বারো ভুঁইয়া

বারো ভুঁইয়া, মোগল সম্রাট আকবর-এর আমলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল শাসনকারী কতিপয় জমিদার বা ভূস্বামী, বারো জন এমন শাসক ছিলেন, যাঁদেরকে বোঝানো হতো 'বারো ভূঁইয়া' বলে। আবার অনেকের অনুমান যে অতি প্রাচীনকালে হয়তো বাংলায় বারো সংখ্যক শক্তিশালী সামন্তরাজা ছিলেন যার ফলে ‘বারোভুঁইয়া’ শব্দটি জনশ্রুতিতে পরিণত হয়| ‘বারো ভুঁইয়া’ দের কিছু বিবরণ অসমের ইতিহাসেও দ্রষ্টব্য,কামরূপের এক অধিপতি গৌড়রাজের ভুঁইয়া ছিলেন বলেও জানা যায় | মধ্যযুগের উত্তর ভারতের শাসকরাও অনেক সময় বাংলাকে ” বারোভুইয়ার মুল্ক” বলে উল্লেখ করতেন (এদের অনেক বিবরণ আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি ও মির্জা নাথানের বহরিস্তান-ই-ঘইবিতে পাওয়া যায়)| এর কারণ হল যে বাংলার অধিপতি যেই হোক না কেন ,পরম্পরাগতভাবে মূল শাসক এই ভুঁইয়ারাই ছিলেন| এর কিছু উদাহরণ আরও প্রাচীনকালে পাল,সেন ও গুপ্তদের আমলেও দেখা যায়| রামপাল যখন বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি করছিলেন তখন তাকে বিপুল সংখ্যক সামন্তকে ভূমিদানসহ বিভিন্ন উপঢৌকনের প্রলোভন দেখিয়ে নিজের পক্ষে টানতে হয়েছিল। সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত “রামচরিতম্” কাব্যে এ বিষয়ের বিবরণ দ্রষ্টব্য | বলাবাহুল্য, মূল রাজার অনুপস্থিতিতে বা অরাজক অবস্থায় এরাই হয়ে উঠতেন রাজ্যের প্রধান হর্তা-কর্তা| বাংলায় পাঠান কর্‌রানী বংশের রাজত্ব দূর্বল হয়ে পড়লে বাংলাদেশের সোনারগাঁও, খুলনা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে কিছু সংখ্যক জমিদার স্বাধীন রাজার মতো রাজত্ব করতে থাকেন। সম্রাট আকবর ১৫৭৫ সালে বাংলা দখল করার পর এসকল জমিদার ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোগল সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। 'বারো ভুঁইয়া' নামে পরিচিত এই সকল জমিদাররা হলেন:

  1. ঈসা খাঁ - খিজিরপুর বা কত্রাভূ,
  2. প্রতাপাদিত্য - যশোর বা চ্যাণ্ডিকান,
  3. চাঁদ রায় ও  কেদার রায় - শ্রীপুর বা বিক্রমপুর,
  4. কন্দর্প রায় রামচন্দ্ররায় - বাক‌্লা বা চন্দ্রদ্বীপ,
  5. লক্ষ্মণমাণিক্য - ভুলুয়া,
  6. মুকুন্দরাম রায় ও সত্রাজিৎ রায়, ভূষণা বা ফতেহাবাদ,
  7. ফজল গাজী - ভাওয়াল ও চাঁদপ্রতাপ,
  8. বীর হাম্বীর - বিষ্ণুপুর,
  9. কংসনারায়ন রায় - তাহিরপুর,
  10. রাজা রামকৃষ্ণ - সাতৈর বা সান্তোল,
  11. পীতম্বরনীলাম্বর - পুঁটিয়া, এবং
  12. ঈশা খাঁ লোহানীউসমান খাঁ লোহানীঃ - উড়িষ্যা ও হিজলী।[1]
যে সিরিজের অংশ সেটি হল
বাংলার ইতিহাস
প্রাচীন বাংলা
 বৈদিক যুগ 
বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহ
গঙ্গারিডাই, বঙ্গ,
পুণ্ড্র, সুহ্ম,
অঙ্গ, হরিকেল

মৌর্যযুগ
ধ্রুপদী বাংলা
ধ্রুপদী যুগ
শশাঙ্ক
সাম্রাজ্যের যুগ
পাল সাম্রাজ্য, সেন সাম্রাজ্য
মধ্যযুগীয় বাংলা
ইসলামের আগমন
বাংলা সুলতানী, দেব রাজ্য
বখতিয়ার খিলজি, রাজা গণেশ, জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ, হুসেন শাহী রাজবংশ

