গৌড়
গৌড় বাংলার এককালীন রাজধানী এবং অধুনা ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি নগর যার অবস্থান বর্তমান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। এটি লক্ষনাবতী নামেও পরিচিত। প্রাচীন এই দুর্গনগরীর অধিকাংশ পড়েছে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা জেলায় এবং কিছু অংশ পড়েছে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। শহরটির অবস্থান ছিল গঙ্গানদীর পূর্ব পাড়ে, রাজমহল থেকে ৪০ কি:মি: ভাটিতে এবং মালদার ১২ কি:মি: দক্ষিণে। তবে গঙ্গানদীর বর্তমান প্রবাহ গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে অনেক দূরে।
গৌড় | |
The historical entry gate to Gaur | |
পশ্চিমবঙ্গে এর অবস্থান দেখাচ্ছে | |
বিকল্প নাম | Lakhnauti |
---|---|
অবস্থান | পশ্চিমবঙ্গ, |
ধরন | Settlement |
দৈর্ঘ্য | ৭ ১/৮ কিমি |
প্রস্থ | ১ – ২ কিমি |
এলাকা | ২০ - ৩০ কিমি2 |
ইতিহাস | |
প্রতিষ্ঠিত | 15th century (earlier establishment not clear) |
পরিত্যক্ত | ১৬তম শতক |
গঙ্গারিডাই, বঙ্গ, পুণ্ড্র, সুহ্ম, অঙ্গ, হরিকেল |
পাল সাম্রাজ্য, সেন সাম্রাজ্য |
বাংলা সুলতানী, দেব রাজ্য বখতিয়ার খিলজি, রাজা গণেশ, জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ, হুসেন শাহী রাজবংশ |
কন্দর্প রায়, প্রতাপাদিত্য, রাজা সীতারাম রায় বাংলার নবাব, বারো ভুঁইয়া, রাণী ভবাণী |
পলাশীর যুদ্ধ, জমিদারী ব্যবস্থা, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর |
বাংলার নবজাগরণ ব্রাহ্মসমাজ স্বামী বিবেকানন্দ, জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসু |
বঙ্গভঙ্গ (১৯৪৭), বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমান, জ্যোতি বসু, বিধানচন্দ্র রায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা |
ইতিহাস
সেন শাসনামলে লক্ষনাবতী বা লখনাউতি উন্নতি লাভ করে। অনেকে ধারণা করেন লক্ষনাবতী নগরের নামকরণ করা হয়েছে সেন রাজা লক্ষন সেন - এর নামানুসারে। সেন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের আগে গৌড় অঞ্চলটি পাল সাম্রাজ্যের অধীনের ছিল এবং সম্ভবতঃ রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ ছিল এর প্রশাসনিক কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ শহর থেকে দশ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় ও পান্ডুয়া (প্রাচীন নাম গৌড়নগর ও পান্ডুনগর )।[1] অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ যুগে পাল বংশের রাজাদের সময় থেকে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। ১১৯৮ সালে মুসলমান শাসকেরা গৌড় অধিকার করবার পরেও গৌড়েই বাংলার রাজধানী থেকে যায়। ১৩৫০ থেকে রাজধানী কিছুদিনের জন্য পান্ডুয়ায় স্থানান্তরিত হলেও ১৪৫৩ সালে আবার রাজধানী ফিরে আসে গৌড়ে, এবং গৌড়ের নামকরণ হয় জান্নাতাবাদ।[2]
বিশ্ব স্বীকৃতি
