অ্যানি হল

এলেন যখন সহ-লেখক মার্শাল ব্রিকমানের সাথে নিউ ইয়র্কে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখনই অ্যানি হল তৈরির ধারণা আসে। তারা এই ধারনা নিয়ে বিভিন্ন দিন আলোচনা করেছেন, অনেক সময় পরিশ্রান্ত হয়ে এই ধারণাটি বাতিলের কথাও ভেবেছিলেন। এলেন চার দিনে প্রথম চিত্রনাট্যটি লেখেন এবং কিছু পরিবর্তনের জন্য ব্রিকমানের কাছে পাঠান। ব্রিকমানের মতে, সেই লেখনিটি চল্লিশ বছরের একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ছিল যার জীবনে "নানা কিনারা ছিল"। একজনের যুবতী মহিলার সাথে সম্পর্ক ছিল, অন্যজন জীবন নিয়ে চিন্তিত ছিল যেটি আমাদের সবার জীবনেই থাকে, এবং তৃতীয় জনের নিজেকে প্রমাণ করার এবং নিচের চরিত্রকে পরীক্ষা করার অভ্যাস ছিল।[8] ১৯৭৫সালে এলেন নিজেই চল্লিশে পরিণত হন, আর ব্রিকমান বলেন যে বয়স বাড়া এবং মৃত্যু নিয়ে চিন্তা এলেনের দার্শনিকতা ও তার ব্যবসায়ীক অংশকে ব্যক্তিগতভাবে পূরণ করার বিষয়কে প্রভাবিত করেছে।[8] এলেন " মানবজাতিকে নিয়ে একটি হাসির গল্প" বানানোর সিদ্ধান্ত নেন।[9] তিনি বলেন যে প্রথম বারের জন্য সম্পূর্ণ কৌতুক নির্ভর চলচ্চিত্র না বানাতে তার সাহস হয় আর তার ইচ্ছা হয় গভীর মানের একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করা যা দর্শকদের মনোরঞ্জন করবে।[2] তাকে প্রভাবিত করেছে ফেডেরিকো ফেল্লিনির ১৯৬৩সালের কৌতুক নাটক 8½, যা একই রকম ব্যাক্তিগত মোড়ে বানানো হয় এবং প্রত্যেক পরিচালক তাদের মনের মতো একইভাবে এটিকেও নির্মাণ করেছেন।[10]

ব্রিকমান এবং এলেন সংযুক্ত শিল্পী থেকে ৪০লাখ ডলার চাবার আগে তারা চিত্রনাট্যটি অনেকের কাছে পাঠান।[10] প্রথম দিকের লেখনির অনেক অংশ টিকে থাকেনি। এটি আসলে কৌতুক ও রোমান্টিক ধাচে তৈরি একটি খুন রহস্যের চিত্রনাট্য ছিল।[11] এলেনের মতে, খুনটি মূলত চলচ্চিত্রে থাকা একটি দৃশ্যের পরে ঘটে, যেই দৃশ্যে অ্যানি এবং আলভি ইংগমার বার্জম্যানের চলচ্চিত্র ফেস টু ফেসকে মনে করে।[12] যদিও তারা খুনের কাহিনী বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এলেন এবং ব্রিকমান খুন রহস্য নিয়ে অনেক বছর পরে চলচ্চিত্র বানান: ১৯৯৩সালের ম্যানহাটান মার্ডার মিসারি, যেটিতেও ডায়ান কিয়াটোন অভিনয় করেছেন।[13] যেই লেখনিটি এলেন চলচ্চিত্র সম্পাদক রাফ রোজেনব্লামের কাছে দিয়েছিলেন, সেটিতে লেখা ছিল "এন্ডিং টু বি শট" (শেষাংশ নির্মাণ করতে হবে)।[14]

