বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়

বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়, বা বিষ্টু ঠাকুর (এপ্রিল ১৯১০ - ১১ এপ্রিল ১৯৭১) ছিলেন জমিদারতন্ত্র বিরোধী কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক নেতা ও সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ। বিপ্লবী এই নেতা ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব, বাঁধ নির্মাণের নায়ক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকারী একজন জনগণের দরদি সংগ্রামী। এসরাজ বাজানো ছাড়াও ছবি আঁকায় তার দক্ষতা ছিলো।[1]

বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়
Vishnu chatterjee
জন্মএপ্রিল ১৯১০
মৃত্যু১১ এপ্রিল, ১৯৭১
খুলনা, বাংলাদেশ
প্রতিষ্ঠানভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতি
আন্দোলনভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন,

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় জন্মেছিলেন বাংলাদেশের খুলনা জেলার খানকায়। তার পিতার নাম রাধাচরণ চট্টোপাধ্যায়। তার জন্ম হয়েছিলো জমিদার পরিবারে। নিজ গ্রামের নিকট নৈহাটি স্কুলে পড়ালেখা করেন।[1]

বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সংযুক্তি

নৈহাটি স্কুলে পড়ার সময় বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় সাধুসঙ্গের ইচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়ে যান এবং সন্ন্যাসজীবনে মুক্তির আশা না দেখে ফিরে আসেন। ভাই বোনদের অনেকেই তখন যশোর-খুলনা সমিতির আবরণে গোপন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে রত। তার ভাইবোনদের মধ্যে বলাই ও ভানু দেবী ব্রিটিশ কারাগারে নিপীড়িত হয়েছেন। দাদা নারায়ন চট্টোপাধ্যায় প্রথম জীবনে ছিলেন সক্রিয় বিপ্লববাদী।[1]

জেলজীবন ও মার্কসবাদ গ্রহণ

১৯২৬ সালে 'যশোর খুলনা যুবসংঘ' বিপ্লবী গোষ্ঠীর সাথে কাজ করতে শুরু করেন তরুন বিষ্ণু। খালিশপুর স্বরাজ আশ্রমে কাজ করার সময়ে ১৯২৯ সনে রাজনৈতিক ডাকাতির অভিযোগে প্রথম গ্রেপ্তার হন। পরে প্রমাণাভাবে ছাড়া পান। ১৯২৬-১৯৩২ সালের মধ্যে এই সংঘের কর্মীরা অস্ত্রসংগ্রহের পরিকল্পনায় একাধিক স্বদেশী ডাকাতির কাজে লিপ্ত হন। পুলিশের তরফে এনাদের 'টেরো কমিউনিস্ট গ্রুপ' আখ্যা দেওয়া হয়। বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মীরূপে ১৯৩০ সনের ২৫ মে বঙ্গীয় সংশোধিত ফৌজদারি আইনে আটক-বন্দি হন। বন্দি জীবনের প্রথম খেলাধুলায় ও এসরাজ শিখে কাটালেও, ক্রমে প্রমথ ভৌমিকআবদুর রেজ্জাক খানের প্রভাবে মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী হন। তার শিক্ষা গুরুর মধ্যে ছিলেন ভবানী সেন, শচীন্দ্রনাথ মিত্র প্রমুখও। ১৯৩৮ সালে স্বগৃহে অন্তরীণাবস্থায় মুক্তি পান। দেশবিভাগের পরে বহুদিন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। জীবনের ২৪ বছর জেলে থাকার ফলে তার স্বাস্থ্যভঙ্গ হয় এবং গুরুতর পীড়ায় আক্রান্ত হলে মুক্তি পান।[1][2]

কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ ও কৃষক আন্দোলনে যোগদান

১৯৩৮ সনের পর তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন, খুলনা জেলা কমিটির মেম্বার হিসেবে দক্ষিণ খুলনায় কৃষক সংগঠনের কাজ শুরু করেন। শোভনার শাখাবাহী নদীর বাঁধ এবং "নবেকী বাঁধ" তার সংগঠনমূলক কৃষক আন্দোলনের চিরস্মরণীয় কাজ। প্রতিক্রিয়াশীল জমিদার ও সরকারি আ্মলাদের যোগাযোগে চাষের জমি নোনাজলে ভাসিয়ে চাষি উৎখাতের যে বর্বর প্রথা সুদীর্ঘকাল বাংলাদেশে চালু আছে তা তিনি কৃষকদের একতার বলেই নিজ অঞ্চলে প্রতিরোধ করেন। দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল ও বন্দুকধারী পুলিসকে স্তব্ধ করে কয়েক হাজার যুবকের সাহায্যে এই বাঁধ দুটি বাঁধেন। ১৯৪০ সালে ভূমি উদ্ধার করে ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করেন। এই বাঁধ দুটির আওতায় যথাক্রমে ১৬ হাজার ও ৭ হাজার বিঘা জমি উদ্ধার ও বিলি হয়। জেলা জুড়ে চালু হয়ে যায় 'বিষ্টু ঠাকুরের আইন চালু হয়েছে' ।খুলনার চাষিদের মধ্যে বিশ্বাস ছিলো বিষ্টু ঠাকুর বাঁধের উপর হাঁটলে সে বাঁধ ভাঙার ক্ষমতা কারুর নেই।[1][3]

কৃষক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন

বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৯ ও ১৯৪৪ সালে দুটি জেলা কৃষক সম্মেলনে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দেন। তারই উদ্যোগে তার এলাকা মৌভাগে ১৯৪৬ সনে প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন সংগঠিত হয়।[1] দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে তিনি কমিউনিস্ট কার্যকলাপের জন্যে গ্রেফতার হন। ২৪ এপ্রিল তারিখে জনপ্রিয় নেতা বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারের প্রতিবাদে মিছিল বের করা হয়। মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। তিনজন নিহত হয়েছিল।[4]

কৃষি গবেষক

একজন অভিজ্ঞ কৃষকের মতোই কোন জমিতে কী সার দিতে হয় তা তিনি জানতেন। কুমড়া মানকচু, কলা ও অন্যান্য কৃষিপণ্য উন্নত আকারে উৎপন্ন করবার জন্য সফল গবেষণা করেন। আম, জাম, কুল প্রভৃতি গাছের কলম বাঁধার বহু পদ্ধতি জানতেন। পশুপালন পদ্ধতি এবং পশু চিকিৎসাও জানতেন। মাছের চাষ ও মাছ ধরার নানা কলাকৌশল তার আয়ত্ত ছিলো। শত শত বুনো উদ্ভিদের নাম জানতেন।[1]

লেখালেখি

মেহনতি মানুষ তার প্রবন্ধ সংগ্রহ। কৃষক জীবনের পটভূমিকায় রচিত তার কয়েকটি গল্প আছে।[1]

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা

নিজ এলাকায় কৃষকদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলটি তখন উচ্চ ইংরেজি স্কুলরূপে গণ্য হয়েছিলো। তার চেষ্টায় বয়স্কদের জন্য একটি নৈশ বিদ্যালয় গড়ে উঠে এবং বিশ্বভারতীর লোকশিক্ষা সংসদের কেন্দ্র স্থাপিত হয়।[1]

মৃত্যু

১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল নির্জন দুপুরে কৃষক নেতা বিষ্টু ঠাকুর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মুসলিম লিগ দালালদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন।[1][3]

তথ্যসূত্র

  1. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, সংশোধিত ও পরিমার্জিত পঞ্চম সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৪৮৯-৪৯০, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. সূচনা পর্ব, অমিতাভ চন্দ্র (১৯৯২)। অবিভক্ত বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলন। কলকাতা: পুস্তক বিপণি। পৃষ্ঠা ১১৫, ১১৭। আইএসবিএন 81-85471-08-8।
  3. পিনাকী বিশ্বাস, সেইসব শহীদেরা (২০১৪)। শহীদ বিষ্টু ঠাকুর: এক দুরন্ত অগ্নিঝড়। কলকাতা: অতিরিক্ত পাবলিকেশন। পৃষ্ঠা ৫৩। আইএসবিএন 978-81-928741-0-4।
  4. শেখ রফিক (২ মার্চ ২০১৬)। "ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী কামাখ্যা রায় চৌধুরী"। সংবাদ। সংগ্রহের তারিখ ২৫ মার্চ ২০১৭

বহিঃসংযোগ

টেমপ্লেট:ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.