জাতীয় রক্ষীবাহিনী
জাতীয় রক্ষীবাহিনী একটি নিয়মিত আধা-সামরিক বাহিনী যা নবপ্রতিষ্ঠ বাংলাদেশে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে রক্ষীবাহিনী আইন ১৯৭২ দ্বারা গঠন করা হয়।[2] শুরুতে মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এই বাহিনীর পত্তন করা হয়। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে এই বাহিনীর সদরদপ্তর স্থাপন করা হয়। ক্যাপ্টেন এ. এন. এম. নূরুজ্জামানকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান করা হয়। আনুষ্ঠানিক নাম জাতীয় রক্ষীবাহিনী হলেও সাধারণত এই বাহিনীকে ‘রক্ষীবাহিনী’ বা সংক্ষেপে জেআরবি (JRB) বলে অভিহিত হতো।
জাতীয় রক্ষী বাহিনী | |
---|---|
সক্রিয় | ৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ - ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ |
দেশ | ![]() |
আনুগত্য | বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ |
ধরন | রাজনৈতিক সৈন্যবাহিনী |
ভূমিকা | বিদ্রোহ দমন, সন্ত্রাসবাদ দমন,[1] সাম্যবাদ বিরোধী, রাজনৈতিক প্রয়োগকারী |
আকার | ২,০০০ নিয়োগপ্রাপ্তসহ প্রায় ৮,০০০ জন |
সদর দপ্তর | শের-ই-বাংলা নগর, ঢাকা |
ডাকনাম | রক্ষীবাহিনী |
পৃষ্ঠপোষক | শেখ মুজিবুর রহমান |
মাস্কট | শেখ মুজিবুর রহমানের তর্জনী |
বিযুক্ত | আগস্ট, ১৯৭৫ |
প্রাথমিকভাবে বিদ্রোহ দমন এবং আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য গঠিত হয়।[2] পরে এই বাহিনী রাজনৈতিক হত্যাসহ মানবাধিকার অপব্যবহারের অসংখ্য অভিযোগে যেমন[3][4][5]গুম,[6] গোলাগুলি,[7] এবং ধর্ষণ.[5] সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। এটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সশস্ত্র শাখা হিসেবে দেখা যায়[8] এবং এটি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে।[9]
এই বাহনী অনেক শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিক যেমন, গোলাম মুরশিদ কে নিন্দা করে কারণ তিনি এই বাহিনীকে গেস্টাপোর সাথে তুলনা করেছিলেন।[10]। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলেছিলেন যে এটার ধোঁকা নাৎসির বাদামি শার্টের থেকে ধোঁকা সামান্য আলাদা।[11] হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে যে, জাতীয় রক্ষী বাহিনী কর্তৃক সংঘবদ্ধ সংস্থাগত সহিংসতা দায়মুক্তির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার সাহায্যে স্বাধীন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী মানবাধিকারের অপব্যবহার অব্যাহত রেখেছে।[3] আওয়ামী লীগ ধারাভাষ্যকাররা এই অভিযোগ খারিজ করে দেয়।[12][13]
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই বাহিনী অবলুপ্ত করা হয়। অবলুপ্ত হওয়ার পর রক্ষীবাহিনীর অনেক সদস্য নিয়মিত সামরিক বাহিনীতে আত্মীকৃত হন। [14][15]
ইতিহাস
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম চরম লক্ষ্যে পৌঁছায় এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। কয়েক দিন পর ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বাহিনী ও ভূতপূর্ব ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সদস্যদের নিয়ে একটি জাতীয় মিলিশিয়া গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই লক্ষ্যে একটি জাতীয় মিলিশিয়া বোর্ডও গঠন করা হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সহ রাজনৈতিক নেতারা এই বোর্ডের সদস্য ছিলেন। অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তনের পর ২৪ জানুয়ারি তারিখে এই ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার একটি আদেশ জারি করে। মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার এ. এন. এম. নূরুজ্জামানকে জাতীয় মিলিশিয়ার পরিচালক নির্বাচন করা হয়। এই মিলিশিয়ার গোড়াপত্তনকালে পিলখানা গোলযোগ এর কারণে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদস্যদের বাদ দিয়ে বিশেষ বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই অবস্থায় ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ তারিখে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনের সরকারি আদেশ জারি করা হয়। এ. এন. এম. নূরুজ্জামানকে এই বাহিনীর পরিচালক নিয়োগ করা হয়।এছাড়া সহকারী পরিচালক হিসেবে আনোয়ারুল আলম এবং সরোয়ার হোসেন মোল্লাকে নিযুক্ত করা হয়।
