রশীদ তালুকদার
রশীদ তালুকদার (জন্ম: ২৪শে অক্টোবর, ১৯৩৯ - মৃত্যু: ২৫শে অক্টোবর, ২০১১) বাংলাদেশের প্রথিতযশা ও জনপ্রিয় আলোকচিত্রশিল্পী ছিলেন। তার ডাক নাম ছিল কাঞ্চন। সহকর্মীদের কাছে 'রশীদ ভাই' নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। যৌবনে গোটা রাজশাহীতে পরিচিত ছিলেন 'প্রিন্স রশীদ' নামে।[1] বীর বাঙালীদের স্বাধিকারের দাবিতে স্বাধীনতা-পূর্ব ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের স্থিরচিত্র ধারণ করে স্মরণীয় করে রেখেছেন নিজেকে।
রশীদ তালুকদার | |
---|---|
![]() রশীদ তালুকদার | |
জন্ম | কাঞ্চন ২৪ অক্টোবর, ১৯৩৯ চব্বিশ পরগণা, বৃটিশ ভারত |
মৃত্যু | ২৫ অক্টোবর ২০১১ ৭২) | (বয়স
নাগরিকত্ব | ![]() |
পেশা | আলোকচিত্র সাংবাদিক |
পরিচিতির কারণ | আলোকচিত্রশিল্পী |
আদি নিবাস | কালকিনি, মাদারিপুর |
দাম্পত্য সঙ্গী | হালিমা খাতুন (বিবাহ-পরবর্তী: হালিমা রশীদ) |
সন্তান | মিজানুর রশীদ, শাহানা চৌধুরী ও সোনিয়া রশীদ |
আত্মীয় | রাইয়ান রশীদ (নাতি) |
পুরস্কার | ছবি মেলা আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড |
শৈশবকাল
২৪শে অক্টোবর, ১৯৩৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের চব্বিশ পরগণায় রশীদ তালুকদার জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবদুল করিম তালুকদার ছিলেন চাকুরীজীবি এবং মা রহিমা খাতুন ছিলেন গৃহিণী।[2] বাবা স্টেশন মাস্টার হওয়ায় পৈত্রিক ভিটা মাদারিপুরের কালকিনী থানার দক্ষিণ রমজানপুর গ্রামের পরিবর্তে তার জন্ম হয় চব্বিশ পরগণায়। তারা ছিলেন চার ভাই, চার বোন।[3]
শিক্ষা জীবন
বাবার চাকুরীগত কারণে তিনি বিভিন্ন জায়গায় লেখাপড়া করতে বাধ্য হন। তন্মধ্যে - প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন 'এম ই প্রাথমিক বিদ্যালয়', 'টাওয়ার এম ই প্রাথমিক বিদ্যালয়' এবং 'মহসীন উচ্চ বিদ্যালয়ের' সাথে সংশ্লিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেন - রাজশাহীর 'লোকনাথ হাই স্কুল', 'কক্সবাজার হাই স্কুল' এবং 'রাজা হাই স্কুলে'।[3]
ফটো সাংবাদিকতা
১৯৫৯ সালে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে পিআইডি বা প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টে ৮০ টাকা বেতনে যোগ দেন তিনি। পেশা হিসেবে ফটো সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছিলেন রশীদ তালুকদার। সেলক্ষ্যে, দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ফটো সাংবাদিক বা আলোকচিত্রী হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে প্রবেশ করেন ১৯৬২ সালে। ফটো সাংবাদিক হিসেবে তাকে জীবনের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টটি দিয়েছিলেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি শহীদুল্লাহ কায়সার।[1] এরপর সেখান থেকে চলে এসে ১৯৭৫ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগ দেন।[4] সেখানে তার সহকর্মী হিসেবে ছিলেন ইত্তেফাকের সাবেক সম্পাদক রাহাত খান। সেখানে তিনি একাধারে ২৯ বছর চাকরি করে ২০০৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন।[5]
বাংলাদেশের বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে তার আলোকচিত্র। বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব - মাদার তেরেসা, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, বুদ্ধিজীবিদের লাশ উত্তোলনের স্থিরচিত্র ধারণ করে রশীদ তালুকদার স্মরণীয় হয়ে আছেন।[1]
