বরাহ পুরাণ

বরাহ পুরাণ (সংস্কৃত: वराह पुराण, Varāha Purāṇa) হল হিন্দুধর্মের পৌরাণিক সাহিত্যের অন্তর্গত একটি সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ।[1] এটি একটি বৈষ্ণব পুরাণ। এই পুরাণের উপজীব্য বিষয় নারায়ণের (বিষ্ণু) মাহাত্ম্য কীর্তন হলেও এর কয়েকটি অধ্যায়ে শিবশক্তির (পুরাণটিতে ব্রাহ্মী, বৈষ্ণবী ও রৌদ্রী নামে উল্লিখিত দেবীত্রয়ী) মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়গুলি সম্পূর্ণতই শিবশক্তি-কেন্দ্রিক।[1][2]

বরাহপুরাণ পুথির একটি পৃষ্ঠা

বরাহ পুরাণ গ্রন্থের একাধিক পাঠান্তর রয়েছে। পুরাণটির প্রধান অংশগুলি কালের সঙ্গে সঙ্গে অবলুপ্ত হয়েছে।[2] অনুমান করা হয়, খ্রিস্টীয় ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে এই পুরাণটি রচিত হয়েছিল এবং তারপর ক্রমাগত এটি পুনর্লিখিত হতে থাকে।[2][3] এই পুরাণের যে পুথিগুলি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি লিঙ্গপুরাণ গ্রন্থের প্রাপ্ত পুথিগুলির মতোই বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। উভয় গ্রন্থেই হিন্দু পুরাণসাহিত্যের অতিআবশ্যিক "পঞ্চলক্ষণ" (পাঁচটি বৈশিষ্ট্য) অনুপস্থিত।[2] এটি যথার্থ পুরাণ গ্রন্থ কিনা, নাকি অসাম্প্রদায়িক পন্থায় শিব, শক্তি ও অন্যান্য দেবতাদের মাহাত্ম্য কীর্তনের[1][2] পাশাপাশি প্রধানত বৈষ্ণব রীতিনীতি-সংক্রান্ত একটি নিছক ধর্মীয় বিবরণ-পুস্তকের প্রাপ্ত পুথি,[3][4] সেই বিষয়ে গবেষকেরা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন।

বরাহ পুরাণ গ্রন্থে পৌরাণিক কাহিনিও সন্নিবিষ্ট হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, মহাপ্লাবনের সময় বিষ্ণুর বরাহ অবতার কর্তৃক পৃথিবী দেবীকে উদ্ধারের কাহিনি।[2][5] এছাড়া শিব ও শক্তি-সংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনিও এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।[4] পৌরাণিক কাহিনি ছাড়াও এই গ্রন্থের ধর্মসংহিতা অংশে কর্ম ও ধর্ম-সংক্রান্ত দার্শনিক বিষয়গুলিও আয়োজিত হয়েছে।[6] এই গ্রন্থের একটি বড়ো অংশে মথুরানেপাল অঞ্চলের মন্দির ও তীর্থক্ষেত্রগুলির মধ্যযুগীয় ভৌগোলিক "মাহাত্ম্য" (পথনির্দেশিকা ও স্থানমাহাত্ম্য) আলোচিত হয়েছে।[7] কিন্তু কৌতুহলজনকভাবে অন্যান্য পুরাণের মথুরা-সংক্রান্ত অংশে কৃষ্ণের যে মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে, তা এই পুরাণে নেই।[6][8]

ইতিহাস

বরাহ পুরাণ গ্রন্থটি ঠিক কোন শতাব্দীর রচনা, তা জানা যায় না। উইলসনের মতে, খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে যখন রামানুজের প্রভাব সর্বাধিক ছিল, সেই সময়েই এই পুরাণ রচিত হয়।[6] এটি যে অপেক্ষাকৃতভাবে পরবর্তীকালে রচিত একটি পুরাণ, সেই বিষয় অধিকাংশ গবেষকই ঐক্যমত প্রকাশ করেছেন।[3] কয়েকজন গবেষকের মতে এই গ্রন্থের আদি সংস্করণটির রচনা খ্রিস্টীয় ১০শ শতাব্দীর মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছিল।[6] গ্রন্থটি বিষ্ণুর বরাহ অবতারের নামাঙ্কিত এবং এই গ্রন্থে বরাহ কর্তৃক ভূদেবী উদ্ধারের কাহিনি বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয়েছে।[4]

মৎস্য পুরাণ, স্কন্দ পুরাণঅগ্নি পুরাণ গ্রন্থের পুথিগুলিতে বরাহ পুরাণ গ্রন্থের উল্লেখের পাশাপাশি এই পুরাণের সারাংশও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ওই সকল নথিতে যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা বরাহ পুরাণ গ্রন্থের প্রাপ্ত পুথির পাঠের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সেই জন্য মনে করা হয়, এই পুরাণের আদি পাঠটি সম্পূর্ণতই অন্যরকম ছিল।[9][10] এই পুরাণের একাধিক সংস্করণ প্রচলিত। তাতেও উল্লেখযোগ্য বহু পাঠান্তর রয়েছে।[2][11]