কাঠামো
রক্ষীয়বাহিনীর অধিনায়কদের “লিডার” পদবীতে আখ্যায়িত করা হতো।
দায়িত্ব ও কার্যকলাপ
গোড়ার দিকে রক্ষীবাহিনী বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অনেক অস্ত্রশস্ত্র, চোরাচালানের মালামাল উদ্ধার করে এবং মজুতদার ও কালোবাজারীদের কার্যকলাপ কিছুটা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু খুব শীঘ্রই বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হতে থাকে, কারণ দেখা যায় এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে পাশাপাশি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড[3][4] [5] গুম,[16] গোলাগুলি,[17] এবং ধর্ষণ.[5] সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। ঝটিকা বাহিনীর মতো রক্ষীবাহিনী প্রায়ই একেকটি গ্রামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং অস্ত্র ও দুষ্কৃতিকারীদের খুঁজত। তাদের যথেচ্ছাচার নিয়ন্ত্রণ বা তাদের কার্যকলাপের জবাবদিহিতার আইনগত কোন ব্যবস্থা ছিল না। অপরাধ স্বীকার করানোর জন্য গ্রেফতারকৃত লোকদের প্রতি অত্যাচারের অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়। তাদের বিরুদ্ধে লুটপাট এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও ছিল। তাদের কার্যকলাপের সমালোচনা যখন তুঙ্গে ওঠে এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে, তখন ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-১৯৭৩ জারি করে রক্ষীবাহিনীর সকল কার্যকলাপ আইনসঙ্গত বলে ঘোষণা করে। রক্ষীবাহিনীর কোন সদস্য সরল বিশ্বাসে কোন কাজ করলে অথবা সৎ উদ্দেশ্যে উক্ত কাজ করে থাকলে অনুরূপ কাজের জন্য তার বিরুদ্ধে বিচারের জন্য কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে না বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। বাহিনীটির কাঠামোগত দুর্বলতার জন্য এবং জনগণের দৃষ্টিতে এর ভাবমূর্তি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকলে অনেক রক্ষী বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে যায়। বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার মূল আদেশে আরেকটি সংশোধনী (জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ১৯৭৫) জারি করে। এর মাধ্যমে বহুসংখ্যক গুরু ও লঘু অপরাধের উল্লেখ করা হয়, যার জন্য অফিসার ও রক্ষীদের বিশেষ আদালত ও সংক্ষিপ্ত আদালতে বিচার করা যাবে।
সমালোচনা
রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে সমালোচনার অভাব নেই। তারা জনসাধারণকে গুম, খুন সহ বিভিন্ন কায়দায় অত্যাচার করেছে। নিজেদের মতবাদ চাপিয়ে দিতে এমন কোন অপকর্ম নেই যা রক্ষীবাহিনী করেনি।
অবলুপ্তি
১৯৭৫ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব নিহত হন। এতে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পটভূমিতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। এই অভ্যুত্থানের পরবর্তী কয়েক মাস ছিল অস্থিতিশীল এবং নাটকীয় পরিবর্তনে ভরপুর। এ রকম একটি জায়মান অবস্থায় নতুন সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে অবলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত সামরিক বাহিনীতে আত্মীকরণ করা হয়। এই অবলুপ্তির লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ৯ অক্টোবর তারিখে সরকারি আদেশ প্রকাশ করা হয়। এই আদেশে বলা ছিল যে ১৯৭৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় রক্ষীবাহিনী অবলুপ্ত হয়েছে বলে গণ্য হবে [18]।