বুদ্ধিজীবী

বুদ্ধিজীবী (ইংরেজি: Intellectual, ইন্টেলেকচুয়াল) হল কোন ব্যক্তি যিনি সমাজ সম্পর্কিত জটিল চিন্তা, গবেষণা ও প্রভাব-বিস্তারে জড়িত থাকেন, সমাজের মূল সমস্যাগুলোর সমাধান ও সমাধানের পদ্ধতির প্রস্তাব দেন, এবং একজন জনপ্রিয় ব্যক্তির স্বীকৃতি অর্জন করেন।[1][2] বুদ্ধিজীবীরা কোন বাস্তব বিষয়কে রক্ষা বা সমর্থন করার জন্য বা অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করার জন্য সৃজনশীল স্রষ্টা বা মধ্যস্ততাকারী হিসেবে সংস্কৃতির জগৎ হতে এসে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন, যা তারা করে থাকেন কোন মতবাদকে প্রত্যাখ্যান, সৃষ্টি অথবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে, অথবা কোন একটি মুল্যবোধ ব্যবস্থাকে সমর্থন করার মাধ্যমে।[3]

রটারডামের ইরামাস ছিলেন তার সময়ের একজন প্রধানতম বুদ্ধিজীবী।
ফরাসি-আমেরিকান বুদ্ধিজীবী জ্যাকুয়েস বারজান ছিলেন একাধারে শিক্ষক, "ম্যান অব লেটারস" এবং পন্ডিত।

সংজ্ঞা

বুদ্ধিজীবী হলেন একধরনের বুদ্ধিমান ব্যক্তি যারা কার্যকারণ ও জটিল চিন্তাকে ব্যবহার করেন। প্রাত্যহিক কর্মে সে সকল দ্ক্ষতায় বুদ্ধি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় যেগুলোতে কোন মানসিক শিক্ষার উপাদান রয়েছে, যেমন চিকিৎসা কিংবা শিল্পকলার ক্ষেত্র, কিন্তু এ দুটি চিন্তার জগতের সঙ্গে পেশাদার হিসেবে অপরিহার্যভাবে জড়িত নয়। বুদ্ধিবৃত্তি বলতে কোন ব্যক্তির নিজস্ব কর্ম, শিক্ষা, জীবনের প্রতিফলন কিংবা দর্শনবোধের মাধ্যমে সমাজকে প্রভাবান্বিত করার চিন্তাধারাকে বুঝানো হয়। এ ধরনের চিন্তাধারায় প্রশ্ন এবং উত্তরের যথার্থতার মাধ্যমে বৈশ্বিক মানদণ্ডে বিচিত্রমূখী ভাবধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। তাঁরা প্রধানতঃ বুদ্ধিকে উপজীব্য করে পেশাদারীত্ব অথবা ব্যক্তি উদ্যোগকে কাজে লাগান। অর্থাৎ, সমাজ ও সংস্কৃতি সচেতন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষ সুশিক্ষিত মানুষ হিসেবে স্বীয় বুদ্ধির বলে বা বুদ্ধির কাজ দিয়ে তাঁরা জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁরা জ্ঞান বা বুদ্ধিকৌশলকে যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করেন। সাধারণতঃ লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, শিল্পবোদ্ধা ব্যক্তিত্বগণ বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁরা তাঁদের ধ্যান-ধারণা অথবা সমালোচনাধর্মী চিন্তা-চেতনার যথার্থ প্রতিফলন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন।

প্রধানতঃ তিন ধরনের ব্যক্তিত্বগণ বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজে পরিচিতি পেতে পারেন। বুদ্ধিজীবী একজন ব্যক্তি, যিনি চিন্তা ও কারণকে ব্যবহার করেন। বুদ্ধি এবং সমালোচনা ও বিশ্লেষণাত্মক কারণও তাঁর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে সম্পৃক্ত। পেশাদার অথবা ব্যক্তিগত চাহিদায় -

  1. একজন ব্যক্তি বিমূর্ত, চিন্তাধারা ও তাত্ত্বিক বিষয়ে জড়িত;
  2. দর্শনতত্ত্ব, সাহিত্যিক সমালোচনা, সমাজতত্ত্ব, আইন, রাজনৈতিক বিশ্লেষণকারী, তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী হিসেবে একজন ব্যক্তির পেশা একান্তই উৎপাদনমূখী ভাবনায় নিমজ্জ্বিত হবে;[4] অথবা,
  3. উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক এবং বিশেষজ্ঞ শিল্পবোদ্ধার জ্ঞান যা তাঁকে জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম।

