শাহ চখা

শাহ চখা (বৈজ্ঞানিক নাম: Tadorna tadorna) (ইংরেজি: Common Shelduck), পাতি চকাচকি বা সাচকা Anatidae (অ্যানাটিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Tadorna (টাডোর্না) গণের এক প্রজাতির বড় আকারের হাঁস[1][2] শাহ চখার বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ চখাচখি (ফরাসি tador = চখাচখি)।[2] সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস, প্রায় ২২ লাখ বর্গ কিলোমিটার।[3] শাহ চখা পৃথিবীর সেই সব প্রজাতির অন্যতম যাদের সংখ্যা গত কয়েক দশক ধরে ক্রমেই বাড়ছে। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে Least Concern বা ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।[4] শীতে বাংলাদেশে এরা পরিযায়ী হয়ে আসে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।[2] সমগ্র পৃথিবীতে আনুমানিক ৫লাখ ৮০ হাজার থেকে ৭ লাখ ১০ হাজার শাহ চখা রয়েছে।[3] প্রজাতিটির কোন উপপ্রজাতি নেই।

শাহ চখা
Tadorna tadorna
প্রজনন মৌসুমে পূর্ণবয়স্ক চখা
পূর্ণবয়স্ক চখি

ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত  (আইইউসিএন ৩.১)
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Animalia
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: পক্ষী
বর্গ: Anseriformes
পরিবার: Anatidae
উপপরিবার: Tadorninae
গণ: Tadorna
প্রজাতি: T. tadorna
দ্বিপদী নাম
Tadorna tadorna
(লিনাইয়েস, ১৭৫৮)
বৈশ্বিক বিস্তৃতি
(হলুদ: গ্রীষ্মকালীন অবস্থান, নীল: শীতকালীন অবস্থান, সবুজ: সারা বছর অবস্থান)
প্রতিশব্দ

Anas tadorna

বিস্তৃতি

এশিয়া, ইউরোপআফ্রিকার উত্তরাংশে শাহ চখা দেখা যায়। বিশ্বের অনেক দেশে এরা পরিযায়ী হয়ে আসে।[4] এশিয়ার মধ্যে পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, ইরান, মালয়েশিয়া, চীন, তিব্বত, ইরাক, জাপানসহ বহু দেশে বিস্তৃত। শীতকালে বাংলাদেশের বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী এবং সিলেট বিভাগের হাওর, সমুদ্র উপকূল ও নদ-নদীতে এদের দেখা যায়।[2]

বিবরণ

শাহ চখা টকটকে লাল ঠোঁট আর সাদা বুকে লাল ফিতা পরা বড় আকারের হাঁস। এদের দৈর্ঘ্য কমবেশি ৬২ সেন্টিমিটার, ডানা ১১.৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৩.২ সেন্টিমিটার, পা ৫.২ সেন্টিমিটার ও লেজ ১১.৫ সেন্টিমিটার। ওজন প্রায় এক কিলোগ্রাম।[2] এর মাথা চকচকে কালো রঙের। মাথায় একটু সবজে ভাব রয়েছে। অভিনব সাদা দেহে তিনটি প্রশস্ত কালো লাইন দেখা যায়। কালো লাইন তিনটি পিঠ, ডানার ওড়ার পালক আর পেটের মাঝ বরাবর থাকে। বুকে তামাটে ছিট ছিট দাগ দেখা যায়। পা ও পায়ের পাতা মেটে পাটল বর্ণ থেকে মেটে লাল। দূর থেকে পা লালচে-গোলাপি মনে হয়। নখর কালো। চখা ও চখির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। চখার ঠোঁটের গোড়ায় লাল বর্ম আছে। ডানায় সবুজাভ পট্টি থাকে যার উপরে নিচে কালো মোটা রেখা থাকে। চখি চখার চেয়ে আকারে ছোট। এর বুকে তামাটে বর্ণের দাগের প্রান্ত কালো। অপ্রাপ্তবয়স্ক হাঁসের মাথার চাঁদি, ঘাড় ও পিঠ কালচে-বাদামি বা ধূসর-বাদামি; দেহতল, কপাল, গাল, গলার উপরিভাগ সাদা। বুকে ছিটে দাগ নেই।[1][2]

