শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
ভারত কেশরী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী (জন্ম জুলাই ৬, ১৯০১- মৃত্যু জুন ২৩, ১৯৫৩) একজন ভারতীয় পন্ডিত ও নেতা। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী প্রথম হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জন সংঘ গঠন করেন। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী হিন্দু মহাসভার সভাপতি ছিলেন। তিনি জওহরলাল নেহেরুর ক্যাবিনেটের মন্ত্রী ছিলেন।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় | |
---|---|
জুলাই ৬, ১৯০১ – জুন ২৩, ১৯৫৩ | |
![]() | |
জন্ম তারিখ: | জুলাই ৬, ১৯০১ |
জন্মস্থান: | কলকাতা, (ব্রিটিশ ভারত) |
মৃত্যু তারিখ: | ২৩ জুন ১৯৫৩ ৫১) | (বয়স
মৃত্যুস্থান: | কাশ্মীর (ভারত) |
জীবনকাল: | জুলাই ৬, ১৯০১ – জুন ২৩, ১৯৫৩ |
আন্দোলন: | ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ভারত ছাড় আন্দোলন |
প্রধান সংগঠন: | ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস হিন্দু মহাসভা ভারতীয় জনসঙ্ঘ |
পিতামাতা: | আশুতোষ মুখোপাধ্যায়(পিতা) |
পারিবারিক ইতিহাস
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের আদিনিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার জিরাট গ্রামে ৷ তাঁর প্রপিতামহ পারিবারিক কারণে হুগলী জেলারই এক ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত গ্রাম দিগসুই থেকে জিরাটে এসে বসতি গড়েন ৷ তাঁর পিতামহ ছিলেন মেধাবী ৷ তিনি জিরাটের বিত্তশালীদের সাহায্যে কলকাতায় ডাক্তারী পড়তে আসেন এবং পরে জিরাট গ্রাম ছেড়ে কলকাতার ভবানীপুরে বসতি স্থাপন করেন ৷
শৈশব ও শিক্ষা
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ১৯০১ সালের ৬ই জুলাই কলকাতায় এক উচ্চ সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা স্যার আশুতোষ মুখার্জী ও মাতা শ্রীমতী যোগমায়া দেবীর কাছ থেকে তিনি কিংবদন্তিতুল্য পাণ্ডিত্য ও ঐকান্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। তাঁরা তাঁকে ‘পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন’-যাপনে অনুপ্রাণিতও করেন। ১৯২১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান দখল করার পর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ভারতীয় ভাষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ১৯২৪ সালে বি.এল পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেন। ছাত্র থাকাকালীন সময় থেকে শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ভাইস-চ্যান্সেলর পিতাকে শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করেন।
পিতার মত তিনিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (১৯৩৪-১৯৩৮) হন। ১৯৩৭ সালে তদনীন্তন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুরোধ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি "বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত" রচনা করে দেওয়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ একটির বদলে দুটি গান রচনা করে দেন - "চলো যাই, চলো যাই" ও "শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান"। "চলো যাই, চলো যাই " গানটি গৃহীত হয় এবং ১৯৩৭ সালের ২৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাদিবস উপলক্ষে কুচকাওয়াজে ছাত্রদের দ্বারা প্রথম গীত হয়। ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গীত হিসেবে "শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান" গানটি গৃহীত হয়।
রাজনৈতিক জীবন
ড.মুখার্জি ভারত বিভাজনের তীব্র বিরোধী ছিলেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে তিনি বলেন, মুসলিমরা যদি ভারত বর্ষের বিভাজন চায় তবে ভারতের সকল মুসলিমদের উচিত তাদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে পাকিস্তান চলে যাওয়া। [1]
ডঃ মুখার্জী ফজলুল হক মন্ত্রীসভায় অবিভক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী রূপে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ১১ ডিসেম্বর, ১৯৪১ থেকে ২০ নভেম্বর, ১৯৪২ পর্যন্ত কাজ করে যান। এই সময় কাজী নজরুল ইসলাম আর্থিক অনটনের কারণে ফজলুল হক সাহেবের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে ডঃ মুখার্জীর শরণাপন্ন হন এবং সহযোগিতা পান। ডঃ মুখার্জী’র পৈত্রিক বাড়ি মধুপুরে সস্ত্রীক থাকার ব্যবস্থা করেছেন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য। কাজী নজরুল ইসলাম মধুপুর থেকে ১৭ জুলাই, ১৯৪২-এ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে একটা চিঠি লেখেন।
শ্রী চরণেষু,
…এই coalition ministry-র একমাত্র আপনাকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি ও ভালবাসি, আর কাউকে নয়। আমি জানি আমরাই এই ভারতবর্ষকে পূর্ণ স্বাধীন করব। সেদিন বাঙালীর আপনাকে ও সুভাষবাবুকেই সকলের আগে মনে পড়বে-আপনারাই হবেন এদেশের পতাকার নায়ক।
