সাইমন ড্রিং
সাইমন ড্রিং (জন্মঃ ১১ জানুয়ারি, ১৯৪৫) একজন আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী বৈদেশিক সংবাদদাতা, টেলিভিশন উপস্থাপক এবং প্রতিবেদন নির্মাতা। তিনি বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের বৈদেশিক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের অনেক জায়গা ভ্রমণ করে তরতাজা ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পরিবেশনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। এছাড়াও তিনি লন্ডনভিত্তিক দ্য ডেইলী টেলিগ্রাফ, বিবিসি টেলিভিশন এবং রেডিও সংবাদ ও চলতি ঘটনা তুলে ধরার লক্ষ্যে অনবরত কাজ করছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জঘন্য ও নৃশংসতার বিবরণ দৈনিকে তুলে ধরে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সাইমন ড্রিং | |
---|---|
![]() সাইমন ড্রিং | |
জন্ম | ১১ জানুয়ারি, ১৯৪৫ ফাকেনহাম, নরফোক, ইংল্যান্ড |
জাতীয়তা | ইংরেজ |
পেশা | সাংবাদিকতা |
পরিচিতির কারণ | সাংবাদিক, টেলিভিশন উপস্থাপক, অনুষ্ঠান নির্মাতা |
দাম্পত্য সঙ্গী | ফাইওনা ম্যাকফেরসন |
সন্তান | আভা রোজ, ইন্ডিয়া রোজ তানিয়া (পূর্বেকার সংসারের কন্যা) |
পুরস্কার | রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার ভ্যালিয়ান্ট ফর ট্রুথ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সনি নিউইয়র্ক ফেস্টিভ্যাল গ্রান্ড প্রাইজ |
শিক্ষা লাভ
ইংল্যান্ডের নরফোকের ফাকেনহাম নামক এক ছোট্ট শহরে ১১ জানুয়ারি, ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন সাইমন ড্রিং। শৈশবকালে আওজ নদীতে উলঙ্গ অবস্থায় সাঁতার কাটার অভিযোগে তাকে বোর্ডিং স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এরপর তিনি কিংস্ লিন টেকনিক্যাল কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৬ বৎসর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন। ১৯৬২ সালে বহিঃবিশ্ব ভ্রমণের অংশ হিসেবে ভারত ভ্রমণ করেন।
সাংবাদিকতা
১৭ বছর বয়সে তিনি প্রথম চাকুরীতে যোগদান করেন। ১৯৬৩ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড সংবাদপত্রে 'প্রুফ রিডার' (সম্পাদনা সহকারী) হিসেবে কাজ করেন। তারপর ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের স্ট্রিংগার হিসেবে কাজ করেন লাওস থেকে।[1] একই বছর ভিয়েতনাম ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের যুদ্ধবিষয়ক সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এর মাধ্যমেই তিনি রয়টার্সের সর্বকনিষ্ঠ বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে নিজেকে ইতিহাসের পর্দায় ঠাঁই করে নেন।
১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর পুরো দশক জুড়ে তিনি ডেইলী টেলিগ্রাফ সংবাদপত্র এবং বিবিসি টেলিভিশন নিউজের বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে সারা পৃথিবীতে কর্মরত ছিলেন। ঐ সময়ে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে প্রতিবেদন পাঠাতেন। ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ইউরোপের অস্থিতিশীল ঘটনাপ্রবাহ নিয়মিত তুলে ধরতেন সংবাদ মাধ্যমগুলোয়। পেশাগত জীবনে ২২টি যুদ্ধ ও অভ্যুত্থান কাভার করেছেন। বিবিসি টেলিভিশন ও রেডিও'র সংবাদ এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে কাজ করেছেন প্রায় ২০ বছর। এছাড়া চলচ্চিত্র, আন্তর্জাতিক ঘটনা এবং সঙ্গীত বিষয়ে তার রয়েছে ব্যাপক ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা।[1] ইরানের শাহবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করে সায়মন ড্রিং নন্দিত হয়েছিলেন এবং অর্জন করেছিলেন অনেক পুরস্কার।
সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি দু'বার আহতও হয়েছিলেন। প্রথমবার ভিয়েতনামে এবং দ্বিতীয়বার সাইপ্রাসে তুর্কিদের আগ্রাসনে। বিবিসি রেডিও এবং টেলিভিশনে কাজ করার পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে লিখেছেন তিনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদন তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও সুনাম এনে দেয়। সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশী সাংবাদিক যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরী করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানী বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভরা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাতে সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরবর্তীতে - হোটেল শেরাটন, বর্তমানে -হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ) লুকিয়ে ছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তানে সামরিক আইনের তোয়াক্কা না করে ২৭ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে প্রেরণ করেন যা ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান শিরোনামে ৩০ মার্চ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে তার এ প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। উক্ত প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে,[2]
“ | আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরের...। | ” |
১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে পুণরায় নভেম্বর, ১৯৭১ সালে কলকাতায় আসেন তিনি। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় খবরাখবর নিরপেক্ষভাবে ঐ দৈনিকে প্রেরণ করতেন। ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে বিজয়ের দিনে যৌথবাহিনীর সাথে তিনিও ঢাকায় এসেছিলেন।
