শকাব্দ
শকাব্দ (অথবা শালীবাহনাব্দ) হল ভারতীয় উপমহাদেশে বহুলপ্রচলিত এক প্রাচীন সৌর অব্দ। এই অব্দ বঙ্গাব্দের ৫১৫ বছর পূর্বে এবং খ্রিস্টাব্দের ৭৮ বছর পরে প্রচলিত হয়। শকাব্দের উৎস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতানুসারে প্রাচীন ভারতীয় নৃপতি শালীবাহনের প্রয়াণ দিবস থেকেই শকাব্দের সূচনা। রাজা শালীবাহনের রাজত্বকালে একবার বহিরাগত শক জাতি তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে। তখন শালীবাহন শকদের পরাজিত করেন এবং ‘শকারি’ উপাধি গ্রহণ করেন। সেখান থেকেই এই অব্দের নাম হয় শকাব্দ। শকাব্দ একটি সৌর অব্দ এবং পূর্বে এর মাস এবং দিনাঙ্ক গণিত হত খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে উদ্ভূত প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিষয়ক গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্তের’ সৌরবর্ষ গণনার বিধি মান্য করে অর্থাৎ রবিসংক্রান্তি অনুসারে।[1]
একটি রাশি থেকে অপর একটি রাশিতে সূর্যের আপাতগমনের(প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর বার্ষিক গতি) ফলে মাস পরিবর্তিত হত।[1] পূর্ব ভারতে প্রচলিত বঙ্গাব্দে এবং ভাস্করাব্দে বর্ষগণনার ক্ষেত্রে এখনও এই প্রাচীন পদ্ধতিটিই অনুসৃত হয়ে থাকে। শকাব্দে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন সময়ে বর্ষারম্ভ হত। যেমন উত্তর ভারতে বছর শুরু হত চৈত্র মাসে কিন্তু পূর্ব ভারতে নববর্ষ অনুষ্ঠিত হত বৈশাখ মাসে। ভারতীয় ইতিহাসের আধুনিক যুগেও অন্যান্য অব্দের পাশাপাশি শকাব্দের ব্যবহার বহুলভাবে লক্ষিত হয়। আসামে "ভাস্করাব্দ" নামক একটি অব্দ প্রচলিত থাকলেও শকাব্দের ব্যবহারই বহুল প্রচলিত। সূর্যসিদ্ধান্তের প্রাচীন নিয়ম মেনেই অসমে ১ বহাগ (বৈশাখ) পালিত নববর্ষ উৎসব "বহাগ বিহু" থেকে শকাব্দ গণনা করা হয়।[2] ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গদেশে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক এবং সাময়িক পত্রে শকাব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা”।
ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দ
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ভারত একটি গণপ্রজাতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবার পরে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একটি জাতীয় অব্দ প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এর ফলে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে(১৮৭৯ শকাব্দ) ভারত সরকার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি “পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি” গঠন করেন। এই কমিটি শকাব্দ সহ ভারতে প্রচলিত অন্যান্য বর্ষপঞ্জিসমূহের সংস্কারসাধনে নিযুক্ত হয়। উক্ত কমিটি শকাব্দকে ঋতুনিষ্ঠ ও সর্বস্তরে ব্যবহারোপযোগী করে তোলার জন্য এবং আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচলিত গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার জন্য এই অব্দকে সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়। “সূর্যসিদ্ধান্তে” উল্লিখিত নিরয়ণ বর্ষগণনারীতি[1] পরিহার করে “পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি” শকাব্দকে সায়ন সৌর অব্দে রূপান্তরিত করে এবং বারো মাসের দৈর্ঘ্য স্থির করে দেয়।