কোণার্ক সূর্য মন্দির
কোণার্ক সূর্য মন্দির (ওড়িয়া: କୋଣାର୍କ ସୂର୍ଯ୍ୟ ମନ୍ଦିର) ১৩শ-শতাব্দীতে নির্মিত ভারতের ওড়িশা রাজ্যের পুরী জেলার কোণার্ক শহরে অবস্থিত। বিশ্বাস করা হয় যে, মন্দিরটি ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের[2] প্রথম নরসিংহদেব এটি নির্মাণ করেছিলেন।[3] মন্দির কমপ্লেক্সটি একটি বিশাল রথের আকৃতিতে (সূক্ষ্ম কারুকার্যময় পাথরের চাকা, স্তম্ভ ও দেওয়াল সহ) তৈরি করা হয়েছে।[4] কাঠামোর একটি প্রধান অংশ এখন ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান[5] এবং ভারতে সাতটি বিস্ময়ের বিভিন্ন তালিকাতেও রয়েছে। মন্দিরটি পু্রী থেকে ৩৫ কিমি এবং ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিমি দূরে অবস্থিত।
![]() | |
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান | |
---|---|
অবস্থান | ভারত ![]() |
আয়তন | |
মানদণ্ড | i, iii, vi[1] |
তথ্যসূত্র | ২৪৬ |
স্থানাঙ্ক | ১৯°৫৩′১৫″ উত্তর ৮৬°০৫′৪১″ পূর্ব |
শিলালিপির ইতিহাস | ১৯৮৪ (৮ম সভা) |
বিপদাপন্ন | – |
ওয়েবসাইট | konark |
konark | |
![]() ![]() কোণার্ক সূর্য মন্দিরের অবস্থান | |
নামের ব্যুৎপত্তি
কোণার্ক নামটি সংস্কৃত কোণ (কোনা বা কোণ) এবং অর্ক (সূর্য) শব্দদুটির সমন্বয়ে গঠিত, যা মন্দিরের উল্লেখিত সৌর দেবতা সূর্যকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।[5] অর্থাৎ সূর্যের বিভিন্ন কোণের অবস্থান। এই মন্দিরটি সূর্যেের বিভিন্ন অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে।
স্মৃতিস্তম্ভটিকে ইউরোপীয় নাবিকরা ব্ল্যাক প্যাগোডা (কালো পাগোডা) নামেও অভিহিত করতো। এর বিপরীতে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরটি হোয়াইট প্যাগোডা (সাদা পাগোডা) নামে পরিচিত ছিল। উভয় মন্দিরই নাবিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হতো।[6] কোণার্ক সূর্য মন্দিরের পরিকাঠামোর জন্য লোহার বিম ব্যবহৃত হয়েছিল।
ইতিহাস
ব্যুৎপত্তি
মন্দির গড়ে ওঠার পেছনে দুটি মত আছে। প্রথমত, পূর্বগঙ্গ রাজবংশের (১০৭৮- ১৪৩৪) নরসিংহদেব (১২৩৮ - ১২৬৪ খ্রিষ্টাব্দ) ১২৩২ - ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বাংলা জয়ের স্মারকরূপে চন্দ্রভাগা নদীর তীরে প্রাচীন মিত্রাবনে অর্থাৎ আজকের কোনারকে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয়ত, পুরাণ মতে শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব রূপে অত্যন্ত নয়নভোলানো ছিলেন। সব মহিলাদের নজর কাড়তেন। শাম্ব একদিন নারদের ডাকে সাড়া দিতে ভুলে গেলে নারদের মনে প্রতিরোধ স্পৃহা জাগে। একদিন কৃষ্ণ যখন গোপিনীদের সঙ্গে লীলায় ব্যস্ত তখন নারদের মন্ত্রনায় শাম্ব সেখানে ঢুকে পড়ে। সেইসময় গোপিনীদের নজর তার ওপর গিয়ে পড়ে। তখন কৃষ্ণ প্রচুর রেগে গিয়ে তাকে অভিশাপ দানের প্রয়োজনে শাস্তি দেন যে তার রূপ হারিয়ে যাবে। তখন মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে সে কোনারকে সমুদ্রের তীরে এসে সূর্যদেবকে কঠোর তপস্যায় মুগ্ধ করে নিজের হারানো রূপ ফিরে পেয়ে সমুদ্রতীরে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
