ছোট সাহেলি

ছোট সাহেলি (বৈজ্ঞানিক নাম: Pericrocotus cinnamomeus) (ইংরেজি: Small Minivet), সাত সাইলি বা কেবলই সাত সহেলি Campephagidae (ক্যাম্পেফ্যাগিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Pericrocotus (পেরিক্রোকোটাস) গণের এক প্রজাতির ছোট পোকাখেকো পাখি।[1][2] ছোট সাহেলির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ দারুচিনিরঙ পীতবর্ণের পাখি (গ্রিক: pere = খুব, krokotos = গাঢ় পীত রঙ; লাতিন: cinnamun = দারুচিনি, -inus = ধারণ করা)।[2] সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪৮ লাখ ৫৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এদের আবাস।[3] বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা স্থিতিশীল রয়েছে, আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেনি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।[4] বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।[2] পৃথিবীতে এদের সংখ্যা সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় নি।[3]

ছোট সাহেলি
পুরুষ, P. c. malabaricus, অন্ধ্রপ্রদেশ, ভারত
স্ত্রী, P. c. separatu, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড

ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত  (আইইউসিএন ৩.১)
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Animalia
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: পক্ষী
বর্গ: Passeriformes
পরিবার: Campephagidae
গণ: Pericrocotus
প্রজাতি: P. cinnamomeus
দ্বিপদী নাম
Pericrocotus cinnamomeus
Linnaeus, 1766
প্রতিশব্দ

Parus cinnamomeus

বিস্তৃতি

ছোট সাহেলির মূল আবাস দক্ষিণদক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল, মায়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়াভিয়েতনাম জুড়ে এদের বিস্তৃতি।[4]

উপপ্রজাতি

ছোট সাহেলির মোট নয়টি উপপ্রজাতি সনাক্ত করা গেছে।[5] উপপ্রজাতিগুলো হল:

  • P. c. pallidus (Stuart Baker, 1920) - এদের বিস্তৃতি পাকিস্তান (সিন্ধু উপত্যকা) ও উত্তর-পশ্চিম ভারত জুড়ে।
  • P. c. peregrinus (Linnaeus, 1766) - এদের প্রধান আবাস উত্তর-পশ্চিম হিমালয়, উত্তর ভারত (দক্ষিণ পাঞ্জাব থেকে উত্তর মধ্য প্রদেশ, পূর্ব বিহার ও উত্তর উড়িষ্যা)
  • P. c. cinnamomeus (Linnaeus, 1766) - এদের প্রধান আবাস ভারত (দক্ষিণ রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ এবং দক্ষিণ উড়িষ্যা) ও শ্রীলঙ্কায়
  • P. c. malabaricus (J. F. Gmelin, 1789) - এদের বিস্তৃতি দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত (কর্ণাটক, বেলগাউম, কেরালা) জুড়ে
  • P. c. vividus Stuart (Baker, 1920) - এদের বিস্তৃতি মধ্য হিমালয়, পূর্ব ভারত (পশ্চিম বঙ্গ, আসাম), বাংলাদেশ, পশ্চিম ও মধ্য মায়ানমার, দক্ষিণ-পশ্চিম থাইল্যান্ড ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ জুড়ে
  • P. c. thai (Deignan, 1947) - লাওস, উত্তর মায়ানমার, উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ড জুড়ে এদের আবাস
  • P. c. sacerdos (Riley, 1940) - কম্বোডিয়া ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম জুড়ে এদের আবাস
  • P. c. separatus (Deignan, 1947) - এদের প্রধান আবাস দক্ষিণ মায়ানমার ও থাই উপদ্বীপে
  • P. c. saturatus (Stuart Baker, 1920) - জাভা ও বালি দ্বীপ।

বর্ণনা

ছোট সাহেলি কমলা বুকের ছোটখাটো পাখি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ১৬ সেন্টিমিটার, ডানা ৭ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ১.৩ সেন্টিমিটার, পা ১.৭ সেন্টিমিটার ও লেজ ৭ সেন্টিমিটার। ওজন মাত্র ৮ গ্রাম।[2] স্ত্রী ও পুরুষ পাখির মধ্যে সামান্য তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখির পিঠ কালচে-ধূসর। গলা কালচে। দেহতল কমলা-হলুদ। বুকের দিকে কমলার ভাগ বেশি। কোমর ও লেজ উপরি-ঢাকনি লালচে-কমলা। ডানার পালক-ঢাকনি কালো। ডানার প্রান্ত-পালকে হলুদ-কমলা পট্টি দেখা যায়। লেজ লম্বা ও কালো রঙের। লেজের বাইরের পালকগুলো কমলা-হলুদ। বগলের রঙ কমলা। পেট ও অবসারণী হলদে রঙের।