প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষাবৃত্তিধারী এবং বুদ্ধিজীবী উভয়ই পারস্পারিকভাবে সম্পর্কিত হতে পারে। একজন বুদ্ধিজীবীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ হতে পারে এবং তাঁরা কোন পেশার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। বেশিরভাগ দার্শনিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত, পাশাপাশি শিল্পকলা, বিজ্ঞান, সাহিত্য, বাণিজ্য, সমাজকল্যাণ সহ বিভিন্ন শ্রেণী থেকে আগত ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারে।


ঐতিহাসিক সংজ্ঞা

শিক্ষিত মানুষ (ম্যান অফ লেটারস)

"ম্যান অফ লেটারস" পরিভাষাটি ফরাসি পরিভাষা বেলেটারিস্ট বা হোমি ডি লেটারস নামক পরিভাষা থেকে উদ্ভুত, কিন্তু তা কেতাবী জ্ঞানীর সমার্থক নয়।[5][6] একজন "ম্যান অফ লেটারস" বলতে স্বাক্ষর লোককে বোঝানো হত ("পড়তে লিখতে সক্ষম") যা নিরক্ষর লোকের বিপরীতে ব্যবহার করা হত, এমন একটি সময়ে যখন স্বাক্ষরতা প্রধান সংস্কৃতির একটি বিরল রূপ ছিল। ১৭ ও ১৮ দশকে বেলিটারিস্ট ছিলেন লিটারেটিরা, ফরাসি ভাষায় রিপাবলিক অফ লেটারস বা শিক্ষিত প্রজাতন্ত্রের নাগরিকগণ, যা রুপান্তরিত হয় সেলুন নামক প্রতিষ্ঠানে। এটি ছিল একটি সামাজিক গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা একজন হোস্টেস বা সেবিকা দ্বারা পরিচালিত হত, এবং অংশগ্রহণকারীদের শিক্ষাদীক্ষা ও সাংষ্কৃতিক পরিশোধনে নিবেদিত হত।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১৯শ-শতক

ব্রিটেন

ইউরোপ মহাদেশ

জার্মা‌নি

প্রাচ্য

বুদ্ধিজীবী শব্দটির সবচেয়ে প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায় ভারতীয় ধর্মীয় পান্ডুলিপি মহাভারতে, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়। মহাভারতের বর্ননাতে, অর্জুন ও রাজা-মহারাজাদের আগমনের পরপরই সভাস্থলে উপস্থিত হয় ‘নিপুণা বুদ্ধিজীবিন’ নামক ব্যক্তিগণ, যারা সয়ম্বরদের লক্ষভেদের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয়প্রকাশক আলোচনায় ব্যস্ত ছিল।[7]

সাম্রাজ্যবাদী চীনে ২০৬ খৃস্টপূর্ব হতে ১৯১২ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে, স্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা নিয়োজিত হতেন স্কলার অফিসিয়াল বা পন্ডিত-দাপ্তরিক (পন্ডিত ভদ্রমহোদয় বা স্কলার জেন্টেলম্যান) হিসেবে, যারা ছিলেন চীনের সম্রাট কর্তৃক দৈনিক সরকারি কর্মকান্ড সম্পাদনের জন্য নিয়োজিত কর্মচারী। এসকল বেসামরিক কর্মচারী শিক্ষাগত ডিগ্রী অর্জন করতেন সাম্রাজ্যের রাজকীয় পরীক্ষার মাধ্যমে, এবং পাশাপাশি তারা ছিলেন দক্ষ হস্তলিপিবিদ, এবং তারা কনফুসীয় দর্শন জানতেন। ইতিহাস-রচয়িতা উইং-সিত চ্যান অভিমত দেন:

সহজভাবে বললে, এসকল পন্ডিত-ভদ্রোমহোদয়ের বিবরণ-সম্বলিত নথি ছিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য নথি। ১৮ শতকের ইউরোপে এটি যথেষ্ট প্রশংসিত ও অনুকরণীয় বিষয় ছিল। বলতেই হবে, জনগণের সরকার থেকে আইনের সরকারে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে এটি চীনকে একটি ভয়াবহ সমস্যা এনে দিয়েছিল, এবং চীনা সরকারের ব্যক্তিগত বিবেচনা একটি অভিশাপ হয়ে উঠেছিল। [8]