ধ্বংস
মন্দিরে সূর্যদেবতার যে বিশাল বিগ্রহ ছিল তা এখন নেই। কালের করাল গ্রাসে স্থাপনার অনেকটাই আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। এর কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, বাংলার সুলতান সুলায়মান খান করনানির সেনাপতি কালাপাহাড়ের আক্রমণে কোনার্ক মন্দির প্রথম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। উড়িষ্যার ইতিহাস অনুযায়ী কালাপাহাড় ১৫০৮ সালে কোনার্ক আক্রমণ করে। দ্বিতীয়ত, নরসিংহদেব মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে বহিস্কৃত হয়। তাই তিনি নিজে মন্দির ধ্বংস করেন। তৃতীয়ত, ১৬২৬ সালে খুরদার তত্কালীন রাজা পুরুষোত্তমদেবের পুত্র নরশিমাদেব সূর্যদেবের বিগ্রহটি পুরীর জগন্নাথের মন্দিরে নিয়ে যান। সেখানে একটি পৃথক মন্দিরে সূর্য ও চন্দ্রদেবতার বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। শুধু বিগ্রহই নয় তিনি কোনার্ক মন্দির থেকে কারুকার্য করা অনেক পাথর পুরীর মন্দিরে নিয়ে যান। এমনকি নবগ্রহ পথ নামে একটি বিশাল প্রস্তর খন্ডও তিনি পুরীতে নিয়ে যান। মারাঠা শাসনামলে কোনার্ক মন্দির থেকে অনেক ভাস্কর্য ও প্রস্তরখন্ড পুরীতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৭৭৯ সালে কোনার্ক থেকে অরুণ কুম্ভ নামে বিশাল একটি স্তম্ভ নিয়ে পুরীর সিংহদ্বারের সামনে স্থাপন করা হয়। এই সময় মারাঠা প্রশাসন কোনার্কের নাট মন্ডপটি অপ্রয়োজনীয় মনে করে ভেঙ্গে ফেলে। সূর্যদেবের বিগ্রহ অপসারণের পর কোনার্কে পূজা ও আরতি বন্ধ হয়ে যায়। চতুর্থত,পর্তুগীজ জলদস্যুদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে কোনার্ক বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়। পর্তুগীজ জলদস্যুদের দস্যুবৃত্তি করতে অসুবিধা হওয়ার জন্য পর্তুগীজ দস্যুরা কোনার্ক মন্দিরের মাথায় অবস্হিত অতি শক্তিশালি চুম্বকটিকে নষ্ট করে দেয়।
আঠারশো শতক নাগাদ কোনার্ক মন্দির তার সকল গৌরব হারিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। মন্দিরের অনেক অংশ বালির নিচে চাপা পড়ে যায়। মন্দির চত্বর ও এর আশেপাশের এলাকা ধীরে ধীরে ঘন অরণ্যে ছেয়ে যায়। বুনো জন্তুরা বাসা বাঁধে মন্দিরের ভিতর। জলদস্যু ও ডাকাতের আস্তানায় পরিণত হয় কোনার্ক মন্দির। সেসময় দিনের আলোতেও সাধারণ মানুষ ভয়ে এর ত্রিসীমানায় যেত না।
নির্মাণ ও গঠন


কলিঙ্গ রীতিতে নির্মিত মন্দিরের চূড়াগুলো পিরামিড আকৃতির। মন্দিরের সামনে রয়েছে নাটমন্ডপ। এখানে একসময় দেবদাসীরা দেবতার উদ্দেশ্যে পূজানৃত্য পরিবেশন করতেন। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে নাটমন্দির,ভোগমন্দির ও গর্ভগৃহ। মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৮৫৭ ফুট। তবে মন্দিরের অনেক অংশ এখন বালিতে ডেবে গেছে। মন্দিরের দেউল এখনো ২০০ ফুট উঁচু।
