মাহমুদুর রহমান মজুমদার
ব্রিগেডিয়ার (অব:) মাহমুদুর রহমান মজুমদার (১৯২২ - ১৯ ডিসেম্বর ২০১১) যিনি এম আর মজুমদার নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের একজন সেনাকর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদ। পূর্ব পাকিস্তান সেনা বাহিনীর একমাত্র বাঙ্গালী ব্রিগেডিয়ার হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অমান্য করে "সোয়াত" জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে বাধা দান করায় নিজের পদ হতে অপসারিত হন। তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে দুই মেয়াদে (১৯৮৬ ও ১৯৮৮) সিলেট-৫ আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন।[1][1][2][3][4][5][6]
মাহমুদুর রহমান মজুমদার এম. আর. মজুমদার | |
---|---|
![]() | |
জন্ম | ২৫ ডিসেম্বর, ১৯২২ |
মৃত্যু | ১৯ ডিসেম্বর ২০১১ ৮৯) ঢাকা, বাংলাদেশ | (বয়স
অন্যান্য নাম | এম. আর. মজুমদার |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত) পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে) বাংলাদেশ |
পেশা | রাজনীতিবিদ ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা |
পরিচিতির কারণ | রাজনীতিবিদ |
আত্মীয় | হাফিজ আহমেদ মজুমদার (ভাতিজা) |
প্রাথমিক ও শিক্ষাজীবন
মাহমুদুর রহমান মজুমদার ১৯২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর তারিখে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের কাছাড় জেলার কাঠিহড়া থানার চন্ডিনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন; তার পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায় কসকনকপুর ইউনিয়নের বলরামের চক গ্রামে। তার পিতার নাম ওয়াজেদ আলী মজুমদার। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তারপর সিলেট এম.সি কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। শিক্ষা জীবন শেষে ১৯৫০ সালে পাকিস্তান আর্মিতে ক্যাপ্টেন হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে তার সামরিক জীবন শুরু হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের শিয়ালকোট সেক্টরে বীরত্ত্বের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ঐ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার কোন বাঙ্গালী অফিসার ছিলেন না। দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ সরকারের সচিব সহ বিভিন্ন গুরুত্ত্বপূর্ণ দায়িত্ত্ব পালন করেন।[3][4]
কর্মজীবন
এম. আর. মজুমদার ১৯৫০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগদান করেন ও ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে শিয়ালকোট সেক্টরে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সম্মানসূচক "টিকিউ" পদক লাভ করেন। তাকে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে 'ব্রিগেডিয়ার' পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। তিনি ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট (ইবিআরসি) হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ব জ্যেষ্ঠ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা।[7] পূর্ব পাকিস্তানে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ছিলেন একমাত্র বাঙালি ফর্মেশন কমান্ডার। সম্ভবত সেনা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খেয়াল করেনি, ফলে অতি গোপনীয় চিঠির একটি কপি তার কাছে এসে পৌঁছে। বিষয়টি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে তৎক্ষণাৎ জানানো জরুরি মনে করলেন। [4] ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেও তিনি শেষ ও জাতির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশন, পরিকল্পনা কমিশন সহ বিভিন্ন গুরুত্ত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়োজিত থেকে জাতীয় জীবনে গুরুত্ত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। [3][8]
স্বাধীনতা যুদ্ধে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে তিনি পরিচিত।[7] সোয়াত জাহাজ হতে অস্ত্র খালাসে বাধা দেবার পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন তথ্য পাচার করছিলেন।[9] ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গুলি বর্ষণে অস্বীকৃতি জানিয়ে এমভি সোয়াত এর মালামাল খালাসের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করলে তাকে ২৪ মার্চ তার পদ থেকে অব্যাহতি দেন জেনারেল খাদিম। তাকে এই বলে অব্যাহতি দেয়া হয়ে যে তার এখন জয়দেবপুরে গিয়ে ২ ইবিআর এর কাছে রিপোর্ট করতে হবে, তার বদলে ব্রিগেডিয়ার এম এইচ আনসারি চট্টগ্রাম এলাকার দায়িত্ব পান।[10]
চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের (ইবিআরসি) কমান্ড্যান্ট ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন এবং সেটা অনুমোদনের জন্য কর্নেল ওসমানীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে পাঠান। তিনি ২৫ মার্চ পর্যন্ত তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন না পাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। [11] ২৭ মার্চ তাকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো নয় মাস পাকিস্তানি সেনারা তাকে দফায় দফায় পৈশাচিক নির্যাতন করে।[2] পরবর্তীতে তার কর্মকান্ড ফাঁস হয়ে গেলে ২৬ মার্চ তারিখে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।[3] তিনি ১৯৭৩ সালে সেখানকার কনসেনট্রেশন ক্যাম্প মুক্তি পেয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।[2][7] তিনি ১৯৪৯ সালের ৩০ জুলাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কমিশন পান, স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের ১ জানুয়ারি চাকরি থেকে অকালীন অবসরে যান।[4][8]
রাজনৈতিক জীবন
সেনাবাহিনীর চাকুরী হতে অবসর গ্রহণের পর তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে দুই মেয়াদে (১৯৮৬ ও ১৯৮৮) সিলেট-৫ আসন (কানাইঘাট - ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জকিগঞ্জ আসন) হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।[1][2][3]
ব্যক্তিগত জীবন
স্ত্রী সাদাত সুলতানা মজুমদারের সাথে ১৯৫২ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ছেলেরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তার তৃতীয় ছেলে হাসান মজুমদার কর্মজীবনে বিভিন্ন এনজিও’র সাথে জড়িত থেকে জনসেবা করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সাথে কাজ করছেন। মৃত্যুকালে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ছাড়াও অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে যান। সিলেট-৫ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার তার ভাইয়ের ছেলে।
মৃত্যু
তিনি ২০১১ সালে ১৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮৯ বছর। [1][2]
তথ্যসূত্র
- "বঙ্গবন্ধুর অনুমতি ছাড়া কিছু করা ঠিক হবে না"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৬-২০।
- "একটি টপ সিক্রেট চিঠি পেলাম"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৬-২০।
- ব্রিগেডিয়ার মজুমদার - মো. মাহমুদুর রহমান। দৈনিক সিলেটের ডাক; ১৯ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে প্রকাশিত
- "তাঁর অবদান ভোলার নয়"। www.prothom-alo.com। ২০১২-০১-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৬-২০।
- "৩য় জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ-সদস্যদের নামের তালিকা" (PDF)। জাতীয় সংসদ। বাংলাদেশ সরকার। ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা।
- "৪র্থ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মাননীয় সংসদ-সদস্যদের নামের তালিকা"। জাতীয় সংসদ। বাংলাদেশ সরকার। ৯ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ আগস্ট ২০১৯।
- মৃর্তুবার্ষিকী - প্রথম আলো
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – হোসনে আরা শাহেদ সম্পাদিত।
- শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ - প্রথম আলো
- Salik, Siddiq, Witness To Surrender, p69
- "১৯৮১ সালের মে মাসের বিদ্রোহ এবং শহীদ জিয়া"। Daily Nayadiganta। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৬-২০।