মক্কা অবরোধ (৬৮৩)

মক্কা অবরোধ ৬৮৩ সালে দ্বিতীয় মুসলিম গৃহযুদ্ধের সময় সংঘটিত হয়। এসময় মক্কার প্রধান ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরউমাইয়া খলিফা প্রথম ইয়াজিদের বিপক্ষে সবচেয়ে শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের। মদিনার পর ইসলামের আরেক পবিত্র শহর মক্কা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। উমাইয়া কর্তৃপক্ষ আরবের বিদ্রোহ দমন করার জন্য সেনা প্রেরণ করে। উমাইয়া সেনারা মদিনার লোকদের পরাজিত করে শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। কিন্তু মক্কা মাসব্যাপী অবরোধের মুখে পড়ে। এসময় কাবা আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ইয়াজিদের আকস্মিক মৃত্যুর খবর পৌছার পর অবরোধ সমাপ্ত হয়। উমাইয়া কমান্ডার হুসাইন ইবনে নুমায়েরের অনেক অনুরোধের পরও সিরিয়া গিয়ে খলিফা হওয়ার প্রস্তাবে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের সাড়া না দিলে তিনি একাই তার সেনাদের নিয়ে ফিরে আসেন। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের গৃহযুদ্ধের পুরো সময়েই মক্কায় ছিলেন। তবে মুসলিম বিশ্বে তিনি খলিফা হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ছিলেন না। ৬৯২ সালে উমাইয়ারা আরেকটি সেনাদল প্রেরণ করে এবং এসময় মক্কা অবরোধ ও জয় করা হয়।

মক্কা অবরোধ
মূল যুদ্ধ: দ্বিতীয় ফিতনা

অবরোধের সময় কাবা অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হয়
তারিখসেপ্টেম্বর-নভেম্বর ৬৮৩
অবস্থানমক্কা
ফলাফল উমাইয়াদের অবরোধ প্রত্যাহার
যুধ্যমান পক্ষ
উমাইয়া খিলাফত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের সমর্থক মক্কাবাসী
সেনাধিপতি
হুসাইন ইবনে নুমায়ের আল সাকুনি আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের . মুখতার আল সাকাফি

পটভূমি

উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা খলিফা প্রথম মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর মুসলিম বিশ্ব অস্থিতিশীল অবস্থায় পড়ে। মুয়াবিয়া তার পুত্র প্রথম ইয়াজিদকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। তবে তার এই সিদ্ধান্ত সবার কাছে গ্রহণীয় হয়নি, বিশেষ করে মদিনার উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের কাছে। খিলাফতের দুজন দাবিদার ব্যক্তি ছিলেন হুসাইন ইবনে আলিআবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের। উমাইয়াদের বিরুদ্ধে প্রথমে হুসাইন ইবনে আলি বিদ্রোহ করেন। ৬৮০ সালে কারবালার যুদ্ধে তিনি নিহত হন। এরপর উমাইয়াদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের। তিনি মক্কা থেকে উমাইয়াদের প্রতিবাদ করে যান। তিনি দাবি করেন যে সকল কুরাইশের উপস্থিতিতে একটি সমাবেশের প্রথানুযায়ী খলিফা নির্বাচন করতে হবে এবং এই সমাবেশে শুধু উমাইয়ারা থাকবে এমন হতে পারবে না।[1][2]

প্রথম ইয়াজিদ ও তার মদিনার গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের এবং অসন্তুষ্ট অন্যান্য আনসার পরিবারের সাথে আলোচনার চেষ্টা করেন। শহরের চারপাশে মুয়াবিয়ার বৃহৎ কৃষি প্রকল্প নিয়ে মদিনের উচ্চপর্যায়ের অনেকে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তারা ইয়াজিদকে খলিফার দায়িত্বের জন্য অযোগ্য মনে করতেন। ভবিষ্যত খলিফা মারওয়ান ইবনুল হাকামসহ উমাইয়া পরিবারের আরো অনেক সদস্যকে মদিনা থেকে বের করে দেয়া হয়। তাই ইয়াজিদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রদেশে সৈন্য পাঠান এবং মুসলিম ইবনে উকাবা আল মুরিকে এর নেতৃত্ব দেয়া হয়। ৬৮৩ সালের ২৬ আগস্ট হারার যুদ্ধে তার ১২,০০০ সিরিয়ান সেনা মদিনার প্রতিরোধ প্রতিহত করতে সক্ষম হয় এবং মদিনার দিকে এগিয়ে যায়।

অবরোধ

মদিনা দখলের পর মুসলিম ইবনে উকাবা মক্কার দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মুশাল্লালে মারা যান। এরপর তার অধীনস্থ হুসাইন ইবনে নুমায়ের আল সাকুনির কাছে নেতৃত্ব হস্তান্তর হয়। সেপ্টেম্বরে তারা মক্কায় পৌছান। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের ও তার সমর্থকরা আত্মসমর্পণে অসম্মতি জানান এবং একটি লড়াইয়ে তারা পরাজিত হওয়ার পর শহরের উপর অবরোধ আরোপ করা হয়। এতে উমাইয়ারা পাথরের গোলাবর্ষণের জন্য কেটাপুল্ট ব্যবহার করে। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের কাবা চত্বরে তার কমান্ড পোস্ট বসান। কাবা রক্ষার জন্য চারপাশে কাঠের একটি কাঠামো তৈরী করা হয়েছিল। ৩১ অক্টোবর রোববার এটিতে আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তী অনেক সূত্রের মতে উমাইয়াদের গোলাবর্ষণের কারণে এই অগ্নিকান্ড ঘটে। তবে বেশি বিশ্বাসযোগ্য সূত্র অনুযায়ী আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের এক অনুসারীর হাতের মশাল থেকে আগুন লাগে।[3][4][5]

