরিসনের উপর আক্রমণ করে।[64] দামেস্ক অবরোধের সময় আবু বকর ইন্তেকাল করেন। এরপর উমর নতুন খলিফা হন। উমর খালিদকে পদচ্যুত করে আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহকে সিরিয়ায় মুসলিম বাহিনীর কমান্ডার নিয়োগ দেন। অবরোধ চলাকালীন সময়ে আবু উবাইদা তার নিয়োগ ও খালিদের পদচ্যুতির চিঠি পেয়েছিলেন কিন্তু শহর জয় করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি খবর জানানো থেকে বিরত ছিলেন।[65]

উমরের যুগ (৬৩৪–৬৪২)

খালিদের পদচ্যুতি

৬৩৪ সালের ২২ আগস্ট আবু বকর ইন্তেকাল করেন। তিনি উমরকে নিজের উত্তরসূরি নিয়োগ দিয়ে গিয়েছিলেন।[55] খলিফা হওয়ার পর উমর খালিদকে পদচ্যুত করে আবু উবাইদাকে সেনাপতি নিয়োগ করেন।[66] খালিদ অপরাজেয় হওয়ায় অনেক মুসলিম তার কারণে যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হচ্ছে বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। এই ব্যাপারে উমর বলেছিলেন :"আমি খালিদ বিন ওয়ালিদকে আমার ক্রোধ বা তার দায়িত্বহীনতার কারণে অব্যাহতি দিই নি, এর কারণ ছিল আমি লোকদের জানাতে চাইছিলাম যে বিজয় আল্লাহর তরফ থেকে আসে।".[65] খালিদ খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে নির্দেশ অনুযায়ী আবু উবাইদার অধীনে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি বলেছিলেন : "যদি আবু বকর ইন্তেকাল করেন আর উমর খলিফা হন, তবে আমরা শুনব এবং মানব".[67] আবু উবাইদার নেতৃত্বে এরপর সিরিয়া অভিযান চলতে থাকে। আবু উবাইদা খালিদের গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি খালিদকে অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং নিজের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন।[65]

মধ্য লেভান্ট বিজয়

মানচিত্রে প্রদর্শিত খালিদ বিন ওয়ালিদের মধ্য সিরিয়া অভিযানের পথ।

আবু উবাইদা প্রধান কমান্ডার নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি আবু-আল-কুদসে অনুষ্ঠিত বার্ষিক মেলায় একটি ছোট সেনাদল পাঠান। বাইজেন্টাইন ও খ্রিষ্টান আরব গেরিসন এই মেলা পাহারা দিচ্ছিল। গেরিসনের সৈনিকরা দ্রুত মুসলিমদের ঘিরে ফেলে। সেনাদলটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পূর্বে আবু উবাইদা গোয়েন্দা মারফত খবর পান এবং তাদের উদ্ধার করার জন্য খালিদকে প্রেরণ করেন। ৬৩৪ সালের ১৫ অক্টোবর সংঘটিত আবু-আল-কুদসের যুদ্ধে খালিদ তাদের পরাজিত করেন। উক্ত মেলা থেকে প্রচুর সম্পদ অর্জিত হয় এবং অনেক রোমান বন্দী হয়।[68]

মধ্য সিরিয়া অধিকারের মাধ্যমে মুসলিমরা বাইজেন্টাইনদের উপর প্রবল প্রভাব সৃষ্টি করে। উত্তর সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের মধ্যে যোগাযোগ এসময় বন্ধ হয়ে যায়। আবু উবাইদা ফাহলের দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন। এখানে একটি শক্তিশালী বাইজেন্টাইন গেরিসন ও আজনাদয়ানের যুদ্ধে রক্ষা পাওয়ারা আশ্রয় নিয়েছিল।[69] বাইজেন্টাইনরা এখান থেকে পূর্ব দিকে আক্রমণ করতে পারত এবং এর ফলে আরব থেকে সহায়তা বন্ধ হয়ে যেত বলে এই অঞ্চল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।[70] এছাড়াও পেছনে বৃহৎ গেরিসন থাকায় ফিলিস্তিনে অভিযান চালানো সম্ভব ছিল না। মুসলিম বাহিনী ফাহলের দিকে যাত্রা করে। খালিদ এই বাহিনীর অগ্রবর্তী দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৬৩৫ সালের ২৩ জানুয়ারি সংঘটিত ফাহলের যুদ্ধে বাইজেন্টাইন বাহিনী পরাজিত হয়।[55]

এমেসার যুদ্ধ এবং দামেস্কের দ্বিতীয় যুদ্ধ

ফাহলের বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। আমর ইবনুল আসশুরাহবিল ইবনে হাসানা ফিলিস্তিন জয়ের জন্য দক্ষিণে এবং আবু উবাইদা ও খালিদ উত্তর সিরিয়া জয়ের জন্য উত্তরদিকে যাত্রা করেন। মুসলিমরা ফাহলে ব্যস্ত থাকাকালীন সময়ে সম্রাট হেরাক্লিয়াস সুযোগ লাভ করেন। দামেস্ক পুনরাধিকারের জন্য তিনি দ্রুত সেনাপতি থিওডরের অধীনে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন।[71] হেরাক্লিয়াসের এই নতুন বাহিনী প্রেরণের পর মুসলিমরা ফাহল থেকে এমেসার দিকে যাত্রা করছিল। এমেসার দিকে অর্ধেক যাত্রা করার পর মুসলিম ও বাইজেন্টাইন বাহিনী মারাজ-আল-রোমে মুখোমুখি হয়। সেনাপতি থিওডর রাতের বেলা বাহিনীর অর্ধেককে দামেস্কের মুসলিম গেরিসনে অতর্কিত আক্রমণের জন্য পাঠান। [72] খালিদের গোয়েন্দারা তাকে এই খবর জানায়। আবু উবাইদার অনুমতিক্রমে তিনি মোবাইল গার্ডদের নিয়ে দামেস্কের দিকে রওয়ানা হন। মারাজ-আল-রোমের যুদ্ধে আবু উবাইদা রোমানদের সাথে লড়াই করার সময় খালিদ দামেস্কের দিকে যাত্রা করেন এবং দামেস্কের দ্বিতীয় যুদ্ধে সেনাপতি থিওডরাসকে পরাজিত করেন।[70] একসপ্তাহ পর আবু উবাইদা বালবিক জয় করেন। এখানে জুপিটারের মন্দির অবস্থিত ছিল। এরপর তিনি খালিদকে এমেসার দিকে পাঠান।[73]

