কৌলীন্য প্রথা
কৌলীন্য বা কুলীন শব্দটি এসেছে কনৌজ বা কন্নৌজ (হিন্দি: कन्नौज, উর্দু: قنوج; পূর্বতন ইংরেজি বানান: Kannauj) হতে। কনৌজ বা কন্নৌজ হল ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের কনৌজ জেলার একটি মহানগর, প্রশাসনিক প্রধান কার্যালয় ও একটি নগর পালিকা পরিষদ। এই শহরের নামটি ধ্রুপদি সংস্কৃত নাম কান্যকুব্জ (কুব্জা রমণীগণের নগরী) নামটির আধুনিক রূপ।[1] মিহির ভোজের রাজত্বকালে এই শহরটি মহোদয় নামেও পরিচিত ছিল। কনৌজ একটি প্রাচীন শহর। ইতিহাসবিদদের মতে এই কৌলীন্য প্রথা হর্ষবর্ধনের সময়কাল হতে শুরু হয়েছে। কনৌজকে কেন্দ্র করে তিনটি সাম্রাজ্যের স্থাপনা হয়েছিলো। রাজ্যসীমার দক্ষিণ দিকে ছিল রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য, পূর্ব দিকে ছিল পাল সাম্রাজ্য এবং গুর্জর-প্রতিহার শাসক বৎসরাজার হাতে।[2] পাল সম্রাট ধর্মপাল সর্বপ্রথম বাংলায় কৌলীন্য প্রথা প্রচলন করেছিলেন ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তবে তা সর্বজনস্বীকৃত নয়।
কুলীন ও পরামানিক উপাধি প্রাপ্তি
রাঢ় ও বরেন্দ্র এর ব্রাহ্মণদের মধ্যে কৌলীন্য প্রথা অধিক মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারা সম্ভবত কান্যকুব্জের পাঁচ ব্রাহ্মণ-রক্ষিতীশ, মেধতিথী, বিতরগ, সুধনিধি এবং সম্ভরি-এর উত্তরসূরি। বলা হয়ে থাকে যে, রাজা আদিশূর-এর নিমন্ত্রণে তাঁরা এখানে আসে। তবে উল্লেখ্য, আদিশূরের ঐতিহাসিকতা তর্কের উর্ধ্বে নয়। গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক এবং বর্মণ রাজা হরিবর্মণ উভয়েই যথাক্রমে শকদ্বীপী ও বৈদিক ব্রাহ্মণ নিয়ে এসেছিলেন বলে জানা যায়। বলা হয়ে থাকে, এ ব্রাহ্মণদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির ফলস্বরূপ বাংলায় সামাজিক প্রথা হিসেবে কৌলিন্য প্রথার সূত্রপাত হয়েছে। কৌলিন্য প্রথায় হিন্দু পদবী ব্যবহার শুরু হয়। এই পদবী সমাজের চার বর্ণ যথা- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র বিভাজনের একটি চিহ্ন বহন করে[3]।
রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণ
চোলরাজা দেবেন্দ্র বর্মনের ছয় শতকের শিলালিপিতে উত্তর রাঢ় সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। রাঢ়ের এ অংশটিকে রাজেন্দ্র চোলের এগারো শতকের তিরুমুলাই শিলালিপিতে সুস্পষ্টরূপে একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভোজবর্মনের বেলাভ তাম্রলিপিতে উত্তর রাঢ়ের সিদ্ধলা গ্রামকে ভট্টভবদেবের জন্মস্থান হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে। সিদ্ধলাকে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বীরভূম জেলার সিদ্ধলা গ্রামের সঙ্গে এবং নৈহাটী লিপিতে উল্লিখিত বল্লহিত্তহ গ্রামকে বর্ধমান জেলার উত্তর প্রান্তের বালুটিয়ার সাথে শনাক্ত করা হয়েছে। শান্ডিল্য গোত্রীয় বন্ধ্যঘাটিগ্রামবাসী, কাশ্যপ গোত্রীয় চট্টগ্রামবাসী, ভরদ্বাজ গোত্রিয় মুখুটিগ্রামী, সাবর্ণী গোত্রীয় গাঙ্গুলি ও কুন্দলাল গ্রামী এবং বাৎস্য গোত্রীয়, ঘোষাল, কাঞ্জিলাল এবং পুতিতুন্ড এই আট গ্রামীরা রাঢ়ীয় কুলীন ব্রাহ্মণ[4]।
বারেন্দ্রীয় কুলীন ব্রাহ্মণ
বরেন্দ্রভূমির নামকরণের পেছনে একাধিক পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। ‘বর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে আশীর্বাদ এবং ‘ইন্দ্র’ শব্দের অর্থ দেবতাদের রাজা। অর্থাৎ ইন্দ্রের বর বা ইন্দ্রের আশীর্বাদ থেকে সাধারণভাবে বরেন্দ্র শব্দটির উৎপত্তি। এই কাহিনীর অনুসারিগণ বিশ্বাস করেন যে, বরেন্দ্রভূমি ইন্দ্রের পক্ষ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ। রামায়ণ ও মহাভারত গ্রন্থদ্বয়ে বরেন্দ্রভূমিকে ‘পুন্ড্র’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। পুন্ড্র অঞ্চলে বসবাসকারী ব্রাহ্মণ লাহিড়ী, সান্যাল, সরখেল, মৈত্র ও ভাদুড়ী পদবী ব্যাবহার করেন[5]।
কায়স্থ কুলীন
বঙ্গরাজ দেবপাল গৌড় নগর থেকে কয়েক ঘর কায়স্থ এনে বঙ্গদেশে স্থাপন করেন। তাদের সঙ্গে তিনি বিবাহ আদান প্রদান করে নিজে তাদের সমাজে মিলিত হন। সেই বঙ্গজ কায়স্থরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে বঙ্গজ ও দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ বলে পরিগণিত হয়।এদেরকে বল্লাল কৌলিন্য মর্যাদা দেন।
তথ্যসূত্র
- Rama Shankar Tripathi (১৯৮৯)। History of Kanauj: To the Moslem Conquest। Motilal Banarsidass Publ। পৃষ্ঠা 2। আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২০৮-০৪০৪-৩, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২০৮-০৪০৪-৩।
- Series-16 Indian History–Medieval India (ইংরেজি ভাষায়)। Upkar Prakashan।
- "কৌলীন্য প্রথা - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২৩।
- "রাঢ় - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২৩।
- "বরেন্দ্রভূমি - বাংলাপিডিয়া"। bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-২৩।