পদ্ম পুরাণ গ্রন্থে বরাহ পুরাণ গ্রন্থটিকে সাত্ত্বিক পুরাণের শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।[12] তবে গবেষকদের মতে, পৌরাণিক সাহিত্যের এই "সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ" শ্রেণিবিভাগ "সম্পূর্ণতই অলীক কল্পনাপ্রসূত" এবং এই গ্রন্থটিকে উক্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করার কোনও যথাযথ কারণ নেই।[13]

বিষয়বস্তু

বরাহ পুরাণ গ্রন্থের অলংকরণ, কল্যাণনগর্যছম: লক্ষ্মীবেঙ্কটেশ্বর মুদ্রণালয়, ১৯২৩

পাঠান্তরের ভিত্তিতে এই পুরাণের মুদ্রিত সংস্করণগুলি ২১৭ অথবা ২১৮টি অধ্যায়ে বিভক্ত।[14] প্রকাশিত সমালোচনামূলক সংস্করণটি ২১৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত।[14] প্রথাগত হিন্দু বিশ্বাস ও অন্যান্য পুরাণের বক্তব্য অনুযায়ী বরাহ পুরাণ গ্রন্থের শ্লোকসংখ্যা ২৪,০০০।[15] যদিও যে পুথিগুলি এখন পাওয়া যায়, তাতে এর অর্ধেকেরও কম সংখ্যক শ্লোক গ্রন্থিত রয়েছে।[16]

নারদ পুরাণ গ্রন্থে কথিত হয়েছে, এই পুরাণটি দু’টি ভাগে বিভক্ত: "পূর্বভাগ" ও "উত্তরভাগ"। নারদ পুরাণ গ্রন্থে "পূর্বভাগ" অংশের যে সারসংক্ষেপ প্রদত্ত হয়েছে, তা বরাহ পুরাণ গ্রন্থের প্রাপ্ত পুথিগুলির পাঠের প্রায় অনুরূপ। কিন্তু "উত্তরভাগ" অংশের সারসংক্ষেপ বরাহ পুরাণ গ্রন্থের প্রাপ্ত পুথিগুলিতে পাওয়া যায় না। মনে করা হয়, উক্ত অংশটি কালের গহ্বরে বিলীন হয়ে গিয়েছে।[14]

রাজেন্দ্র হাজরার মতে, প্রাপ্ত পাঠের চারটি পৃথক ভাগ রয়েছে। প্রতিটি ভাগ আলাদা আলাদা ব্যক্তির কথোপকথনের আকারে গ্রথিত এবং পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।[17] প্রত্যেকটি অংশ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন লেখক কর্তৃক রচিত হয়েছে।[14][18]

প্রথম অংশে (১ম থেকে ১১২শ অধ্যায়) সূত হলেন কথক এবং অংশটি বরাহভূদেবীর কথোপকথনের আকারে রচিত। দ্বিতীয় অংশে (১১৩শ থেকে ১৯২শ অধ্যায়) সূত বর্ণনা করেছেন, বরাহ ও ভূদেবীর কথোপকথন সম্পর্কে ভূদেবী সনৎকুমারকে কী বলেছিলেন। তৃতীয় অংশে (১৯৩শ থেকে ২১৩শ অধ্যায়) সূত রাজা জনমেজয় ও ঋষি বৈশম্পায়নের কথোপকথন বর্ণনা করেছেন। এই অংশটি ধর্মসংহিতা নামেও পরিচিত। সর্বশেষ অংশে (২১৩শ থেকে শেষ অধ্যায় পর্যন্ত) সূত বর্ণনা করেছেন ব্রহ্মা ও সনৎকুমারের কথোপকথন।[19]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. Dalal 2014, পৃ. 444।
  2. Rocher 1986, পৃ. 241-242।
  3. Hazra 1940, পৃ. 96।
  4. Winternitz 1922, পৃ. 544।
  5. K P Gietz 1992, পৃ. 29-31 with notes 148 and 152।
  6. Rocher 1986, পৃ. 242।
  7. Ariel Glucklich 2008, পৃ. 146, Quote: The earliest promotional works aimed at tourists from that era were called mahatmyas
  8. Wilson 1864, পৃ. 74।
  9. Hazra 1940, পৃ. 96-97।
  10. Wilson 1864, পৃ. 73।
  11. K P Gietz 1992, পৃ. 981 with note 5694।
  12. Wilson 1864, পৃ. 12।
  13. Rocher 1986, পৃ. 21।
  14. Rocher 1986, পৃ. 241।
  15. Hazra 1940, পৃ. 7 with footnote 42।
  16. Wilson 1864, পৃ. 73-74।
  17. Rocher, Ludo (১৯৮৬)। "The Purāṇas"। Jan Gonda। A History of Indian Literature। Vol.II, Epics and Sanskrit religious literature, Fasc.3। Wiesbaden: Otto Harrassowitz Verlag। পৃষ্ঠা 241–2। আইএসবিএন 3-447-02522-0।
  18. Hazra 1940, পৃ. 97।
  19. Hazra, Rajendra Chandra (১৯৮৭) [1940]। Studies in the Puranic Records on Hindu Rites and Customs। Delhi: Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 96–107। আইএসবিএন 81-208-0422-8।

গ্রন্থপঞ্জি

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.