বীর হাম্বীর

হাম্বীর মল্ল দেব, এছাড়াও বীর হাম্বীর (Beera Hambeera)বীর হাম্বীর নামে পরিচিত, মল্লভূমের উনপঞ্চাশতম রাজা।বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে অন্যতম।

হাম্বীর মল্ল দেব
মল্লভূম এর ৪৯ তম রাজা
রাজত্ব১৫৬৫ - ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ
পূর্বসূরিধারী মল্ল
উত্তরসূরিধারী হাম্বীর মল্ল দেব, রঘু নাথ সিংহ
ধর্মহিন্দু

তিনি ১৫৬৫ থেকে ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দ শাসন করেন। [1] [2][3] মল্ল রাজবংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন রাজা বীর হাম্বির।পারিবারিক নথি অনুযায়ী, বিষ্ণুপুরের রাজারা মুসলমান শাসকদের রাজস্ব প্রদান করলেও, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তারা স্বাধীনই ছিলেন। মুসলমান ঐতিহাসিকেরাও এই ব্যাপারে একই কথা লিখছেন। বিষ্ণুপুরের রাজারা করদ রাজা হলেও, মুর্শিদাবাদের দরবারে তাদের উপস্থিত থাকতে হত না। তবে মুর্শিদাবাদে তাদের একজন রাজপ্রতিনিধি থাকতেন। বাংলার উর্বর অংশের মুসলমান শাসকেরা এই অরণ্যরাজ্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন না। তারা এই অঞ্চলে কখনও আসেনওনি। এই কারণে, শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল বিষ্ণুপুরের রাজারা নির্বিঘ্নে শাসনকাজ চালিয়ে যান। পরবর্তীকালে অবশ্য মুঘল রাজশক্তি এই অঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। মাঝে মাঝে মুঘল বাহিনী বিষ্ণুপুরের নিকটে এসে রাজস্ব দাবি করত এবং সম্ভবত বিষ্ণুপুরের রাজারা রাজস্ব দিয়েও দিতেন।

ব্যক্তিগত জীবন

ধারীমল্লের পুত্র বীর হান্ধীরের সময়ে মল্লভূমরাজ্য উন্নতির চরমশিখরে আরোহণ করে। মল্ল রাজবংশের ৪৯তম শাসক বীর হাম্বীর ১৫৮৬ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন।তিনি সেনাবাহিনীর ও দুর্গের পুনর্গঠন করেন। তিনি ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবরের সমসাময়িক।পাঠান সর্দার সুলেমান কররানী নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করলে,রাজা হাম্বীর মুঘল সম্রাট আকবরের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। ১৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার নবাব সোলেমান কররানীর পুত্র দাউদ খান বিষ্ণুপুর আক্রমণ করেন, কিন্তু বীর হাম্বীরের হস্তে তাহাব পরাজয় ঘটে। দুর্গের পূর্বদ্বারে মৃত নবাব সৈন্যের এত শবদেহ জমিয়াছিল যে উহা “মুণ্ডমালাঘাট” নামে আখ্যাত হয়।[4] রাজা পরাক্রমের সহিত সে হামলা মোকাবেলা করেন এবং দাউদ খানকে বন্দী করেন। পরে অবশ্য সসম্মানে তাকে মুক্তি দেন। তিনি বাংলার সুবাদারের নিকট বার্ষিক রাজস্ব প্রদান করতেন এবং মুঘল সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেন।[5]

এর পরেই ঘটে পালা-বদল।বীর হাম্বীর ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি যিনি বৈষ্ণববাদের অনুসরণ শুরু করেছিলেন। দুই বৈষ্ণব ( নিত্যানন্দ দাস (ওরফে বলরাম দাস) এর প্রেম-বিলাস এবং নরহরি চক্রবর্তী এর ভক্তি রত্নাকর এ উল্লেখ করেছেন যে শ্রীনিবাস ও অন্যান্য ভক্তরা বৃন্দাবন থেকে গৌড় পর্যন্ত বহু বৈষ্ণব পান্ডুলিপি নিয়ে ভ্রমণের সময় বীর হাম্বীর তাদেরকে লুট করেছিল। বীর হাম্বীর শ্রীনিবাসের ভাগবত পড়ার পর শৈব উপাসক বীর হাম্বীর মহাপ্রভুর শিষ্য আচার্যের কাছে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন এবং শ্রীনিবাসকে বহু জমি ও অর্থ দেন।

