মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা
মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা বা ড. কুদরাত-এ-খুদা (১ ডিসেম্বর, ১৯০০ - ৩ নভেম্বর, ১৯৭৭) ছিলেন একজন বাংলাদেশী রসায়নবিদ, গ্রন্থকার এবং শিক্ষাবিদ। শিক্ষায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৭৬ সালে একুশে পদক এবং ১৯৮৪ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা | |
---|---|
![]() কুদরাত-এ-খুদা | |
জন্ম | ১৯০০[1][2] মাড়গ্রাম, বীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত |
মৃত্যু | ৩ নভেম্বর ১৯৭৭ ৭৬) ঢাকা, বাংলাদেশ | (বয়স
জাতীয়তা | বাংলাদেশি |
কর্মক্ষেত্র | রসায়ন বিজ্ঞান |
প্রাক্তন ছাত্র | প্রেসিডেন্সি কলেজ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় |
পরিচিতির কারণ | রসায়নবিদ, গ্রন্থকার এবং শিক্ষাবিদ |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | একুশে পদক (১৯৭৬) স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮৪) তমঘা-ই-পাকিস্তান সিতারা-ই-ইমতিয়াজ |
শৈশব
কুদরাত-এ-খুদা ১৯০০ সালের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের মাড়গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খোন্দকার আব্দুল মুকিদ, মাতা সৈয়দা ফাসিহা খাতুন। তাদের সাত সন্তানের মধ্যে কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন দ্বিতীয়।[2] কুদরাত-এ-খুদার নাম রেখেছিলেন কুদরতের পিতার পীর কলকাতার তালতলার হযরত সায়ীদ শাহ মুর্শিদ আল কাদেরী। খোন্দকার আবদুল মুকিত তৎকালীন সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেছিলেন। তিনি সেসময় হাতে গোনা কয়েকজন মুসলিমের মধ্যে ছিলেন, যারা ইংরেজি ভাষা জানত।[3]
শিক্ষা
তার পিতা খোন্দকার আব্দুল মুকিত পীর বংশের সন্তান এবং নিজেও পীর হওয়ায় কুদরাত-এ-খুদাকে মাদ্রাসায় পীর বানানোর নিমিত্তে ভর্তি করিয়ে দেন।[3]
একদিন খুদার এক মামা তাদের বাড়িতে আসেন। তিনি তখন কলকাতায় পড়াশোনা করছেন। তিনি খুদাকে বাংলা বর্ণমালার বই দেন। বিকাল বেলা খুদাকে খেলতে দেখে, তার মামা, সেই বইটি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করায় বালক খুদা সব মুখস্ত উত্তর দেন। তিনি বালক খুদার প্রতিভা দেখে তাকে মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে এনে মাড়গ্রাম এম.ই. স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন।[4] পরবর্তীতে তিনি চলে আসেন কলিকাতা উডবার্ন এম.ই. স্কুলে এবং কলকাতা মাদ্রাসায়। কলকাতা মাদ্রাসা থেকে তিনি ১৯১৮ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর তিনি ভর্তি হন বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। সেখান থেকেই তিনি ১৯২৫ সালে রসায়নে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এম.এস.সি পাশ করেন। পাশ করার পর তিনি সরকারী বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান ডক্টরেট করার জন্য। সেখানে তিনি স্যার জে. এফ থর্পের অধীনে থিসিস করেন। প্রফেসর থর্প কুদরত এ খুদাকে স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে দেন। ফলে তিনি চারবছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ কাজ করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে Stainless Configuration of Multiplanmet Ring বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি ১৯২৯ সালে রসায়নে ডি.এসসি. ডিগ্রি লাভ করেন।
পেশা
ডক্টর অব সায়েন্স (ডি.এসসি. ডিগ্রী) লাভ করার পর দেশে ফিরে এসে প্রাথমিক ভাবে তার কোনো চাকরি জুটে নি। আড়াই বছর বেকার ছিলেন তিনি। সেসময় প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে গবেষণা থিসিস লিখেন তিনি।[3]
ড. কুদরাত-এ-খুদা ১৯৩১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি এ কলেজে বিভাগীয় প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তাকে ইসলামিয়া কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ড. কুদরাত-এ-খুদা পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং জনশিক্ষা পরিচালকের দায়িত্ব নেন (১৯৪৭-১৯৪৯)। অতঃপর তিনি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োজিত হন (১৯৫০-১৯৫৩)। ১৯৫৩-১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারসমূহের পরিচালক ছিলেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে গড়ে তুলেন বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার। বাংলাদেশের দেশীয় শিল্পের বিকাশ হয় তার হাত দিয়ে।[3] ১৯৬৩ সালে চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য যে শিক্ষাকমিশন গঠন করা হয় ড. কুদরাত-এ-খুদা তার সভাপতি নির্বাচিত হন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণীত হয়।