অনুমান করা হয় ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে এটি বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মধ্যে বিজয়নগর(বিজয়নগর সাম্রাজ্য এর রাজধানী) ও গৌড় সবথেকে নগরায়িত বলে সুপরিচিত ছিল।
উল্লেখ্য স্থাপত্য
বড় সোনা মসজিদ বা বারো দুয়ারী
গৌড়ের স্থাপত্য কীর্তিগুলির মধ্যে এটি সবথেকে বড়। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এটির নির্মাণ কার্য্য শুরু করলেও তিনি এ কাজ সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। তার পুত্র সুলতান নাসিরউদ্দীন (নুসরাত শাহ) ১৫২৬ সালে এই কাজ সম্পন্ন করেন। এর উচ্চতা ২০ ফুট, দৈর্ঘ্য ১৬৮ ফুট ও প্রস্থ ৭৬ ফুট।[2]
দাখিল দরওয়াজা
এটি গৌড় দুর্গে প্রবেশের প্রধান দ্বার। এটি ৬০ ফুট উঁচু ও ৭৩ ফুট চওড়া এই দরওয়াজাটি ছোট ছোট ইঁট ও পাথর দিয়ে তৈরী করেছিলেন সম্ভবতঃ সুলতান রুখনউদ্দীন (বারবক শাহ)। ভিতরের পথটি বেশ চওড়া, তাই সওয়ারী সহ হাতি অনায়াসে এই দরওয়াজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে পারত। এই দরজার দুপাশ থেকে তোপধ্বনি করে সুলতান ও উর্ধতন রাজপুরুষদের সম্মান প্রদর্শন করা হত। তাই এই দরওয়াজার আর এক নাম সেলামী দরওয়াজা।[2]
লোটন মসজিদ
কোতোয়ালি দরওয়াজা থেকে ১ কি.মি. উত্তরে রয়েছে এই লোটন মসজিদ। এখানে ইঁটের উপর রং-বেরঙ্গের মীনার কারুকার্য ছিলো, বর্তমানে যার প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবে খুব ভাল করে দেখলে বোঝা যায় এর সামান্য অস্তিত্ব । ছাদের গম্বুজের নিচের দিককার সৌন্দর্য অপূর্ব।[2]
লুকোচুরি দরোয়াজা
১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ সুজা গৌড় দুর্গে প্রবেশ করবার জন্য এই দরোয়াজাটি তৈরি করেন। উচ্চতা ৬৫ ফুট ও চওড়া ৪২ ফুট। দুইদিকে প্রহরীদের ঘর ও ওপরে নহবতখানা আছে।[2]
কদম রসুল মসজিদ
লুকোচুরি ফটক বা দরোয়াজা দিয়ে গৌড় দুর্গে ঢোকার পর ডানদিকে রয়েছে কদমরসুল সৌধ। এখানে রয়েছে হজরত মহম্মদ(সাঃ) এর পদচিহ্ন, যেটা সুদূর আরব থেকে পীর শাহ জালাল তাবরেজী এনেছিলেন পান্ডুয়া-র বড় দরগায়, সেখান থেকে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এটিকে নিয়ে আসেন গৌড় দুর্গে। তার পুত্র সুলতান নসরত শাহ ১৫৩০ সালে একটি কষ্ঠি পাথরের বেদির ওপর পদচিহ্নটি স্থাপন করে তার ওপর কদম রসুল সৌধ নির্মাণ করেন।[2]
চিকামসজিদ
এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই স্থাপত্যটি ১৪৫০ সালে তৈরি। পূর্বে এটি সম্ভবত সমাধিস্থল ছিল। তবে কথিত আছে যে সম্রাট হুসেন শাহ এটিকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। স্থাপত্যটির ভিতরের দেয়ালে অনেক হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি রয়েছে। পরবর্তী কালে এখানে চামচিকার উপদ্রব শুরু হলে এর নাম হয় চামকান মসজিদ বা চিকা(চামচিকা থেকে) মসজিদ।
তথ্যসূত্র
- "ঐতিহাসিক স্থান"। ChapaiPortal।
- চক্রবর্তী, রজনীকান্ত (জানুয়ারি ১৯৯৯)। গৌড়ের ইতিহাস (PDF) (1 & 2 সংস্করণ)। Bankim Chatterjee Street, Calcutta 700 073: Dev's Publishing।