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনে শহীদ আসাদের মৃত্যুতে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় আলোকচিত্র শিল্পী হিসেবে তার ক্যামেরায় স্থিরচিত্র হিসেবে ফুঁটে উঠেছিল ছাত্র-জনতার দীর্ঘ মিছিলসহ আসাদের শার্টের ছবি।[6]
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণ-অভ্যুত্থানের স্থির চিত্র হিসেবে মিছিলের সম্মুখভাগে টোকাই বা পথশিশুর ছবি তুলে সকলের নজর কাড়েন তিনি। পরবর্তীতে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে বুদ্ধিজীবীদের লাশ উত্তোলনের ছবিও তিনিই ধারণ করেন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনকেও ক্যামেরায় ধারণ করেন রশীদ তালুকদার।[7]
১৯৭১ সালে পেশাগত জীবন থেকে কিছুটা দূরে সরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিশে যান তিনি। নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে শুরু করেন বীরসেনানীদেরকে। এ সময় তার প্রিয় ১৩৫ মি.মি. ক্যামেরা সবসময় সঙ্গে থাকতো। আইস্যুলেট ক্যামেরা দিয়ে শুরু করেছিলেন ছবি তোলা। এরপর রোলিকর্ড, রোলিফ্লেক্স এবং নাইকন ক্যামেরাও ব্যবহার করেছেন রশীদ তালুকদার।[1]
পুরস্কার ও সম্মাননা
আলোক চিত্রকলায় অসামান্য অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্বর্ণপদকসহ প্রায় ৭৭টি পুরস্কার লাভ করেন রশীদ তালুকদার।[8] তন্মধ্যে -
- ২০০৬ সালে তাকে 'ছবি মেলা আজীবন সম্মাননা পুরস্কার' প্রদান করেন বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সি. এম. শফি সামি।[9][10]
- ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অলাভজনক বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি'র পক্ষ থেকে ‘পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার লাভ।[8]
- জাতিসংঘ কর্তৃক ‘নিরাশ্রয়ের জন্য আশ্রয়’ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় একত্রে ৬টি পুরস্কার অর্জন।
- জাপান ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও আসাহি সিমবুন পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় পরপর দুইবার পুরস্কৃত হওয়া অন্যতম।
উল্লেখ্য যে, রশীদ তালুকদার ছিলেন বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।[11]
ব্যক্তিগত জীবন
তিনি হালিমা রশীদকে (বিবাহ-পূর্ব: হালিমা খাতুন) বিয়ে করেন। তার স্ত্রী ২৩ মে, ২০০৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। পরিবারে এক ছেলে - মিজানুর রশীদ এবং দুই মেয়ে - শাহানা চৌধুরী ও সোনিয়া রশীদ রয়েছে।[3]
মৃত্যুবরণ
মাথায় আঘাতজনিত কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটে রশীদ তালুকদারের। পরে ৭২ বছর বয়সে ২৫ অক্টোবর, ২০১১ইং তারিখ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।[2]
তথ্যসূত্র
- দৈনিক প্রথম আলো, ছুটির দিনে, মুদ্রিত সংস্করণ, ১৭ জুলাই, ২০১০ইং
- "দৈনিক আমারদেশ: প্রখ্যাত ফটোসাংবাদিক রশীদ তালুকদার আর নেই"। ২৯ অক্টোবর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ অক্টোবর ২০১১।
- গুণীজন: রশীদ তালুকদার
- সকালের খবর: রশীদ তালুকদার আর নেই
- বিবিসি: রশীদ তালুকদার আর নেই
- "সাপ্তাহিক.কমের প্রতিবেদনে শহীদ আসাদের শার্ট"।
- স্বপ্নের একীকরণ
- দেশ টিভি: ফটোসাংবাদিক রশীদ তালুকদার আর নেই
- ছবি মেলা আজীবন সম্মাননা পুরস্কার
- আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পেলেন রশীদ তালুকদার
- "বাংলারকণ্ঠ: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের আলোকচিত্রী সাংবাদিক রশীদ তালুকদার আর নেই"। ১১ আগস্ট ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ অক্টোবর ২০১১।