উড়িষ্যা ও দ্রাবিড় স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে নির্মিত মন্দিরটি ধূসর বেলেপাথরে বিশাল একটি রথের আকারে গড়া হয়েছে। সমুদ্র থেকে উঠে আসা সূর্যদেবের বিশাল রথ, তার সামনে রয়েছে সাত জোড়া ঘোড়া। সাতটি ঘোড়া মানে সপ্তাহের সাত দিন। বারো জোড়া বিশাল চাকার ওপর পুরো মন্দিরটি নির্মিত। চব্বিশটি চাকা মানে চব্বিশ পক্ষ। চাকার কারুকার্য দর্শকদের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ। প্রতিটি চাকা একেকটি সূর্যঘড়ি। চাকার ভেতরের দাঁড়গুলো সূর্যঘড়ির সময়ের কাঁটা। আটটি দাড়ি মানে অষ্টপ্রহর। এখনো নিখুঁতভাবে সময় জানা যায় এই সূর্যঘড়ির সাহায্যে। মন্দিরের প্রবেশপথেই রয়েছে বিশাল দুটি সিংহের মূর্তি যারা লড়াই করছে দুটি রণহস্তীর সঙ্গে।
এছাড়া রয়েছে নৃত্যকক্ষ, ছায়াদেবীর মন্দির ও মায়া মন্দির। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে মন্দির প্রাঙ্গনে বসে ডান্স ফেস্টিবল। সেইসময় বহু দূর থেকে ছুটে আসেন বহু নৃত্যপ্রেমী মানুষ।
ভাস্কর্য
আজও ভোরের সূর্যোদয়ের প্রথম আলো মন্দিরের প্রাঙ্গনে এসে পড়ে। মন্দিরের ভাস্কর্য অনুপম। বেদী থেকে শুরু করে চূড়া পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চি জায়গায় পাথরের ভাস্কর্য ও কারুকার্য রয়েছে। দেবতা,অপ্সরা, কিন্নর, যক্ষ, গন্ধর্ব, নাগ, মানুষ, বালিকা বধূ বিয়ের শোভাযাত্রা, সমকামিতা, রাজার যুদ্ধ প্রস্তুতি, মৃদঙ্গকরতাল বীণা, মোহিনী, মিঠুন মূর্তি, ছয় হাতের শিব, রাজদরবারের নানান দৃশ্য, পৌরাণিক বিভিন্ন ঘটনার প্রতিরূপ, নৃত্যরত নরনারী, প্রেমিক যুগল, ফাঁদ দিয়ে হাতি ধরা,শিকারের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাথরের বুকে। মূর্তিগুলোর মানবিক আবেদন, নিখুঁত গড়ন,লীলায়িত ভঙ্গী শিল্পকলার চরম উত্কর্ষের নিদর্শন। মন্দিরের তোরণে মানুষের মূর্তি শায়িত। সিংহ শক্তি অর্থাৎ ক্ষমতার প্রতীক এবং হাতি কিংবা সম্পদের প্রতীক এদের মাঝে পিষে মরছে মানুষ।
উদ্ধার
বিংশ শতাব্দীতে প্রত্নতত্ববিদরা কোনার্ক মন্দির পুনঃরাবিষ্কার করেন। ৩০০ বছর ধরে বালিরস্তূপের নীচে অনাদর ও অবহেলায় পড়ে থাকা এই সূর্য মন্দিরটিকে ১৯০৪ সালে বড়লাট লর্ড কার্জন উদ্ধার করেন৷ তবে তারও আগে কোন বিপর্যয়বশত মূল সূর্য মন্দিরটি অবুলুপ্ত হয়। আমরা যেটাকে মন্দির হিসেবে দেখি সেটা আসলে নাট মন্দির, মূল মন্দির নয়৷ ফলে লোকচক্ষুর সামনে উন্মোচিত হয় কোনার্ক মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য শৈলী, বিস্ময়কর ভাস্কর্যকীর্তি ও অনন্য শিল্প সম্ভার। কোনার্ক মন্দিরের অনেক শিল্পকীর্তি এখন সূর্য মন্দির জাদুঘর ও উড়িষ্যার জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী কোনার্কের সূর্য মন্দির দেখতে আসেন। প্রাচীন ভারতীয় স্থপতি ও ভাস্করদের শিল্পনৈপুণ্য ও সৃষ্টিশীলতা আজও মানুষকে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ করে।
গ্যালারি
প্রাচীন চিত্র এবং ছবি
- Watercolour painting of two European officers with a dog exploring the interior (1812)
- Watercolour "somnath"drawing of the north view of Konark (1820). It depicts part of the main tower still standing.