রক্ষীবাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত শতাধিক অফিসার কর্নেল, জেনারেল পর্যন্ত চাকরি করে মেয়াদ শেষকরে অবসরে যায়। দুজন সেনা প্রধান পর্যন্ত হয়েছিলেন, এখনো অনেকেই সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে ব্রিগেডিয়ার, জেনারেল পদমর্যাদা সম্পন্ন দেখা যায়।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় সামরিক অভ্যুত্থানে রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ।
তথ্যসূত্র
- History of Bangladesh ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৬ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে, Banglapedia
- Bangladesh; Hossain, Hamza (১৯৭৪)। Jatiya Rakkhi Bahini Act (ইংরেজি ভাষায়)। Khoshroz Kitab Mahal।
- "Ignoring Executions and Torture : Impunity for Bangladesh's Security Forces" (PDF)। Human Rights Watch। ২০০৯-০৩-১৮। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৮-১৬।
- রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। Amar Desh। ১৬ জানুয়ারি ২০১১। ১৭ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- Fair, Christine C.; Riaz, Ali (২০১০)। Political Islam and Governance in Bangladesh। Routledge। পৃষ্ঠা 30–31। আইএসবিএন 1136926240। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুন ২০১৬।
- Ahmed, Moudud (২০১৫) [First published 1983]। Bangladesh, Era of Sheikh Mujibur Rahman। Dhaka: The University Press Limited। পৃষ্ঠা 69। আইএসবিএন 978-984-506-226-8।
- Chowdhury, Atif (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)। "Bangladesh: Baptism By Fire"। Huffington Post। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুন ২০১৬।
- Ahamed, Emajuddin (২০০৪)। The military and democracy in Bangladesh (PDF)। Sydney: Australian National University Press। পৃষ্ঠা 108–110।
- Pike, Francis. (২০১০)। Empires at war : a short history of modern Asia since World War II। London: I.B. Tauris। আইএসবিএন 978-1-4416-5744-2। ওসিএলসি 656823453।
- মুরশিদ, গোলাম (২০১০)। মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস। Ḍhākā: Prathamā Prakāśana। আইএসবিএন 978-984-8765-37-1। ওসিএলসি 693213189।
- মাসকারেনহাস, অ্যান্থনি (১৯৮৬)। Bangladesh : a legacy of blood। London: Hodder and Stoughton। আইএসবিএন 0-340-39420-X। ওসিএলসি 16583315।
- "Myth, reality and Rakkhi Bahini"। The Daily Star (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৪-০১-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-০৩।
- আলম, আনোয়ার উল (২০১৩)। রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা। Ḍhākā। আইএসবিএন 978-984-90253-9-9। ওসিএলসি 858611124।
- আনোয়ার-উল আলম: রক্ষবিাহিনীর সত্য-মিথ্যা, প্রথমা প্রকাশণী, ঢাকা, ২০১৩
- মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব:) বীরবিক্রম : এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০০ খ্রি. পৃষ্ঠা: ৩৬-৩৭
- Ahmed, Moudud (২০১৫) [First published 1983]। Bangladesh, Era of Sheikh Mujibur Rahman। Dhaka: The University Press Limited। পৃষ্ঠা 69। আইএসবিএন 978-984-506-226-8।
- Chowdhury, Atif (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)। "Bangladesh: Baptism By Fire"। Huffington Post। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুন ২০১৬।
- Bangladesh Gazette, 9th October 1975: "The Jatiyo Rakkhi (Absorption in the Army) Ordinance , 1975.