পরশুরাম (শহর)


পরশুরাম বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত ফেনী জেলায় অবস্থিত একটি শহর। এই শহরটি পরশুরাম উপজেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং প্রধান শহর।

পরশুরাম
পৌরশহর
পরশুরাম
বাংলাদেশে পরশুরাম শহরের অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ২৩.২১৩৫১৮° উত্তর ৯১.৪৪৪৬৯৩° পূর্ব / 23.213518; 91.444693
দেশ বাংলাদেশ
বিভাগচট্টগ্রাম বিভাগ
জেলাফেনী জেলা
উপজেলাপরশুরাম উপজেলা
পৌরসভা স্থাপিত২২শে এপ্রিল ২০০১
সরকার
  ধরনপৌরসভা
  শাসকপরশুরাম পৌরসভা
  পৌর মেয়রনিজাম উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী [1]
আয়তন
  মোট২২.৪ কিমি (৮.৬ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা (২০১১)
  মোট২৯,৬৯১[2]
সময় অঞ্চলবিএসটি (ইউটিসি+৬)
কলিং কোড+৮৮০

নামকরণ

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় পরশুরাম খন্ডল নামে এক বৃহৎ অঞ্চলের ছোট্ট একটি স্থান ছিল। খন্ডল বিভিন্ন সময়ে ত্রিপুরা, বাংলা সালতানাত, মুঘল সাম্রাজ্য ইত্যাদির অধীনে ছিল। সময়ের বিবর্তনে খন্ডলের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বহুবার হাত বদল হলেও এর নাম অপরিবর্তিতই থাকে। এ অঞ্চলের স্বাধীন দেশপ্রেমিক বীর রাজা শমশের গাজীর সময়েও (১৭৪৮-১৭৬০) খন্ডল পরগণা হিসেবেই ইতিহাসে তথ্য মিললেও তার আমলেই এ ছোট জায়গাটির নাম মূলত পরশুরাম বাজার হিসেবে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। মূলত পরশুরাম বাজার নামক একটি বাজারকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে ক্রমাগত উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে এ শহরের উৎপত্তি। পরশুরামের নামকরণ নিয়ে প্রচুর মতানৈক্য থাকলেও সম্প্রতি বহু পুরনো দলিলাদি প্রাপ্তির মাধ্যমে এ মতানৈক্যের অবসান ঘটেছে। যেমন পরশুরাম নামে এ অঞ্চলে দুজন ব্যাক্তি ছিলেন। পরশুরাম উপজেলার দক্ষিণ কোলাপাড়া গ্রামে পরশুরাম সাহা নামে জনৈক ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। অনেকের মতে, তার নামেই পরশুরাম বাজারের নামকরণ করা হয়। কিন্তু পরশুরাম বাজারের পত্তন ও নামকরণ হয়েছে অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং এই সময়ে কোলাপাড়ায় পরশুরাম সাহা নামে কোন ব্যক্তি ছিলেন বলে জানা যায়নি। পরশুরাম বাজারের নামকরণের পেছনে প্রাপ্ত একমাত্র প্রমাণিত মতটি হল, উপজেলার বাউর পাথর নামক গ্রামে পরশুরাম চৌধুরী নামে এক বিত্তবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বীর রাজা শমসের গাজীর সমসাময়িক ছিলেন। তার বর্তমান বংশধরদের মতে তিনি ছিলেন তান্ত্রিক। তার নামেই পরশুরাম বাজারের নামকরণ হয়। ত্রিপুরা রাজা কর্তৃক পরশুরাম চৌধুরীকে জমি বন্দোবস্ত প্রদানের দলিল উদ্ধার হয়েছে।[3]