এমেসা ও চেলসিসের তরফ থেকে এক বছরের শান্তির আবেদন করা হয়।[74] আবু উবাইদা এই আবেদন গ্রহণ করে অন্যান্য বিজিত অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠা করায় মনোযোগী হন। তিনি হামা, মারাত আন নুমান জয় করেন। হেরাক্লিয়াসের নির্দেশনায় সম্পাদিত শান্তিচুক্তিগুলির কারণ ছিল যাতে উত্তর সিরিয়ার প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাওয়া যায়। এন্টিওকে বাহিনী গঠন করার পর হেরাক্লিয়াস তাদেরকে উত্তর সিরিয়ার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাঠান, বিশেষত চেলসিসের দুর্গে।[75] শহরে বাইজেন্টাইন বাহিনীর আগমনের ফলে শান্তিচুক্তি লঙ্ঘিত হয়। এরপর আবু উবাইদা ও খালিদ এমেসার দিকে যাত্রা করেন। খালিদের অগ্রবর্তী দলের মুখোমুখি হওয়া বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করা হয়। মুসলিমরা এমেসা অবরোধ করে। দুই মাস অবরোধের পর ৬৩৬ সালের মার্চে এমেসা আত্মসমর্পণ করে।[76]

ইয়ারমুকের যুদ্ধ

ইয়ারমুকের যুদ্ধের পূর্বে মুসলিম ও বাইজেন্টাইন সৈনিকদের চলাচলের পথ।

এমেসা অধিকার করার পর মুসলিমরা উত্তর সিরিয়া অধিকারের জন্য যাত্রা করে। ইতিমধ্যে, হেরাক্লিয়াস এন্টিওকে একটি বৃহদাকার সেনাদল গঠন করেছিলেন। উত্তর সিরিয়ার রোমান বন্দীদের কাছ থেকে খালিদ এই খবর পান। পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে হেরাক্লিয়াস মুসলিমদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত লড়াইয়ে নামতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি মুসলিম সেনাদলগুলিকে পরস্পর থেকে পৃথক করে ফেলে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। ৬৩৬ সালের জুনে পুনরাধিকারের জন্য পাঁচটি বৃহদাকার সেনাদল বিভিন্ন দিক থেকে সিরিয়ার দিকে প্রেরণ করা হয়।[77] খালিদ হেরাক্লিয়াসের পরিকল্পনা আন্দাজ করতে পারেন। যুদ্ধসভায় তিনি আবু উবাইদাকে সব মুসলিম সেনাদল এক স্থানে জমায়েত করার প্রস্তাব দেন যাতে বাইজেন্টাইনদের সাথে চূড়ান্তভাবে লড়াই করা সম্ভব হয়।[78] খালিদের পরামর্শক্রমে আবু উবাইদা সিরিয়ার সকল মুসলিম সেনাদলকে বিজিত অঞ্চল ত্যাগ করে জাবিয়ায় একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেন।[79] এর ফলে হেরাক্লিয়াসের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তিনি মুসলিমদের সাথে খোলা ময়দানে যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না কারণ এর ফলে মুসলিমদের হালকা অশ্বারোহী বাহিনী বাইজেন্টাইনদের ভারি এবং কম দ্রুততাসম্পন্ন অশ্বারোহী বাহিনীর উপর আধিপত্য স্থাপন করার সম্ভাবনা ছিল। খালিদের পরামর্শ অনুযায়ী আবু উবাইদা মুসলিম বাহিনীকে জাবিয়া থেকে ইয়ারমুক নদীর সমতল ভূমিতে একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেন। এই স্থান পশুখাদ্য ও পানির সরবরাহ ভালো ছিল এবং এখানে অশ্বারোহীদেরকে অধিক কার্যকারিতার সাথে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল।[80] যুদ্ধসভায় আবু উবাইদা মুসলিম বাহিনীর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব খালিদের হাতে তুলে দেন। খালিদ যুদ্ধের মাঠ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেন এবং বাইজেন্টাইনদের পরাজিত করায় মূল পরিকল্পনাকারীর ভূমিকা রাখেন।[81]

১৫ আগস্ট ইয়ারমুকের যুদ্ধ শুরু হয় এবং ছয়দিন ধরে চলে। যুদ্ধে বাইজেন্টাইন পক্ষ পরাজিত হয়। ইয়ারমুকের যুদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম ফলাফল নির্ধারণকারী যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত।[82] পরাজয়ের মাত্রার কারণে বাইজেন্টাইনদের বিপর্যয় সামলে উঠতে সময় লেগেছিল। তখন পর্যন্ত সিরিয়ায় সংঘটিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই যুদ্ধে বিজয় ছিল মূলত খালিদ বিন ওয়ালিদের কৌশলগত নৈপুণ্য।[2]

জেরুজালেম জয়

যুদ্ধে বাইজেন্টাইনরা পরাজিত ও বিক্ষিপ্ত হওয়ার পর মুসলিমরা দ্রুত ইয়ারমুকের পূর্বে বিজিত এলাকা পুনরায় অধিকার করে নেয়। এরপর মুসলিমরা দক্ষিণ দিকে বাইজেন্টাইনদের শেষ শক্তঘাটি জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হয়। ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশ নেয়া অনেক বাইজেন্টাইন সদস্য এখানে আশ্রয় নিয়েছিল।[83] জেরুজালেমের অবরোধ চার মাস স্থায়ী হয়। এরপর খলিফা উমরকে আসতে হবে এই শর্তে জেরুজালেম আত্মসমর্পণ করে। জেরুজালেমের আত্মসমর্পণের পর মুসলিম বাহিনীকে পুনরায় কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ানের সেনাদল দামেস্ক আসে এবং বৈরুত অধিকার করে। আমর ইবনুল আসশুরাহবিল ইবনে হাসানার সেনাদল ফিলিস্তিনের বাকি অঞ্চল অধিকারের জন্য অগ্রসর হয়। আবু উবাইদা ও খালিদের ১৭,০০০ সৈনিকের সেনাদল সমগ্র উত্তর সিরিয়া অধিকারের জন্য অগ্রসর হয়।[84]

উত্তর সিরিয়া জয়

মানচিত্রে প্রদর্শিত খালিদ বিন ওয়ালিদের উত্তর সিরিয়া অভিযানের পথ।

এমেসা ইতিমধ্যে হস্তগত হয়েছিল। আবু উবাইদা ও খালিদ চেলসিসের দিকে যাত্রা করেন। কৌশলগত কারণে এটি বাইজেন্টাইনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ ছিল। এখান থেকে তারা আনাতোলিয়া, আর্মেনিয়া ও এন্টিওককে রক্ষা করতে সক্ষম ছিল। আবু উবাইদা খালিদকে সম্পূর্ণ মোবাইল গার্ড বাহিনী প্রদান করে চেলসিসের দিকে প্রেরণ করেন।[85] কমান্ডার মেনাসের অধীনে গ্রীক সৈনিকরা এটি প্রহরা দিচ্ছিল। বলা হয় যে মেনাস সম্রাটের পর দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বাইজেন্টাইনদের প্রথামাফিক কৌশল বাদ দিয়ে খালিদের মুখোমুখি হওয়ার এবং মুসলিমদের মূল বাহিনী এসে পৌছার পূর্বে অগ্রবর্তী দলকে ধ্বংস করার সিদ্ধন্ত নেন। চেলসিস থেকে ৫কিমি পূর্বে অবস্থিত হাজিরে সংঘটিত হাজিরের যুদ্ধে রোমানরা পরাজিত হয়। এই বিজয়ের পর উমর খালিদের সামরিক কৃতিত্বের প্রশংসা করেছিলেন।[86] উমর নিম্নোক্ত কথা বলেছিলেন বলে জানা যায়: "খালিদ সত্যিকার সেনাপতি, আল্লাহ আবু বকরের উপর রহমত করুক। তিনি মানুষকে আমার চেয়েও উত্তমরূপে চিনতে পারতেন।".[87]

