চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠন

চাঁদের গড় ঘনত্ব ৩৩৪৬.৪ কিলোগ্রাম প্রতি ঘন মিটার হওয়ায়[1] এটি একটি পৃথক ধরনের মহাজাগতিক বস্তু। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে চাঁদের উৎপত্তির কিছুকাল পরেই ম্যাগমা মহাসাগরের যে আংশিক কেলাসন ঘটেছিল, তার ফলে ভূরাসায়নিকভাবে পৃথক এক ধরনের ভূত্বক, গুরুমণ্ডলগ্রহীয় কেন্দ্রস্থল নিয়ে এই উপগ্রহটি গঠিত হয়। চাঁদের বহিরাংশটির গলনের জন্য যে শক্তির প্রয়োজন হয়েছিল, তার উৎস সাধারণভাবে মনে করা হয় একটি মহাসংঘাতের ঘটনা। এই ঘটনাটিকে চান্দ্র-পার্থিব জগতের স্রষ্টা এবং তার পরবর্তীকালে পৃথিবীর কক্ষপথে পদার্থের পুনঃসংযোজনের কারণ বলেও মনে করা হয়। এই ম্যাগমা মহাসাগরের কেলাসন চাঁদে ম্যাফিক গুরুমণ্ডল ও একটি প্ল্যাজিওক্ল্যাস-সমৃদ্ধ ভূত্বকের জন্ম দিয়ে থাকবে।

চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠন
অলিভাইন ব্যাসাল্ট, অ্যাপোলো ১৫ কর্তৃক সংগৃহীত।

কক্ষপথ থেকে গৃহীত চিত্র অনুযায়ী অঙ্কিত ভূরাসায়নিক মানচিত্র ইঙ্গিত করে চাঁদের ভূত্বক প্রধানত অ্যানর্থোসাইটিক উপাদানে গঠিত।[2] এটি ম্যাগমা মহাসাগর উপপ্রমেয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ভূত্বকের প্রধান মৌলগুলি হল অক্সিজেন, সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম, লোহা, ক্যালসিয়ামঅ্যালুমিনিয়াম। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অপ্রধান ও ক্ষুদ্র উপাদানগুলির মধ্যে টাইটানিয়াম, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, পটাসিয়ামহাইড্রোজেনও পাওয়া যায়। ভূপদার্থবিজ্ঞানের পদ্ধতি অবলম্বনে এই ভূত্বকটিকে গড়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পুরু বলে অনুমান করা হয়।[3]

চাঁদের ভূত্বকের আংশিক গলনের ফলে চন্দ্রপৃষ্ঠে মেয়ার ব্যাসাল্টের উদ্‌গীরণ ঘটেছে। এই ব্যাসাল্টের বিশ্লেষণের ফল ইঙ্গিত করে যে, চাঁদের ভূত্বক প্রধানত খনিজ অলিভাইন, অর্থোপাইরক্সিনক্লাইনোপাইরোক্সিন দ্বারা গঠিত এবং চান্দ্র ভূত্বক পৃথিবীর ভূত্বকের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে লৌহসমৃদ্ধ। কোনও কোনও চান্দ্র ব্যাসাল্টে টাইটানিয়াম (খনিজ ইলমেনাইটে উপস্থিত) প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এটি ইঙ্গিত করে যে, এই ভূত্বকের উপাদানগুলি অত্যন্ত অসমসত্ত্ব। চন্দ্রপৃষ্ঠের থেকে ১০০০ কিলোমিটার ভূত্বকের গভীরে চন্দ্রকম্পের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা মাসিক পর্যায়বৃত্তে ঘটে এবং এগুলির সঙ্গে পৃথিবীর চারিদিকে চাঁদের উৎকেন্দ্রিক কক্ষপথ কর্তৃক সৃষ্ট জোয়ারগত চাপের যোগসূত্র বর্তমান। এমন অল্প কয়েকটি অগভীর চন্দ্রকম্প শনাক্ত করা গিয়েছে যেগুলির অবকেন্দ্র চন্দ্রপৃষ্ঠের ১০০ কিলোমিটার গভীরে অবস্থিত। কিন্তু এই ধরনের চন্দ্রকম্প খুব ঘন ঘন ঘটে না এবং এগুলির সঙ্গে চান্দ্র জোয়ারের কোনও সম্পর্ক আছে বলেও মনে হয় না।[3]