মুঘল যুগ
কন্দর্প রায়, প্রতাপাদিত্য, রাজা সীতারাম রায়
বাংলার নবাব, বারো ভুঁইয়া, রাণী ভবাণী

আধুনিক বাংলা
কোম্পানি রাজ
পলাশীর যুদ্ধ, জমিদারী ব্যবস্থা, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
ব্রিটিশ ভারত
বাংলার নবজাগরণ
ব্রাহ্মসমাজ
স্বামী বিবেকানন্দ, জগদীশচন্দ্র বসু,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসু

উত্তর-সাম্রাজ্য যুগ
বঙ্গভঙ্গ (১৯৪৭), বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ
শেখ মুজিবুর রহমান, জ্যোতি বসু, বিধানচন্দ্র রায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা

এছাড়াও দেখুন
বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ

সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) তার জীবদ্দশায় সমগ্র বাংলার উপর মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি। কারণ বাংলার বড় বড় জমিদারেরা স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে মুঘলদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।তারা বারভূঁইয়া নামে পরিচিত। এখানে 'বারো' বলতে অনির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝায়।তারা কখনো দিল্লীতে কর দিতেন,কখনো বা দিতেন না এবং অনেকবার কেন্দ্রীয় শক্তিকে পরাস্ত করে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করতেন | বলা হয় সম্রাট বাবরের সময় থেকেই বাংলায় মোগল আক্রমণ শুরু হলেও মোগল শাসনের সমগ্র বাংলা থেকে পরিপূর্ণ খাজনা আদায় একমাত্র শাহজাহানের সময় সম্ভব হয়েছিল | বাবরের আত্মজীবনীতে বাঙালিদের প্রতি তার রাগের উল্লেখ দেখা যায় – ” বাঙালিদের আমি দেখে নেব |”

ঈসা খাঁ

ঈশা খাঁর জমিদার বাড়ি, সোনারগাঁও

বারভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন। মুঘল সেনাপতি মানসিংহ জীবনে কখোনো পরাজিত করতে পারেননি ঈসা খাঁ'কে। ১৫৩৭ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার সরাইল পরগণায় ঈসা খাঁর জন্ম। তার পিতা কালিদাস গজদানী ভাগ্যান্বেষণে অযোধ্যা থেকে গৌড়ে এসে স্বীয় প্রতিভা গুণে রাজস্বমন্ত্রী পদে উন্নীত হন।পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তার নাম হয় সুলাইমান খাঁ।তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৫৩৩-৩৮) মেয়েকে বিয়ে করে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল পরগণা ও পূর্ব মোমেনশাহী অঞ্চলের জায়গীরদারী লাভ করেন। ১৫৪৫ সালে শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করার পর সুলাইমান খাঁ দিল্লীর আনুগত্য অস্বীকার করলে কৌশলে তাকে হত্যা করে তার দুই নাবালক পুত্র ঈসা খাঁ এবং ইসমাইল খাঁকে একদল তুরানী বণিকের নিকট বিক্রি করা হয়। ১৫৬৩ সালে ঈসা খাঁর চাচা কুতুব খাঁ রাজকার্যে নিযুক্তি লাভ করে বহু অনুসন্ধানের পর সুদূর তুরান দেশের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ২ ভ্রাতুস্পুত্রকে উদ্ধার করেন। এ সময় ঈসা খাঁ'র বয়স মাত্র ২৭ বছর। সুলতান তাজ খাঁ কররানী (১৫৬৪-৬৫) সিংহাসনে আরোহণ করে ঈসা খাঁকে তার পিতার জায়গীরদারী ফেরত দেন। বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খাঁ কররানীর রাজত্বকালে (১৫৭২-৭৬) ঈসা খাঁ বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেন অসাধারণ বীরত্বের জন্যে।

১৫৭৫ সালের অক্টোবর মাসে বাংলার সুবাদার মুনিম খাঁর মৃত্যু হলে আফগান নেতা দাউদ খাঁ কররানী স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজ নামে বাংলা ও বিহারে খুতবা পাঠ করান। স্বাধীন ভূঁইয়ারাও তাকে অনুসরণ করে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