বংশধর

হাম্বীর এবং তার পুত্র ও পৌত্র রঘুনাথ সিংহ ও বীর সিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় সমস্ত সপ্তদশ শতক জুড়ে বৈষ্ণবধর্মাশ্রিত সাহিত্য, সঙ্গীত, মন্দির স্থাপত্য, এবং চিত্রকলা এক অসাধারণ সৃজনশীলতা নিয়ে বিকাশলাভ করল। এই সাংস্কৃতিক বিকাশ অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইংরেজ শাসনের সূচনাকালে বিষ্ণুপুর রাজাদের বিপর্যয় ঘটার আগে পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থেকে বাংলার পরস্পরা গত কলা শিল্প কে আধুনিক কালের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছিলো।

মদনমোহন ও বিষ্ণু মন্দির

তিনি বিষ্ণুপুরের মদন মোহন পূজা শুরু করেন। [5] মদনমোহনের প্রাপ্তি নিয়ে অনেক মত আছে ,

  • মল্লরাজ বীর হাম্বীর বৃন্দাবন থেকে মদনমোহনের একটি মূর্তি এনেছিলেন। ফকির নারায়ণ কর্মকার প্রণীত বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী গ্রন্থটিতেও তার ইঙ্গিত আছে।  কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী মদনমোহনের মন্দিরটি বিষ্ণুপুরে স্থাপিত হয় 1694 সালে মল্ল রাজা দুর্জন সিংহের আমলে। অর্থাৎ বীর হাম্বীরের রাজত্বকাল শেষ হবার আনুমানিক ৭৪ বছর পরে।
  • এই প্রসঙ্গেই উঠে আসে আর একটি প্রচলিত জনশ্রুতি। শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে দীক্ষা নেবার পর বীর হাম্বীর মনস্থ করেন বৃন্দাবন যাবেন এবং সেখান থেকে মদনমোহনের একটি মূর্তি নিয়ে আসবেন। বৃন্দাবন যাত্রার আগে তিনি এক গ্রীষ্মের দিনে মৃগয়ায় গিয়ে এক জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়েন। প্রচণ্ড খুধা তৃষ্ণায় জীবন যায় যায় অবস্থা। কোথাও কিছু নেই। হঠাত এক গোয়ালিনীকে আসতে দেখে তিনি  জল চাইলেন। কিন্তু গোয়ালিনীর কাছে জল ছিলনা। কিছুটা মাত্র দই অবশিষ্ট ছিল। তাই খেয়েই সে যাত্রা তার প্রাণ রক্ষা হয় এবং তিনি সংকল্প করেন সেখানে একটি জনবসতি এবং  দেবালয় স্থাপন করবেন। তার ইচ্ছা অনুসারে গড়ে উঠে জনপদ। সেই গ্রামটিই বর্তমান বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত দধিমুখা। অনেকে বলেন এখানেই গোয়ালিনী তার মুখে দধির ভাণ্ড ধরেছিলেন, তাই নাম হয়েছিল ‘দধিমুখ’। তা থেকে মুখে মুখে দধিমুখা। আবার অনেকে বলেন ঐ অঞ্চলে প্রচুর দধিমুখ বা বানরের উৎপাত ছিল, তাই ওইরকম নামকরণ। কোনটিরই কোন তথ্যগত প্রমাণ পাওয়া যায়না।পরিকল্পনা মত বৃন্দাবন গিয়েছিলেন বীর হাম্বীর। তার সঙ্গে গিয়েছিলেন রামচরণ সিং জমাদার। তিনি ছিলেন দধিমুখার পার্শ্ববর্তী গ্রাম হরেকৃষ্ণপুরে্র জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারী। সবই তখন মল্লরাজাদের অধীন। বৃন্দাবন  থেকে তারা নিয়ে এসেছিলেন মদনমোহনের একটি বিগ্রহ। বৃন্দাবনে তখন সেবাইত ছিলেন সুবলচন্দ্র দাস গোস্বামী। মল্লরাজের ইচ্ছানুযায়ী বিগ্রহটি স্থাপিত হল দধিমুখা গ্রামে একটি মন্দির তৈরি করে। এখনও দধিমুখা ভাণ্ডারে যে মদনমোহনের বিগ্রহ পুজো হয় সেটি কষ্টিপাথরের এবং জনশ্রুতি অনুযায়ী আর ‘ভাণ্ডার’ এর পরিচালক ও সেবাইত শ্রীশুকদেব কিশোর দেব গোস্বামীর বয়ান অনুযায়ী সেটিই বৃন্দাবন থেকে নিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং বীর হাম্বীর।
  • আরো এক মতে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজবংশের পরাক্রান্ত রাজা বীর হাম্বীর গিয়েছিলেন মৃগয়ায়। রাতে বিশ্রাম নিতে আশ্রয় নিলেন এক তান্ত্রিকের কুটিরে। নজরে পড়লো এক অপুর্ব রাধামাধব মূর্তি। চোখ ফেরাতে পারলেন না। মনে মনে ঠিক করে ফেললেন হস্তগত করবেন এই বিগ্রহ। ভোররাত্রে তান্ত্রিক যখন নিদ্রামগ্ন, হাম্বীর মল্ল বিগ্রহ নিয়ে চলে এলেন বিষ্ণুপুরে। প্রতিষ্ঠা করলেন মদনমোহনের। বিষন্ন তান্ত্রিক হাজির হলেন রাজদরবারে। ফেরত চাইলেন বিগ্রহ। কোনওমতেই রাজী হলেন না রাজা। বললেন ধনসম্পত্তি যা চাও নিয়ে যাও, মদনমোহনকে দেব না। প্রিয় দেবতাকে হারিয়ে হতাশ সাধক দিলেন অভিশাপ – যার জন্য তুমি আজ আমার চোখের জল ফেলালে, আমার ঘর খালি করে দিলে, একদিন ঠিক এমনই একটি দিন আসবে তোমার পরিবারে।