-কাজী নজরুল ইসলাম
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট নেহেরুর মন্ত্রিসভায় শ্যামাপ্রাসাদ মুখার্জী শিল্পমন্ত্রী রূপে শপথ গ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীনের পর হিন্দু মহাসভাকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে আত্মনিয়োগের পরামর্শ দেন তিনি।
ভারতের শিল্পমন্ত্রী থাকাকালীন শিল্প উন্নয়ন নিগম, প্রথম শিল্পনীতি প্রণয়ন, চিত্তরঞ্জন লোকমটিভ স্থাপন, সিন্ধ্রি সার কারখানা-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। খড়গপুরে ভারতের প্রথম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স স্থাপনা, কলকাতার প্রথম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সোশাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট স্থাপনার ভাবনা তাঁরই মস্তিষ্ক প্রসূত।
১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বেড়ে চলে। হত্যা, লুন্ঠন, নারীর সম্ভ্রমহানি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এর প্রতিবাদে ১৪ এপ্রিল, ১৯৫০ নেহেরু মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হয়েও সংখ্যালঘু নিরাপত্তা (পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা) ও নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির প্রতিবাদে লোকসভায় প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন ডঃ মুখার্জী। অবশেষে নেহেরু মন্ত্রিসভা থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৫০ সালে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মৃত্যু হয়। কংগ্রেসের মধ্যে জাতীয়তাবাদী শক্তির ভর কেন্দ্রে শূণ্যতা সৃষ্টি হয়। ১৯৫১ সালের অক্টোবরে অনেক চিন্তন ও মন্থন শেষে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গুরুজী গোলওয়ালকারের সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে নতুন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫২ সালের মে মাসে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ভারতীয় জনসংঘ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনটি আসন লাভ করে।
ডঃ মুখার্জী লোকসভায় ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে বিরোধী দলের প্রতিষ্ঠা ও নেতৃত্ব দান করেন। লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা হিসেবে নিজেকে উদাহরণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
জনসংঘ ঐ সময় বিধানসভা ভোটে বাংলা প্রদেশে ৮টি আসন ও রাজস্থানে ৮টি আসন লাভ করে। রাজস্থানে জমিদার প্রথা বিলোপ আইনের প্রশ্নে বিধায়করা দ্বিধাবিভক্ত ছিল। ডঃ মুখার্জী রাজস্থান পরিষদীয় দলের জরুরি বৈঠক ডেকে নির্বাচনী ইস্তেহারের প্রতিশ্রুতি পালনের দায়বদ্ধতার কথা বলেন। ওই সভায় আটজন বিধায়কের মধ্যে মাত্র দু’জন ভৈরব সিং শেখাওয়াত ও জগৎ সিং জালান উপস্থিত ছিলেন। ডঃ মুখার্জী তৎক্ষনাৎ বাকি ছ’জন বিধায়ককে বহিষ্কার করেন। রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার স্বীকার করে তিনি নিজের দলকে মাত্র দুই সদদ্যের দলে পরিণত করেন।
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা চালু রাখলে অদূর ভবিষ্যতে সমস্যা বাড়তে পারে তা তিনি বারবার লোকসভার ভিতরে ও বাইরে ব্যক্ত করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সংবিধানের ৩৭০ ধারায় লেখা হয়। ‘Temporary, Transitional and Special Provision of Article 370’। সংবিধান প্রণেতা সাময়িক, পরিবর্তনমুখী ও বিশেষ কথাগুলির মধ্যে দিয়ে দূরদৃষ্টি প্রতিভাত হয়।
ভারতের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সংবিধানের বিশেষ অনুচ্ছেদ ৩৭০ ধারা বিলোপ ও পারমিটরাজ বাতিলের দাবিতে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কাশ্মীর অভিযান করেন। ১৯৫৩ সালের ১১ই মে পাঞ্জাবের উধমপুরে শেষ সভা করে কাশ্মীরে প্রবেশের পথে গ্রেফতারি বরণ করেন।
মৃত্যু
জম্মু-কাশ্মীরের ৩৭০ নং ধারা নিয়ে নেহরু মন্ত্রিসভার সাথে মতবিরোধ দেখা দিলে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তিনি দক্ষিণপন্থী প্রজা পরিষদ গঠন করে “এক প্রজাতন্ত্রের মধ্যে আরেকটা প্রজাতন্ত্র থাকতে পারে না” এই দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৫৩ সালের ১১ই মে[2] শ্যামাপ্রসাদকে গ্রেপ্তার করে জেলবন্দি করা হলে তিনি বন্দি থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
- Legislative Council Proceedings [BLCP], 1941, Vol. LIX, No. 6, p 216
- http://books.google.co.in/books?id=Ye3VUMLhaz8C&pg=PA49&dq=Syama+prasad+mukherjee+arrested+in+kashmir+by+nehru&hl=en&ei=lTlwTov0BsjorQeJzfXnBg&sa=X&oi=book_result&ct=result&resnum=5&ved=0CD4Q6AEwBA#v=onepage&q=arrested%20kashmir&f=false