এরপর অনেক বীরত্বগাথাঁ রচিত হয়। সর্বশেষ ১৫৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর হতে ১২ মাইল দূরে ঈসা খাঁ,মাসুম খাঁ কাবুলীর সম্মিলিত বাহিনী দুর্জন সিংহকে (মানসিংহের ছেলে) বাধা দিলে দুর্জন সিংহ বহু মুঘল সৈন্যসহ নিহত হন। অনেকে বন্দী হন।কিন্তু সুচতুর ঈসা খাঁ মুঘলদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা উচিত বলে মনে করে আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। তিনি বন্দীদের মুক্তি দেন এবং মানসিংহের সাথে আগ্রায় গিয়ে সম্রাট আকবরের সাথে সাক্ষাত করেন।সম্রাট এ বীর পুরুষকে দেওয়ান ও মসনদ-ই-আলা উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৫৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তার মৃত্যু হয়।

মাসুম খাঁ কাবুলী

তিনি প্রথমে সম্রাট আকবরের সেনাপতি ও বাংলার শাসনকার্যে নিয়োজিত ছিলেন। আকবরের "দ্বীন-ই-এলাহী" প্রবর্তন করলে মুঘল কর্মকর্তারা বাংলায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মাসুম খাঁ ছিলেন বিদ্রোহীদের অন্যতন নেতা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মুঘল বিরোধিতা অক্ষুণ্ন রাখেন। ১৫৯৯ সালে তার মৃত্যু হয়।

মুসা খাঁ

ঈসা খাঁর পুত্র মুসা খাঁ সম্রাট জাহাংগীরের আমলে (১৬০৫-২৭) ভূঁইয়াদের মধ্যে সর্বাপাক্ষা শক্তিশালী ছিলেন। তিনি মুঘল আনগত্য অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে আজীবন যুদ্ধ করেন। বৃহত্তর ঢাকা,কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলার অধিকাংশ স্থান নিয়ে তার রাজত্ব গঠিত হয়েছিল। সোনারগাঁ ছিল তার রাজধানী।১৬১১ সালের এপ্রিল মাসে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে সোনারগাঁয়ের পতন ঘটে। মুসা খাঁ মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করেন।

ফজল গাজী

তিনি শেরশাহ এবং সম্রাট আকবরের সমসাময়িক।বীরত্বের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। মুঘলদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন।

বাহাদুর গাজী

তিনি তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে মুসা খাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেন।মুসা খাঁ পরাজিত হলে বাহাদুর গাজী মুঘলদের পক্ষে যোগদান করে যশোর ও কামরূপ অভিযানে অংশ নেন।

খাজা উসমান খাঁ লোহানী

তিনি কখনো মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করেননি এবং প্রাণ বিসর্জন দেন।তিনি ২ হাজার অশ্বারোহী, ৫ হাজার পদাতিক ও ৪০ টি হস্তীর এক বাহিনী নিয়ে মুঘলবাহিনীর গতিরোধ করতে উষার ত্যাগ করেন। শেরে ময়দান, খাজা ইব্রাহীম এবং খাজা দাউদ প্রমুখ আফগান নেতৃবৃন্দ স্ব স্ব সৈন্যবাহিনী নিয়ে উসমান বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলেন। ৪৪-পরগনার দৌলম্ভপুর গ্রামে তারা সমবেত হন। সেখান থেকে মাত্র দেড়মাইল দূরে ছিল মুঘলবাহিনীর শিবির। ১৬১২ সালের ১২ মার্চ, রোববার ভোরবেলা মুঘলবাহিনী প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করে।ক্রমেই উভয়পক্ষের আক্রমণ তীব্র হয়ে উঠে।দুপুরবেলা মুঘল সৈনিক আব্দুল জলীল শেখের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে খাজা উসমান নিহত হন।

বায়েজিদ কররানী

সম্রাট জাহাংগীরের আমলে তিনি সিলেটে রাজা ছিলেন। বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আফগান সর্দার তার বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। খাজা উসমা্নের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। খাজা উসমা্নের পতন সংবাদে বায়েজিদ আত্মসমর্পণ করেন। বায়েজি্দের পতনে মুঘলদের বিরুদ্ধে আজাদী আন্দোলনের শেষ স্ফুলিংগ নিভে যায় এবং গোটা বাংলা দিল্লী সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।