বীর হাম্বীরের বৈষ্ণব ধৰ্ম্মগ্রহণ মল্লভূমের ইতিহাসে এক নূতন অধ্যায়। মল্লভূমের তৎকালীন চিন্তায়, চর্চায়, শিক্ষা দীক্ষায় সমগ্র জীবন যাপনে যার গভীর প্রভাব পড়েছিল। মল্ল বংশে তিনিই প্রথম রাজা যিনি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন এবং তাঁহারই সময়ে মল্লভূমে বৈষ্ণব ধর্মের বিস্তৃতি ঘটে ।।এর ঠিক পর পরই মল্লরাজা হাম্বীরের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে একের পর এক বিষ্ণু মন্দির। তার মধ্যে ১৬০০ খ্রীস্টাব্দে বীরহাম্বির কতৃক নির্মিত রাসমঞ্চ টি অন্যতম।বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে সামান্য দূরে দ্বারকেশ্বর নদের উত্তর পাড়ে ধরাপাট গ্রামে একটি মন্দির আছে। মন্দিরটি যা পাথর দিয়ে তৈরি। তার উপরে চুন-সুরকির পলেস্তারা দেওয়া ছিল। মন্দিরের নিচের অংশের রং ছিল সাদা। উপরের অংশটি ছিল কালো। সংস্কারের পরে পুরো মন্দিরটিই ঝকঝকে গেরুয়া রঙের হয়ে গিয়েছে। সংস্কারের সময়ে মন্দিরগাত্রের অলঙ্করণেও কিছু পরিবর্তন ঘটেছে।মল্ল রাজা বীর হাম্বীর ১৬০৩ সালে মন্দিরটির সংস্কার করেছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। তাই তিনি ধরাপাটের মন্দিরের গায়ে পুব দিকে একটি তিন ফুটের বাসুদেব মূর্তিও স্থাপন করেন বলে অনুমান করা হয়। মন্দিরটির পশ্চিম দিকে রয়েছে পার্শ্বনাথের মূর্তি। [6]