অ্যানি হল ২০এপ্রিল ১৯৭৭সালে আনুষ্ঠানিক মুক্তির পূর্বে মার্চে লস এঞ্জেলস চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়।[1][15] $৪মিলিয়ন বাজেটের পরিবর্তে এই চলচ্চিত্র যুক্তরাষ্ট্রে $৩৮,২৫১,৪২৫ (২০১৩সালে $১৪৩,২২৮,৪০০) আয় করে, যা ১৯৭৭সালের চলচ্চিত্রে ১১তম সর্বোচ্চ আয় করা চলচ্চিত্র।[1] সাংখ্যিকভাবে, এটি এলেনের চতুর্থ সেরা আয়ের চলচ্চিত্র, যেটি ম্যানহেটেন, হান্নাহ এন্ড হার সিস্টার্স, এবং মিডনাইট ইন প্যারিস এর পরে অবস্থিত; মুদ্রাস্ফিতীতে খাপ খাওয়ানোর পরে আয়ের অঙ্কটি বক্স অফিসে এলেনের সবচেয়ে বড় সফলতা হিসেবে রূপ নেয়।[16] এটি ব্লুরে হিসেবে প্রথম মুক্তি পায় ২৪জানুয়ারি, ২০১২সালে আর পাশাপাশি মুক্তি পায় এলেনের ১৯৭৯সালের চলচ্চিত্র ম্যানহেটেন।[17] উভয় মুক্তিতে আসল চলচ্চিত্রের ট্রেইলার অন্তর্ভুক্ত থাকে।[17]

৩এপ্রিল,১৯৭৮সালের ৫০তম একাডেমি এওয়ার্ডস এ অ্যানি হল চারটি অস্কার পায় এবং সর্বমোট পাঁচটির জন্য মনোনয়ন পেয়েছিল। প্রযোজক চার্লস হ. জোফে সেরা চলচ্চিত্রের জন্য মূর্তিটি পায়, এলেন সেরা পরিচালনার জন্য, এলেন ও ব্রিকম্যান একসাথে সেরা চিত্রনাট্যের জন্য, আর কিয়াটোন সেরা অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার পান। সেরা অভিনেতা হিসেবে এলেনও মনোনয়ন পেয়েছিলেন।[18] ব্রিকম্যান এবং সহ প্রযোজক রবার্ট গ্রিণহাট সহ অনেকেই ভেবেছিলেন মূল পুরস্কারগুলো স্টার ওয়ার্স পাবে।[9]

বাফতা এওয়ার্ডসে চলচ্চিত্রটি চারবার পুরস্কৃত হয়। সেরা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি, কিয়াটোন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পায়, এলেন সেরা পরিচালনায় পুরস্কার পায় এবং ব্রিকম্যান সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার পায়। [19] চলচ্চিত্রটি গান বা কৌতুকে সেরা অভিনেত্রীর (ডায়ান কিয়াটোন) জন্য শুধু একটি গোল্ডেন গ্লোভ এওয়ার্ড পায়, যেখানে এটি তিনটি মনোনয়ন পায়: সেরা চলচ্চিত্র (গান বা কৌতুক, সেরা পরিচালক, এবং গান বা কৌতুকে সেরা অভিনেতা (উডি এলেন)।

