ছানাবড়া

লালবাগের ছানাবড়া বাংলার মিষ্টির মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত মিষ্টি। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ শহরে এই মিষ্টির আবির্ভাব।[1][2] আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই মিষ্টি আবিষ্কার হয় বলে মনে করা হয়। লালবাগের একটি আদি মিষ্টির দোকানের মালিক ছিলেন নিমাই মণ্ডল। তার হাত ধরেই ছানাবড়ার পথ চলা শুরু। তাঁর দোকান থেকেই নবাবের প্রাসাদে নিয়মিত ছানাবড়া সরবরাহ করা হতো। রুপোর থালায় এক মণ বা দেড় মণ সাইজের পেল্লায় ছানাবড়া সাজিয়ে নবাবরা অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতেন এবং এতে অতিথিদের চোখ নাকি ছানাবড়া-ই হয়ে যেত। সেই থেকেই চোখ ছানাবড়া কথাটার উদ্ভব। আগে এই মিষ্টিটি মুর্শিদাবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও খাগড়ার সোনাপট্টি এলাকার মিষ্টি ব্যবসায়ী পটল সাহা বা পটল ওস্তাদের হাত ধরেই ছানাবড়া মুর্শিদাবাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কাশিমবাজারের রাজা শ্রী মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ছিলেন ছানাবড়ার পৃষ্ঠপোষক। তিনি পটল ওস্তাদকে বরাত দিতেন। [3] ছানাবড়ার প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী হিসাবে গোপেশ্বর সাহার নাম ছিল।[1]

ছানাবড়া
বহরমপুরের ছানাবড়া
উৎপত্তিস্থলভারত
অঞ্চল বা রাজ্যলালবাগ, পশ্চিমবঙ্গ
প্রস্তুতকারীনিমাই মণ্ডল
পরিবেশনস্বাভাবিক তাপমাত্রা
প্রধান উপকরণছানা, গাওয়া ঘি, বড় এলাচ, চিনি, মিছরি
রন্ধনপ্রণালী: ছানাবড়া  মিডিয়া: ছানাবড়া

ইতিহাস ও নামকরণ

সৃষ্টির ইতিহাসে দুটি কিংবদন্তি প্রচলিত। একটিতে বলা হয় ছানাবড়া সৃষ্টির ইতিহাস নবাবি আমল থেকেই।

অপর কিংবদন্তিতে প্রায় ২০০ বছর আগে কাশিমবাজারের রাজা শ্রী মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী সাহেবদের মিষ্টি উপহার দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। রাজা তাঁর ভাণ্ডারের কারিগরদের মিষ্টি তৈরির আদেশ দেন। ছানাকে ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে ঘি দিয়ে ভাজেন কারিগররা। সেই ভাজা মিষ্টি গাঢ় রসে ডুবিয়ে দেন। অপূর্ব সেই স্বাদ। সেই মিষ্টি ইংরেজদের উপহার দেন রাজা। তাতে বেশ সুনামও করে ইংরেজরা। ইংরেজরা মিষ্টির নাম জানতে চাইলে মণীন্দ্রচন্দ্র বলেন, যেহেতু ছানাকে ঘি দিয়ে ভাজা হয়েছে, তাই এর নাম ছানাবড়া।

উপকরণ ও প্রস্তুত প্রণালী

উৎকৃষ্ট ছানাবড়ার জন্য উৎকৃষ্ট ছানা, গাওয়া ঘি, বড় এলাচ, চিনি, মিছরি প্রয়োজন।[4] ছানাবড়া গোল এবং চ্যাপ্টা, দু’রকম আকারের হলেও গোলটির জনপ্রিয়তাই বেশি। ছানাবড়া তিনটি ধাপে তৈরি করা হয়। প্রথমে ছানাকে বেঁটে মিহি করে মণ্ড তৈরি করা, দ্বিতীয় ধাপে সেই মণ্ডকে ভাজাশেষ ধাপে  চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা। প্রথমে ভাল জাতের ছানাকে বেটে নিয়ে, তাকে মনমতো আকার দিয়ে, তার কেন্দ্রস্থলেড় মধ্যে কয়েকদানা বড় এলাচ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তারপর দ্বিতীয় ধাপে গাওয়া ঘিয়ের মধ্যে সেগুলিকে প্রথমে মৃদু আঁচে এবং পরে কড়া আঁচে অনেকক্ষণ ধরে ঢুলিয়ে ঢুলিয়ে (ধিরে ধিরে) ভাজা হয়। ফলে এর উপরের পরতটি বা স্তরটি আস্তে আস্তে লালচে কালো ও কড়া হয়ে যায়, কিন্তু ভেতরটি থাকে অত্যন্ত নরম, সাদা ও মৌচাকের মতো জালিজালি। আঁচে ভাজা শেষ হলে শেষ ধাপে গাঢ় চিনির রসে ছানাবড়াটিকে প্রায় ২৪ ঘণ্টা চুবিয়ে রাখা হয়।[5]

তবে বিশালাকার ছানাবড়ার জন্য প্রক্রিয়াটি একটু আলাদা ও দীর্ঘ। ওজন এক মণ বা তার চেয়েও বড় হয় তবে ধুতির মতো একটি পরিষ্কার পাতলা কাপড়ের মধ্যে ওই ছানার মণ্ডটিকে ঝুলিয়ে নিয়ে, বেশ কয়েক জন হালুইকর ঘিয়ের মধ্যে ডুবিয়ে ঢিমে আঁচে তা ভাজেন। আকৃতি অনুযায়ী এটিকে দু’দিন ধরেও ভাজতে হতে পারে। শেষে গাঢ় চিনির রসে ছানাবড়াটিকে প্রায় ২৪ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখা হয়।