মোঘলদের সাথে সুসম্পর্ক

মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। আকবরের সেনাপতি রাজা মান সিংহর ছেলে রাজা জগৎ সিংহকে তিনি সাহায্য করেছিলেন বলে আবুল ফজলের লেখা থেকে জানা যায়। [6] ১৫৯০ সালে উত্তর ওড়িশার অধিপতি আফগান শাসক কতলু খান লোহানীর সঙ্গে এই অঞ্চলে যুদ্ধ হয়েছিল মুঘল সেনাপতি মানসিংহের পুত্র জগত সিংহের। পাঠান সেনানায়ক বাহাদুর কুরুর চক্রান্তে জখম হয়েছিলেন জগত সিংহ। তাকে উদ্ধার করে বিষ্ণুপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন মল্লরাজা বীর হাম্বীর। কিন্তু রটে গিয়েছিল ওই যুদ্ধে জগত সিংহ মারা গিয়েছেন। সে সংবাদ শুনে কতলু খানের বিরুদ্ধে নিজে অস্ত্র ধরেন মানসিংহ। যুদ্ধ জয়ের ১০ দিনের মাথায় প্রাণ যায় কতলু খানের। জনশ্রুতি রয়েছে, তার দেহ এখানেই কবর দেহ দেওয়া হয়। তাকে কোতল করা হয়েছিল বলে সেই থেকে এই জনপদের নাম কোতুলপুর।[7]

পদকর্তা বীরহাম্বীর

এরপরই তিনি বৈষ্ণব ভাবধারায় জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। তার রচিত দুটি পদ পাওয়া গিয়েছে। দুটি পদেই “বীর হাম্বীর” ভণিতা দেওয়া রয়েছে। প্রথম পদটি “প্রভু মোর শ্রীনিবাস পূরাইলা মনে আশ” রচনা করেছিলেন শ্রীনিবাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পরেই। দ্বিতীয় পদটি “শুন গো মরম-সখি কালিয়া কমল- আঁখি”।

দেব উপাধি

তার শাসনামলে (১৫৬৫ থেকে ১৬২০) ,মল্ল এবং মল্ল‌ভূম নিরাপদ এবং সুরক্ষিত হওয়ার পর তিনি দেব উপাধি গ্রহণ করেন। [8]

রাসমঞ্চ

বিষ্ণুপুরের ঐতিহাসিক ভবন রাসমঞ্চ বিষ্ণুপুরে অবস্থিত। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে এটি মল্ল রাজা বীর হাম্বির দ্বারা নির্মিত হয়।বিষ্ণুপুরে এটিই সর্বপ্রথম নির্মিত বিষ্ণু মন্দির।স্থাপত্য বিন্যাসে অদ্বিতীয় এই রাসমন্চ মন্দিরের গঠনাকৃতির অনুরূপ অন্য কোনো স্থাপত্য সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষের আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। ৫ ফুট উঁচু ও ৮০ বর্গফুট আয়তনের দেশী লাল মকরা পাথরের আসনের উপর ইটের তৈরি ৩৫ ফুঁট উঁচু প্রধান মন্দির ।সম্পূর্ণ মন্দির টি সূর্যে পোড়ানো ইটের গাঁথা।তবে গাঁথার জন্য লোহার রড বা সিমেন্টের ব্যবহার করা হয়নি।প্রচুর পরিমানে চুন,গাছের আঠা এবং কাঁদামাটির মিশ্রণ ও সুরকী ব্যবহার করে মন্দিরের ইট গুলিকে গাঁথা হয়েছিলো। মন্দিরটি তৈরী হওয়ার পর,সৌন্দর্যায়নের জন্য ইটের গাঁথুনির উপর দেওয়া হয় টেরাকোটার আচ্ছাদন ।সমগ্র মন্দির গাত্রে বসানো হয়েছে অসংখ্য টেরাকোটার ফলক এবং পাথরে খোদাইকৃত নকশা। অলঙ্করনের বিষয়বস্তু হল মানবমানবী,সমাজজীবন,ঘোড়া,পালকী,ফুল­­­,পাতা ,রামায়ণ ও রাধা কৃষ্ণের আখ্যান ইত্যাদি।