আবু উবাইদা শীঘ্রই চেলসিসে খালিদের সাথে যোগ দেন। ৬৩৭ সালের জুন মাসে চেলসিস আত্মসমর্পণ করে। এই বিজয়ের ফলে চেলসিসের উত্তরের অঞ্চল মুসলিমদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এরপর খালিদ ও আবু উবাইদা অক্টোবরে আলেপ্পো অধিকার করেন।[88] এরপরের লক্ষ্যবস্তু ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এশীয় অঞ্চলের রাজধানী এন্টিওক। এন্টিওকের দিকে যাত্রা করার পূর্বে খালিদ ও আবু উবাইদা শহরটিকে আনাতোলিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্দেশ্যে এন্টিওককে কৌশলগত প্রতিরক্ষা প্রদানকারী সকল দুর্গকে দখল করা হয়। এর মধ্যে এন্টিওকের উত্তরপূর্বের আজাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অরন্টেস নদীর নিকটে বাইজেন্টাইন বাহিনীর সাথে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ লোহা সেতুর যুদ্ধ নামে পরিচিত[89] বাইজেন্টাইনরা পরাজিত হওয়ার পর এন্টিওকে আশ্রয় নিলে মুসলিমরা শহর অবরোধ করে। সম্রাটের দিক থেকে সাহায্যের আশা ক্ষীণ হওয়ায় সকল বাইজেন্টাইন সৈনিককে নিরাপদে কনস্টান্টিনোপল যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে এই শর্তে ৬৩৭ সালের ৩০ মার্চ এন্টিওক আত্মসমর্পণ করে।

আবু উবাইদা খালিদকে উত্তরদিকে পাঠান এবং নিজে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করে লাজকিয়া, জাবলা, তারতুস ও লেবানন পর্বতমালার বিপরীতের উপকূল জয় করে। খালিদ উত্তরদিকে অগ্রসর হয়ে আনাতোলিয়ার কিজিল নদীর অববাহিকায় অভিযান চালান। মুসলিমদের আগমনের পূর্বে সম্রাট হেরাক্লিয়াস এন্টিওক ত্যাগ করে এডেসা চলে গিয়েছিলেন। তিনি আল-জাজিরা ও আর্মেনিয়ায় প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে রাজধানী কনস্টান্টিনোপল রওয়ানা হন। এসময় তিনি অল্পের জন্য খালিদের মুখোমুখি হওয়া থেকে বেঁচে যান। খালিদ এসময় মারাশ অধিকার করার পর দক্ষিণে মুনবিজের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন।[90] হেরাক্লিয়াস বলেছিলেন:

বিদায়, দীর্ঘ বিদায় সিরিয়া, আমার চমৎকার প্রদেশ। তুমি এখন শত্রুদের হাতে। তুমি শান্তিতে থাকো, হে সিরিয়া - শত্রুদের জন্য তুমি কত সুন্দর ভূমি.[91]

সম্রাট হেরাক্লিয়াস

ইয়ারমুকে বাইজেন্টাইনদের শোচনীয় পরাজয়ের ফলে সাম্রাজ্য দৃঢ়ভাবে মুসলিমদের করায়ত্ত হয়। সামরিক সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে হেরাক্লিয়াসের পক্ষে সিরিয়া ফিরে পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালানো সম্ভব ছিল না। হেরাক্লিয়াস জাজিরার খ্রিষ্টান আরবদের নিকট সহায়তা চান। তারা একটি বৃহৎ সেনাদল গঠন করে এবং আবু উবাইদার সদরদপ্তর এমেসার দিকে যাত্রা করে। আবু উবাইদা সমগ্র উত্তর সিরিয়া থেকে তার সেনাদের এমেসায় ফিরিয়ে আনেন এবং খ্রিষ্টান আরবরা এমেসা অবরোধ করে।[92] খালিদ দুর্গের বাইরে উন্মুক্ত ময়দানে যুদ্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আবু উবাইদা এই বিষয়ে খলিফা উমরের কাছে বার্তা পাঠান। খলিফা উমর বিষয়টি দক্ষতার সাথে নিষ্পত্তি করেন। তিনি তিনটি ভিন্ন দিক থেকে ইরাকের মুসলিম বাহিনীকে প্রতিপক্ষ খ্রিষ্টান আরবদের আবাসভূমি জাজিরা আক্রমণের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি কাকা ইবনে আমরের নেতৃত্বে ইরাক থেকে আরেকটি সেনাদল এমেসায় পাঠানো হয়।[93] কাকা ইবনে আমর ইতিপূর্বে ইয়ারমুকের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং কাদিসিয়ার যুদ্ধের জন্য তাকে ইরাকে পাঠানো হয়েছিল। উমর ব্যক্তিগতভাবে ১,০০০ জন সৈনিক নিয়ে মদিনা থেকে অগ্রসর হন। এসকল পদক্ষেপের ফলে খ্রিষ্টান আরবরা অবরোধ তুলে নেয়। এই পর্যায়ে খালিদ তার মোবাইল গার্ডদের নিয়ে এমেসা থেকে বেরিয়ে এসে তাদের উপর আক্রমণ চালান।[94] সিরিয়া ফিরে পাওয়ার জন্য এটি ছিল হেরাক্লিয়াসের সর্বশেষ প্রচেষ্টা।

আর্মেনিয়া ও আনাতোলিয়া অভিযান

মানচিত্রে প্রদর্শিত খালিদ বিন ওয়ালিদের আনাতোলিয়া ও আর্মেনিয়া অভিযানের পথ।

এই যুদ্ধের পর উমর জাজিরা জয়ের নির্দেশ দেন। ৬৩৮ সালের গ্রীষ্মের শেষনাগাদ এই অভিযান সম্পন্ন হয়। জাজিরা জয়ের পর খালিদ ও জাজিরা বিজেতা আয়াজ বিন গানিম উভয়কে আবু উবাইদা জাজিরার উত্তরের বাইজেন্টাইন অঞ্চল আক্রমণের নির্দেশ দেন।[95] তারা অগ্রসর হয়ে এডেসা, দিয়ারবাকির, মালাতিয়া জয় করেন এবং আরারাত অঞ্চল পর্যন্ত বাইজেন্টাইন আর্মেনিয়া আক্রমণ চালান। এছাড়াও তারা মধ্য আনাতোলিয়ায় আক্রমণ করেছিলেন বলে জানা যায়। হেরাক্লিয়াস ইতোমধ্যে মুসলিম নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল এবং আনাতোলিয়ার মূল ভূখন্ডের মধ্যে নো ম্যানস ল্যান্ড প্রতিষ্ঠার জন্য এন্টিওক ও তারতুসের মধ্যবর্তী দুর্গগুলি পরিত্যাগ করেছিলেন। [96] উমর এরপর মুসলিমদেরকে আনাতোলিয়ার বেশি অগ্রসর হতে দেননি। এর পরিবর্তে তিনি আবু উবাইদাকে বিজিত অঞ্চলে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। আনাতোলিয়া ও আর্মেনিয়া অভিযান ছিল খালিদের সামরিক জীবনের সমাপ্তি।[97]

সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুতি

খালিদ এসময় তার কর্মজীবনের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌছান। তিনি খ্যাত হয়ে উঠেন এবং মুসলিমদের কাছে তিনি জাতীয় বীর গণ্য হতেন।[98] জনসাধারণ তাকে সাইফউল্লাহ ("আল্লাহর তলোয়ার") বলে ডাকত। খালিদ মারাশ অধিকার করার কিছুকাল পর জানতে পারেন যে খ্যাতনামা কবি আশ’আস খালিদের প্রশংসা করে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। খালিদ তাকে ১০,০০০ দিরহাম উপহার হিসেবে দেন।[99]

রাশিদুন খিলাফতের বিস্তৃতি।

উমর এই ঘটনাকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হিসেবে বিবেচনা করেন। উমর আবু উবাইদাকে চিঠি লিখে আশ’আসকে দেয়া খালিদের অর্থের উৎস বের করার নির্দেশ দেন। বলা হয়েছিল যে যদি খালিদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেন তবে তা ক্ষমতার অপব্যবহার।[100] আর যদি তিনি নিজের অর্থ প্রদান করেন তবে তা অপচয়। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন। আবু উবাইদাকে একাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আবু উবাইদা খালিদের গুণগ্রাহী ছিলেন এবং ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন।[101] ফলে এই দায়িত্ব পালন তার জন্য কঠিন ছিল। এর পরিবর্তে তিনি বিলাল ইবনে রাবাহকে এই দায়িত্ব দেন এবং খালিদকে চেলসিস থেকে এমেসায় তলব করেন।[102] খালিদ বলেন যে তিনি নিজের অর্থ থেকে এই উপহার দিয়েছেন। তিনি আবু উবাইদার কাছে উপস্থিত হলে আবু উবাইদা তাকে জানান যে উমরের নির্দেশে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।[103] এর মাধ্যমে খালিদের সামরিক জীবনের ইতি ঘটে।

মৃত্যু

খালিদ বিন ওয়ালিদ মসজিদে খালিদের মাজার অবস্থিত, হিমস, সিরিয়া
খালিদের মাজার।

বাহ্যিকভাবে উমর ও খালিদের সম্পর্ক শীতল হলেও তারা একে অন্যের প্রতি খারাপ মনোভাব পোষণ করতেন না। মৃত্যুর আগে খালিদ তার সম্পদ উমরের হাতে অর্পণ করে যান এবং উমরকে নিজ অসিয়তের বাস্তবায়নকারী মনোনীত করেছিলেন।[104]

পদচ্যুতির চার বছর পর ৬৪২ সালে খালিদ ইন্তেকাল করেন। তাকে এমেসায় দাফন করা হয়। সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর থেকে তিনি সেখানে বসবাস করছিলেন। তার মাজার বর্তমানে খালিদ বিন ওয়ালিদ মসজিদের অংশ। খালিদের কবরফলকে তার নেতৃত্বাধীনে জয় হওয়া ৫০টি যুদ্ধের নাম (ছোট যুদ্ধ ব্যতীত) উৎকীর্ণ রয়েছে। [105] তিনি যুদ্ধে শহিদ হতে ইচ্ছুক ছিলেন তাই বাড়িতে মৃত্যুর পূর্বে তিনি বিমর্ষ হয়ে যান।[106] মৃত্যুর পূর্বে তিনি বেদনা নিয়ে বলেন :

আমি শাহাদাতের ইচ্ছা নিয়ে এত বেশি যুদ্ধে লড়াই করেছি যে আমার শরীরের কোনো অংশ ক্ষতচিহ্নবিহীন নেই যা বর্শা বা তলোয়ারের কারণে হয় নি। এরপরেও আমি এখানে, বিছানায় পড়ে একটি বৃদ্ধ উটের মতো মারা যাচ্ছি। কাপুরুষদের চোখ যাতে কখনো শান্তি না পায়।[107]

খালিদ বিন ওয়ালিদ

এ কথা শুনে খালিদের স্ত্রী বলেন : "আপনাকে সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তলোয়ার) উপাধি দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহর তলোয়ার ভাঙতে পারে না আর তাই আপনি শহিদ হিসেবে নয় বরং বিজয়ী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবেন।"

যুদ্ধসমূহ

সনযুদ্ধবর্ণনা
৬২৫ ২৩ মার্চউহুদের যুদ্ধখালিদ বিন ওয়ালিদ মুসলিমদের পরাজিত করেন।
৬২৯মুতার যুদ্ধবাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধে খালিদ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে বৃহদাকার বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে বিজয়ের জন্য তিনি ‘’আল্লাহর তলোয়ার’’ উপাধিতে ভূষিত হন
৬৩৩ এপ্রিলশেকলের যুদ্ধপারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধে খালিদ পার্সিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করেন।
৬৩৩ মেওয়ালাজার যুদ্ধপিনসার মুভমেন্ট কৌশল ব্যবহার করে খালিদ পারস্যের বৃহদাকার বাহিনীকে পরাজিত করেন।
৬৩৩ মেউলাইসের যুদ্ধখালিদ বিন ওয়ালিদ পারস্য সাম্রাজ্যের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করেন
৬৩৩ নভেম্বরজুমাইলের যুদ্ধখালিদ পারস্যের বাহিনীকে পরাজিত করে মেসোপটেমিয়ার অধিকাংশ জয় করেন।
৬৩৪ জানুয়ারিফিরাজের যুদ্ধপারস্য, রোমানখ্রিষ্টান আরবদের সম্মিলিত জোটবাহিনীকে পরাজিত করে মেসোপটেমিয়া বিজয় সম্পূর্ণ করেন।
৬৩৪ জুন-জুলাইবুসরার যুদ্ধখালিদের নেতৃত্বে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী বুসরা শহর অবরোধ করে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ রোমান ও খ্রিষ্টান আরব বাহিনীকে পরাজিত করে।
৬৩৪ জুলাইআজনাদয়ানের যুদ্ধখালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিম ও বাইজেন্টাইনদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ। এতে মুসলিমরা বড় আকারের বিজয় অর্জন করে
৬৩৫ফাহলের যুদ্ধখালিদ বিন ওয়ালিদে অপেক্ষাকৃত বৃহদাকার বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করে ফিলিস্তিন অঞ্চল, জর্ডান ও দক্ষিণ সিরিয়া জয় করেন।
৬৩৬ আগস্টইয়ারমুকের যুদ্ধখালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিমরা বৃহদাকার বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করে।
৬৩৭লোহা সেতুর যুদ্ধবাইজেন্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করার মাধ্যমে খালিদ বিন ওয়ালিদ উত্তর সিরিয়া ও দক্ষিণ তুরস্ক জয় করেন।
৬৩৭হাজিরের যুদ্ধখালিদ বিন ওয়ালিদ কিন্নাসরিনের ঘাটিকে পরাজিত করেন।

