মণিপুরী (জাতি)

মণিপুরী জাতি ভারতবাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নাম। এদের আদি নিবাস ভারতের মণিপুর রাজ্যে। মণিপুরীদের নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সাহিত্য এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। ভারতের মণিপুর রাজ্যেবাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোক বাস করে।

মণিপুরী বাদ্যযন্ত্র শিক্ষক

বাংলাদেশে মণিপুরী জাতির অভিবাসন

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত সংঘটিত বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের শিকার হয়ে এবং যুদ্ধজনিত কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা দেশত্যাগ করে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। পার্শ্ববর্তী আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলায়, ত্রিপুরা রাজ্যে, পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে এবং বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক মণিপুরী অভিবাসন ঘটে। বার্মা-মণিপুর যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫) তৎকালীন মণিপুরের রাজা চৌরজিৎ সিংহ, তার দুই ভাই মারজিৎ সিংহ ও গম্ভীর সিংহসহ সিলেটে আশ্রয়গ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষে আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকেই স্বদেশে ফিরে যায়, কিন্তু বহু মণিপুরী তাদের নতুন স্থানে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়। বাংলাদেশে আসা মণিপুরীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর, ঢাকার মণিপুরী পাড়া এবং প্রধানত বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলে। [1]

বর্তমানে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় মণিপুরী জনগোষ্ঠীর লোক বাস করে।

মণিপুরী জাতির শাখাসমুহ

ভাষাগত এবং ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের মণিপুরীরা তিনটি শাখায় বিভক্ত এবং স্থানীয়ভাবে তারা (১) বিষ্ণুপ্রিয়া, (২) মৈতৈ ও (৩) পাঙন নামে পরিচিত[2]। মণিপুরের অধিবাসীদের মধ্যে এই তিনটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের শিকার হয় এবং তারা বাংলাদেশে এসে পাশাপাশি বসতি স্থাপন করে।

বিষ্ণুপ্রিয়ারা ককেশয়েড মহাজাতির আর্য-ভারতীয় উপপরিবারের অন্তর্গত এবং তাদের ভাষার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা। মৈতৈরা মঙ্গোলয়েড মহাজাতির তিব্বতী-বর্মী উপ-পরিবারের অন্তর্গত এবং তাদের ভাষার নাম মৈতৈ। পাঙনরা আর্য বংশদ্ভুত হলেও মৈতৈ ভাষায় কথা বলে এবং ধর্মীয়ভাবে তারা মুসলিম। বাংলাদেশের মণিপুরীদের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

এসআইএল ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৩ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া জনসংখ্যা ৪০ হাজার এবং মণিপুরী মৈতৈ জনসংখ্যা ১৫ হাজার[3]। ভাষাগত ভিন্নতা বাদ দিলে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈদের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তেমন পার্থক্য নেই।

মণিপুরীদের সংস্কৃতি

মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স
মণিপুরী ছেলেরা বাদ্যযন্ত্র শিক্ষায় ব্যস্ত

মণিপুরীদের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী। মণিপুরী সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম দিক হলো মণিপুরী নৃত্য যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।

মণিপুরীদের মধ্যে ঋতুভিত্তিক আচার অনুষ্ঠান বেশি। বছরের শুরুতে হয় মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের বিষু এবং মৈতৈদের চৈরাউবা উৎসব। আষাঢ় মাসে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ও কাঙ উৎসবের সময় প্রতিরাত্রে মণিপুরী উপাসনালয় ও মন্ডপগুলোতে বৈষ্ণব কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ নাচ ও গানের তালে পরিবেশন করা হয়।

কার্ত্তিক মাসে মাসব্যাপী চলে ধর্মীয় নানান গ্রন্থের পঠন-শ্রবন। এরপর আসে মণিপুরীদের বৃহত্তম উৎসব রাসপূর্ণিমা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলানুকরন বা রাসপুর্ণিমা নামের মণিপুরীদের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রায় দেড়শত বছর ধরে (আনুমানিক ১৮৪৩ খ্রী: থেকে) পালিত হয়ে আসছে। কার্ত্তিকের পুর্ণিমা তিথিতে দুরদুরান্তের লক্ষ লক্ষ ভক্ত-দর্শক সিলেটের মৌলবীবাজার জেলার কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়ামন্ডবের এই বিশাল ও বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষনে ছুটে আসেন।