এই ধর্মীয় স্থাপত্যটি তিন প্রকার স্থাপত্য রীতির অনুকরনে নির্মিত।চারিদিক থেকে ধাপে ধাপে চাল ছাদে গিয়ে মিলিত হয়েছে।মন্দিরের একদম শীর্ষেস্থানে রয়েছে এক প্রকান্ড ১১মিটার উুঁচু মিশরীয় পিরামিডের ন্যায় চূড়ামুলক ছাঁদ।এই চূড়ামূলক পিরামিডটির চারিদিকে ৫১/৫২ টি সিঁড়ি বেষ্টিত।

এবং এই ছাঁদকে প্রধান লক্ষ্য করে এর শেষ পর্যায়ের চার কোনায় চারটি চারচালা এবং নিচের প্রকোষ্ঠের দুই দিকের খিলান আচ্ছাদিত স্তম্ভ গুলির উপরের প্রতিটিদিকে চারটি করে বাংলার দোঁচালা আকৃতির ছাঁদ রাখা হয়েছে,অর্থাৎ চারিদিকে মোট ৬টি করে চালা যুক্ত করে ,ইমারতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।

ইসলামিক স্থাপত্যের অনুকরনে মন্দিরের খিলানবৃত্ত বিশিষ্ট দরজা গুলি নির্মিত হয়।

দূর থেকে লক্ষ করলে মনে হয় যেন একটি পাহারের কোলে একটি ছোট্ট গ্রাম বাংলা গড়ে উঠেছে।মূল সৌধকে বেস্টন করে বেদীটি চারিদিকে সমান পরিমাপের প্রশস্ত।

গর্ভগৃহ ও তার দক্ষিণে ছোটকক্ষটিকে ঘিরে তিন প্রস্থ ও ১.৩ মিটার চওড়া খিলান বিশিষ্ট ধারাবাহিক ও প্রদক্ষিত দেওয়াল চারিদিকে বেস্টন করে আছে।একেবারে ভিতরের দেওয়ালের প্রতিদিকে পাঁচটি,দ্বিতীয় দেওয়ালের প্রতিদিকে আটটি এবং বাইরের দেওয়ালের প্রতিদিকে আটটি এবং বাইরের দেওয়ালে আটকানো প্রসস্থ ফুলকাটা খিলান বড় স্তম্ভের ওপর সংস্থাপিত।মন্দিরের প্রত্যেকদিকে রয়েছে ১১ টি করে ইটের নির্মিত ফুলকাটা খিলানবৃত বড়ো বড়ো স্তম্ভ।সম্পুর্ন মন্দিরের চারিদিকে ১.৩ মিটার চওড়া ও ১.৯ মিটারের উুঁচু ,১০ টি করে দরজা রয়েছে। প্রত্যেকটি দরজার উপরে ফুলকাটা খিলান গুলিতে টেরাকোটার নির্মিত প্রুষ্ফুটিত পদ্মের অলঙ্করন দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল এই মন্দিরে সারা বছরে কোনো পূজা হত না বা কোনো প্রতিষ্ঠিত মূর্তিও ছিলো না ,তবে প্রতি বছর মল্ল রাজাদের আমলে অঘ্রায়ণ মাসের রাসপূর্ণিমা তিথীতে বার্ষিক রাস উৎসব উদযাপনের সময় বিষ্ণুপুরের যাবতীয় মন্দিরের দেব-বিগ্রহ জনসাধারনের দর্শনের জন্য এখানে নিয়ে এসে পূজা করা হত। রাধাকৃষ্ণের মূর্তি অলিন্দে সাজিয়ে রাসলীলা করা হতো।[9]

রাসমঞ্চের দক্ষিণে প্রশস্ত সমতল ভূমি,পুর্বপার্শ্বে অপেক্ষাকৃত কম প্রশস্ত ভূমি।সমস্ত মিলিয়ে দেখলে মনে হয় রাসমঞ্চ এর ৫ ফুট উঁচু বেদীতে রাস যাত্রাভিনয় হত।আর দক্ষিণে ও পুর্বের সমতল জায়গায় বসে দর্শকগণ যাত্রাভিনয় দর্শণ করত।১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এখানে রাস উৎসব পালিত হয়েছে।বর্তমানে মল্ল রাজাদের স্বৃতি বিজড়িত, ৪১৬ বছরের প্রাচীন এই মন্দিরটি ইউনেস্কোর সুরক্ষার অধীনে রয়েছে।