স্মরণ

সামরিক

মানচিত্রে প্রদর্শিত খালিদ বিন ওয়ালিদের অভিযানের স্থান

পুরো সামরিক জীবনে মূল যুদ্ধ, ছোট খণ্ডযুদ্ধ, একক দ্বন্দ্বযুদ্ধ মিলিয়ে খালিদ প্রায় ১০০টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়।[3] আজীবন অপরাজিত যোদ্ধা হওয়ায় তাকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সেনাপতিদের অন্যতম বিবেচনা করা হয়।[3]

খালিদ প্রথম যুগের অনেক মুসলিম সামরিক বিধির প্রণেতা ছিলেন।[108] প্রথম যুগে মুসলিম অভিযানের সময় তিনি মুসলিমদের ব্যবহৃত প্রায় সব প্রধান কৌশলের পথপ্রদর্শক ছিলেন। আরব বেদুইন যোদ্ধাদের ব্যক্তিগত দক্ষতাকে বৃহদাকারে কাজে লাগানো তার অন্যতম প্রধান অর্জন ছিল। তিনি মুবারিজুন নামক ইউনিট গঠন করেছিলেন। এই ইউনিটের সদস্যরা উচ্চপ্রশিক্ষিত ছিল। প্রতিপক্ষের প্রধান যোদ্ধাদের সাথে লড়াইয়ে তাদেরকে খালিদ সফলভাবে ব্যবহার করেছিলেন যাতে শত্রুর মনোবল ভেঙে যায়। আজনাদয়ানের যুদ্ধ এই প্রকার মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের একটি উত্তম দৃষ্টান্ত। খালিদের পূর্ব পর্যন্ত আরবরা মূলত ক্ষুদ্র সংঘর্ষে অংশ নিত কিন্তু তাদের এই ক্ষুদ্র সংঘর্ষের কৌশলগুলিকে তিনি বৃহদাকারে কাজে লাগান। তিনি তার বাহিনীকে শত্রুর সামনে নিয়ে আসতেন এবং সম্পূর্ণ যুদ্ধ বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে ক্ষুদ্র সংঘর্ষে পরিণত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। প্রতিপক্ষের ইউনিটগুলি বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার পর তিনি তার অশ্বারোহীদের সহায়তায় প্রতিপক্ষের পার্শ্বভাগ থেকে হাতুড়ি ও নেহাই কৌশলে আক্রমণ পরিচালনা করতেন।[109]

তার ব্যবহৃত কৌশলগুলিতে তার মূল মেধা নিহিত ছিল। তিনি প্রতিপক্ষকে শুধুমাত্র পরাজিত না করে নিঃশেষ করার উপর জোর দিতেন। ওয়ালাজার যুদ্ধে পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে পিনসার মুভমেন্ট কৌশল ব্যবহার এর একটি উদাহরণ।[110] ইয়ারমুকের যুদ্ধে তিনি বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পালানোর একমাত্র পথটি দখল করে নিয়ে তাদেরকে তিন দিকের খাড়া গিরিখাত দ্বারা আবদ্ধ করে ফেলেন।

কৌশলগত সুবিধা অর্জনের জন্য খালিদ যুদ্ধের সময় ভূপ্রকৃতির উপর তার জ্ঞান কাজে লাগিয়েছেন। পারস্যে অভিযানের সময় প্রথমদিকে তিনি পারস্যের সীমানার বেশি গভীরে প্রবেশ করেন নি এবং সবসময় আরবের মরুভূমিকে পেছনের দিকে রেখে লড়াই করেছেন যাতে কোনো কারণে পরাজয় ঘটলে পিছু হটা যায়।[111] পারস্য ও পারস্যের মিত্রবাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ার পর তিনি ইউফ্রেটিস অঞ্চলের গভীরে প্রবেশ করে ইরাকের আঞ্চলিক রাজধানী হিরা অধিকার করে নেন। ইয়ারমুকের ভূপ্রকৃতিকেও তিনি বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছেন।

১৩শ শতাব্দীতে মোঙ্গলদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত দ্রুতগামিতার দিক থেকে কোনো বাহিনীই খালিদের বাহিনীর সমকক্ষ ছিল না।[112] মরুভূমির আরব এবং স্তেপের মোঙ্গলদের কৌশল অনেকাংশ একইরূপ ছিল। সমগ্র আরব সেনাদল উটে চড়ে অগ্রসর হত; অন্যদিকে মোঙ্গলরা ঘোড়ায় চড়ে অগ্রসর হত। তবে আরবদের মধ্যে আরোহী তীরন্দাজ যোদ্ধা ছিল না।[113] আচমকা হামলা ছিল খালিদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রণকৌশল। জুমাইল, মুজাইয়াহসানিইতে তিনি এরূপ আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। তার দ্রুত চলাচলে সক্ষম বাহিনী দ্রুত পার্সিয়ান ও তাদের আরব মিত্রদের ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। মারাজ-আল-দিবাজের যুদ্ধেও তার বাহিনী বাইজেন্টাইন বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে একই সময় চারটি পৃথক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে। এই কৌশলটি ১৩শ শতাব্দীতে মোঙ্গল সেনাবাহিনীর প্রধান রণকৌশলে পরিণত হয়।[114]

ইতিহাসবিদ ওয়াকিদি লিখেছেন যে মারাজ-আল-দিবাজের যুদ্ধের পর সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার মেয়ের মুক্তির জন্য খালিদের কাছে একজন দূত পাঠান। দূত খালিদকে সম্রাটের যে চিঠি দেন তাতে নিম্নোক্ত কথা লেখা ছিল :[115]

খালিদ দূতকে বলেন :

দূত হেরাক্লিয়াসের মেয়েকে নিয়ে এন্টিওকে ফিরে আসেন।

মারাজ-আল-দিবাজের যুদ্ধে বাইজেন্টাইন সেনাদলের (নীল) বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর (লাল) রণকৌশল।