প্রতাপাদিত্য

(১৫৬১–১৬১১ খ্রিষ্টাব্দ) একজন জমিদার ছিলেন, পরবর্তীতে একজন হিন্দু রাজা হিসাবে আত্ম প্রকাশ করেন।, বারো ভুঁইয়ার অন্যতম প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তার রাজ্য উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে শুরু করে, বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, যশোর ও নড়াইল পর্য়ন্ত বিস্তৃত ছিল।যশোরের ইতিহাস প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস। তার ২৫ বছরের রাজত্বকালের গৌরবগাঁথা আজ পর্যন্ত যশোর-খুলনা অঞ্চলে বিদ্যমান।

বীর হাম্বীর

মল্ল রাজবংশের ৪৯তম শাসক বীর হাম্বীর ১৫৮৬ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবরের সমসাময়িক। আফগানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি আকবরের পক্ষাবলম্বন করেন। মুসলমান ঐতিহাসিকগণ তার নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি বাংলার সুবাদারের নিকট বার্ষিক রাজস্ব প্রদান করতেন এবং মুঘল সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেন।

বীর হাম্বীর ছিলেন শক্তিশালী ও ধার্মিক রাজা। শ্রীনিবাস আচার্য তাকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করেন। নরোত্তম দাস (ওরফে বলরাম দাস) রচিত প্রেমবিলাস ও নরহরি চক্রবর্তী রচিত ভক্তিরত্নাকরগ্রন্থ থেকে জানা যায়, শ্রীনিবাস ও অন্যান্য ভক্তেরা বৃন্দাবন থেকে গৌড় যাত্রাপথে হাম্বীর কর্তৃক লুণ্ঠিত হন। কিন্তু শ্রীনিবাসের ভাগবত পাঠ শুনে তিনি বৈষ্ণবধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং শ্রীনিবাসকে প্রচুর অর্থ ও ভূসম্পত্তি দান করেন। তিনি বিষ্ণুপুরে মদনমোহন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

চাঁদ রায় ও কেদার রায়

বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম হল ভ্রাতৃদ্বয় কেদার রায় ও চাঁদ রায়| কেউ কেউ কেদার রায়কে শ্রেষ্ঠ ভুঁইয়া বলেছেন এবং মহারাজ প্রতাপাদিত্যের থেকেও অধিক বীর ও চরিত্রবান বলেছেন|বিক্রমপুরের জমিদার।

মুকুন্দরাম রায়

রাজা মুকুন্দ রাম রায় ছিলেন ভূষণা অঞ্চলের একজন প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার এবং পরবর্তীতে তিনি নিজেকে ভূষণা রাজ্যের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রথমে তিনি মোঘলদের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং জলদস্যুদের দমন পূর্বক তিনি মোঘলদের কর দেয়া বন্ধ করে মোঘলদের সংগে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

অসমের বারো ভূঁইয়া

আসামের বারো-ভূঁইয়া দুটি প্রধান দলে বিভক্ত করা যেতে পারে: আদী ভূইয়া বা পূর্ব গোষ্ঠী এবং পশ্চিমা গোষ্ঠী।

পূর্ব গোষ্ঠী বা আদি ভূঁইয়া

উত্তরের বারো ভূঁইয়াদের উত্স রহস্য হয়ে আছে। আসল গোষ্ঠীটিকে প্রায়ই আদি ভূইয়া হিসাবে অভিহিত করা হয়। ১২৮২ সালে সুকফা অহম রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার সময় আদি-ভূঁইয়াগণ ইতোমধ্যে চুটিয়া রাজ্যের পশ্চিমে অবস্থিত অঞ্চলে আবদ্ধ হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কিংবদন্তী অনুসারে, দুই ভাই সাঁতানু ও সুমন্তের প্রত্যেকের বারো পুত্র ছিল এবং তারা মূল বোর বারো- ভূঁইয়া ও সরু বারো-ভূঁইয়া। সরু বারো-ভূঁইয়া শীঘ্রই নওগা জেলায় চলে এলেন। বার বারো-ভূঁইয়া চুটিয়ার পাশাপাশি কাচারি রাজ্যের শক্তির সাথে লড়াই করেছিলেন। তারা চুটিয়া এবং কাচারী রাজ্যের বিরুদ্ধে অহমদের রাজা সুহংমুং এর অভিযানে যোগদান করেছিল। তাদের সহায়তাকারী, বারো-ভূঁইয়ারা উপনদীর উত্তরে সামন্ত জমিদার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অহম রাজ্যের বিরুদ্ধে চিল্লারায়ের প্রথম অভিযানের সময়, অহমরা অহম রাজ্যের সাথে ছিল (যাতে চিলারায় হারেন), কিন্তু দ্বিতীয় অভিযানের সময় তারা কোচদের সাথে ছিল (যা চিলারায় জিতেছিল)। ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে এই গোষ্ঠীটি প্রতাপ সিংহ কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়েছিল, যিনি ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে তাদের স্থানান্তরিত করেছিলেন।

