পুরনো ঢাকা
পুরনো ঢাকা বা পুরান ঢাকা ঢাকা মহানগরীর আদি অঞ্চলটিকে বলা হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাধারণ বাঙালী সংস্কৃতি থেকে এখানকার সংস্কৃতি অনেকটাই ভিন্নতর। পুরান ঢাকা পূর্ব-পশ্চিমে সূত্রাপুর মিল ব্যারাক থেকে হাজারীবাগ ট্যানারি মোড় পর্যন্ত এবং দক্ষিণে ঢাকা সদর ঘাট থেকে নবাবপুর পর্যন্ত বিস্তৃত।





.jpg)
ইতিহাস পর্যবেক্ষণে জানা যায়, পুরান ঢাকা একসময় অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, সুন্দর ও ছিমছাম একটি শহর ছিলো। কিন্তু মুঘল শাসকদের পতনের পর থেকে পুরান ঢাকা'র ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। ব্রিটিশ শাসকরা এ শহরের কিছু দেখভাল করলেও বর্তমান সময়ের প্রশাসনযন্ত্রের অবহেলায় পুরান ঢাকা ধীরে ধীরে তার শ্রী হারিয়ে ফেলছে।
ইতিহাস
৭০০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পূর্ববঙ্গের ঢাকা নামক অঞ্চলটিতে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে শহর গড়ে ওঠে। ঢাকার নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। কথিত আছে যে, সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণকালে সন্নিহিত জঙ্গলে হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিগ্রহ খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ঐ এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু দেবীর বিগ্রহ ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো তাই রাজা বল্লাল সেন মন্দিরের নাম রাখেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে স্থানটির নাম ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠে। আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকাকে সুবাহ্ বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং উড়িষ্যার বেশকিছু অঞ্চল) রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন; তখন সুবাদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ শহরে ঢাক বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্তির রূপ নেয় এবং তা থেকেই শহরের নাম ‘ঢাকা’ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, মুঘল সাম্রাজ্যের বেশ কিছু সময় ঢাকা সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর নামে পরিচিত ছিলো।[1] তাছাড়া ক্ষুদ্র ব্যাক্তিত্বের চাঁনমাল সরদার ছিলেন ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার নারিন্দা,ওয়ারি, ধোলাইখাল,গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর,সদরঘাট,সিদ্দিক বাজার সহ আশেপাশের সকল এলাকার সরদার যিনি পুরনো ঢাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে তার ও তার সমগ্র পৈতৃক সম্পত্তি ভান্ডার বিলিন করে দেন।
প্রশাসন
পুরান ঢাকা ৮টি মেট্রোপলিটন থানা এলাকা নিয়ে গঠিত। এগুলো হলঃ হাজারীবাগ, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, কোতোয়ালী, সূত্রাপুর, ওয়ারী ও গেন্ডারিয়া।
পুরোনো ঢাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এর অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল।[2] পুরান ঢাকা'র পশ্চিমে মোহাম্মদপুর, উত্তরে ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, শাহবাগ, রমনা, মতিঝিল ও সবুজবাগ, পূর্বে যাত্রাবাড়ী ও শ্যামপুর এবং দক্ষিণে কামরাঙ্গীরচর থানা ও কেরানীগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত।
যাতায়াত
পুরান ঢাকা'র সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাহন হলো রিকশা।[3] এই প্রাচীন শহরটির রাস্তাগুলো খুব সরু হওয়াতে রিকশা এখানকার প্রধান বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পণ্য পরিবহনের জন্য মানুষ টানা চাকা গাড়ীও রয়েছে প্রচুর। সীমিতভাবে ঘোড়ার গাড়ী বা টমটম এখনো চালানো হয়ে থাকে। এছাড়া যান্ত্রিক বাহনগুলোর মধ্যে বাস, টেম্পো, সি.এন.জি. চালিত অটোরিকশা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অঞ্চল হওয়ায় মালপত্র আনা-নেয়ার জন্য গভীর রাতে পুরান ঢাকার সড়কগুলো ট্রাকের দখলে চলে যায়।
অর্থনীতি ও বাণিজ্য
পুরান ঢাকা বাংলাদেশের প্রধানতম বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানকার চকবাজার এলাকায় সব রকমের পণ্যসামগ্রীর পাইকারী বিপণন হয়ে থাকে। ঢাকা মহানগরীর এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাজারগুলোর ব্যবসায়ীরা এখান থেকেই তাদের বেশিরভাগ মালামাল ক্রয় করে। মৌলভীবাজার হলো স্বল্প সময়ে পচনশীল নয়, এমন সব খাদ্যপণ্যের বৃহত্তম বিক্রয় অঞ্চল। কাওরান বাজার এর দোকানদারগণ এখান থেকে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে নিয়ে যান। চামড়া শিল্প হলো বাংলাদেশে তৃতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প। বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান চামড়া প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলটি পুরান ঢাকা'র হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত। লালবাগের পোস্তা হলো দেশের অন্যতম কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ অঞ্চল। ইসলামপুর হলো থান কাপড়ের বৃহত্তম বিপণন অঞ্চল। এছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো হলো: নয়াবাজার, মিটফোর্ড, সিদ্দিকবাজার, আলুবাজার, নবাবপুর, পাটুয়াটুলী, সদরঘাট, বংশাল ইত্যাদি। এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা মূলত ব্যবসায়ী। বংশ পরম্পরায় তারা ব্যবসা করে আসছে। বহিরাগত অনেক লোক এখানে চাকুরী করে থাকে।
জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতি
পুরান ঢাকা'র বেশিরভাগ স্থানীয় অধিবাসী আদি ঢাকাইয়া। এখানকার অধিবাসীগণ ঢাকা মহানগরীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অধিকতর রক্ষণশীল। পুরান ঢাকা'র সংস্কৃতির সাথে দিল্লি'র স্থানীয় অধিবাসীদের সংস্কৃতির কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের মানুষজন কিছুটা আলাদা ভাষায় কথা বলে। যাকে ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা বলা হয়।[4][5] এই ভাষাতেও অনেক আরবি, ফার্সি এবং হিন্দি-উর্দু শব্দের ব্যবহার বেশি। আদি ঢাকাইয়া'রা উর্দুতে কথা বলে থাকে।
ঢাকাইয়া লোকেরা চালাক-চতুর, কিন্তু ব্যবহারে খুবই অমায়িক হয়ে থাকেন। অতিথিদের আপ্যায়ন বা খাতিরদারীতে পুরান ঢাকা'র লোকেরা দেশে সর্বশ্রেষ্ঠ। ঢাকাইয়া পরিবারে ও মহল্লায় বয়স্ক ব্যক্তিদের অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখানো হয়। এখানকার সংখ্যাগুরু লোকের ধর্ম ইসলাম। তারা ঢাকা'র অন্য এলাকার মানুষের তুলনায় অধিকতর ধর্মসচেতন। প্রায় প্রতিটি মহল্লায় একটি অথবা দু'টি করে মসজিদ রয়েছে। এর কারণেই ঢাকাকে 'মসজিদের নগরী' বলা হয়ে থাকে। পুরান ঢাকায় হিন্দু ও ঈসায়ী, এ দুই সম্প্রদায়ের লোকজনও রয়েছেন।
খাদ্য
ঢাকাইয়ারা ভোজনরসিক। মুঘল প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে অনেক আগে থেকেই উত্তর ভারতীয় খাবারগুলো এখানে জনপ্রিয়। এখানকার উল্লেখযোগ্য খাবারগুলো হলো - টিক্কা, জালি কাবাব, কাঠি কাবাব, শাম্মি কাবাব, বটি কাবাব, নার্গিস কাবাব, শিক কাবাব, দই-বড়া, মুরগি মুসাললাম, খাসির পায়া, কাচ্চি বিরিয়ানী, পাক্কি বিরিয়ানী, মোরগ পোলাও, নান রুটি, বাকরখানি বা সুখা রুটি, নিহারী, বোরহানী, লাবান, ইত্যাদি। এছাড়া অন্যান্য মসলাদার খাবার ঢাকাইয়াদের বিশেষ পছন্দনীয়। নান্নার বিরিয়ানী, হাজী'র বিরিয়ানী আল রাজ্জাক রেস্টুরেন্ট, রয়েল রেস্টুরেন্ট, আমানিয়া হোটেল, ইত্যাদি এখানকার সুপরিচিত খাদ্যসামগ্রী বিক্রেতা।[6]
উৎসব
ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ও শবে বরাত পুরান ঢাকা'র প্রধান ধর্মীয় উৎসব। পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখীও এখানে সাড়ম্বরে পালিত হয়। পৌষ সংক্রান্তির দিনে লোকজন ঘুড়ি উৎসবে মেতে ওঠে। প্রতিবছর ১৪ বা ১৫ই জানুয়ারি এ উৎসব পালিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হাজারীবাগ লেদার টেকনোলজি কলেজ মাঠে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে মধ্য পুরান ঢাকা'র প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদে ঘুড়ি উড়ানো হয়। উত্তর ভারতীয় এ ঘুড়ি উৎসবটিকে স্থানীয়রা 'সাকরাইন' নামে অভিহিত করে। এছাড়া ১০ মহরর্ম এখানে সাড়ম্বরে শিয়া রীতিতে আশুরা উদযাপন করা হয়।[7]
সামাজিক ব্যবস্থা
ঢাকা মহানগর সমিতি নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় ঢাকাইয়াদের স্বার্থ সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পুরান ঢাকার কিছু মহল্লায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে। এসব পঞ্চায়েতের প্রধানদের সরদার বলা হয়।[8] বেশ ক'জন জীবিত ও মৃত উল্লেখযোগ্য সরদারগণ হলেন - সিদ্দিক সরদার,আলহাজ্ব গণি সরদার, মাজেদ সরদার, সোরাজ সরদার, পিয়ারু সরদার, আলহাজ্ব খলিলুর রহমান সরদার, আলম সরদার, কাদের সরদার, বেল্লাল সরদার, সাহাবুদ্দিন সরদার ও আরো অনেকে। তারা বিভিন্নসময় পুরান ঢাকা'র সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এখনো রাখছেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
পুরান ঢাকা'র উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ইন্সটিটিউট অব লেদার টেকনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক বাংলাদেশ কলেজ অব লেদার টেকনোলজি), পোগোজ স্কুল, তিব্বিয়া হাবিবিয়া ইউনানী মেডিকেল কলেজ, আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি।
দর্শনীয় স্থানসমূহ
পুরোনো ঢাকায় অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব দেশ-বিদেশের মানুষকে টেনে আনে। সদরঘাটে লঞ্চ আগমন ও প্রস্থান এবং ডিঙ্গী নৌকার উত্তাল অবস্থা আকর্ষণীয়।[9]
তথ্যসূত্র
- বাংলাপিডিয়া
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন
- "প্রতিদিনের আলো"। ১১ জুলাই ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০১৯।
- বাংলাপিডিয়া
- ইত্তেফাক
- "বণিকবার্তা"। ১১ জুলাই ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০১৯।
- "বণিকবার্তা"। ১১ জুলাই ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুলাই ২০১৯।
- ইত্তেফাক
- নয়াদিগন্ত