রোমান সিরিয়ায় খালিদের অগ্রযাত্রা তার কৌশলগত প্রণালীর একটি উদাহরণ।[116] সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার সব গেরিসন সৈনিককে সিরিয়ায় আজনাদয়ানের দিকে পাঠান যাতে মুসলিমদের সিরিয়া-আরব সীমান্তে ঠেকিয়ে রাখা যায়। দক্ষিণ দিকের সিরিয়া-আরব পথের মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত সৈন্য আসবে এমনটা ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু খালিদ এসময় ইরাকে ছিলেন। তিনি পুরোপুরি অনাকাঙ্ক্ষীত একটি পথ বেছে নেন : বাইজেন্টাইন বাহিনীকে চমকে দেওয়ার জন্য তিনি পানিবিহীন সিরিয়ান মরুভূমির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে উত্তর সিরিয়ায় উপস্থিত হন। তিনি দ্রুত কয়েকটি শহর অধিকার করে নেন ফলে আজনাদয়ানের বাইজেন্টাইন বাহিনীর সাথে সম্রাট হেরাক্লিয়াসের অবস্থানস্থল এমেসার সদরদপ্তরের যোগাযোগের পথ বন্ধ হয়ে যায়।[117]

সিরিয়া আক্রমণের সময় খালিদের উচ্চশ্রেণির হালকা অশ্বারোহী মোবাইল গার্ড বাহিনী মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনীর মূল হিসেবে কাজ করেছে। এতে উচ্চ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ সৈনিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের অধিকাংশ খালিদের আরব ও পারস্য অভিযানের সময় সরাসরি তার অধীনে লড়াই করেছে।[118] মুসলিম অশ্বারোহীরা ছিল হালকা অশ্বারোহী বাহিনী এবং তারা ৫ মিটার দীর্ঘ বল্লম ব্যবহার করত। তারা অকল্পনীয় গতিতে এবং সাধারণত কার ওয়া ফার কৌশলে (আধুনিক "হিট এন্ড রান") আক্রমণ করত। তারা প্রতিপক্ষ দলের পার্শ্বভাগ ও পশ্চাৎভাগেও আক্রমণ করত। তাদের রণকৌশলের কারণে বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় ভারী অশ্বারোহীদের বিরুদ্ধে তারা খুবই কার্যকরভাবে আঘাত হানতে সক্ষম হয়।[109] ইয়ারমুকের যুদ্ধের চূড়ান্ত দিনে পার্শ্বভাগের আক্রমণের মাধ্যমে আরোহী সেনাদলের সক্ষমতা ব্যবহারে তার নৈপুণ্য ফুটে উঠেছে।

রোমান ও পার্সিয়ানরা প্রতিপক্ষ আরবদের তুলনায় অনেক ভারি বর্মে সজ্জিত থাকত ফলে লড়াইয়ের তারা সহজে আক্রমণযোগ্য হয়ে উঠে এবং প্রতিপক্ষের তীরন্দাজদের সহজ শিকারে পরিণত হয়।[108] যুদ্ধের সময় তিনি গুপ্তচরদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং এজন্য স্থানীয় লোকজনকে নিয়োগ দিতেন। ইতিহাসবিদ আল-তাবারি বলেন :

তিনি (খালিদ) নিজে ঘুমান নি এবং অন্যদের ঘুমাতে দেন নি; তার কাছ থেকে কিছু গোপন করা যেত না।[119]

আল-তাবারি, তারিখুল রসুল ওয়াল মুলুক

রাজনৈতিক

খালিদ ৬৩২-৬৩৩ সাল পর্যন্ত ইরাকের সামরিক গভর্নর ছিলেন এছাড়াও তিনি উত্তর সিরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সেনাছাউনি চেলসিসেরও গভর্নর হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন।

ধর্মীয় মর্যাদা

খালিদ বিন ওয়ালিদ একজন সাহাবী ছিলেন। এ কারণে সুন্নি মুসলিমদের কাছে তিনি খুবই সম্মানিত। মুতার যুদ্ধে বিজয়ের পর মুহাম্মাদ (সা.) তাকে “আল্লাহর তলোয়ার” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।[120][121][122]

শিয়ারা খালিদকে সম্মানিত মনে করে না। শিয়া মতানুযায়ী আলির অনুসারীদের দমনের জন্য খলিফা আবু বকরকে খালিদ সহায়তা করেছিলেন।[123]

বিভিন্ন মাধ্যমে উপস্থাপন

  • ইসলামের প্রথম যুগের উপর নির্মিত উমর সিরিজে খালিদ বিন ওয়ালিদের ভূমিকায় সিরিয়ান অভিনেতা মেহয়ার খাদ্দাওর অভিনয় করেছেন। এই সিরিজে খালিদের চরিত্রটি অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিল।
  • ২০০৬-২০০৭ সালের সিরিয়ান টিভি ধারাবাহিক খালিদ বিন ওয়ালিদ-এ বাসসেম ইয়াখুর খালিদ বিন ওয়ালিদের চরিত্রে অভিনয় করেন।
  • সিভিলাইজেশন ৫ এবং সিভিলাইজেশন ৪ গেমের বর্ধিত অংশে খালিদকে একজন সেনাপতি হিসেবে দেখানো হয়েছে।
  • পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মূল যুদ্ধট্যাঙ্ক আল-খালিদ তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
  • পাকিস্তান নৌ বাহিনীর আগস্টা ৯০বি ক্লাস সাবমেরিন পিএনএস/এম খালিদ (এস১৩৭)।
  • বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ফ্রিগেট বিএনএস খালিদ ইবনে ওয়ালিদ তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
  • কাজী নজরুল ইসলাম "খালিদ" নামে একটি কবিতা লিখেছেন। এতে তিনি খালিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং স্বদেশবাসীর পরাধীনতার কারণে দুঃখ প্রকাশ করেন।
  • উপসাগরীয় যুদ্ধে অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রেরিত সেনাদলের নাম ছিল "খালিদ বিন ওয়ালিদ ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মর্ড ব্রিগেড গ্রুপ"।

পরিবার

খালিদের পিতা ওয়ালিদ কয়েকটি বিয়ে করেছিলেন বলে জানা যায় এবং তার বেশ কয়েকজন সন্তান ছিল। তবে অল্পকয়েকজনের নাম জানা যায়।

ওয়ালিদের পুত্র : (খালিদের ভাই)
  • হিশাম ইবনে ওয়ালিদ
  • ওয়ালিদ ইবনে ওয়ালিদ
  • আম্মারাহ ইবনে ওয়ালিদ
  • আবদুল শামস ইবনে ওয়ালিদ।[6]
ওয়ালিদের কন্যা : (খালিদের বোন)
  • ফাখতাহ বিনতে ওয়ালিদ
  • ফাতিমা বিনতে ওয়ালিদ।[6]
  • নাজিয়াহ বিনতে ওয়ালিদ(বিতর্কিত).

