দেবদাস

দেবদাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত একটি প্রণয়ধর্মী বাংলা উপন্যাসদেবদাস শরৎচন্দ্রের প্রথমদিককার উপন্যাস। রচনার সমাপ্তিকাল সেপ্টেম্বর ১৯০০,[1] কিন্তু প্রকাশনার বছর ১৯১৭। উপন্যাসটি নিয়ে শরৎচন্দ্রের দ্বিধা ছিল বলে দীর্ঘ ১৭ বছর প্রকাশ করা থেকে বিরত ছিলেন। উপন্যাসটি তিনি রচনা করেছিলেন মাতাল হয়ে এবং বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে ১৯১৩-তে লেখা এক চিঠিতে শরৎচন্দ্র লিখেছেন, 'ওই বইটা [দেবদাস] একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা।'[2] ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান প্রধান ভাষায় উপন্যাসটি অনূদিত হয়েছে। পারুর জন্য দেবদাসের বিরহ উপজীব্য করে রচিত এই উপন্যাস অবলম্বনে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। দেবদাস বিরহকাতর চিরায়ত প্রেমিকের ধ্রুপদি নিদর্শন হিসেবে গণ্য।

দেবদাস
দেবদাস উপন্যাস - বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ
লেখকশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ভাষাবাংলা
ধরনউপন্যাস
প্রকাশকজিসিএস
প্রকাশনার তারিখ
৩০ জুন, ১৯১৭

কাহিনীর সংক্ষিপ্তসার

উপন্যাসে দেবদাস (সম্পুর্ন নাম দেবদাস মুখার্জি) বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৎকালীন ব্রাহ্মন জমিদার বংশের সন্তান, পার্বতী(পারো) এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে৷ বাংলার তালসোনাপুর গ্ৰামে এই দুই পরিবারের পাশাপাশি বাস। ছোটবেলা থেকেই দেবদাস ও পার্বতীর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব যা পরবর্তীতে প্রেমের রূপ নেয়। দেবদাস বয়সে পার্বতীর চেয়ে কিছু বড়ো। দেবদাস ও পার্বতী একে অপরকে 'পারো' ও 'দেবদা' বলে ডাকে। বিদ্যালয়ে পড়াশোনা থেকে পুকুরে মাছ ধরা পর্যন্ত প্রত্যেকটি কাজ‌ই তারা এক সঙ্গে করত৷ পার্বতী কিছু ভুল করলে দেবদাস তাকে মারতো, তবুও এদের সম্পর্ক বন্ধুর মতই ছিল৷

ঘটনা পরম্পরায় দেবদাসকে কলকাতা শহরে পাঠানো হয় পড়াশোনা করার জন্য। কয়েক বছর পর ছুটির সময় সে তার গ্ৰামে ফিরে আসে। কৈশোরে উত্তীর্ণ দুজন হঠাৎই অনুভব করে, তাদের বাল্যকালের বন্ধুত্ত্ব আর‌ও গভীর কিছুতে উত্তীর্ণ হয়েছে। দেবদাস দেখে যে তার ছোটবেলার পারো বদলে গেছে। পার্বতী তাদের কৈশোরের প্রেম বিবাহবন্ধনে পরিস্ফুটনের কথা ভাবে। প্রচলিত সামাজিক রীতি অনুযায়ী, পার্বতীর বাবা-মাকে দেবদাসের বাবা-মায়ের কাছে তাদের বিবাহের প্রস্তাব আনতে হবে।

পার্বতীর মা দেবদাসের মা হরিমতির কাছে বিয়ের প্রস্তাব আনলে তিনি আনন্দিত হলেও পাশের বাড়ির সাথে এই সম্পর্ক রাখতে তিনি বিশেষ উৎসাহী হননা। তাছাড়া পার্বতীর পরিবারে দির্ঘকাল থেকে বরের পরিবার থেকে 'পণ' গ্ৰহনের প্রথা চলে আসছে। দেবদাসের মা তাই পার্বতীর পরিবারকে "বেচা-কেনা ছোটঘর" মনে করে এই সম্পর্কে অসম্মত হন। দেবদাসের বাবা, নারায়ণ মুখার্জিও এই যুক্তি সমর্থন করেন। এতে পার্বতীর পিতা নীলকন্ঠ চক্রবর্তী অপমানিত বোধ করেন ও পার্বতীর জন্য আরও ধনী গৃহে বিয়ে ঠিক করেন।