গবেষণা
পাটকাঠি থেকে মণ্ড তৈরী করে সেই মণ্ড থেকে অতি উন্নতমানের দৃঢ় তক্তা করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। পারটেক্স কাঠ কুদরাত-এ-খুদার বিশেষ অবদান। সমুদ্রের পানি থেকে লবণ চাষিরা যে পদ্ধতিতে লবণ সংগ্রহ করেন তা থেকে শুধুমাত্র খাবার লবণ (NaCl) সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু সমুদ্রের পানিতে NaCl ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ও ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড ও স্বল্পমাত্রায় ব্রোমিন থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এসব রাসায়নিক প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয় এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এসব বাংলাদেশে আমদানী করা হত। কুদরাত-এ-খুদাই প্রথম হিসাব করে দেখান, বড় কোনো কারখানায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লবণ আহরণ করা হলে, সে কারখানা যদি ১ লাখ টন লবণ উৎপাদন করে, তবে সেখানে তার পাশাপাশি বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে ১০ হাজার টন ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড, ১০ হাজার টন ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ও সেই অনুপাতে পটাশিয়াম ক্লোরাইড উৎপন্ন হবে।[3]
ড. কুদরাত-এ-খুদা স্টেরিও রসায়ন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরবর্তীতে তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল বনৌষধি, গাছগাছড়ার গুণাগুণ, পাট, লবণ, কাঠকয়লা, মৃত্তিকা ও অনান্য খনিজ পদার্থ। বিজ্ঞানী হিসাবে তার ও তার সহকর্মীদের ১৮টি আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে, যার মধ্যে ৯টি পাটসংক্রান্ত। এর মধ্যে পাট ও পাটকাঠি থেকে রেয়ন, পাটকাঠি থেকে কাগজ এবং রস ও গুড় থেকে মল্ট ভিনেগার আবিষ্কার উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট
প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উপযোগী সমাজগঠনমূলক একটি সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার রুপরেখা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই গঠিত 'জাতীয় শিক্ষা কমিশন' প্রণীত সুপারিশমালা। এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন ড. কুদরাত-এ-খুদা। তার নাম অনুসারে পরবর্তীকালে রিপোর্টটির নাম রাখা হয় 'ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষাকমিশন রিপোর্ট'। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালের মে মাসে 'বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট' নামে। এতে পরিশিষ্ট বাদে ৩৬টি অধ্যায় ছিল এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল মোট ৪৩০।
রচনাবলী ও প্রকাশনা
|
|
সাময়িকী
- পুরোগামী বিজ্ঞান (১৯৬৩)
- বিজ্ঞানের জয়যাত্রা (১৯৭২)
সম্মাননা
- একুশে পদক: ১৯৭৬
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে স্বাধীনতা পুরস্কার: ১৯৮৪ (মরণোত্তর)[1]
- তমঘা-ই-পাকিস্তান
- সিতারা-ই-ইমতিয়াজ
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী
কাজ
তার গবেষণা পত্র ৬৩ টি এবং পেটেন্ট ১৮ টি।[3]
তথ্যসূত্র
- "শিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণায় অনন্য পথিকৃৎ ড. কুদরত-এ-খুদা | দৈনিক আজাদী"। dainikazadi.net (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১৭ অক্টোবর ২০১৮।
- "বিজ্ঞানী কুদরত-এ-খুদা"। বণিক বার্তা :: Bonikbarta.net | A Business News and Entertainment Daily from Bangladesh.। সংগ্রহের তারিখ ১৭ অক্টোবর ২০১৮।
- প্রদীপ, দেব (১৫ অক্টোবর ২০১৮)। "কুদরত এ খুদা, দেশজ গবেষণার পথিকৃৎ"। বিজ্ঞান চিন্তা। প্রথম আলো।
- তপন চক্রবর্তী (ফেব্রুয়ারি ২০১০)। উপমহাদেশের দুই অমর বিজ্ঞানী। আগন্তুক। আইএসবিএন 9789848840117
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: checksum (সাহায্য)।