খালিদের কয়জন সন্তান ছিল তা সঠিক জানা যায় না। তবে তিনজন পুত্র ও একজন অজ্ঞাতনামা কন্যার কথা জানা যায় :

  • সুলাইমান বিন খালিদ
  • আবদুর রহমান ইবনে খালিদ
  • মুহাজির বিন খালিদ।[124]

খালিদের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলাইমান ইবনে খালিদ মুসলিমদের মিশর বিজয়ের সময় নিহত হন।[124] তবে অন্য কিছু সূত্র অনুযায়ী ৬৩৯ সালে দারবাকিরে মুসলিম অবরোধের সময় তিনি নিহত হন।[125] মুহাজির বিন খালিদ সিফফিনের যুদ্ধে খলিফা আলির পক্ষে লড়াই করার সময় নিহত হন। আবদুর রহমান ইবনে খালিদ তৃতীয় খলিফা উসমানের শাসনামলে এমেসার গভর্নর ছিলেন। তিনি সিফফিনের যুদ্ধে মুয়াবিয়ার অন্যতম সেনাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে ৬৬৪ সালে কনস্টান্টিনোপলে অবরোধের সময় তিনি উমাইয়া সেনাবাহিনীতে ছিলেন।

আরও দেখুন

  • বিষয়শ্রেণী :খালিদ বিন ওয়ালিদের যুদ্ধ
  • বিখ্যাত আরবদের তালিকা
  • সাহাবী

তথ্যসূত্র

  1. Khalid ibn al-Walid, Encyclopædia Britannica Online. Retrieved. 17 October 2006.
  2. Akram 2004, পৃ. 496
  3. Akram 2004, পৃ. 499
  4. Akram 2004, পৃ. 2
  5. Muhammad ibn Saad, Tabaqat vol. 8. Translated by Bewley, A. (1995). The Women of Madina pp. 195-196. London: Ta-Ha Publishers.
  6. Akram 2004, পৃ. 3
  7. Akram 2004, পৃ. 5
  8. Akram 2004, পৃ. 4
  9. Akram 2004, পৃ. 9
  10. Akram 2004, পৃ. 14
  11. Weston 2008, পৃ. 41
  12. Akram 2004, পৃ. 70
  13. Al-Waqidi 8th century, পৃ. 321
  14. Nicolle 2009, পৃ. 22
  15. Akram 2004, পৃ. 80
  16. Akram 2004, পৃ. 90
  17. Al-Waqidi 8th century, পৃ. 322
  18. Ibn Hisham 9th century, পৃ. 382
  19. Akram 2004, পৃ. 128
  20. "List of Battles of Muhammad"। Military.hawarey.org। ২০০৫-১০-২৮। ২০১১-০৬-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-০৮-২৮
  21. The sealed nectar, By S.R. Al-Mubarakpuri, Pg256। Books.google.co.uk। 2002-01। সংগ্রহের তারিখ 2011-08-28 এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  22. ""He sent Khalid bin Al-Waleed in Ramadan 8 A.H", Witness-Pioneer.com"। Witness-pioneer.org। ২০০২-০৯-১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-০৮-২৮
  23. The life of Mahomet and history of Islam, Volume 4, By Sir William Muir, Pg 135। Books.google.co.uk। ১৮৬১। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-০৮-২৮
  24. Ibn Ishaq, Sirat Rasul Allah (Life of Muhammad), trans. Guillaume, Oxford 1955, pp. 561–562
  25. al-Tabari, Victory of Islam, trans. Fishbein, Albany 1997, pp. 188 ff.
  26. In the Footsteps of the Prophet:Lessons from the Life of Muhammad, By Tariq Ramadan Page 179
  27. Tafsir Ibn Kathir all 10 volumes By IslamKotob Page
  28. The Meaning And Explanation Of The Glorious Qur’an (Vol 2) 2nd Edition By Muhammad Saed Abdul-Rahman Page 241
  29. Abu Khalil, Shawqi (১ মার্চ ২০০৪)। Atlas of the Prophet's biography: places, nations, landmarks। Dar-us-Salam। পৃষ্ঠা 239। আইএসবিএন 978-9960-897-71-4।
  30. Abū Khalīl, Shawqī (২০০৩)। Atlas of the Quran। Dar-us-Salam। পৃষ্ঠা 244। আইএসবিএন 978-9960-897-54-7।
  31. Rahman al-Mubarakpuri, Saifur (২০০৫), The Sealed Nectar, Darussalam Publications, পৃষ্ঠা 277
  32. Muir, William (১০ আগস্ট ২০০৩)। Life of Mahomet। Kessinger Publishing Co। পৃষ্ঠা 458। আইএসবিএন 978-0-7661-7741-3। A full online version of it is available here
  33. Muir, William (১০ আগস্ট ২০০৩)। Life of Mahomet। Kessinger Publishing Co। পৃষ্ঠা 458। আইএসবিএন 978-0-7661-7741-3।
  34. Nicolle 2009, পৃ. 25
  35. Akram 2004, পৃ. 167
  36. Walton 2003, পৃ. 17
  37. Akram 2004, পৃ. 178
  38. Al-Tabari 915, পৃ. 501–502
  39. Al-Tabari 915, পৃ. 496
  40. Al-Tabari 915, পৃ. 502
  41. Tabari: Vol. 2, Page no: 5
  42. (A Restatement of the History of Islam and Muslims, Ali Razwy, Chapter 55)
  43. Akram 2004, পৃ. 183
  44. Morony 2005, পৃ. 223
  45. History of the World, Volume IV [Book XII. The Mohammedan Ascendency], page 463, by John Clark Ridpath, LL.D. 1910.
  46. Morony 2005, পৃ. 224
  47. Morony 2005, পৃ. 233
  48. Morony 2005, পৃ. 192
  49. Jaques 2007, পৃ. 18
  50. Akram 2004, পৃ. 217
  51. Morony 2005, পৃ. 225
  52. Morony 2005, পৃ. 230
  53. Morony 2005, পৃ. 149
  54. Allenby 2003, পৃ. 68
  55. Gil 1997, পৃ. 40
  56. Akram 2004, পৃ. 267
  57. Gil 1997, পৃ. 41
  58. Akram 2004, পৃ. 270
  59. Jaques 2007, পৃ. 155
  60. Jaques 2007, পৃ. 20
  61. Nicolle 1994, পৃ. 58
  62. Jaques 2007, পৃ. 636
  63. Nicolle 1994, পৃ. 57
  64. Nicolle 1994, পৃ. 59
  65. Allenby 2003, পৃ. 70
  66. Walton 2003, পৃ. 28
  67. Al-Waqidi 8th century, পৃ. 62
  68. Akram 2004, পৃ. 305
  69. Nicolle 1994, পৃ. 52
  70. Allenby 2003, পৃ. 71
  71. Akram 2004, পৃ. 319
  72. Akram 2004, পৃ. 323
  73. Allenby 2003, পৃ. 72
  74. Akram 2004, পৃ. 338
  75. Akram 2004, পৃ. 345
  76. Akram 2004, পৃ. 389
  77. Akram 2004, পৃ. 409
  78. Gil 1997, পৃ. 45
  79. Weston 2008, পৃ. 50
  80. Nicolle 1994, পৃ. 63
  81. Walton 2003, পৃ. 29
  82. Walton 2003, পৃ. 30
  83. Gil 1997, পৃ. 51
  84. Jaques 2007, পৃ. 491
  85. Nicolle 1994, পৃ. 84
  86. Akram 2004, পৃ. 429
  87. Al-Tabari 915, পৃ. 98
  88. Jaques 2007, পৃ. 28
  89. Akram 2004, পৃ. 445
  90. Haykal 1990, পৃ. 145
  91. Akram 2004, পৃ. 448
  92. Akram 2004, পৃ. 451
  93. Haykal 1990, পৃ. 144
  94. Akram 2004, পৃ. 453
  95. Haykal 1990, পৃ. 146
  96. Haykal 1990, পৃ. 146–47
  97. Haykal 1990, পৃ. 152
  98. Weston 2008, পৃ. 43
  99. Gil 1997, পৃ. 49
  100. Akram 2004, পৃ. 481
  101. Weston 2008, পৃ. 45
  102. Akram 2004, পৃ. 482
  103. Gil 1997, পৃ. 50
  104. Akram 2004, পৃ. 493
  105. Akram 2004, পৃ. 501
  106. Akram 2004, পৃ. 494
  107. Ibn Qutaybah 9th century, পৃ. 267
  108. Pratt 2000, পৃ. 82
  109. Pratt 2000, পৃ. 83
  110. Akram 2004, পৃ. 230
  111. Nicolle 2009, পৃ. 8
  112. Walton 2003, পৃ. 19
  113. Harkavy 2001, পৃ. 166
  114. Malik 1968, পৃ. 39
  115. Akram, c. 30, p. 17.
  116. Malik 1968, পৃ. 87
  117. Malik 1968, পৃ. 89
  118. Malik 1968, পৃ. 90
  119. Malik 1968, পৃ. 118
  120. Bukhari: Military Expeditions led by Mohammed (Al-Maghaazi), which states "Narrated Anas: The Prophet had informed the people of the martyrdom of Zaid, Ja'far and Ibn Rawaha before the news of their death reached. The Prophet said, "Zaid took the flag (as the commander of the army) and was martyred, then Ja'far took it and was martyred, and then Ibn Rawaha took it and was martyred." At that time the Prophet's eyes were shedding tears. He added, "Then the flag was taken by a Sword amongst the Swords of Allah (i.e. Khalid) and Allah made them (i.e. the Muslims) victorious."
  121. Piercing the Fog of War: Recognizing Change on the Battlefield: Lessons from Military History, 216 BC Through Today, by Brian L. Steed, p.144
  122. Badass, by Ben Thompson, p.87
  123. Al-Tabari 915, পৃ. 186–87
  124. Akram 2004, পৃ. 497
  125. Ring and Salkin, 1996, p.193.

