গান্ধারী (চরিত্র)

গান্ধারী(দেবনাগরী:गान्धारी) হলেন গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা । তিনি গান্ধাররাজ্যের রাজকুমারী ছিলেন বলে তার নাম গান্ধারী । সিন্ধুনদের পশ্চিম তীর হতে আফগানিস্তানের অধিকাংশকে পুরাকালে গান্ধারদেশ বলা হতো । বর্তমান কান্দাহার প্রাচীন গান্ধার নগরী ।[1] গান্ধারী দুর্যোধনাদির মাতা ছিলেন । শকুনি এঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা ।

কুন্তী, গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের সাথে বনে গমন করছেন
গান্ধারী (চরিত্র)
মহাভারত চরিত্র
বেদব্যাস দ্বারা বর লাভ
তথ্য
পরিবারসুবল (পিতা) সুদ্ৰামা (মাতা) শকুনি (ভ্রাতা)
দাম্পত্য সঙ্গীধৃতরাষ্ট্র
সন্তানদুৰ্যোধন, দুঃশাসন, বিকৰ্ণ,সহ ৯৭ জন পুত্ৰ ও দুঃশলা(কন্যা)

বিবাহ ও সন্তানলাভ

বিদুরের সাথে পরামর্শ করে ভীষ্ম গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা গান্ধারীর সাথে কুরুবংশের জ্যেষ্ঠপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ দেন । গান্ধারী সুন্দরী ও শিক্ষিতা হলেও মাতা পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপত্তি না করে জন্মান্ধ স্বামীর হাতে আত্মসমর্পণ করেন । তিনি তার অন্ধস্বামীকে অতিক্রম করবেন না এই সংকল্প করে বস্ত্র খণ্ড দিয়ে নিজের দুই চোখ বেঁধে রাখার সিদ্ধান্ত নেন ।[2] ইনি ব্যাসদেবের সেবা করায় তিনি বর দিয়েছিলেন গান্ধারী শতপুত্রের জননী হবেন । যথাকালে গান্ধারী গর্ভবতী হলেন কিন্তু কুড়ি মাস চলে গেলেও তার প্রসব হল না ।[3] এদিকে কুন্তীর পুত্রলাভের খবর পেয়ে গান্ধারী অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে না জানিয়ে লোহার মুগুর দিয়ে নিজের গর্ভপাত করেন ।[4] এর ফলে তার গর্ভ হতে এক লৌহকঠিন মাংসপিণ্ড নির্গত হল । গান্ধারী দাসীদের তা নষ্ট করার হুকুম দিতে যাচ্ছিলেন এমন সময় ব্যাসদেব এসে তাকে নিষেধ করলেন । তিনি ভ্রুণকে শীতল জলে ভিজিয়ে শত ভাগে ভাগ করেন এবং তা ঘৃতপূর্ণ কলসে রাখেন । একবছর পর দুর্যোধন এবং একবছর এক মাসের মধ্যে দুঃশাসন, দুঃসহ, বিকর্ণ প্রভৃতি শতপুত্র ও দুঃশলা নামে একটি কন্যার জন্ম হল । জন্মমাত্রই দুর্যোধন গাধার ন্যায় চীৎকার করেছিলেন এবং নানা অমঙ্গলের চিহ্ন দেখা গিয়েছিল । বিদুর ও ব্রাহ্মণগন তখন দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে বলেছিলেন । কিন্তু পুত্রস্নেহের জন্য ধৃতরাষ্ট্র তা করতে পারেন নি ।

গান্ধারীর ন্যায়বোধ

কপট দ্যূতে যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত ও দ্রৌপদীকে ভরা সভায় অপমানিত করার পর গান্ধারী একাধিকবার অন্ধরাজের কাছে দুর্যোধনকে পরিত্যাগের জন্য অনুরোধ করেন, কিন্তু পুত্রস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সে অনুরোধের কোন ফল হয় না । নিজ পুত্রের অন্যায় আচরণের জন্য তিনি কখনও মার্জনা করতে পারেন নি । একমাত্র দুর্যোধন হতেই যে কুরুকুল ধ্বংস হবে তা তিনি পূর্বেই জ্ঞাত হন । পণ মুক্ত পাণ্ডবদের অর্ধরাজ্য দিতে গান্ধারী যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন । বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাসের পর যখন পাণ্ডবরা কৃষ্ণকে হস্তিনাপুরে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন তখন গান্ধারী রাজসভায় এসে দুর্যোধনকে সন্ধির উপদেশ দিয়ে তিরস্কার করে বলেন যে ধর্মহীন ঐশ্বর্য প্রাপ্তির চেষ্টা পরিণামে মৃত্যু আনে । দুর্যোধন মাতৃবাক্য অবজ্ঞা করে সভা ত্যাগ করেন । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বকালে দুর্যোধন যখন তার মায়ের আশীর্বাদ ভিক্ষা করতে আসেন তখন গান্ধারী শুধু এই বাক্য বলেন বলেন যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ অর্থাৎ ধর্ম যেখানে জয় সেখানে । আঠার দিন যুদ্ধের প্রত্যেক দিনই তিনি দুর্যোধনের আশীর্বাদ প্রার্থনার উত্তরে এই বাক্য বলতেন । আঠার দিন পর গদাযুদ্ধে দুর্যোধনের মৃত্যু হলে ক্রুদ্ধ গান্ধারীকে কৃষ্ণ সান্ত্বনা দেয়ার সময় বলেন তার আশীর্বাদ সফল হয়েছে । এতে সাময়িকভাবে তিনি শান্ত হন ।

