গুহ্যকালী

গুহ্যকালী বা আকালী হিন্দু দেবী কালীর একটি বিশেষ রূপ। দেবীভাগবত পুরাণ মতে, তিনি দেবী শতাক্ষীর শরীর থেকে উৎপন্না অন্যতমা মহাশক্তি[1][2] কোনো কোনো সাধক এই রূপে কালীর আরাধনা করে থাকেন, তবে গৃহস্থের নিকট এই রূপ "অপ্রকাশ্য"।[3] গুহ্যকালী কালীর এক অতি ভয়ংকরী রূপ। এই রূপ কালীর প্রচলিত রূপের চেয়ে অনেকটাই পৃথক। গুহ্যকালী দ্বিভূজা, সর্পভূষিতা ও খড়্গহস্তা। তাকে সূর্যকালী নামেও অভিহিত করা হয়।[4] পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাট মহকুমার অন্তঃপাতী আকালীপুর গ্রামে দেবী আকালীর একটি বিখ্যাত মন্দির বিদ্যমান।[4] এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন মহারাজা নন্দকুমার[4]

গুহ্যকালী
সাধনার অভীষ্ট ফল
দেবী আকালী, কলকাতার চেতলা অঞ্চলের একটি সার্বজনীন কালীপূজা মণ্ডপে, ২০০৮
অন্তর্ভুক্তিকালী
আবাসশ্মশান
মন্ত্রক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হূঁ হ্রীঁ হ্রীঁ গুহ্যকালিকে ক্রীঁ ক্রীঁ ক্রীঁ হূঁ হুঁ হ্রীঁ হ্রীঁ স্বাহা
ওঁ ফ্রেং ফ্রেং ক্রোং ক্রোং পশূন্‌ গৃহাণ হুঁ ফট্‌ স্বাহা।
গায়ত্রীːগুহ্যকালিকায়ৈ বিদ্মহে শ্মশানবাসিন্যৈ ধীমহি। তন্নো ঘোরে প্রচোদয়াৎ।
অস্ত্রখড়্গ
বাহনসর্প

মূর্তিকল্প

দেবী গুহ্যকালীর ধ্যানমন্ত্রে তার যে মূর্তিটি বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপ: গুহ্যকালীর গাত্রবর্ণ গাঢ় মেঘের ন্যায়; তিনি লোলজিহ্বা ও দ্বিভূজা; গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ডের মালা; কটিতে ক্ষুদ্র কৃষ্ণবস্ত্র; স্কন্ধে নাগযজ্ঞোপবীত; মস্তকে জটা ও অর্ধচন্দ্র; কর্ণে শবদেহরূপী অলংকার; হাস্যযুক্তা, চতুর্দিকে নাগফণা দ্বারা বেষ্টিতা ও নাগাসনে উপবিষ্টা; বামকঙ্কণে তক্ষক সর্পরাজ ও দক্ষিণকঙ্কণে অনন্ত নাগরাজ; বামে বৎসরূপী শিব; তিনি নবরত্নভূষিতা; নারদাদিঋষিগণ শিবমোহিনী গুহ্যকালীর সেবা করেন; তিনি অট্টহাস্যকারিণী, মহাভীমা ও সাধকের অভিষ্ট ফলপ্রদায়িনী। গুহ্যকালী নিয়মিত শবমাংস ভক্ষণে অভ্যস্তা।[5]

আকালীপুর মন্দির

বীরভূমের গুহ্যকালী দেবী প্রতিমা

বীরভূম জেলার আকালীপুর গ্রামে ব্রাহ্মণী নদীর তীরে শ্মশানের পাশে মহারাজা নন্দকুমার একটি গুহ্যকালী মন্দির নির্মাণ করেন।[4] তবে এই বিচিত্র কালীমূর্তিটি তার দ্বারা নির্মিত হয়নি। জনশ্রুতি, পৌরাণিক মগধরাজ জরাসন্ধ এই মূর্তিটি নির্মাণ করেছিলেন। কালক্রমে বিভিন্ন রাজার হাতে পূজিত হওয়ার পর কাশীরাজ চৈত সিংহের রাজ্যের এক কৃষক তার জমিতে মূর্তিটি খুঁজে পান। সংবাদ পেয়ে চৈত সিংহ মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবী গুহ্যকালিকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। এদিকে ওয়ারেন হেস্টিংসও এই মূর্তির সন্ধান পেয়ে এটিকে লন্ডনের জাদুঘরে প্রেরণে উদ্যোগী হন। মূর্তিটি হেস্টিংসের হাত থেকে রক্ষা করতে, চৈত সিংহ সেটিকে গঙ্গাবক্ষে লুকিয়ে রাখেন। মহারাজা নন্দকুমার স্বপ্নাদেশ পেয়ে সেটিকে কাশী থেকে নিজ জন্মস্থান বীরভূমের ভদ্রপুর গ্রামে নিয়ে আসেন। নন্দকুমার নিজে ছিলেন পরম শাক্ত ও দেবী মহাকালীর ভক্ত। ১৭৭৫ সালের গোড়ায় তিনি মুর্শিদাবাদ-বীরভূমের সীমান্তবর্তী আকালীপুর গ্রামে দেবী গুহ্যকালীর মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু ওই বছর জুন মাসে তিনি ইংরেজের হাতে বন্দী হলে, মন্দির নির্মাণে ছেদ পড়ে। ফাঁসির পূর্বে তিনি পুত্র গুরুদাসকে তান্ত্রিক মতে দেবী গুহ্যকালীর প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়ে যান। লোকশ্রুতি, ওই বছর ১৫ জুলাই মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন হয়েছিল।[6]

মন্দিরের দক্ষিণে "পঞ্চমুণ্ডী" নামে পরিচিত একটি সিদ্ধাসন রয়েছে। আকালীপুরের দেবী গুহ্যকালীকে ভক্তেরা অতিশয় "জাগ্রত" দেবী মনে করেন। দূর-দূরান্তর থেকে পুণ্যার্থীরা এই মন্দিরে "মানসিক" করে পূজা দেন।[4]

আরও দেখুন

পাদটীকা

  1. দেবীভাগবত পুরাণ, ৭ম স্কন্দ, শ্লোক ২৮
  2. জীবনীকোষ: ভারতীয়-পৌরাণিক, শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার, প্রথম খণ্ড, সদেশ, কলকাতা, ১৪১৩ সং, পৃ. ৪০৪
  3. কোন কালী কেমন, কার পুজোয় কী ফল; সঞ্জয় ভুঁইয়া; বর্তমান রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০০৯
  4. পশ্চিমবঙ্গের কালী ও কালীক্ষেত্র, দীপ্তিময় রায়, মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৪১৪ মুদ্রণ, পৃ. ১৯৯-২০০
  5. গুহ্যকালীর ধ্যান, স্তবকবচমালা ও ধ্যানমালা, পণ্ডিত বামদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, অক্ষয় লাইব্রেরি, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২৮৮
  6. আকালিপুরের কালীপ্রতিমা, তুষার ভট্টাচার্য, সংবাদ প্রতিদিন, ২৮ অক্টোবর, ২০১০
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.