[1][3][4] এছাড়া বার্ষিক গতির সাথে সমন্বয় রেখে অধিবর্ষে চৈত্র মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এই কমিটির ঘোষণা অনুসারে প্রত্যেক বছর মহাবিষুবের পরদিন অর্থাৎ গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জীর ২২ মার্চ তারিখে শকাব্দ আরম্ভ হয় এবং শকাব্দের তারিখ অনুসারে সেই দিনটি হল ১ চৈত্র। কেবল অধিবর্ষে বর্ষারম্ভ হয় ২১ মার্চ। এই সংশোধিত অব্দে বর্ষগণনার বিধি অনুসারে শকাব্দের সাথে ৭৮ যোগ করে প্রাপ্ত যোগফলকে ৪(চার) দ্বারা ভাগ করে যদি ভাগশেষ থাকে ০(শূন্য) তাহলে সেই বছর অধিবর্ষ হয়। কিন্তু শকাব্দের সাথে ৭৮ যোগ করার পর প্রাপ্ত যোগফল যদি ১০০-এর গুণিতক হয় তাহলে তাকে ৪০০ দ্বারা ভাগ করার পর যদি ভাগশেষ থাকে ০ (শূন্য) তাহলে সেই বছর অধিবর্ষ হয়।[1][3][4] উক্ত কমিটির সিদ্ধান্তানুসারে শকাব্দের বারো মাসের দিনসংখ্যা হল এইরূপ[1][3][4]:
# | মাস | দৈর্ঘ্য | গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে মাসের আরম্ভকাল | যে ক্রান্তীয় রাশিতে (Tropical zodiac) সূর্য অবস্থিত |
---|---|---|---|---|
১) | চৈত্র | ৩০ দিন (অধিবর্ষে ৩১ দিন) | ২২ মার্চ (অধিবর্ষে ২১ মার্চ) | মেষ |
২) | বৈশাখ | ৩১ দিন | ২১ এপ্রিল | বৃষ |
৩) | জ্যৈষ্ঠ | ৩১ দিন | ২২ মে | মিথুন |
৪) | আষাঢ় | ৩১ দিন | ২২ জুন | কর্কট |
৫) | শ্রাবণ | ৩১ দিন | ২৩ জুলাই | সিংহ |
৬) | ভাদ্র | ৩১ দিন | ২৩ অগস্ট | কন্যা |
৭) | আশ্বিন | ৩০ দিন | ২৩ সেপ্টেম্বর | তুলা |
৮) | কার্তিক | ৩০ দিন | ২৩ অক্টোবর | বৃশ্চিক |
৯) | অগ্রহায়ণ | ৩০ দিন | ২২ নভেম্বর | ধনু |
১০) | পৌষ | ৩০ দিন | ২২ ডিসেম্বর | মকর |
১১) | মাঘ | ৩০ দিন | ২১ জানুয়ারি | কুম্ভ |
১২) | ফাল্গুন | ৩০ দিন | ২০ ফেব্রুয়ারি | মীন |
১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ (১ চৈত্র ১৮৭৯ শক) ভারত সরকার এই সংস্কারপ্রাপ্ত শকাব্দকে ভারতের জাতীয় অব্দ হিসাবে গ্রহণ করে এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সর্বস্তরে গ্রেগোরিয়ান অব্দের সাথে “ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের” ব্যবহার প্রচলন করে।[5][6][7] কিন্তু সমস্ত প্রশাসনিক বিভাগে, আকাশবাণী এবং দূরদর্শনের ঘোষণায় শকাব্দের প্রচলন হলেও[7] এখনও ১ চৈত্র (২১/২২ মার্চ), শকাব্দের নববর্ষের দিন জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে স্বীকৃত হয়নি। ধর্মীয় নিরয়ণ বর্ষপঞ্জীর বহুল প্রচলনের কারণেই সম্ভবত সংস্কারকৃত শকাব্দ উপেক্ষিত রয়ে গেছে।[1][8]
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- The Indian Calendar, NASA Eclipse Website
- Bihu- the Lifeline of Assamese Society
- পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি, ১৯৫২ - রিপোর্ট
- Meghnad Saha, a pioneer in Astrophysics
- "PANCHANG DATA GIVEN ACCORDING TO THE SAKA ERA"। ২৬ এপ্রিল ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ এপ্রিল ২০১২।
- "PRINCIPAL FESTIVALS OF INDIA LISTED ACCORDING TO THE SAKA ERA"। ২ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ এপ্রিল ২০১২।
- "Government Holiday Calendar"। Govt. of India Official website।
- ""Hindu" New Year's day and related issues"। ২৪ এপ্রিল ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ এপ্রিল ২০০৮।