নবগোপাল মিত্র
নবগোপাল মিত্র (জন্ম: ১৮৪০ - মৃত্যু:১৮৯৪) ছিলেন একাধারে একজন ভারতীয় নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক, দেশপ্রেমিক এবং অন্যদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাকর্তাদের মধ্যে অন্যতম। হিন্দু জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির পটভূমিকায় যে অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান রাজনারায়ণ বসু উদ্বোধন করেছিলেন, সেই হিন্দু মেলা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়া তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল প্রেস,[1] ন্যাশনাল পেপার, ন্যাশনাল সোসাইটি, ন্যাশনাল স্কুল, ন্যাশনাল থিয়েটার, ন্যাশনাল স্টোর,[2] ন্যাশনাল জিমন্যাসিয়াম এবং ন্যাশনাল সার্কাস; এগুলোর জন্যে তাঁর ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল 'ন্যাশনাল মিত্র'।
প্রথম জীবন ও প্রভাবসমূহ
নবগোপাল মিত্র কলকাতার সম্ভ্রান্ত বাঙালি হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যারা কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের কাছে শঙ্কর ঘোষ লেনে বাস করতেন। তাঁর জন্মবর্ষ নিয়ে বিতর্ক আছে। যখন অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে তাঁর জন্ম হয়ছিল ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে, তখন কয়েকটা সূত্র মোতাবেক তাঁর জন্মবর্ষ হিসেবে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দকে নথিভুক্ত করা হয়েছিল।। ছোটোবেলা থেকেই ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল।সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন। তিনি ক্রমান্বয়ে আদি ব্রাহ্মসমাজ এবং তত্ত্ববোধিনী সভার দলপতি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকটতম সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন। কেশবচন্দ্র সেনের অতি-সংস্কারবাদী মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে রক্ষণশীল ছিলেন। যেখানে কেশব সেনের দর্শন বিশ্বজনীনতায় নিবদ্ধ ছিল, সেদিক থেকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ সংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। নবগোপাল মিত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারায় ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
কর্মজীবন
নবগোপাল মিত্র জাতীয়তাবাদের পক্ষে ঐক্যকে মৌলিক নির্ণায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন এবং হিন্দু ধর্মকেই হিন্দুদের তরফে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি মেনেছিলেন। তিনি হিন্দু জাতির একটা সংজ্ঞা দেওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মতে, "হিন্দু জাতীয়তা ... শুধু বাংলায় সীমিত নয়; এটা হিন্দুস্থানের পুরো দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ নির্বশেষে সকল হিন্দু নাম ও হিন্দু বিশ্বাসকে সাগ্রহে গ্রহণ করে; ভূবৈজ্ঞানিক অবস্থান কিংবা ভাষা কোনোটাকেই অযোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়নি। হিন্দুরা একটা ধর্মীয় জাতি হিসেবে পূর্বনির্দিষ্ট ছিল।"[3]
ন্যাশনাল পেপার
নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল পেপার শিরোনামে একটা ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা চালু করেছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পত্রিকার আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন।[4] তিনি বিশেষ উদ্দেশ্যে মুখ্য সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর স্তম্ভগুলোতে কখনো ব্যাকরণগতভাবে সঠিক ইংরেজি ব্যবহার করেননি। কোনো ব্যক্তি যদি ব্যাকরণগত কোনো ভুল ধরত, তাহলে তিনি এটা বোঝাবার চেষ্টা করতেন যে, ইংরেজি তাঁর মাতৃভাষা নয়, যদি তাঁর লিখিত নিবন্ধে ব্যাকরণগত কোনো ত্রুটিও থাকে, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। তাঁর মত অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি ইংরেজিতে নিজেকে জাহির করতে সক্ষম হন, তবে তা ব্যাকরণগতভাবে সঠিক না-হলেও এটা যথোপযুক্ত হবে। অত্যাচারীদের ভাষার প্রতি নবগোপাল মিত্রের ঘৃণা ও অবজ্ঞা, অপরিহার্যভাবে তাঁর পরামর্শদাতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উত্তরাধিকারের টানেই তাঁর গণমাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছিল, এবং সাপ্তাহিক পত্রিকাটি যখন চালু হয়েছিল তখন ভাষাটা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে যেটা মূল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছিল।
হিন্দু মেলা
মূল প্রবন্ধ: হিন্দু মেলা
১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল পেপার রাজনারায়ণ বসু লিখিত এক পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল: 'বাংলার শিক্ষিত অধিবাসীদের মধ্যে জাতীয়তার অনুভূতি জাগানোর জন্যে এক সমিতির প্রচারপত্র'। এই পুস্তিকার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই নবগোপাল মিত্র ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেলা এবং ন্যাশনাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মেলা প্রথমে জাতীয় মেলা নামে পরিচিত ছিল।[5]
তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর লেখা কবিতাগুলো হিন্দু মেলায় আবৃত্তি করতে অনুরোধ করেছিলেন।
যুবক নরেন্দ্রনাথ হিন্দু মেলায় যাতায়াত করতেন।[6]
ন্যাশনাল জিমন্যাসিয়াম
হিন্দু মেলায় নবগোপাল মিত্র জিমন্যাস্টিক্স, মল্লযুদ্ধ এবং ঐতিহ্যপূর্ণ খেলাধুলোর ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর বাড়িতে একটা জিমন্যাস্টিক স্কুল খুলেছিলেন, তিনি যার নাম দিয়েছিলেন 'ন্যাশনাল জিমন্যাসিয়াম'। এটা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল এবং কয়েক বছরের মধ্যে এই বিদ্যালয় একাধিক শারীরশিক্ষার শিক্ষক তৈরি করেছিল। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে বাংলার গভর্নর-জেনারেল জর্জ ক্যাম্পবেল নতুন এক শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। এই নতুন নিয়মে সরকারি স্কুল এবং কলেজগুলোতে ইউরোপীয় কায়দায় জিমন্যাসিয়াম গড়া হয়েছিল। হিন্দু কলেজ জিমন্যাসিয়ামে প্যারালাল বার, হরাইজন্টাল বার, ট্র্যাপিজ ইত্যাদি যন্ত্রপাতি ছিল। নবগোপাল মিত্রের জ্যেষ্ঠ জামাতা সেখানে প্রশিক্ষক ছিলেন। ইউরোপীয় যন্ত্রপাতিগুলোর উপযোগিতা ও আবশ্যকতা অনুভব করে তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যেই এগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেজন্যে 'ন্যাশনাল জিমন্যাসিয়ামে' যখন শরীর চর্চা, মল্লযুদ্ধ, অসি চালনা এবং লাঠি খেলার ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল, তারপর ক্রমান্বয়ে বার এবং ট্রাপিজের মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রবর্তিত হয়েছিল। এমনকি ইউরোপীয় কায়দায় বাঙালি হিন্দু জনতাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে নবগোপাল মিত্র একজন ব্রিটিশ প্রশিক্ষক নিয়োগ করেন।
শারীরিক শিক্ষার পাশাপাশি এই আখড়া ভবিষ্যতের ভারতীয় নেতাদের জাতীয়তাবাদের শিক্ষা প্রদানে সহায়ক হয়ে উঠেছিল। তাঁদের মধ্যে সকলের আগে ছিলেন বিপিন চন্দ্র পাল, সুন্দরী মোহন দাস এবং রাজ চন্দ্র চৌধুরী। স্বামী বিবেকানন্দও তাঁর প্রথম জীবনে ন্যাশনাল জিমন্যাসিয়ামে যোগ দিয়েছিলেন। একবার একজন ব্রিটিশ নাবিক ট্রাপিজের উঁচু ডিগবাজির জায়গায় ধাক্কা লেগে অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই পালিয়েছিলেন কিন্তু নরেন্দ্রনাথ এবং তাঁর বন্ধুরা সাহসে ভর করে কয়েকদিনের জন্যে ওই নাবিক সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত তার শুশ্রূষা করেছিলেন।[7]