বারো-ভূঁইয়াদের সাথে সংঘর্ষের পর পশ্চিমে যাওয়া সরু ভূঁইয়া চাঁদিভারকে সুমন্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র কানভজরকে বংশধর বলে অনেকে, কিন্তু এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়।

পশ্চিম গোষ্ঠী

পশ্চিমা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ভূঁইয়াদের প্রাচীনতম প্রমাণগুলির মধ্যে একটি হল পুরুষোত্তম দাশের রৌত-কুচি অনুদান (১৩২৯) । পরবর্তী বারো-ভূঁইয়ারা পূর্বে কাচারি রাজ্য ,পশ্চিমে কামতা রাজ্য ও দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর পর্যন্ত নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল । নিওগের মতে, গোষ্ঠীর নেতা , চাঁদিভারা মূলত কনৌজ এর শাসক ছিলেন, ফিরোজ শাহ তুগলক এর ১৩৫৩ এ শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ বিরোধী প্রচারের জন্য তাকে ধর্মনারায়ণের রাজত্বে গৌড়ে পালিয়ে আসতে হয়।ধর্মনারায়ণ ও কামতা রাজ্যের দুর্লভনারায়ণের মধ্যে হওয়া চুক্তির ফলে, সাত কায়স্থ ও সাত ব্রাহ্মণ পরিবারগুলির একটি দল চাঁদিভারার নেতৃত্বে বর্তমান গুয়াহাটির উত্তরে কয়েক মাইল উত্তরে লাঙ্গামাগুরিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। [2] চাঁদিভারা এবং তার দল দীর্ঘদিন ধরে লাঙ্গামাগুরিতে থাকত না কারণ এটি প্রায়শই ব্রহ্মপুত্র দ্বারা প্লাবিত হত এবং ভূঁইয়াদের বঞ্চনার কারণে শীঘ্রই বর্ডোওয়া চলে গেল (যা বর্তমানে নওগা জেলা) দুর্লভনারায়ণের সমর্থনে। [2] চাঁদিভারা এর বংশধরদের একজন হলেন শ্রীমন্তশঙ্করদেব । পাঁচ ভূঁইয়ার একটি দ্বিতীয় দল পরে চাঁদিভারার দলে যোগদান করে।[2]

পরবর্তীতে এই ভূঁইয়াদের সদস্যরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ, যিনি ১৪৯৮ সালে নীলাম্বর কে পরাজিত করে খেন রাজবংশ কে করেছিলেন, তার শাসন বর্ধাদী নদী পর্যন্ত বর্ধিত করেছিলেন, হররুপনারায়ণকে পরাজিত করে যিনি ছিলেন গন্ধর্ব রায়ের বংশধর। তিনি ছিলেন বৌসি ('বোয়াসির' ছোটো রাজা) দুর্লভনারায়ণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় গোষ্ঠীর ভূঁইয়া। বারো-ভূঁইয়ারা প্রতিশোধ গ্রহণ করেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসন শেষ করে, তার পুত্র দানিয়ালকে হারানোর মাধ্যমে। কিন্তু খুব শীঘ্রই, কামতায় কোচ সাম্রাজ্যের বিশ্বসিংহের উত্থান তাদের ধারণাকে ধ্বংস করেছিল। তারা কোচদের বিরুদ্ধে পূর্বের নওগা অঞ্চলে পিছিয়ে ছিল। ১৬ তম শতাব্দীর প্রথম ত্রৈমাসিকে বারো-ভূঁইয়া গোষ্ঠীদের পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্রের উত্তর তীরে স্থানান্তরিত হতে হয়েছিল। কোচ এবং আহম ক্রমবর্ধমান দ্বন্দে তারা তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলে।

তথ্যসূত্র

  1. হাবিব ইবনে মোস্তফা; মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল; শামিউল আমিন শান্ত (জুলাই ২০১২)। "বাংলার বার ভূঁইয়া"যশোর ডট ইনফো। সংগ্রহের তারিখ ১৭ মে ২০১৭
  2. (neog 1980)
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.