জোসিয়ন কোরিয়ায় (১৩৯২-১৯১০), বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন লিটারেটি, যারা লিখতে পড়তে জানতেন, এবং কনফুসীয় ব্যবস্থা অনুযায়ী চুঙ্গিন (মধ্যস্ততাকারী লোক) হিসেবে পদমর্যাদা পেতেন। সামাজিকভাবে, তারা পেটিটে বোর্গিয়োসিয়ে নামক সংবিধান পরিচালনা করতেন, এটি লিখতেন পন্ডিত-আমলাগণ (পন্ডিত, পেশাদার কর্মী ও কারিগরি কর্মচারী), যারা জোসিয়ন রাজবংশের রাজকীয় নিয়মকানুন পরিচালনা করতেন।[9]

ইন্টেলিজেনশিয়া

জিন-পল সার্টার সামাজিক শ্রেণী হিসেবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা উল্লেখ করে বলেন, বুদ্ধিজীবীরা হল তাদের সময়ের নৈতিক চেতনা; তাই তাদের নৈতিক দ্বায়িত্ব হল সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা, এবং তাদের চেতনা অনুযায়ী তাদের নিজ নিজ সমাজের প্রতি স্বাধীনভাবে এসকল বিষয়ে কথা বলা।[10]

মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ

জনগণের বুদ্ধিজীবী (পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল)

বহিঃ ভিডিও
"Role of Intellectuals in Public Life", panel featuring Michael Ignatieff, Russell Jacoby, Roger Kimball, Susie Linfield, Alex Star, Ellen Willis and Alan Wolfe, March 1, 2001, C-SPAN

পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বা সর্বজনবিদিত/জনসেবী/জনগণের বুদ্ধিজীবী বলতে এমন বুদ্ধিজীবীদের বোঝায় যারা পড়াশোনা সংক্রান্ত পেশার পাশাপাশি সমাজের সরকারি ও জনগণের বিষয়-সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনায় অংশ নিয়ে থাকে।

সামাজিক পরিমন্ডল

একাডেমিক পরিমন্ডল

সামাজিক নীতি নির্ধা‌রণে ভূমিকা

জনগণের নীতি নির্ধারণীর ব্যাপারে, জনসেবী বুদ্ধিজীবীগণ জ্ঞানগর্ভ গবেষণার সঙ্গে সামাজিক সমস্যা সমাধানের ব্যবহারিক বিষয়ের সমন্বয় ঘটান।

সমালোচনা

ইন্টেলিজেনশিয়া

মার্কিন ইতিতাসবিদ নরম্যান স্টোন বলেন বুদ্ধিজীবী সামাজিক শ্রেণী সমাজের বাস্তবতাকে ভুলভাবে বোঝে এবং এ কারণে তারা যৌক্তিক প্রতারণা, আদর্শিক বোকামি এবং আদর্শ মতবাদ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত দুর্বল পরিকল্পনার ভ্রান্তিতে ভোগে।[11]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. The New Fontana dictionary of Modern Thought. Third Ed. A. Bullock & S. Trombley, Eds. (1999) p. 433.
  2. Jennings, Jeremy and Kemp-Welch, Tony. "The Century of the Intellectual: From Dreyfus to Salman Rushdie", Intellectuals in Politics, Routledge: New York (1997) p. 1.
  3. Pascal Ory and Jean-François Sirinelli, Les Intellectuels en France. De l'affaire Dreyfus à nos jours (The Intellectuals in France: From the Dreyfus Affair to Our Days), Paris: Armand Colin, 2002, p. 10.
  4. Sowell, Thomas (১৯৮০)। Knowledge and Decisions। Basic Books।
  5. The Oxford English Reference Dictionary Second Edition, (1996) p. 130.
  6. The New Cassel's French–English, English–French Dictionary (1962) p. 88.
  7. "আঁতেল কারে কয়"রেশমি বাগচিআনন্দবাজার পত্রিকা। ২০ মার্চ ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০১৮
  8. Charles Alexander Moore, ed. (১৯৬৭)। The Chinese Mind: Essentials of Chinese Philosophy and Culture। U of Hawaii Press। পৃষ্ঠা 22। আইএসবিএন 9780824800758।
  9. The Korea Foundation (ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৬)। Koreana - Winter 2015। পৃষ্ঠা 73–74। আইএসবিএন 9791156041573।
  10. Scriven 1993:119
  11. Jennings and Kemp Welch, 1997.


বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.