- Photograph of a general view from the south-west (c.1890).
- Arunastambha at the Singhadwara at Jagannath Temple in Puri (1870)
বর্তমান দিনের ছবি
- Nata mandir
- Front view of Nata mandir
- A simha-gaja at the entrance
- One of the carved wheels
- A close-up of a wheel
- A weathered horse sculpture
- A secondary statue of the Sun god
- A sculpture on the temple wall
- Mayadevi Temple at Konark
- Sculpture of a crocodile head on Mayadevi Temple
- Vaishnava Temple
- Sanctum of the Vaishnava Temple
- A plaque declaring Konark to be a World Heritage Site
- A plaque declaring Konark to be the Kainapara of the Periplus. It puts the date of construction at c. 1250.
- A close-up of a wheel
- Carvings on the Sun temple
- A sculpture on the temple wall
- A sculpture of a crocodile head
- A sculpture taken from the site at the British Museum
- A simha-gaja at the entrance
- কোণার্ক সূর্য মন্দির
- Replica of Sun Temple at Gwalior
- Elephants of Konark Temple
- Close up of Wheel Axle
- Ornated Wheel of the temple chariot
- GajaNarasimha – Lion on Elephant at the Gateway
- কোণার্ক সূর্য মন্দির
- কোণার্ক সূর্য মন্দির
তথ্যসূত্র
- http://whc.unesco.org/en/list/246.
- Sen, Sailendra (২০১৩)। A Textbook of Medieval Indian History। Primus Books। পৃষ্ঠা 121–122। আইএসবিএন 978-9-38060-734-4।
- Indian History। Tata McGraw-Hill Education। পৃষ্ঠা 2। আইএসবিএন 978-0-07-132923-1। সংগ্রহের তারিখ ৩ মে ২০১৩।
- "Konark Sun Temple"।
- "Sun Temple, Konârak"। UNESCO। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুন ২০১৭।
- Lewis Sydney Steward O'Malley (১ জানুয়ারি ২০০৭)। Bengal District Gazetteer : Puri। Concept Publishing Company। পৃষ্ঠা 283। আইএসবিএন 978-81-7268-138-8। সংগ্রহের তারিখ ১১ জুন ২০১৭।
বহিঃসংযোগ
![]() |
উইকিমিডিয়া কমন্সে কোণার্ক সূর্য মন্দির সংক্রান্ত মিডিয়া রয়েছে। |
- কোণার্ক সূর্য মন্দির (অফিসিয়াল ওয়েবসাইট), পর্যটন বিভাগ, ওড়িশার সরকার
- সূর্য মন্দির, বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, ইউনেস্কো
- কোণার্ক সূর্য মন্দির, ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ
- ওড়িশা পর্যটন পোর্টাল
- কোণার্ক সূর্য মন্দির
- কোণার্ক সূর্য মন্দির, গোলাকার প্যানোরামা ৩৬০°
- Reach পুরী থেকে কোণার্ক সূর্য মন্দির