দাতব্য তহবিল সৃষ্টি
১৯৮৬ সালে লন্ডনে ফিরে তিনি স্পোর্ট এইড নামীয় দাতব্য তহবিলের ধারণা তুলে ধরেন। তহবিল সৃষ্টিতে তাকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করেন বব গেল্ডোফ। অর্থ তহবিল সৃষ্টির বিষয়টি ছিল ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ ঘটনা যাতে অধিক জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বব্যাপী ১২০টি দেশের প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ৩৭ মিলিয়ন ডলার এই তহবিলে জমা হয়। মূলতঃ আফ্রিকা মহাদেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলের জনগণকে সহায়তার জন্য তহবিলটি গড়ে তোলা হয়েছিল।
একই সালে দ্য রেস এসেইন্ট টাইম শিরোনামে অন্য আরেকটি দাতব্য তহবিল গড়েন সাইমন ড্রিং। এতে ১৬০টি দেশের প্রায় ৫৫ মিলিয়ন মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল।
প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ
বিবিসিতে কর্মরত অবস্থায় তিনি অনেকগুলো প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা ও উপস্থাপনা করেন। আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি বিবিসি ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিল্ম কোম্পানী খোলেন। সেখান থেকে বিবিসি ও পাবলিক ব্রডকাস্ট সার্ভিসের জন্য নির্মাণ করেন বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র। তাছাড়া - সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও লাতিন আমেরিকার ওপর নির্মাণ করেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এসব প্রামাণ্যচিত্র বা অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, পরিচালক ও প্রযোজন ছিলেন তিনি নিজেই।
সাইমন ড্রিং তার ১৯৬২ সালের বৈদেশিক ভ্রমণকে কেন্দ্র করে বিবিসি রেডিও ফোরের জন্য 'অন দ্য রোড এগেইন' নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরী করেন ১৯৯২ সালে। পরবর্তীকালে ১৯৯৪ সালে ঐ ভ্রমণ নিয়েই একই নামে আরেকটি আট পর্বের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। প্রামাণ্য চিত্রটি বিবিসি টেলিভিশন এবং ডিসকভারী চ্যানেলে প্রচার করা হয়েছিল। এছাড়াও, ১৯৯৫ সালে অন দ্য রোড এগেইন: থার্টি ইয়ার্স অন দ্য ট্র্যাভেলার্স ট্রেইল টু ইন্ডিয়া নামে একটি ভ্রমণ কাহিনীবিষয়ক বই পাঠকদেরকে উপহার দেন। বিবিসি রেডিও ফোরের জন্য নির্মাণ করেন ৪০ মিনিটের রিটার্ন দ্য রোলিং থান্ডার, যা ছিল তার ২০ বছর পর ভিয়েতনামে ফিরে যাওয়ার স্মৃতি নিয়ে অনুষ্ঠান।
হাইতিতে আমেরিকার আগ্রাসন নিয়ে ভুডু ডানিসংসহ আরও অনেক টেলিভিশন অনুষ্ঠান তৈরী করেন। তাছাড়া, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের।
একুশে টেলিভিশন
সাইমন ড্রিং বাংলাদেশের ১ম বেসরকারী পর্যায়ের টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে বিবিসি ছেড়ে তিনি একুশে'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের বেসরকারী টেলিভিশনের আধুনিকতার অন্যতম রূপকার।[1] ২০০২ সালে একুশে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ সম্প্রচার আইন লঙ্ঘনজনিত কারণে তাদের সম্প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয় এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি ও তার সহযোগী তিনজন নির্বাহী পরিচালক প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন।[3] অতঃপর, ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে সরকার সায়মন ড্রিংয়ের ভিসা এবং ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাকে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগের আদেশ দেন। এরফলে তিনি ১ অক্টোবর, ২০০২ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।
পুরস্কার অর্জন
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের নির্যাতনের ওপর প্রতিবেদন তৈরী করে অর্জন করেন ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার; ইরিত্রিয়া যুদ্ধের ওপর ভ্যালিয়ান্ট ফর ট্রুথ; কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধের প্রতিবেদনের জন্য সনি এবং হাইতিতে আমেরিকান আগ্রাসনের ওপর প্রতিবেদন তৈরী করে অর্জন করেন নিউইয়র্ক ফেস্টিভ্যাল গ্রান্ড প্রাইজ। তিনি একজন সেরা প্রুফ রিডারও ছিলেন।[1]
ব্যক্তিগত জীবন
বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি তার পত্নী ফাইওনা ম্যাকফেরসন সাথে বসবাস করছেন। তার স্ত্রী আইনজীবী এবং রোমানিয়াভিত্তিক ব্রিটিশ চিলড্রেনস্ চ্যারিটি'র নির্বাহী পরিচালক। তাদের সংসারে ২৩ ডিসেম্বর, ২০১০ তারিখে যমজ কন্যা - আভা রোজ এবং ইন্ডিয়া রোজ জন্মগ্রহণ করে। ড্রিংয়ের পূর্বেকার সংসারে তানিয়া নাম্নী আরেকটি কন্যা রয়েছে। সে নিকোলাস এবং জেমস নামের দু'টি পুত্র সন্তান নিয়ে স্পেনে বসবাস করছে।
আরও দেখুন
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
- একুশে টেলিভিশন
- রয়টার্স
- সংবাদ সংস্থা
- অ্যান্থনি মাসকারেনহাস
- ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড
তথ্যসূত্র
- দৈনিক প্রথম আলো, খোলা কলম, মুদ্রিত সংস্করণ, ১১ জানুয়ারি, ২০১২ইং, পৃষ্ঠাঃ ১৩
- বিজয়ের ৪০ বছর: বিদেশি সহযোদ্ধা যুদ্ধসাথি সায়মন ড্রিং, সংগ্রহকালঃ ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১ইং
- বাংলাদেশ সরকার টেলিভিশন প্রধানকে চলে যেতে বলেছেন