গান্ধারীর ক্রোধ ও কৃষ্ণকে অভিশাপ প্রদান

কৃষ্ণের বাক্যে কিয়ৎকাল প্রকৃতিস্থ থাকার পর গান্ধারী তার সম্মুখেই নিজ বস্ত্রে মুখ আবৃত করে বিলাপ করতে থাকেন । শতপুত্রহারা গান্ধারী তার স্বামী, কুন্তী ও পুত্রবধূদের সাথে রণভুমিতে আসেন এবং দিব্যচক্ষে রণভুমির ধ্বংসলীলা দেখে পাণ্ডবদের শাপ দিতে চান । এসময় ব্যাসদেব তাকে শান্ত করেন এবং ভীম তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেন । এরপর গান্ধারী সক্রোধে যুধিষ্ঠিরের দর্শনাভিলাষী হন । কম্পিত কলেবরে যুধিষ্ঠির এসে কৃতাঞ্জলিপুটে গান্ধারীর শাপ নিতে প্রস্তুত হন ও বলেন তিনিই তার পুত্রহন্তা এবং তার অভিশাপের যোগ্য । এই বলে যুধিষ্ঠির গান্ধারীর পাদস্পর্শ করতে অবনত হলে গান্ধারী তার চক্ষু আবরণের অন্তরাল থেকে যুধিষ্ঠিরের আঙ্গুলের অগ্রভাগ দেখতে পান । যুধিষ্ঠিরের নখ গান্ধারীর ক্রোধে কুৎসিত হয়ে যায় । শক্তি থাকা সত্বেও যুদ্ধ নিবারণ না করায় গান্ধারী কৃষ্ণকে এই বলে অভিশাপ দেন পতিসেবা ফলে অর্জিত পূণ্যের বলে আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি যে আজ থেকে ছত্রিশ বছর পর তুমিও পুত্র, বন্ধু ও স্বজন হারিয়ে বনমধ্যে অতি অপকৃষ্ট উপায়ে নিহত হবে এবং যাদবনারীগণও কুরু ও পাণ্ডব পক্ষীয় নারীদের মত ক্রন্দন করবে কৃষ্ণ হাসি মুখে এই অভিশাপ গ্রহণ করেন এবং তা যথাকালে কার্যকর হয় ।

সন্ন্যাসজীবন ও মৃত্যু

পাণ্ডবদের রাজ্যলাভের পর ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী পনের বছর পাণ্ডবদের আশ্রয়ে থাকেন । পাণ্ডবরা তাদের যথেষ্ট সম্মান করলেও ভীম গোপনে ধৃতরাষ্ট্রের অপ্রিয় কাজ করতেন কারণ তিনি ধৃতরাষ্ট্রের অন্যায় আচরণ ভুলতে পারেন নি । অবশেষে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী বাণপ্রস্থ অবলম্বন করে গঙ্গাতীরে রাজর্ষি শতযুপের আশ্রমে উপস্থিত হন । কুন্তী, বিদুর ও সঞ্জয়ও তাদের সাথে আসেন । এখানে তারা আশ্রম তৈরী করে বাস করতে থাকেন । ব্যাসদেব একদিন তাদের দেখতে এলে গান্ধারীর অনুরোধে ধৃতরাষ্ট্রের শোক লাঘবের জন্য অলৌকিক তপস্যা বলে যুদ্ধে নিহত স্বজনদের পুনর্জীবিত করে দেখান । বনবাসকালে গান্ধারী কেবল জল পান করে তপস্যা করতেন । অবশেষে তৃতীয় বছরে তারা অরণ্যে প্রবেশ করেন । একদিন হঠাৎ সেখানে দাবানল সৃষ্টি হয় । ধৃতরাষ্ট্র বন প্রবেশের পূর্বে যে যজ্ঞ করেছিলেন যাজকগণ সেই আগুন নির্জন বনে নিক্ষেপ করেছিলেন তা থেকেই দাবানল সৃষ্টি হয় । সেই আগুনে গান্ধারী, কুন্তীধৃতরাষ্ট্র পুর্বাস্য হয়া বসে জীবন ত্যাগ করেন ।

তত্থ্যসূত্র

  1. পৌরাণিক অভিধান - সুধীরচন্দ্র সরকার
  2. মহাভারত - রাজশেখর বসু
  3. কাশীদাসী মহাভারত
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.