গ্রন্থপঞ্জি

প্রাথমিক উৎস

  • Al-Baladhuri, Ahmad ibn Yahya (9th century), Kitab Futuh al-Buldan এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  • Al-Tabari, Muhammad ibn Jarir al-Tabari (৯১৫), History of the Prophets and Kings
  • Al-Waqidi, Abu Abdullah Muhammad Ibn Umar (8th century), Fatuh al Sham (Conquest of Syria) এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  • Dionysius Telmaharensis (৭৭৪), Chronicle of Pseudo-Dionysius of Tell-Mahre
  • Ibn Hisham, Abd al-Malik bin Hisham (9th century), As-Sirah an-Nabawiyyah (Biography of Prophet Muhammad) এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  • Ibn Ishaq (৭৫০), Sirah Rasul Allah
  • Ibn Qutaybah, Abdullaah bin Muslim (9th century), ‘Uyūn al-Akhbār (In history) এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  • The Maronite Chronicles, ৬৬৪
  • Palmer, Andrew; Brock, Sebastian P; Hoyland, Robert (637 & 819), "Chronicles of 637 and 819", West-Syrian Chronicles, আইএসবিএন 9780853232384 এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  • Khalid Bin Waleed, Sword of Allah, ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০১৬

দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎস

  • Akram, Agha Ibrahim (২০০৪), The Sword of Allah: Khalid bin al-Waleed – His Life and Campaigns, Oxford University Press, আইএসবিএন 0-19-597714-9
  • Allenby, Viscount (২০০৩), Conquerors of Palestine Through Forty Centuries, Kessinger Publishing, আইএসবিএন 0-7661-3984-0
  • Eggenberger, David (১৯৮৫), An encyclopedia of battles: accounts of over 1,560 battles from 1479 B.C. to the present, Courier Dover Publications, আইএসবিএন 0-486-24913-1
  • Haykal, Muḥammad Ḥusayn (১৯৯০), Al-Faruq, 'Umar, Dār al-Maʻārif Publishers, আইএসবিএন 977-02-3092-8
  • Gil, Moshe (১৯৯৭), A history of Palestine, 634–1099, Cambridge University Press, আইএসবিএন 0-521-59984-9
  • Harkavy, Robert E (২০০১), Warfare and the Third World, Palgrave Macmillan, আইএসবিএন 0-312-24012-0
  • Hoyland, Robert G. (১৯৯৭), Seeing Islam as Others Saw It, Darwin Press, আইএসবিএন 0-87850-125-8, ওসিএলসি 36884186
  • Jaques, Tony (২০০৭), Dictionary of Battles and Sieges: A-E, Greenwood Publishing Group, আইএসবিএন 0-313-33537-0
  • Jaques, Tony (২০০৭), Dictionary of Battles and Sieges:F-O, Greenwood Publishing Group, আইএসবিএন 0-313-33538-9
  • Jandora, John W. (১৯৮৬), "Developments in Islamic Warfare: The Early Conquests", Studia Islamica, Maisonneuve & Larose (64): 101–113, জেস্টোর 1596048
  • Kaegi, Walter Emil (১৯৯৫), Byzantium and the Early Islamic Conquests, Cambridge University Press, আইএসবিএন 0-521-48455-3
  • Malik, S. K. (১৯৬৮), Khalid bin Walid: the general of Islam: a study in Khalid's generalship, Ferozsons publishers, Lahore
  • Morony, Michael G. (২০০৫), Iraq After the Muslim Conquest, Gorgias Press LLC, আইএসবিএন 1-59333-315-3
  • Nicolle, David (১৯৯৪), Yarmuk 636 A.D.: The Muslim Conquest of Syria #31, Osprey Publishing, আইএসবিএন 1-85532-414-8
  • Nicolle, David (২০০৯), The Great Islamic Conquests AD 632–750, Osprey Publishing, আইএসবিএন 1-84603-273-3
  • Palmer, Andrew (১৯৯৩), The Seventh Century in the West-Syrian Chronicles, Liverpool University Press, আইএসবিএন 0-85323-238-5
  • Pratt, Fletcher (২০০০), The Battles That Changed History, Courier Dover Publications, আইএসবিএন 0-486-41129-X
  • Ring, Trudy; Salkin, Robert M. (১৯৯৪)। International Dictionary of Historic Places। Taylor & Francis। আইএসবিএন 1-884964-03-6।
  • Walton, Mark W. (২০০৩), Islam at war: a history, Greenwood Publishing Group, আইএসবিএন 0-275-98101-0
  • Weston, Mark (২০০৮), Prophets and Princes: Saudi Arabia from Muhammad to the Present, John Wiley and Sons, আইএসবিএন 0-470-18257-1

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.