পার্বতী একথা জানলে দেবদাস অন্তত তাকে গ্ৰহন করবে এই আশায় রাতের অন্ধকারে তার সাথে দেখা করে। দেবদাস মনস্থির করে তার বাবাকে বললে, তিনি অরাজি হন।

বিভ্রান্ত অবস্থায়, দেবদাস বাড়ি থেকে কলকাতায় পালিয়ে যায়। সে চিঠি লিখে পার্বতীকে জানায় যে সে এই সম্পর্ক আর রাখতে চায় না।

পার্বতী বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয়। এরপর দেবদাস বললেও আর সে ফিরে যেতে চায় না ও কাপুরুষতার জন্য তাকে ধিক্কার জানায়। তবুও, সে দেবদাসকে বলে যে তার মৃত্যুর আগে যেন সে দেবদাসকে অন্তত একবার দেখতে পায়। দেবদাস এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

দেবদাস কলকাতায় ফিরে যায় ও পার্বতীর হাতিপোতা গ্ৰামে ভুবন চৌধুরী নামে এক জমিদারের সাথে বিয়ে হয়। ভুবন চৌধুরীর পূর্বের স্ত্রী মারা গেছেন ও তার তিনজন সন্তান রয়েছে, যারা পার্বতীর প্রায় সমবয়সী বা তার চেয়ে বড়ো।

কলকাতায় গিয়ে দেবদাসের চুনীলালের সাথে বন্ধুত্ব হয় ও তার মাধ্যমে সে চন্দ্রমুখী নামে এক বাঈজীর সাথে পরিচিত হয়। সে দেবদাসের প্রেমে পড়ে, যদিও দেবদাস তাকে ঘৃণা করতে থাকে। হতাশাগ্ৰস্ত দেবদাস অত্যাধিক মদ্যপান শুরু করলে তার শরীর ক্রমশ ভে‌‌ঙে পড়ে। চন্দ্রমুখী তার দেখভাল করতে থাকে। দেবদাস তার মনে প্রতিনিয়ত পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর তুলনা করতে থাকে ও চন্দ্রমুখীকে সে পারোর কথা বলে। দুঃখ ভুলতে দেবদাস ক্রমশ মদ্যপানের মাত্রা বাড়াতে থাকে ও তাতে তার স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটে। চন্দ্রমুখী বুঝতে পারে যে দেবদাসের ভিতরের আসল মানুষটির আজ পতন ঘটেছে। লক্ষ্যশূন্য দেবদাস শেষপর্যন্ত চন্দ্রমুখীর প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়।

শীঘ্র আসন্ন মৃত্যুর কথা অনুভব করতে পেরে দেবদাস, পারোকে দেওয়া তার পূর্বের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে হাতিপোতা গ্ৰামে পার্বতীর কাছে র‌ওনা হয়। পার্বতীর বাড়ির সামনে পৌঁছে, এক অন্ধকার শীতের রাতে দেবদাসের মৃত্যু হয়। দেবদাসের মৃত্যুর খবর শুনে পার্বতী সেখানে ছুটে যায়, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই, বাড়ির লোকজন তাকে বাড়ির চৌকাঠ অতিক্রম করতে দেয়না।

শরৎচন্দ্র তার অন্যান্য অনেক উপন্যাসগুলির মতো এটিতেও তৎকালীন বঙ্গসমাজের নিষ্ঠুরতার চিত্র কঠোরভাবে তুলে ধরেছেন, যে সমাজব্যবস্থা এক সত্যিকারের প্রেমের শুভ পরিনতির এক বৃহৎ বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

চলচ্চিত্র, টিভি, ও নাট্য রূপায়ণ

দেবদাস-এর প্রথম চলচ্চিত্ররূপ ১৯২৮ সালে। এটি ছিলো নির্বাক ছবি। এরপর ১৯৩৫ ও ৩৬ সালে আবার নির্মিত হয়। এ দুটি সবাক। প্রথমটি বাংলায়, দ্বিতীয়টি হিন্দিতে। ১৯৫৫, ২০০২ ও ২০০৯ সালে আবার হিন্দিতে সিনেমা নির্মিত হয়। এ ছাড়া তামিল, তেলেগু, উর্দু, মালয়ালমঅসমীয়া ভাষাতেও নির্মিত হয়েছে।[3][4][5] ভারতে অ-মহাকাব্যিক কাহিনী হিসেবে এটিই সবচেয়ে বেশিবার চিত্রায়িত কাহিনী।

