মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা

সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা (১ মে ১৯৩৪ - ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) ছিলেন একজন বাঙালি শিক্ষাবিদ এবং অধ্যাপক।[1] তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (তৎকালীন রিডার) ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালনকালে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন।

সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা
(১৯৩৪-০৫-০১)১ মে ১৯৩৪ – ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৯৬৯( ১৯৬৯-০২-১৮)

জন্ম তারিখ: (১৯৩৪-০৫-০১)১ মে ১৯৩৪
জন্মস্থান: বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ব্রিটিশ ভারত
মৃত্যু তারিখ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯(1969-02-18) (বয়স ৩৪)
মৃত্যুস্থান: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
জীবনকাল: (১৯৩৪-০৫-০১)১ মে ১৯৩৪ – ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৯৬৯( ১৯৬৯-০২-১৮)
আন্দোলন: ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
দাম্পত্য সঙ্গী: নিলুফার জোহা
পিতামাতা: মুহম্মদ আব্দুর রশীদ (বাবা)

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তিনি দেশের জনগণকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি, ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান, ১৫ ফেব্রুয়ারি, সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক শহীদ শামসুজ্জোহার মৃত্যু দেশেবাসীকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। শামসুজ্জোহাকে দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে গন্য করা হয়। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।

প্রাথমিক জীবন

জন্ম এবং শিক্ষা

সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহার জন্ম মে ১, ১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায়। পিতা মুহম্মদ আব্দুর রশীদ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নিম্নবেতনভোগী চাকরিজীবি। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শামসুজ্জোহার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় পশ্চিমবঙ্গে। বাঁকুড়া জিলা স্কুলে তিনি ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনীতে উত্তীর্ন হন এবং বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে প্রথম শ্রেণীতে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।[1]

শহীদ শামসুজ্জোহা হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

দেশবিভাগের পর ১৯৫০ সালের প্রথমদিকে পূর্বপশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে শামসুজ্জোহা তার পরিবার নিয়ে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হন। এসময় ভাষা আন্দোলনের সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় শ্রেনীতে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি রসায়নবিদ ড. মোকাররম হোসেন খন্দকারের তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীর জন্য গবেষণা শুরু করেন। গবেষণার বিষয় ছিলো বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে ক্রোমাইট খনিজের জারণ প্রক্রিয়া, যা পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে লন্ডনের রসায়ন শিল্প পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স, টেকনোলজিতে অ্যান্ড মেডিসিনে অধ্যয়ন করেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।[1][2][3]

কর্মজীবন

শহীদ শামসুজ্জোহার কবর

১৯৫৫ সালের শেষের দিকে শামসুজ্জোহা পাকিস্তান অর্ডন্যান্স কারখানায় সহযোগী কারখানা পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হন। একই বছর ১৪ ডিসেম্বর তিনি যুক্তরাজ্যের সাউথ ওয়েলসে রয়্যাল অর্ডিনেন্স কারখানায় বিষ্ফোরক দ্রব্যের উপর প্রশিক্ষন লাভের জন্য যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টে সহকারি পরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে রয়্যাল অর্ডিনেন্স থেকে ইস্তফা নিয়ে জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং একই বছর উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের লেকচারার পদে যোগদান করেন। সেখানে অধ্যাপনাকালে তিনি বৃত্তি নিয়ে পুনরায় লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজে চলে যান।

পিএইচডি ও ডিআইসি ডিগ্রি লাভ করে তিনি ১৯৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে পুনরায় অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে তাকে রিডার পদে উন্নীত করা হয়। পরবর্তীবছর ১৯৬৫ সালে তিনি শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক এবং ১৯৬৬ সালে প্রাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। লন্ডনে গবেষণাকালে তিনি কিছুকাল বেরেট স্ট্রিট ওয়েস্ট লন্ডন কমার্স কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৮ সালে নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছর মেয়াদী বৃত্তি পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ছাড়েনি অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাবে।[1][3]

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান

১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ১৯৬৬-এর ছয় দফা১১ দফা দাবিতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে মিছিল করা অবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান শহীদ হন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়।[3]

এই দুটি হত্যাকান্ডে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে, সান্ধ্যকালীন আইন জারি করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার চেষ্টা করে। আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের করলে অনেক ছাত্রের জীবননাশের আশঙ্কা থাকায় প্রক্টর শামসুজ্জোহা নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন সেনাসদস্যদের। কিন্তু সেনাসদস্যরা দ্বারা ছোড়া গুলিতে বিদ্ধ হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[1]

ব্যক্তিগত জীবন

প্রফেসর ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে নিলুফার ইয়াসমিনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। নিলুফার ইয়াসমিন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের একজন শিক্ষয়িত্রী। ১৯৬৬ সালে এই দম্পতি একটি কন্যাসন্তান লাভ করে।

স্ফুলিঙ্গ, স্মৃতি ভাস্কর্য, শহীদ শামসুজ্জোহা আবাসিক হল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মৃত্যু-পরবর্তী চেতনা

জোহার মৃত্যু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলো এবং প্রভাব ছিলো সূদূরপ্রসারী, যা দেশকে স্বাধীন করতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলো। দেশ স্বাধীনের পর তার অবদানের কৃতজ্ঞতাস্বরুপ তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবির সম্মানে ভূষিত করা হয়। তার মৃত্যুর পরপরই তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার নামানুসারে নবনির্মিত আবাসিক হলের নামকরণ করেন শহীদ শামসুজ্জোহা হল

নাটোরে তার নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ প্রতিবছর জোহা সিম্পজিয়াম পালন করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি দেশের শিক্ষকসমাজ জোহার মৃত্যুদিবসকে "জাতীয় শিক্ষক দিবস" হিসেবে পালনের দাবী জানিয়ে আসছে। তার নামানুসারে নির্মিত আবাসিক হলশহীদ শামসুজ্জোহা হলের মূল ফটকের পাশে একটি স্মৃতি স্মারক স্ফুলিঙ্গ নির্মাণ করা হয় ২০১২ সালে।

আরও দেখুন

আরও পড়ুন

  • প্রফেসর আব্দুল খালেক। ড. জোহা এবং আমি (বাংলা ভাষায়)।
  • ড. তুহিন ওয়াদুদ। ইতিহাসের আলোকে শহীদ শামসুজ্জোহা (বাংলা ভাষায়)।
  • আজও স্বীকৃতি মেলেনি প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী জোহা দিবসের।

তথ্যসূত্র

  1. মোহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ (জানুয়ারি ২০০৩)। "শামসুজ্জোহা, শহীদ মুহম্মদ"। সিরাজুল ইসলাম[[বাংলাপিডিয়া]] (বাংলা ভাষায়)। ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশআইএসবিএন 984-32-0576-6। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৭, ২০১৫ ইউআরএল–উইকিসংযোগ দ্বন্দ্ব (সাহায্য)
  2. মোহাম্মদ মাহবুব মুর্শেদ। "শামসুজ্জোহা"bdlinks.net। bdlinks.net। ২২ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৭, ২০১৫
  3. তুহিন ওয়াদুদ (ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১১)। "ইতিহাসের আলোকে শহীদ শামসুজ্জোহা"দৈনিক প্রথম আলোঢাকা। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১৭, ২০১৫

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.