ইতিহাস

পরশুরাম ঐতিহাসিকভাবে ফেনী-নোয়াখালী-কুমিল্লা এর সমন্বয়ে গঠিত খন্ডল নামক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফেনী জেলার উত্তর প্রান্তে তিনদিকে ভারতের পাহাড়ী উচ্চভূমি বেষ্টিত পরশুরাম উপজেলা। ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চল এক সময় সমুদ্রবক্ষে নিমজ্জিত ছিল। ভূ-বিশেষজ্ঞ সুরেশ চন্দ্র দত্তের মতে, এ অঞ্চল প্রায় ৬০০০ বছর আগে সমুদ্রবক্ষ হতে জেগে ওঠে। তার এ মত অত্রাঞ্চলের সমতল অংশের জন্য মান্য হলেও পার্বত্য ত্রিপুরার কোলে অবস্থিত হওয়ায় পরশুরামের ভূভাগ আরো প্রাচীন হওয়াই স্বাভাবিক। ভূমি গঠনের মতো পরশুরামের জনবসতিও ফেনীর দক্ষিণাঞ্চলের আগে শুরু হয়েছে। বেদ, পুরান ও মহাভারতের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করলে কমপক্ষে ৫৫০০ বছর আগে এ অঞ্চলে জনবসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে পরশুরাম অঞ্চল ত্রিপুরার সাথে যুক্ত ছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদগুলোর নামকরণের প্রাচীনত্ব নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য এখন আর পাওয়া না গেলেও পরগনা হিসেবে পরশুরামের এ যাবত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন নামটি হচ্ছে ‘‘খন্ডল।’’ ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় এর মালিকানা অনেকবার পরিবর্তনের প্রমাণ পাওয়া যায়। গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের শাসনকালে খন্ডলকে তার সালতানাতের অংশ হিসেবে জানা যায়। খন্ডল দখলে বারবার ব্যর্থ হয়ে ত্রিপুরা রাজা ধন্যমাণিক্য খন্ডলের বারজন বশিককে (স্থানীয় শাসনকর্তা) নিমন্ত্রণ করে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর নিয়ে যান। সেখানে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আহার গ্রহণের মুহূর্তে বারজন বশিককে ত্রিপুরার সৈন্যরা হত্যা করে। পরবর্তীতে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সেনাপতি হামজা খাঁ পুনরায় খন্ডল দখল করেন। এ সময় ত্রিপুরা রাজা হামজা খাঁকে আক্রমণ করার জন্য দক্ষিণে সৈন্য প্রেরণ করলে হামজা খাঁ সৈন্যবাহিনী নিয়ে বর্তমান পরশুরাম বাজারের উত্তর পাশে বিশাল খন্দক (পরিখা) খনন করে ত্রিপুরা বাহিনীকে প্রতিহত করেছিলেন। ওই খন্দক বেষ্টিত জনপদটি এখনও খন্দকিয়া নামে পরিচিত। পরবর্তীতে পরিখার সাথে কহুয়া নদীকে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বাংলার নবাব সুজাউদ্দিনের সময় খন্ডলকে আবার বাংলার করদ অঞ্চলরূপে পাওয়া যায়। সুজাউদ্দিনের সময়ে বৃহত্তর কুমিল্লা, খন্ডল ও দক্ষিণশিক (বর্তমানে ছাগলনাইয়া উপজেলা) অঞ্চলের নাম ছিল চাকলা রৌশনাবাদ। রৌশনাবাদ-ত্রিপুরার দেশপ্রেমিক, প্রজাদরদী রাজা, ভাটির বাঘ খ্যাত বাংলার বীর শমসের গাজীর সময়ে (১৭৪২-৬০) খন্ডল তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সময় খন্ডলের জমিদার ছিলেন কালু সিং। তিনি বিভিন্ন সমরাভিযানে শমশের গাজীকে সহায়তা করতেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। দখলদার ইংরেজদের অসময় অথচ বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে বীর কেশরী শমশের গাজীর পতনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারেরা এ অঞ্চলের শাসন কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন র‌্যালফ লীক উল্লেখযোগ্য। এ অঞ্চলের দরিদ্র কৃষক-প্রজাদের উপর নির্যাতনকারী হিসেবে তার খ্যাতি থাকলেও ছাগলনাইয়া থেকে খন্ডল তথা পরশুরাম হয়ে চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে তিনি আজো স্মরণীয় হয়ে আছেন। এ সড়কটি ক্যাপ্টেন লীক রোড নামে পরিচিত ছিল।[4] ইংরেজ অফিসার ক্যাপ্টেন লীক অত্র এলাকার প্রশাসক নিযুক্ত হওয়ার পর ১৭৮০ সালের দিকে পরশুরাম বাজারের পাশে একটি পুলিশ চৌকি স্থাপন করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। সুতরাং তখন অত্র এলাকা খন্ডল পরগানা হিসেবে অভিহিত হলেও পরশুরাম বাজারের অস্তিত্ব প্রথম জানা যায়। ক্রমান্বয়ে এই পুলিশ চৌকি ১৮৮০ সালে পূর্ণাঙ্গ থানায় রূপান্তরিত হয়। যোগাযোগ সুবিধার কারণে এটি ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে এ ফলশ্রুতিতে এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে এটি প্রশাসনিক থানা ও ১৯৮৫ সালে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়।[5] সম্প্রতি এ অঞ্চলের শহর এলাকার পূর্ণাঙ্গ নাগরিক সেবা ও পরিকল্পিত নগরায়নের উদ্দেশ্যে ২০০১ সালে পরশুরাম পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হলে পরশুরাম আনুষ্ঠানিকভাবে পৌরশহরের মর্যাদা লাভ করে।

ভূগোল

পরশুরাম ফেনী জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কি.মি. উত্তরে ৩২.২২ হতে ৯১.৪৪ উত্তর অক্ষাংশে এবং ২৩.৩৬ হতে ৯১.৭৩ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।[6]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. "পরশুরাম শহরের পৌরসভার মেয়র"। News24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৩
  2. "পরশুরাম শহরের জনসংখ্যা ও আয়তন"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১২
  3. "পরশুরাম নামের ইতিকথা"। দৈনিক ইত্তেফাক। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-২১
  4. "প্রাচীন জনপদ পরশুরাম"। দৈনিক সংগ্রাম। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-২১
  5. "পরশুরাম নামের ইতিকথা"। দৈনিক সংগ্রাম। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-২১
  6. "23.21138, 91.46864 Latitude longitude Map"www.latlong.net। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-২১
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.