হিন্দুধর্মে গৌতম বুদ্ধ

হিন্দুধর্মের বৈষ্ণব সম্প্রদায়গুলি গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার মনে করে। বৈষ্ণবমতের দশ জন অবতারের মধ্যে বুদ্ধকে নবম অবতার বলে মনে করা হয়।[1][2] যদিও বুদ্ধ নিজের ঈশ্বরত্ব বা অবতারত্ব অস্বীকার করেছিলেন।[3] বুদ্ধ বেদ অস্বীকার করেছিলেন।[4] রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ বৌদ্ধধর্মকে নাস্তিক দর্শন মনে করে।[5]

বিষ্ণুর অবতার রূপে বুদ্ধ দ্বারকা তিরুমালা মন্দির, অন্ধ্র প্রদেশ.

হিন্দুধর্মে বুদ্ধকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ধ্যান ধারণা পরিলক্ষিত হয়। কোন কোন ধর্মগ্রন্থ, যেমন পুরাণে বুদ্ধকে অবতার হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেখানে যারা বৈদিক জ্ঞানকে অস্বীকার করেন তাদেরকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাবার জন্য বুদ্ধের জন্ম হয় বলে বলা হয়েছে।[2][6][note 1] অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ যেমন, বৈষ্ণব কবী জয়দেবের রচিত ত্রয়োদশ শতকের গীতগোবিন্দতে বলা হয়েছে, প্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ করার জন্য বিষ্ণু বুদ্ধ হয়ে জন্মলাভ করেছিলেন।[1] সমকালীন হিন্দুধর্ম আলোচনায় কনস্ট্যান্স জোনস এবং জেমস ডি রায়ান বলেন, যেসব হিন্দু "বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের আরেকটি আকার" বলে বিবেচনা করতেন তারাই বুদ্ধকে ঈশ্বরের স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন।[6]

পুরাণে উল্লেখ

প্রধান পুরাণগুলি সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিন্দুশাস্ত্রে বুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায়। মনে করা হয়, ‘সব কটি বইতে একই ব্যক্তির কথা বলা হয়নি: কোনো কোনো বইতে অন্য কোনো ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, আবার কোনো বইতে কোনো “বুদ্ধিমান” ব্যক্তিকে বুদ্ধ বলা হয়েছে।’ যদিও অধিকাংশই বিশেষভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতার কথাই বলেছে।[8] পুরাণ ও অন্যান্য শাস্ত্রে বুদ্ধের দুটি অবদানের কথা বলেছে। এগুলি হল: ধর্মসংস্থাপনের জন্য নাস্তিক্যবাদী বেদমতের প্রচার এবং পশুবলির সমালোচনা।[9] যেসব প্রধান পুরাণে বুদ্ধের উল্লেখ আছে সেগুলি হল:

পৌরাণিক সাহিত্যে বুদ্ধকে সাধারণত বিষ্ণুর নবম অবতার বলা হয়েছে।

ঋষি পরাশর রচিত বৃহৎ পরাশর হোরা শাস্ত্র আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ যেখানে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলা হয়েছে।

হিন্দুশাস্ত্রে বুদ্ধকে যোগী বা যোগাচার্য এবং সন্ন্যাসী বলা হয়েছে। কোনো কোনো বইতে তাঁর বাবার নাম শুদ্ধোধন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি বৌদ্ধশাস্ত্রসম্মত মত। আবার কোনো কোনো বইতে তাঁর বাবার নাম অঞ্জন বা জিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর বর্ণনায় তাঁকে সুদর্শন (‘দেবসুন্দররূপ’), হলুদ গায়ের রং-বিশিষ্ট এবং গৈরিক বা রক্তবস্ত্রধারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[12]

কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থে বুদ্ধের পূজার উল্লেখ আছে। যেমন বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে সৌন্দর্যকামনায় বুদ্ধের পূজা করতে হয়।[13]

কোনো কোনো পুরাণে বলা হয়েছে, তিনি দৈত্যদের বিভ্রান্ত করতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন:

মোহনার্থং দানবানাং বালরূপীপথিস্থিতঃ।
পুত্রং কল্পয়াং আস মূঢ়-বুদ্ধির্জিনাঃ স্বয়ম্‌।।
তথাঃ সম্মোহয়ং আস জিনায়াং অসুরাংশকান।
ভগবান বাগভিরুগ্রভির অহিংসা-আচিভির হরিঃ।। (ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ)[14]
অনুবাদ: দৈত্যদের মোহিত করতে তিনি [বুদ্ধ] পথে শিশুর বেশে দাঁড়ালেন। মূর্খ জিন (দৈত্য) তাঁকে নিজের সন্তান মনে করল। এইভাবে শ্রীহরি [বুদ্ধ-অবতার রূপে] সুচারুভাবে অহিংসার বাণীর দ্বারা সাঙ্গোপাঙ্গোসহ জিনকে সম্মোহিত করলেন।

ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে বুদ্ধ দেবগণকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন:

তথাঃ কলাসু সম্প্রব্রত্তে সম্মোহায় সুরাদ্বিষাম্‌।

বুদ্ধো নামনাঞ্জন-সুতঃ কীকতেষু ভবিষ্যতি।।
ভাগবত পুরাণ, ১। ৩। ২৪
অনুবাদ: তারপর কলিযুগের শুরুতে দেবগণের শত্রুদের সম্মোহিত করতে, [তিনি] অঞ্জনের পুত্র রূপে বুদ্ধ নামে কীকতদের মধ্যে জন্ম নিলেন।[4]