বসন্তে দোলপূর্ণিমায় মণিপুরীরা আবির উৎসবে মেতে উঠে। এসময় পালাকীর্ত্তনের জনপ্রিয় ধারা "হোলি" পরিবেশনের মাধ্যমে মণিপুরী তরুণ তরুণীরা ঘরে ঘরে ভিক্ষা সংগ্রহ করে। এছাড়া খরার সময় বৃষ্টি কামনা করে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়ারা তাদের ঐতিহ্যবাহী বৃষ্টি ডাকার গান পরিবেশন করে থাকে।

মণিপুরীদের ধর্ম

মণিপুরীদের নিজস্ব লৌকিক ধর্মের নাম "আপোকপা" যা অত্যন্ত প্রাচীন, আধ্যাত্মিকতায় গভীর ও দার্শনিকভাবে উচ্চস্তরের। প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা নিজের প্রতিকৃতি থেকে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিটি মানুষ সৃষ্টিকর্তার একেকটি ছায়া। এখনো মণিপুরী মৈতৈদের অনেকে এই ধর্মের অনুসারী। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের একাংশের মধ্যের "আপোকপা" পূজার প্রচলন রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরীরা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়।

মণিপুরীদের ভাষা

মণিপুরী জনগোষ্ঠীর প্রধান দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষার পার্থক্য রয়েছে, যেমন -

  • মৈতৈ
  • বিষ্ণুপ্রিয়া

মণিপুরী মৈতৈ ভাষাকে তিব্বতি-বর্মী উপ-পরিবারের কুকি-চিন দলে এবং বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাকে ইন্দো-আর্য উপ-পরিবারের বাংলা-অসমীয়া দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যদিও এই শ্রেণীকরণ নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। অনেকে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাকে মহারাষ্ট্রী-সৌরসেনী ভাষাশ্রেণীর আবার কেউ কেউ একে ইন্দো-মঙ্গোলয়েড উপশ্রেণীর তালিকাভুক্ত করা সমিচীন মনে করেন। উৎস ও বিকাশের ক্ষেত্রভুমি অভিন্ন হওয়ায় উভয় ভাষার মধ্যে ব্যাকরণগত সামঞ্জস্য রয়েছে। উভয় ভাষাতেই পার্বত্য নাগা ও কুকিভাষার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে উভয় ভাষাতেই ব্যবহৃত হয় এমন শব্দসংখ্যা চার হাজারেরও বেশি।

১৮৮৯ সনে প্রকাশিত ভারতবর্ষের ভাষা শ্রেণীবিভাগের প্রধান ভিত্তি স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সনের Linguistic Survey of India-তে মৈতৈ ভাষার পাশাপাশি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে মণিপুরের অন্যতম ভাষা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে[4]। দুইটি ভাষাই ভারতে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের স্কুলগুলোতে মণিপুরী মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া উভয় ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। মণিপুরি (মৈতৈ) ভাষা ভারতের অন্যতম রাস্ট্রভাষা এবং মণিপুর রাজ্যের রাজ্যভাষা। মণিপুর রাজ্যে মণিপুরী মৈতৈ ভাষায় স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। তবে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় মণিপুরে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ নেই।

১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্র থেকে প্রতি সপ্তাহে "মণিপুরী অনুষ্ঠান" শিরোনামে পর্যায়ক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয় এবং এই অনুষ্ঠানের সম্প্রচার এখনো অব্যাহত রয়েছে।