১৯৯২সালে, যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস এই চলচ্চিত্রকে জাতীয় চলচ্চিত্র রেজিস্ট্রিতেসংরক্ষণের জন্য নির্বাচন করে যেটি "সাংস্কৃতিকভাবে, ঐতিহাসিকভাবে বা নান্দনিকভাবে" সেরা চলচ্চিত্রগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে।[5] এই চলচ্চিত্রকে মাঝে মাঝে সর্বকালের সেরা কৌতুক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। দ্যা আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট এটিকে আমেরিকার চলচ্চিত্র ইতিহাসে ৩১তম স্থানে তালিকাভুক্ত করেছে।[20] ২০০০সালে, তারা আমেরিকার চলচ্চিত্রে এটিকে দ্বিতীয় সেরা রোমান্টিক কমেডি হিসেবে ঘোষণা করে।[20] "সিমস্ লাইক ওল্ড টাইমস" গানটিতে কিয়াটোনের অভিনয়কে সেরা চলচ্চিত্রে অন্তর্ভুক্ত গানের তালিকায় ৯০তম স্থান দেয়া হয়, এবং তার লাইন "লা-দে-দা, লা-দে-দা" কে ৫৫তম সেরা চলচ্চিত্র উক্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।[20] এটির চিত্রনাট্যকে রাইটার্স গিল্ড অফ আমেরিকা সেরা চিত্রনাট্যের ৬ষ্ঠ স্থান দেয়া হয়।[21] আবার ইজিএন এটিকে সর্বকালের সেরা কৌতুক চলচ্চিত্র হিসেবে সপ্তম স্থান দেয়।[22] ২০০০সালে, টোটাল ফিল্ম সাময়িকীর পাঠকরা এটিকে সর্বকালের ৪২তম সেরা চলচ্চিত্র এবং ৭ম সেরা রোমান্টিক কমেডি চলচ্চিত্র হিসেবে ভোট দেয়।[23] এলেনের সেরা চলচ্চিত্রের মাঝে অ্যানি হল কে সবথেকে সেরা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[24][25][26]

২০০৮সালের জুনে, এএফআই ১০ সেরা ১০ মুক্তি দেয়- ১০টি আমেরিকান সিনেমার শ্রেণিবিভাগে ১০টি সেরা চলচ্চিত্র-১,৫০০লোকের সম্প্রদায় থেকে ভোট নেওয়ার পরে এবং রোমান্টিক কমেডি শাখায় অ্যানি হল দ্বিতীয় স্থান লাভ করে।[27] এএফআই আরও তালিকায় অ্যানি হলকে অন্তর্ভুক্ত করে। ২০০৭সালের নভেম্বরে, এম্পায়ার সাময়িকীর সর্বকালের সেরা ৫০০ চলচ্চিত্র তালিকায় অ্যানি হল কে ৬৮নাম্বার স্থান দেয়।[28] তাছাড়া রটেন টমেটোর ২৫সেরা রোমান্টিক কমেডির তালিকায় এটি #২ নাম্বার স্থানে রয়েছে, প্রথমে রয়েছে দ্যা ফিলাদেলফিয়া স্টোরি।[29] ২০১২সালে, সাইট এন্ড সাইন্ড এর সমালোচক ভোটে এই চলচ্চিত্রটি ১২৭তম সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র হয়।[30] এই চলচ্চিত্রটি সাইট এন্ড সাউন্ড এর পরিচালকদের ভোটে ১৩২তম সেরা চলচ্চিতৃর হয়।[30] ২০১৩সালের অক্টোবরে, গার্ডিয়ান পাঠকদের ভোটে এই চলচ্চিত্রটি উডি এলেনের দ্বিতীয় সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ভূষিত হয়।[31] ২০১৫সালের নভেম্বরে, রাইটার্স গিল্ড অফ আমেরিকার ১০১ সবচেয়ে হাস্যকর চিত্রনাট্য তালিকায় এই চলচ্চিত্রটিকে সবচেয়ে হাস্যকর চিত্রনাট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[32]

চলচ্চিত্রটি নিম্নের আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট এর তালিকাগুলোতে অন্তর্ভুক্ত:

• ১৯৯৮: এএফআই'র ১০০বছর...১০০চলচ্চিত্র – #৩১[33]
• ২০০০: এএফআই'র ১০০বছর...১০০হাসি – #৪[34]
• ২০০২: এএফআই'র ১০০বছর...১০০আবেগ – #১১[35]
• ২০০৪: এএফআাই'র ১০০বছর...১০০গান:
  • "সিমস লাইক ওল্ড টাইমস" – #৯০[36]
• ২০০৫: এএফআই'র ১০০বছর...১০০চলচ্চিত্র উক্তি:
  • অ্যানি হল: "লা-দে-দা, লা-দে-দা" – #৫৫[37]
  • আলভি সিঙ্গার "আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু মুভ টু এ সিটি হোয়ার দ্যা ওনলি কালচারাল এডভান্টেজ ইজ বিং এবল টু মেক এ রাইট টার্ন অন এ রেড লাইট" – মনোনীত
  • আলভি সিঙ্গার "ডোন্ট নক মাস্টারভিউশন। ইটস সেক্স উইথ সামওয়ান আই লাভ।" – মনোনীত
• ২০০৭: এএফআইর ১০০বছর...১০০চলচ্চিত্র (১০ম বার্ষিক সংস্করণ) – #৩৫[38]
• ২০০৮: এএফআইর সেরা ১০:
  • #২ রোমান্টিক কমেডি চলচ্চিত্র[39]