কেন্দ্রস্থল

চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠনের ছকবদ্ধ চিত্র

বিভিন্ন প্রমাণ অনুসন্ধান করে এই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে যে, চাঁদের কেন্দ্রস্থলটি ছোটো। এটির ব্যাসার্ধ ৩৫০ কিলোমিটার অথবা তারও কম।[3] অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুগুলির বেশিরভাগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বস্তুটির কেন্দ্রস্থলের আকার বস্তুর আকারের প্রায় ৫০%। কিন্তু চাঁদের কেন্দ্রস্থলের আকার চাঁদের মোট আকারের প্রায় ২০% মাত্র। চাঁদের কেন্দ্রস্থলের উপাদানগুলি সুসংবদ্ধ নয়। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মতে এটি গঠিত হয়েছে ধাতব লৌহ সংকর এবং অল্প পরিমাণ সালফার ও নিকেল দ্বারা। চাঁদের সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল আবর্তন ইঙ্গিত করে যে, চাঁদের কেন্দ্রস্থল অংশত গলিত।[4]

২০১০ সালে আধুনিক প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি অবলম্বনে পুরনো অ্যাপোলো গভীর চন্দ্রকম্প-বিষয়ক তথ্য-পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে, চাঁদের কেন্দ্রস্থলটি ৩৩০ ± ২০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ-বিশিষ্ট এবং লৌহসমৃদ্ধ। একই বিশ্লেষণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে শুদ্ধ লৌহগঠিত কঠিন অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রস্থলটির ব্যাসার্ধ ২৪০ ± ১০ কিলোমিটার। এই কেন্দ্রস্থলটি ঘিরে রয়েছে আংশিকভাবে (১০ থেকে ৩০%) গলিত নিম্নবর্তী ভূত্বকের স্তর। এই অংশের ব্যাসার্ধ ৪৮০ ± ২০ কিলোমিটার (গভীরতা ~১৫০ কিলোমিটার)। এই ফলাফল ইঙ্গিত করে যে কেন্দ্রস্থলের ৪০% ঘনত্বের দিক থেকে কঠিনীভূত। কেন্দ্রস্থলের তরল বহিরাংশের ঘনত্ব প্রায় ৫ গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার এবং ওজনের দিক থেকে এটি ৬% মতো সালফার দ্বারা গঠিত। কেন্দ্রভাগের তাপমাত্রা সম্ভবত প্রায় ১৬০০-১৭০০ কেলভিন।[5]

চাঁদ – ওশেনাস প্রোসেলারাম (ঝঞ্ঝা মহাসাগর)
প্রাচীন গ্রস্থ উপত্যকা – আয়তাকার গঠন (দৃশ্য – ভূসংস্থান – গ্রেইল অভিকর্ষ অবক্রম) (১ অক্টোবর, ২০১৪)।
প্রাচীন গ্রস্থ উপত্যকা – বিবরণ।
প্রাচীন গ্রস্থ উপত্যকা – নিকট-দৃশ্য (শিল্পীর কল্পনায়)

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. আইয়োর পরে সৌরজগতের দ্বিতীয় সর্বাধিক ঘনত্বযুক্ত প্রাকৃতিক উপগ্রহ হল চাঁদ।
  2. P. Lucey and 12 coauthors, P. (২০০৬)। "Understanding the lunar surface and space-Moon interactions"। Reviews in Mineralogy and Geochemistry60: 83–219। doi:10.2138/rmg.2006.60.2বিবকোড:2006RvMG...60...83L
  3. Mark Wieczorek and 15 coauthors, M. A. (২০০৬)। "The constitution and structure of the lunar interior" (PDF)Reviews in Mineralogy and Geochemistry60: 221–364। doi:10.2138/rmg.2006.60.3বিবকোড:2006RvMG...60..221W। ২০১৪-১২-২১ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা।
  4. J. G. Williams; S. G. Turyshev; D. H. Boggs; J. T. Ratcliff (২০০৬)। "Lunar laser ranging science: Gravitational physics and lunar interior and geodesy"। Advances in Space Research37 (1): 67–71। arXiv:gr-qc/0412049doi:10.1016/j.asr.2005.05.013বিবকোড:2006AdSpR..37...67W
  5. Weber, R. C.; Lin, P.-Y.; Garnero, E. J.; Williams, Q.; Lognonne, P. (২০১১)। "Seismic Detection of the Lunar Core"। Science331 (6015): 309–312। doi:10.1126/science.1199375। PMID 21212323বিবকোড:2011Sci...331..309W

বহিঃসংযোগ

টেমপ্লেট:গ্রহীয় ভূতত্ত্ব টেমপ্লেট:ভূতত্ত্ব

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.