শ্রী শ্রী হরিদেব

শ্রী শ্রী হরিদেব (অসমীয়া:শ্ৰী শ্ৰী হৰিদেৱ) অসমের মহাপুরুষ ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম । তিনি অসমের বৈদিক বৈষ্ণব ধর্মের প্রথম প্রচারক। তিনি ইশ্বরের আরাধনায় বলি প্রথার সমর্থক ছিলেন না। গীতা, বেদ ও ভাগবত শাস্ত্রে প্রতিষ্ঠিত এক ইশ্বর উপাসনা ধর্মে তিনি বিশ্বাস করিতেন ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকল দেবতার মূল জ্ঞাত করে তিনি কেবল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজা অর্চনা করিতেন। একশরন বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করার উদ্দেশ্যে তিনি মনোরী সত্র, হরিপুর সত্র ও কৈহাটি সত্র স্থাপন করেছিলেন। অসমের নব-বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারক চাঁরজন যথাক্রমে শ্রীমন্ত শংকরদেব, শ্রীমন্ত মাধবদেব, শ্রী শ্রী হরিদেব ও দামোদরদেব। সত্রপাতি বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করার উপরিও তিনি ভক্তিজ্ঞাপক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

জন্ম ও পূর্বপুরুষ

ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে লক্ষীমপুর নগরের নরনারায়ণপুরে হরিদেবের জন্ম হয়েছিল। তার পিতার নাম দ্বিজ অজনাভ ও মাতার নাম পারিজাতি দেবী। তার পূর্বপুরুষ কন্যাকুজ্বের ছিলেন যদিও পরিবর্তিত সময়ে অসমের বাসিন্দা হয়েছিলেন।

বাল্যকাল ও শিক্ষা

শ্রী শ্রী হরিদেব ব্রাহ্মন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নয় বৎসর বয়সে তিনি গোবিন্দ পন্ডিত থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি শিশুকালে পিতা অজনাভ থেকে সংস্কৃত ও ব্যাকরনের জ্ঞান পেয়েছিলেন। বাল্যকালে তিনি পানিনি ব্যাকারন, বেদ ও দর্শনের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। জৌবন কাল থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার পান্ডিত্য গুন প্রকাশ পেয়েছিল।

কর্মজীবন

শ্রী শ্রী হরিদেব হিংসা-দ্বেষ পরিহার করে বলিপ্রথা ত্যাগ করে বৈদিক বৈষ্ণব ধর্মে ব্রতি হয়েছিলেন। প্রায় ১৭বৎসর বয়সে তিনি ঘড় থেকে পালিয়ে এসে গুয়াহাটির অশ্বক্লান্তে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি মাধব নামক সন্যাসী থেকে শরন দীক্ষা গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর তিনি হাজোর হয়গ্রীব মাধব মন্দির ও কেদার মন্দির পরিদর্শন করেন। তারপর তিনি শ্রীক্ষেত্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন ও বিশাম্বর নামক পুজারির সহায়তায় শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ মন্দির দর্শন করেন। শ্রী শ্রী হরিদেব উত্তর ভারতের সকল তীর্থস্থান দর্শন করে কাশীর শ্রদ্বানন্দ আচার্যীর অধীনে চার বৎসর বেদ ও দর্শনের অধ্যয়ন করেন। বেদ ও দর্শনে অপরিসীম জ্ঞান থাকার জন্য তাকে দর্শন বেদাচার্য উপাধিতে বিভুষিত করা হয়েছে। তিনি জগন্নাথে পাঁচ বৎসরে ভাগবত চর্চা করে ভাগবতাচার্য্য উপাধি লাভ করেন। ভাগবত সমাপ্ত করে তিনি নিজের পূর্বপুরুষের স্থানে ফিরে যান ও সেই স্থানের অসৎ চরিত্রের ব্যক্তিকে নিজ প্রতিভার বলে সৎ পথে আনতে সমর্থ হন। ১৪৫৩ সনে তিনি পুর্বপুরুষের স্থানে সৎ সঙ্গী হরিদেবাশ্রম নামক একটি আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন। কালক্রমে এটি গুরুদেব সেবাশ্রম নামে নামান্তরিত হয়। এই আশ্রমটি নামেরি সত্র ও বাহরি নামেও পরিচিত।[1] তিনি কৃষ্ণকান্ত অধ্যাপকের কন্য তিলোত্তমাকে বিবাহ করেছিলেন। তার কন্যার নাম ভুবনেশ্বরী। ভুবনেশ্বরী চিরকুমারী গ্রহণ করে জ্ঞান চর্চায় ব্রতি হয়ে নামেরি সত্রের সত্রাধিকার হিসেবে অনুষ্ঠিত হন। তিনি প্রথম মহিলা যিনি বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের এই সন্মানীয় স্থান লাভ করেন। শ্রী শ্রী হরিদেবের গুন,গরিমা ও পান্ডিত্যের কথা জানতে পেয়ে কোচবিহারের রাজা মল্লদেবে তার থেকে পত্নীসহ দীক্ষা গ্রহণ করেন। রাজা মল্লদেব কোচবিহার থেকে চার-পাচ কিঃমিঃ দূরত্বে হরিপুত্র সত্র নামক একটি সত্রের স্থাপন করে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করার ব্যবস্থা করেন। কিছুকাল কোচবিহারে ধর্ম প্রচার করে তিনি পুনরায় অসমের বরপেটায় ফিরে আসেন ও মানেরি সত্র থেকে ধর্ম প্রচার অব্যাহত রাখেন।

বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার

গীতা, বেদ ও ভাগবত শাস্ত্রে প্রতিষ্ঠিত এক ইশ্বর উপাসনা ধর্মে তিনি বিশ্বাস করিতেন ও এই ধর্ম প্রচার করার জন্য তিনি আপ্রান চেষ্টা করেছিলেন। তারমতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকল দেবতার মুল ইশ্বর। তিনি বলি প্রথার বিরোধ করেছিলেন ও অন্যান্য দেব-দেবীর নিন্দা অপরাধ বলে গন্য করেছিলেন। তারমতে পৃথিবীর সকল জলভাগ যেমন সমুদ্রের দিকে গতি করে ঠিক সেইভাবে অন্যান্য দেব-দেবীকে করা পূজা কেশব অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের দিকে গতি করে। তিনি বিশ্বাস করিতেন যে ভাগবতের নববিধা ভক্তির দ্বারা পরম গতি লাভ করা সম্ভব কিন্তু ইহার জন্য সৎ গুরুর প্রয়োজন। উল্লেখযোগ্য যে শ্রী শ্রী হরিদেব অসমে প্রথম বৈদিক বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তার জন্মের ২৩ বৎসর পর শ্রীমন্ত শংকরদেবের জন্ম হয়েছিল ও ৩৯ বৎসর পর শ্রী দামোদরের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু গুরুদের পরস্পরের সহিত সমন্বয় ও সদভাবনা ছিল।

প্রতিভা

শ্রী শ্রী হরিদেব সরল, ধর্মপরায়ণ, বেদ,উপনিষদ, ভাগবত , গীতা ইত্যাদির জ্ঞান থাকা একজন বিদগ্ধ পন্ডিত বা যোগসিদ্ধ পুরুষ । তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রের মুলতত্ব একত্রিত করতে ভক্তদের মাঝে প্রচার করার উপরি লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

সাহিত্যে হরিদেবের অবদান

সহজ-সরল ছোট ছোট বাক্যকে একত্রিত করে গভীর ভাব প্রকাশ করাই ছিল শ্রী শ্রী হরিদেবের গদ্যশৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট। তিনি রচনা করা ভক্তিরস তরংগিনী প্রাচীন অসমীয়া গদ্য সাহিত্যের অন্যতম নির্দেশন।

রচনাবলী

  • শরন সংহিতা
  • ভক্তিরস তরংগিনী

তিনি কয়েকটি ভক্তিমূলক গান রচনা করেছিলেন।

ইংরেজিতে অনুবাদিত গ্রন্থ

  • শরন সিদ্ধান্ত,১৯৯১, প্রকাশকঃ উত্তর-পুব ভারত হরিদেব সংঘ
  • ভক্তিরস তরংগিনী, ১৯৯২, প্রকাশকঃ উত্তর-পুব ভারত হরিদেব সংঘ

হরিদেব সম্পর্কীয় কয়েকটি পুস্তক

  • দ্বিজ বানরশ্বর রচিত সংস্কৃত গুরুচরিতামৃত
  • দ্বিজ বানেশ্বর রচিত সংস্কৃত চরিত পুথির দ্বিক দিবাকরে করা অসমীয়া পদানুবাদ- শ্রী শ্রী হরিদেব চরিত্র
  • বনগঞাগিরি বিরচিত মহাপুরুষ শ্রীশ্রীহরিদেব চরিত
  • শ্রীদোদরদেব গোস্বামী বিরচিত আধুনিক মহাপুরুষ শ্রীশ্রীহরিদেব কীর্তন।

স্থাপন করা সত্রসমূহের নাম

  • নামেরী সত্র
  • হরিদেব সত্র
  • কৈহাটী সত্র

মৃত্যু

শ্রী শ্রী হরিদেব জীবনের অন্তিম মূ্হর্ত পর্যন্ত ধর্ম প্রচার করেছিলেন। ১৫৬৬ সনের জৈষ্ঠ মাসের অমবস্যা তিথিতে তিনি মৃত্যুবরন করেন।

তথ্যসূত্র

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.