২০০৬সালে, প্রিমিয়ার সাময়িকি অ্যানি হলে কিয়াটোনের অভিনয়কে "সর্বকালের ১০০ সেরা অভিনয়" এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং বর্ণনা করে:

বোকামির অভিনয় করা খুবই কষ্টকর। ... অ্যানির দক্ষতা হলো তার খারাপ ব্যাকহেন্ড, খারাপ গাড়ি চালানো এবং চিন্তার সময় হাত কাঁপলেও তিনি খুব জটিল এবং বুদ্ধিমান মহিলা। কিয়াটোন তার চরিত্রের দুটি রূপকে খুব বুদ্ধিমানভাবে প্রদর্শন করেছেন, বিশেষ করে আলভির (উডি এলেন) সাথে প্রথম সাক্ষাতে যখন সে মনে মনে কথা বলে, তখন সে বলে, 'হি প্রোভ্যাবলি থিংকস আই এম এ ইয়ো ইয়ো।' ইয়ো-ইয়ো? খুবই শান্তভাবে।[40]

২০০৬সালে নিউ ইয়র্ক শহরে উডি এলেন

সমাজবিজ্ঞানী ভার্জিনিয়া রাটার এবং পিপার স্কয়ার্টজ আলভি এবং অ্যানির সম্পর্ককে যৌনতায় লিঙ্গ বৈষম্যের রূপক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[41] এলেনের জীবনে ভালোবাসার পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং সহ-অভিনেতা টনি রবার্টস এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলেন, "এই গল্পটি যারা প্রেমে পড়ে তাদের জন্য, এবং প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আবার বেঁচে থাকে তাদের জন্য।"[9] আলভির সাথে অ্যানির সম্পর্কে ব্যর্থতায় তার বিষন্নতা কাটিয়ে উঠতে আলভি ভালোবাসার কারণ খুঁজে বেরায়। কিছুসময় সে তার সম্পর্কের স্মৃতিগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে, একটি সময় সে একজন মহিলার সাথে ফুটপাথে দাড়িয়ে বলে, " এটি আপনি কখনো করতে চান না। কিন্তু মানুষ এরকমই। এভাবেই ভালোবাসা হারিয়ে যায়।" এই পরামর্শ থেকে জানা যায় যে এটি কারোরই দোষ নয়, তারা আলাদাভাবে বেড় উঠেছিল এবং এটির সমাপ্তি হওয়া অনিবার্য ছিল। চলচ্চিত্রের শেষে, আলভি এটিকে মেনে নেয় এবং সিদ্ধান্তে পৌছায় যে ভালোবাসা হলো, "যুক্তিহীন এবং পাগলামী এবং হাস্যকর" কিন্তু এটি জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়।[42] ক্রিস্টোফার নাইট বলেন আলভির অ্যানিকে দেখার ইচ্ছা মূলত যৌনসঙ্গমকামী যা মূলত আবেগপূর্ণ।[43]

দ্যা নিউ ইয়র্কার এর রিচার্ড ব্রোডি বলেন চলচ্চিত্রটি "ইউরোপকেন্দ্রিক শিল্পে আত্মসচেতনতা" বাড়িয়েছে এবং আলভি সিঙ্গারের "যৌন চাহিদা এবং নিরাশা, প্রেমে ব্যর্থতা এবং স্নায়ুর বাধা" কে বর্ণনা করেছে।[44]