স্বভাব

শাহ চখা সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় থাকে। তবে প্রজনন মৌসুমের শেষে আর পরিযায়নকালে এরা ছোট বা বিশাল দলে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। প্রজনন মৌসুমের শেষে প্রায় এক মাস (২৫-৩১ দিন) যাবৎ এরা উড়তে পারে না, এসময়টায় এরা সমস্ত পালক পরিবর্তন করে। এ সময় প্রতি দলে এদের সংখ্যা এক লাখ বা তার বেশি হয়।[3] এরা সাধারণত উপকূলের কাদামাঠ, নতুন জেগে ওঠা বালুচর, মিঠাপানি ও লোনাপানির হ্রদ, হাওর, মোহনা এবং বড় নদ-নদীতে ঘুরে বেড়ায়। কাদাপানিতে ঠোঁট ডুবিয়ে অথবা অগভীর জলে মাথা ডুবিয়ে এরা খাবার খোঁজে। শাহ চখা সর্বভূক,এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে লোনাপানির শামুক, চিংড়িকাঁকড়াজাতীয় প্রাণী (ক্রাস্টাশিয়ানস), ছোট মাছ, পোকামাকড়, কেঁচো, কচি ঘাস, শৈবাল, জলজ উদ্ভিদের বীজ, পাতা, শস্যদানা ইত্যাদি। এরা প্রধানত নিশাচর। চখা পরিষ্কার গলায় শিস দেয়, চখি খুব দ্রুত ডাকে: গ্যাগ-অ্যাগ-অ্যাগ-অ্যাগ[2] বেশিরভাগ সময়ে উড়তে উড়তে ডাকে।[1]

প্রজনন

মে-জুন মাস এদের প্রজননকাল। এ সময় তিব্বতমধ্য এশিয়ার অন্যান্য অংশে এদের প্রজনন ঘটে। প্রজননকালে এক জোড়া বা ছোট দলে বিচরণ করে। মাটির প্রাকৃতিক ফাটল বা খাড়া উঁচু পাহাড়ের গর্তে বা মাটির গর্তে পালক দিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো গজদন্তের মত সাদা হয়। ডিমগুলো সংখ্যায় ৬-১০টি হয়। ডিমের মাপ ৬.৫ × ৪.৫ সেন্টিমিটার। চখি একাই ডিমে তা দেয়। এ সময় চখা বাসা পাহারা দেয়। ৩০ দিনে ডিম ফোটে।[2] ছানারা ফোটার পর বাবা-মা বা অন্য কোন হাঁসকে অনুসরণ করে নিকটবর্তী জলাশয়ে নামে। বাসা থেকে জলাশয়ের দূরত্ব কখনও কখনও এক মাইলও হতে পারে। যেসব ছানারা পিতামাতা হারায়, তাদের দায়িত্বভার অন্য হাঁসেরা নেয়। বড় দলে এ ধরনের নার্সারিতে ছানার সংখ্যা ২০-৪০ এমনকি ১০০ পর্যন্ত হয়। ছানারা প্রায় ৫৫ দিনে উড়তে শেখে। দুই বছর বয়সে তারা বয়োঃপ্রাপ্ত হয়।[5]

তথ্যসূত্র

  1. রেজা খান, বাংলাদেশের পাখি (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮), পৃ. ১২১।
  2. জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: পাখি, খণ্ড: ২৬ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ১৭।
  3. Tadorna tadorna, BirdLife International এ শাহ চখা বিষয়ক পাতা।
  4. Tadorna tadorna, The IUCN Red List of Threatened Species এ শাহ চখা বিষয়ক পাতা।
  5. Shelduck, Birds of Britain এ শাহ চখা বিষয়ক পাতা।

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.