দল মাদল কামান

বীর হাম্বিরের শাসনামলে দল মাদল, যা সবচেয়ে বড় কামানগুলির মধ্যে একটি, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।যা সেই সময়কার কারিগরদের দক্ষতা প্রদর্শন করে। [10] দল মাদল জগন্নাথ কর্মকার দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। "দল মাদল" মানে "শত্রুদের ধ্বংস"। [11]বিষ্ণুপুরের সুবিখ্যাত দলমাদল কামানটির দৈর্ঘ ১২ ফুট ৫ ইঞ্চি ও পরিধি ১১ ইঞ্চি। গঠনে ইহা বিজাপুরের স্বপ্রসিদ্ধ কামান “ মালিক-ই-ময়দান ” এর অনুরূপ। ইহা এরূপ লৌহের দ্বারা প্রস্তুত যে আজ পর্য্যন্ত ইহার কোথাও একটু মরিচ ধরে নাই। ইহাতে স্বতঃই দিল্লীর প্রসিদ্ধ প্রাচীন ও মরিচাবিহীন লৌহস্তম্ভের কথা মনে হয়। বৰ্ত্তমানে এই কামানটি সরকারের রক্ষিত কীৰ্ত্তির অন্তর্গত । ইহার গায়ে ফাসিতে একটি লিপি খোদিত আছে, তাহা হইতে জানা যায় যে এই কামানটি প্রস্তুত করিতে একলক্ষ পচিশ হাজার টাকা লাগিয়াছিল। প্রবাদ যে মারাঠা সর্দার ভাস্কর পণ্ডিত ১৭৪২ খষ্টাব্দে বিষ্ণুপুর আক্রমণ করিলে রাজধানী রক্ষা করিবার জন্য স্বয়ং মদনমোহন দেব দলমাদল কামান দাগিয়া শত্রু সৈন্যকে দূরীভূত করিয়াছিলেন। [12]

দল মাদল কামান বা দালা মর্দানা
কামান বাম দিকে কামানের সামনের দিক কামানের ডান পাশে কামানের পিছনের দিকে

আরো দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. Dasgupta 2009, পৃ. 36।
  2. মালভূম, বিষ্ণুপুর-চন্দ্র, মনরঞ্জন; 2004; কলকাতা. ডেইস প্রকাশনা
  3. Mallik, Abhaya Pada (১৯২১)। History of Bishnupur-Raj: An Ancient Kingdom of West Bengal (the University of Michigan সংস্করণ)। Calcutta। পৃষ্ঠা 129। সংগ্রহের তারিখ ১১ মার্চ ২০১৬
  4. "পাতা:বাংলায় ভ্রমণ -দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/২০৪ - উইকিসংকলন একটি মুক্ত পাঠাগার"bn.wikisource.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-০৫
  5. ও'মল্লি, এলএসএস, আইসিএস, বাঁকুরা , বাংলার জেলা গেজেটর , পিপি 21-46, প্রথম প্রকাশিত 1908, 1995, পশ্চিমবঙ্গ সরকার পুনর্নির্মাণ
  6. "আনন্দবাজার পত্রিকা - পুরুলিয়া"archives.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-০৫
  7. বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপন। "অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে মল্লরাজের কীর্তি - Anandabazar"anandabazar.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-০৫
  8. Dasgupta 2009, পৃ. 22।
  9. "Bankura :: Tourism"bankura.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-০৫
  10. "Bishnupur Sub-division"bankura.gov.in
  11. Dasgupta 2009, পৃ. 55।
  12. "পাতা:বাংলায় ভ্রমণ -দ্বিতীয় খণ্ড.pdf/২০৫ - উইকিসংকলন একটি মুক্ত পাঠাগার"bn.wikisource.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-০৫

বহিঃসংযোগ

  • website on Bankura
  • Kumkum Chatterjee. "Cultural flows and cosmopolitanism in Mughal India : The Bishnupur Kingdom" in Indian Economic and Social History Review Vol. 46 (2009), p. 147-182.
  • Heritage Tourism: An Anthropological Journey to Bishnupur
  • O’Malley, L.S.S., ICS, Bankura, Bengal District Gazetteers, pp. 21–46(25), 1995 reprint, first published 1908, Government of West Bengal
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.