অনেক পুরাণে বলা হয়েছে, বিষ্ণু বুদ্ধ অবতারে দৈত্য বা মানবজাতিকে বৈদিক ধর্মে দীক্ষিত করতে এসেছিলেন। ভবিষ্য পুরাণে বলা হয়েছে:

এই সময়, কলি যুগে, বিষ্ণু শাক্যমুনি গৌতম রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তিনি দশ বছর বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা দিলেন। তারপর শুদ্ধোধন কুড়ি বছর রাজত্ব করলেন। তারপর শাক্যসিংহ কুড়ি বছর রাজত্ব করলেন। কলি যুগের প্রথম দিকে সকল বৈদিক পথ ধ্বংস হয়েছিল এবং সবাই বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাঁরা বিষ্ণুর পায়ে আশ্রয় চেয়েছিলেন তাঁরা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।[15]

বুদ্ধ এবং হিন্দুধর্মের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া

সোমনাথপুরের চেন্নাকেশভ মন্দিরে বিষ্ণুরূপে বুদ্ধ
বিষ্ণুর অবতার রূপে বুদ্ধ পারসিক-রচনাশৈলীর চিত্র

সমকালীন হিন্দুধর্মের আলোচনায় কনস্ট্যান্স জোনস, এবং জেমস ডি. রায়ান এর মতে যারা বুদ্ধকে হিন্দুধর্মের আরেকটি রূপ বলে মনে করেন[6] তারাই বুদ্ধের পূজা করেন বা অবতার হিসেবে মেনে ঈশ্বরের স্থানে অধিষ্ঠিত করেন। যদিও, কয়েক শত বছরের পুরনো আঞ্চলিক ধর্মগ্রন্থগুলোতে বৌদ্ধধর্ম নিয়ে অনেক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, আর এগুলো বৌদ্ধ ও হিন্দু সন্ন্যাসীদের মধ্যকার প্রতিযোগিতারই প্রতিফলন ঘটায়।[6] ত্রয়োদশ শতকের পূর্বের কোন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে দেখানো হয়েছে বুদ্ধ অসুরদের ভুল পথে চালিত করার জন্য জন্ম নিয়েছিলেন যাতে তারা জীবহত্যা বন্ধ করে।[1] চতুর্দশ শতকের পূর্বের কোন হিন্দু মন্দিরে দেখা যায় যে, বুদ্ধ বিষ্ণুর অন্যান্য অবতারদের সাথে পূজিত হচ্ছেন।[16] ভারতের সাম্প্রতিক এবং সমকালীন হিন্দুধর্ম অনুসারে, বুদ্ধকে একটি পবিত্র সত্তা হিসেবে পূজা করা হয় যিনি এক সময় জাগ্রত ছিলেন।[6] ভারতের বাইরে কোন কোন সমকালীন হিন্দু উৎসবগুলোতে বুদ্ধকে তাদের অন্যান্য দেবতাদের সাথে পূজা করে থাকেন।[17]

পাদটীকা

  1. James G. Lochtefeld (২০০২)। The Illustrated Encyclopedia of Hinduism: A-M। The Rosen Publishing Group। পৃষ্ঠা 73, 128। আইএসবিএন 978-0-8239-3179-8।
  2. John Clifford Holt (২০০৮)। The Buddhist Viṣṇu: Religious Transformation, Politics, and Culture। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 18–21। আইএসবিএন 978-81-208-3269-5।
  3. "Bhagavata Purana 1.3.24"। Srimadbhagavatam.com। ২০০৭-০৯-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৮-১৪
  4. "In Sanskrit philosophical literature, 'āstika' means 'one who believes in the authority of the Vedas' or 'one who believes in life after death'. ('nāstika' means the opposite of these). The word is used here in the first sense." Satischandra Chatterjee and Dhirendramohan Datta. An Introduction to Indian Philosophy. Eighth Reprint Edition. (University of Calcutta: 1984). p. 5, footnote 1.
  5. Constance Jones; James D. Ryan (২০০৬)। Encyclopedia of Hinduism। Infobase। পৃষ্ঠা 96। আইএসবিএন 978-0-8160-7564-5।
  6. Nagendra Kumar Singh (১৯৯৭)। "Buddha as depicted in the Purāṇas"। Encyclopaedia of Hinduism, Volume 7। Anmol Publications PVT. LTD.। পৃষ্ঠা 260–275। আইএসবিএন 978-81-7488-168-7।
  7. Singh, page 264.
  8. Motilal Banarsidass, Delhi 1982.
  9. Dhere Ramchandra Chintaman, Shri Vitthal: ek maha samanvaya, Shri Vidya Prakashan, Pune, 1984 (Marathi)
  10. Singh, pp. 262–264
  11. Singh, p.267
  12. Bhāgavatatātparya by Madhva, 1.3.28
  13. Wendy O'Flaherty, Origins of Evil in Hindu Mythology. University of California Press, 1976, page 203.
  14. Stella Kramrisch (১৯৪৬)। The Hindu Temple। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 349–350। আইএসবিএন 978-81-208-0224-7।
  15. Timothy P. Daniels (২০০৫)। Building Cultural Nationalism in Malaysia: Identity, Representation, and Citizenship। Psychology Press। পৃষ্ঠা 129–130। আইএসবিএন 978-0-415-94971-2।

বহিঃসংযোগ

  1. The reverse is found in Buddhist texts which similarly caricature Hindu sacred figures. According to Alf Hiltebeitel and other scholars, some of the stories in Buddha-related Jataka tales found in Pali texts seem slanderous distortions of Hindu legends, but these may reflect the ancient local traditions and the complexities of early interaction between the two Indian religions.[7]
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.