  • দেবদাস উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র সংস্করণ এর নিম্মে অন্তর্ভুক্ত করা হলো:
বছরশিরোনামভাষাপরিচালকভূমিকানোট
দেবদাসপার্বতীচন্দ্রমুখী
১৯২৭দেবদাসনির্বাক চলচ্চিত্রনরেশ মিত্রফণী শর্মাতারকবালানিহারবালা/মিস পারুল
১৯৩৫দেবদাসবাংলাপ্রমথেশ বড়ুয়াপ্রমথেশ বড়ুয়াযমুনাচন্দ্রাবতী দেবী
১৯৩৬দেবদাসহিন্দিপ্রমথেশ বড়ুয়াকুন্দন লাল সায়গলযমুনারাজকুমারী দুবে
১৯৩৭দেবদাসঅসমীয়াপ্রমথেশ বড়ুয়াফণী শর্মাজুবেইদা বেগম ধনরাজগিরমোহিনী
১৯৫৩দেবদাসুতামিলতেলুগুবেদান্তম রাঘবৈয়াহঅক্কিনেনী নাগেশ্বর রাওসাবিত্রীললিথা"দেবদাসু" নামেও এটি পরিচিত
১৯৫৫দেবদাসহিন্দিবিমল রায়দিলীপ কুমারসুচিত্রা সেনবৈজয়ন্তীমালা
১৯৬৫দেবদাসউর্দুখাজা সরফরাজহাবিব তালিশশামিম আরানাইয়ার সুলতানাপাকিস্তানি চলচ্চিত্র
১৯৭৪দেবদাসুতেলুগুবিজয়া নির্মলাঘত্তমনেনী কৃষ্ণবিজয়া নির্মলাজয়ন্তী
১৯৭৯দেবদাসবাংলাদিলীপ রায়সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়সুপ্রিয়া চৌধুরী
১৯৮২দেবদাসবাংলাচাষী নজরুল ইসলামবুলবুল আহমেদকবরী সারোয়ারআনোয়ারাবাংলাদেশী চলচ্চিত্র
১৯৮৯দেবদাসমালয়ালমক্রসবেল্ট মণিবেণু নাগবল্লীপার্বতীরম্য কৃষ্ণা
২০০২দেবদাসবাংলাশক্তি সামন্তপ্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়অর্পিতা পালইন্দ্রানী হালদার
২০০২দেবদাসহিন্দিসঞ্জয় লীলা বনসালিশাহরুখ খানঐশ্বর্যা রাইমাধুরী দীক্ষিত
২০০৯দেব.ডিহিন্দিঅনুরাগ কাশ্যপঅভয় দেওলমাহী গিলকল্কি কয়েচলীনদেবদাসের আধুনিক চিত্রায়ন
২০১০দেবদাসউর্দুইকবাল কাশ্মীরিনাদীম শাহজারা শেখমীরাপাকিস্তানি চলচ্চিত্র
২০১৩দেবদাসবাংলাচাষী নজরুল ইসলামশাকিব খানঅপু বিশ্বাসমৌসুমীবাংলাদেশী চলচ্চিত্র
২০১৭দেবিবাংলারিক বসুপাওলি দামশুভ মুখার্জিশাতাফ ফিগারআধুনিক রূপায়ণ
২০১৭দেব ডিডিহিন্দিকেন ঘোষঅসীমা ভার‌্ডানঅখিল কাপুরসঞ্জয় সুরিওয়েব সিরিজ
আধুনিক রূপায়ণ
২০১৮দাস দেবহিন্দিসুধীর মিশ্ররাহুল ভাটরিচা চাদ্দাঅদিতি রাও হায়দারিআধুনিক রূপায়ণ

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. সেন, সুকুমার (১৩৫৩ বঙ্গাব্দ)। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস৩য় খণ্ড। কলিকাতা: মডার্ণ বুক এজেন্সি। পৃষ্ঠা ৫৫২।
  2. "শতবর্ষে দেবদাস"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১২-২৩
  3. Sharma, Sanjukta (জুন ৭, ২০০৮)। "Multiple Takes: Devdas's journey in Indian cinema -- from the silent era of the 1920s to the opulent Hindi blockbuster of 2002"। Livemint। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০২-২২
  4. "The Hindu : The immortal lover"। ৯ আগস্ট ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
  5. "Devdas phenomenon"। ১৩ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.