মণিপুরী সাহিত্য

সূর্যদেবতার উদ্দেশ্যে রচিত গীতিকবিতা ঔগ্রী মণিপুরী মৈতৈ সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন, যা খ্রীস্টিয় ৩৩ অব্দে রচিত। ঐছাড়া অনেক প্রেমগীতি ও লোকগাথা মণিপুরী মৈতৈ সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। মণিপুরি (মৈতৈ) সাহিত্যের লিখিত অস্তিত্ব পাওয়া যায় খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে। অপরদিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষারও প্রাচীন সাহিত্যেভাণ্ডার রয়েছে। বরন ডাহানির এলা (বৃষ্টি ডাকার গান / ১৪৫০-১৫০০ খ্রী:), মাদই সরাহাল এলা (বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী লোকগান / ১৬০০-১৭০০ খ্রী:),খাম্বাথৈবীর প্রেমকাহিনী(১৫০০-১৬০০ খ্রী:), আপাঙর য়্যারী (লোককথা), পৌরেই (প্রবচন) ইত্যদি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী লোকসাহিত্যর অমূল্য সম্পদ। উনিশ শতকের মধ্যভাগে তৎকালীন বৃটিশ ভারতের রাজনৈতিক এজেন্ট Colonel McCullock তার Valley of Manipur and Hill Tribes গ্রন্থে ইংরেজি, মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরী মৈতৈ ভাষার তুলনামুলক সংক্ষিপ্ত অভিধান প্রণয়ন করেন।

মণিপুরী হস্তশিল্প

হাতে বোনা কাপড় তৈরীতে মণিপুরীরা খুবই দক্ষ। নিজেদের কাপড় তারা নিজেরাই তৈরি করে থাকে। প্রায় প্রতিটি ঘরেই তাঁত রয়েছে। মণিপুরী হস্তশিল্প বিশ্বময় সমাদৃত। মণিপুরীদের বোনা তাঁতের শাড়ি, গামছা, চাদর, ব্যাগ ইত্যাদি অন্যান্য জাতির মধ্যেও সমান জনপ্রিয়।

ভানুবিল কৃষক-প্রজা আন্দোলন

বৃটিশ শাসনামলে মণিপুরী কৃষকদের সংগ্রামের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। ১৯৪৩ সনে জমিদারী ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল তৎকালীন মৌলবীবাজার মহকুমার ভানুগাছ পরগনার ভানুবিল গ্রামের মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়ের কৃষকরা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মণিপুরী সম্প্রদায়

১৯৭১ সনে মণিপুরী জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ সম্প্রদায়ের অসংখ্য মণিপুরী তরুণ মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। মণিপুরী মহিলা ও গৃহবধুরাও নানানভাবে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সাহায্য সহযোগিতা করেন।

পাদটীকা

  1. বাংলাপিডিয়া, প্রকাশকঃ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা ৪৬৮
  2. “বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতৈ ও মৈতৈ পাঙন এই তিন সম্প্রদায়ে মণিপুরীরা বিভক্ত, তন্মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ সম্প্রদায়ের লোকেরা হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভূক্ত।” - মৌলভীবাজার জেলার জনজীবন/ অধ্যক্ষ রসময় মোহান্ত, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৮৭
  3. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৫ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ নভেম্বর ২০০৮
  4. Linguistic Survey of India, 1891. Compiled by Sir G. A. Grierson, Vol V, page 419

আরও পড়ুন

তথ্যসূত্র

  • মৌলভীবাজার জেলার জনজীবন/ অধ্যক্ষ রসময় মোহান্ত, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৮৭
  • আরণ্য জনপদে/ আবদুস সাত্তার, পৃষ্ঠা ২৯৭
  • মণিপুরী জাতিসত্তা বিতর্ক: একটি নিরপেক্ষ পাঠ / অসীম কুমার সিংহ, ২০০১ সিলেট,
  • রিপোর্ট: জাতীয় আদিবাসী গোলটেবিল বৈঠক / ডিসেম্বর ১৮-২০,১৯৯৭ ঢাকা, পৃষ্ঠা ৩২
  • পুর্ব্ববঙ্গ ও আসাম/ শ্রী কৃষ্ণমোহন ধর, ১৯০৯ , পৃষ্ঠা ১০৬-১০৭
  • নানকার বিদ্রোহ / অজয় ভট্টাচার্য ,১৯৭৭
  • ভানুবিল কৃষক প্রজা আন্দোলন বারোহ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সমাজ / অধ্যাপক রণজিৎ সিংহ, ১৯৮৫
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.