চোখ ছানাবড়া প্রবাদের উৎপত্তি

বাংলায় আশ্চর্য কিছু দেখে বিস্ফারিত চোখের অপর নামই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়া। আর নবাবের অতিথিদের চোখ যখন বিশালাকার ছানার এই নতুন মিষ্টি দেখে অবাক অপলক দৃষ্টি বিস্ফারিত হতো, তখনই আদর করে এই মিষ্টির নাম দেওয়া হয় ছানাবড়া। শুধু সেকালেই নয় আজও এই মিষ্টির বিশালতা অবাক করে দেয়। দেশের বিশিষ্ট মানুষদের বহরমপুরের নিকটবর্তী লালবাগের বিশাল বিশাল ছানাবড়া উপহার দেওয়ার প্রথা বহুদিনের । স্বামী বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, রাজীব গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকলেই এই ছানাবড়ার প্রশংসা করেছেন।[6] এছাড়া কাশিমবাজার রাজবাড়ির মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ব্যক্তিগত ভাবে ছানাবড়ার দারুণ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর নির্দেশে প্রায় দিনই অতিথি আপ্যায়নে সেখানে ছানাবড়া পরিবেশন করা হত।

ইতিহাসে ছানাবড়া উপহার

বিবেকানন্দ জীবিত থাকা অবস্থায় ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে, স্বামী অখণ্ডানন্দ বেলুড়ে দু’টি বিশাল ছানাবড়া নিয়ে গিয়েছিলেন এই বহরমপুর থেকেই। ছানাবড়া দু’টির ওজন হয়েছিল এক মণ চোদ্দো সের।[7] ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বহরমপুর থেকে একটি একমণি ওজনের ছানাবড়া পেয়ে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।[8] প্রয়াত রাজীব গান্ধী এসেছিলেন বহরমপুরে দলীয় সভায়। তখন তাকে ২৫ কিলোর ছানাবড়া দিয়েছিলেন প্রয়াত কংগ্রেস নেতা শঙ্করদাস পাল।[9] রাজীব শুধু ছানাবড়া চামচ দিয়ে কেটে খাননি, খাবার পর দিল্লিতেও নিয়ে যান। সম্প্রতি বিশিষ্ট ছানাবড়া ব্যবসায়ী অরুন বাবু ৫ কিলো ওজনের বিশালাকার ছানাবড়া উপহার দেন রাহুল গান্ধীকে।[10] ২০০৯ সালে রাহুল গাঁধীকে ১০ কেজি ওজনের পেল্লাই এক ছানাবড়া উপহার দিয়েছিলেন কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী৷মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যপাধ্যায়কেও ১২ কেজির এক ছানা বড়া উপহার দেওয়া হয়। প্রয়াত রাজ্যপাল সৈয়দ নুরুল হাসানকে ৬০ কেজির ছানাবড়া দিয়ে সম্মান জানানো হয়েছিল।সম্প্রতি তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৩১তম জন্মদিনে তাঁকে ৩১ কিলো ওজনের একটি ছানাবড়া উপহার দিয়েছিলেন মিষ্টি ব্যবসায়ীরা। [11][12][13]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. রায়, প্রণব। বাংলার খাবার
  2. "রসগোল্লা 'জাতে' উঠেছে, কম যায় না বাংলার বাকি মিষ্টিগুলিও"। প্রতিদিন।
  3. "রসগোল্লার পর এবার ছানাবড়া ও সরভাজাকেও GI স্বীকৃতির দাবি উঠল"। নভে ১৪, ২০১৭।
  4. "বহরমপুরে মুখ্যমন্ত্রীকে ছানাবড়া ভেট"abpananda। abpananda। ২৯ আগস্ট ২০১২। ২৫ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
  5. "ঐতিহ্যের ছানাবড়া"এবেলা। এবেলা। ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬।
  6. "DIARY"। June 7 , 2009। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  7. স্মৃতিকথা। উদ্বোধন। Authors list-এ |প্রথমাংশ1= এর |শেষাংশ1= নেই (সাহায্য)
  8. "ছানাবড়ার নবাবি আমেজে আজও চক্ষু ছানাবড়া"। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬। ১৯ জুন ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
  9. "ছানাবড়াও চায় স্বীকৃতি"আজকাল। আজকাল। বুধবার ১৫ নভেম্বর, ২০১৭। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  10. "ফেরার পথে মিষ্টি-মুখ, পাঁচ বছর পরে কথা রাখলেন রাহুল"। আনন্দবাজার। ২০ এপ্রিল ২০১৪।
  11. "রসগোল্লার পর এবার ছানাবড়া, স্বীকৃতি চাইছে মুর্শিদাবাদের মিষ্টি ব্যবসায়ীরা"সোনার বাংলা। সোনার বাংলা। 24th November 2017। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  12. "ছানাবড়ার জন্য প্রার্থনা বহরমপুরের"আনন্দবাজার। আনন্দবাজার। ১৬ নভেম্বর ২০১৭।
  13. Mitra, Asok। The New India, 1948-1955: Memoirs of an Indian Civil Servant। পৃষ্ঠা ৪২।
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.