ন্যাশনাল স্কুল
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্র ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমির চত্বরে ন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।[8] শিল্পকলা, সংগীত এবং শারীরশিক্ষা চর্চার জন্যে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়েছিল। শিক্ষাক্রমের মধ্যে ছিল অঙ্কন, মডেলিং, জ্যামিতিক অঙ্কন, স্থাপত্যকলার অঙ্কন, প্রকৌশল এবং জরিপ। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন কলাবিদ্যার প্রধান শিক্ষক শ্যামাচরণ শ্রীমানি এবং ভারতের প্রথম শিল্প পত্রিকা 'শিল্প পুষ্পাঞ্জলি'র প্রতিষ্ঠাতা কালিদাস পাল।[9]
ন্যাশনাল থিয়েটার
মূল প্রবন্ধ: ড্রামাটিক পারফর্ম্যান্সেস অ্যাক্ট
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পিছনে নবগোপাল মিত্রের সহায়তা ছিল। তিনিই প্রথম ন্যাশনাল থিয়েটার নামের প্রস্তাব করেছিলেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর ওই গোষ্ঠী তাদের প্রথম প্রদর্শন নীলদর্পণ মঞ্চস্থ করে। ন্যাশনাল পেপার সংবদপত্রে এই মঞ্চ উপস্থাপনাকে 'একটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা' বলে উল্লেখ করেছিল।
ন্যাশনাল সার্কাস
নবগোপাল মিত্র অগ্রগামী জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তিকে ব্যবহার করেছিলেন। পরিশেষে ন্যাশনাল সার্কাসের তহবিল সংগ্রহের জন্যে তিনি তাঁর বাড়ি বন্ধক দিয়েছিলেন, যে অগ্রগামী প্রতিষ্ঠান ভারতে অ্যাক্রোব্যাটিক সংস্কৃতি, জিমন্যাস্টিক্স ও শারীরিক সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়েছিল এবং খুবই বিখ্যাত ও সফল প্রিয়নাথ বসু প্রতিষ্ঠিত গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের অগ্রবর্তী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেছিল। অগ্রগামী বেলুনিস্ট ও প্যারাসুটিস্ট রাম চন্দ্র চ্যাটার্জি ন্যাশনাল সার্কাসেই তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।
নবগোপাল মিত্র ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ১০/২, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ন্যাশনাল সার্কাস প্রতিষ্ঠা করেন।
তথ্যসূত্র
- Sen, Amit (২০১৪)। Notes on the Bengal Renaissance। Peoples Publishing House।
- Saroj Kumar Mitra (২১ আগস্ট ২০০৫)। "The centenary year of the war-cry: Vande Mataram"। Organiser। ১৯ জুন ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ নভেম্বর ২০১৯।
- Saha, Panchanan (২০০৭)। Hindu-Muslim relations in a new perspective। Biswabiksha। পৃষ্ঠা 131। আইএসবিএন 978-81-901959-5-9।
- Guha-Thakurta, P. (২০০০)। The Bengali Drama: Its Origin and Development। Psychology Press। পৃষ্ঠা 145। আইএসবিএন 978-0-415-24504-3।
- Datta, Amaresh (১৯৮৮)। Encyclopaedia of Indian Literature: Devraj to Jyoti। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা 1578। আইএসবিএন 978-81-260-1194-0।
- Dr. Bhupendranath Datta। Swami Vivekananda: Patriot-Prophet। Nababharat Publishers।
- Chattopadhyaya, Rajagopal (১৯৯৯)। Swami Vivekananda in India: A Corrective Biography। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 22। আইএসবিএন 978-81-208-1586-5।
- Ghatak, Kamal Kumar (১৯৯১)। Hindu Revivalism in Bengal: Rammohan to Ramakrishna। Minerva Associates (Publications)। পৃষ্ঠা 39। আইএসবিএন 978-81-85195-35-3।
- Guha-Thakurta, Tapati (১৯৯৫)। "Recovering the Nation's Art"। Chatterjee, Partha। Texts of Power: Emerging Disciplines in Colonial Bengal। University of Minnesota Press। পৃষ্ঠা 66, 76। আইএসবিএন 978-0-8166-2687-8।