২৬ নভেম্বর পর্যন্ত অবরোধ চলে। এসময় ইয়াজিদের মৃত্যুর খবর পৌছায়। এরপর হুসাইন ইবনে নুমায়ের আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের সাথে আলোচনায় আসেন। দামেস্কের উমাইয়া কর্তৃপক্ষ ইয়াজিদের তরুণ পুত্র দ্বিতীয় মুয়াবিয়াকে খলিফা ঘোষণা করলেও পরিস্থিতি বিভিন্ন প্রদেশে ভাল ছিল না। হুসাইন ইবনে নুমায়ের তাই আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরকে খলিফা হিসেবে মানতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং শর্ত দেন তাকে ক্ষমা ঘোষণা করতে হবে এবং হুসাইনের সাথে দামেস্ক যেতে হবে। ইবনে জুবায়ের দ্বিতীয় শর্তে রাজি ছিলেন না। কারণ এটি তাকে সিরিয়ান অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে ফেলত। এরপর হুসাইন তার সেনাদল নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন।[4][5]

পরবর্তী অবস্থা

উমাইয়া সেনাদের প্রত্যাবর্তনের ফলে মক্কায় ইবনে জুবায়েরের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। উমাইয়া কর্তৃপক্ষের ভেঙে পড়ার পর তিনি দ্রুত উত্তর সিরিয়াসহ অধিকাংশ মুসলিমদের কাছে ন্যায়সংগত খলিফা হিসেবে স্বীকৃত হন। মারজ রাহিতের যুদ্ধে উমাইয়ারা মারওয়ান ইবনুল হাকামের নেতৃত্বে সিরিয়ায় তাদের অবস্থান শক্ত করতে সক্ষম এবং মিশরে নিয়ন্ত্রণ পুনপ্রতিষ্ঠা করে। ইরাকের নিয়ন্ত্রণ লাভের একটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এতে উমাইয়া বিরোধী শিবিরে নেতা ছিলেন আল মুখতার। মসুলের নিকটে তারা উমাইয়াদের পরাজিত করে। পরবর্তী খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান নিজ অবস্থান শক্ত করেন। অন্যদিকে ইবনে জুবায়েরের ভাই মুসাব ইবনে জুবায়ের উমাইয়া বিরোধী নেতা আল মুখতারকে পরাজিত করে ৬৮৭ সালে সমগ্র ইরাকের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। ৬৯১ সালে খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান জুফার আল কিলাবির কায়েসকে উমাইয়াদের নিকটে টানতে সক্ষম হন এবং ইরাকের দিকে অগ্রসর হন। মুসাব ইবনে জুবায়ের পরাজিত ও নিহত হন। ফলে উমাইয়ারা পূরবাঞ্চলজুড়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ৬৯২ সালে আরেকটি অবরোধের পর আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের নিহত হন। এসময় গৃহযুদ্ধের অবসান হয়।[6][7]

কাবার সংস্কার

উমাইয়ারা ফিরে যাওয়ার পর আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের কাবা পুনর্নির্মাণ শুরু করেন। তিনি হাতিমে কাবাকে কাবার সাথে যুক্ত করে তার আদিরূপ ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছুক ছিলেন। মুহাম্মদ (সা) নিজেও তার জীবদ্দশায় এমন ইচ্ছা করেছিলেন তবে তা নতুন ইসলাম গ্রহণকারীরা সঠিকভাবে বুঝতে পারবে না ভেবে বাস্তবায়ন করেননি। সম্পূর্ণ পাথর দিয়ে নতুনভাবে কাবা নির্মাণ করা হয় এবং এতে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি দরজা স্থাপন করা হয়। তাছাড়া অর্ধবৃত্তাকার হাতিম কাবার সাথে যুক্ত করা হয়। হজরে আসওয়াদকে রূপার ফ্রেমে বাধিয়ে কাবায় সংযুক্ত করা হয়। উমাইয়ারা শহর পুনরায় জয় করলে হাতিমকে মূল ভবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং পশ্চিম দরজায় দেয়াল তুলে দেয়া হয়। এই রূপেই কাবা বর্তমানকাল অবধি রয়েছে।[8]

তথ্যসূত্র

  1. Kennedy, Hugh N. (২০০৪)। The Prophet and the Age of the Caliphates: The Islamic Near East from the 6th to the 11th Century (Second সংস্করণ)। Harlow, UK: Pearson Education Ltd.। আইএসবিএন 0-582-40525-4।
  2. Hawting, G. R. (২০০০)। The First Dynasty of Islam: The Umayyad Caliphate AD 661–750 (2nd Edition)। London and New York: Routledge। পৃষ্ঠা 47। আইএসবিএন 0-415-24072-7।
  3. Lammens, H. (১৯৮৭)। "Yazīd b. Mu'āwiya"। Houtsma, Martijn Theodoor। E.J. Brill's first encyclopaedia of Islam, 1913–1936, Volume VIII: Ṭa'if–Zūrkhāna। Leiden: BRILL। পৃষ্ঠা 1162–1163। আইএসবিএন 90-04-08265-4।
  4. Wellhausen, Julius (১৯২৭)। The Arab Kingdom and Its Fall। Calcutta: University of Calcutta। ওসিএলসি 752790641 p.165-166
  5. Hawting (2000), pp. 48–49, 51–53
  6. Kennedy (2001), pp. 92–98
  7. Wensinck & Jomier (1997), p. 319

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.