স্ত্রী পাখির পিঠ ফিকে ধূসর। বগলে হলুদের আভা। দেহতল সাদাটে-ধূসর বা হলুদাভ। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় পাখির চোখ কালচে-বাদামি। ঠোঁট খাটো ও কালো। লেজে সবসময় ১০টি পালক থাকে।[6] মুখ কিছুটা পাটকিলে-কমলা। পা ও পায়ের পাতার রঙ শিঙ-বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠে কিছুটা পীতাভ আঁশ থাকে।[2]

স্বভাব

জন গুল্ড অঙ্কিত ছোট সাহেলি, ১৮৬৭-৭২

ছোট সাহেলি বেশ লাজুক পাখি, লোকালয় বা খোলা জায়গায় এরা আসেই না বলতে গেলে। কুঞ্জবন, বন প্রান্ত, বাগান, গ্রামীণ বন ও আবাদি জমিতে বিচরণ করে। সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় বা ছোট ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায়। গাছের চাঁদোয়ায় উড়ে বেড়ায় ও পাতায় পাতায় শিকার খোঁজে। প্রায়ই এদের বনতলে ঝাঁপ দিয়ে শিকার করতে দেখা যায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে মথ, মাছি, শুঁয়োপোকা এবং অন্যান্য পোকামাকড় ও তাদের লার্ভা। খাবার খোঁজার সময় নরম কণ্ঠে সমস্বরে ডাকে: সুয়ি....সুয়ি....[2] প্রজনন ঋতুতে এদের ডাকাডাকি বেড়ে যায়। তখনকার ডাক অনেকটা হু-হু-ইউটি টিট টিট, গিইট-পিট্-সিট্-সিউটি, গিইই-এ....পিট্....[6]

এরা অনেকসময় ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ায়। দূর থেকে তখন এদের মশার ঝাঁকের মত মনে হয়। খুব ঘন হয়ে ওড়ে বলে এমনটি মনে হয়। ঘন হয়ে উড়লেও একটির সাথে আরেকটি কখনো ধাক্কা খায় না।[6]

প্রজনন

ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর ছোট সাহেলির প্রধান প্রজনন ঋতু। স্থানভেদে প্রজনন মৌসুমে বিভিন্নতা দেখা যায়। উঁচু গাছের বিভক্ত ডালে সরু ডাল, তৃণ, লাইকেন, বাকল, কচুরিপানার শিকড় ইত্যাদি মাকড়সার জালে জড়িয়ে ছোট পেয়ালার মত করে বাসা বানায়। বাসার বুনট বেশ শক্ত। বাসার মুখের গড় ব্যাস ১৬ সেন্টিমিটার ও গভীরতা ৯ সেন্টিমিটার। বাসার অবস্থান ভূমি থেকে কমপক্ষে ১২ মিটার পর্যন্ত হয়। বাসা বানানোর জায়গা নির্ধারণ করতে এরা ১-৩ দিন সময় ব্যয় করে। বাসা বাঁধতে সময় লাগে ২-৭ দিন। বনের মধ্যে এদের বাসা খুঁজে বের করা এক কঠিন কাজ। বাসা বানানো হয়ে গেলে ২-৪টি ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ হালকা সবুজাভ, তাতে হালকা বাদামি ও হালকা বেগুনি ছিটে থাকে। ডিমের মাপ ১.৭ × ১.৪ সেন্টিমিটার।[2] ১৪ থেকে ১৯ দিনে ডিম ফুটে ছানা বের হয়। ছানারা উড়তে শেখে ১৫ থেকে ২০ দিনে।[6]

তথ্যসূত্র

  1. রেজা খান, বাংলাদেশের পাখি (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০৮), পৃ. ৮৬।
  2. জিয়া উদ্দিন আহমেদ (সম্পা.), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ: পাখি, খণ্ড: ২৬ (ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯), পৃ. ৩৩৭।
  3. Pericrocotus cinnamomeus, BirdLife International এ ছোট সাহেলি বিষয়ক পাতা।
  4. Pericrocotus cinnamomeus, The IUCN Red List of Threatened Species এ ছোট সাহেলি বিষয়ক পাতা।
  5. Small Minivet, The Internet Bird Collection এ ছোট সাহেলি বিষয়ক পাতা।
  6. শরীফ খান, বাংলাদেশের পাখি, (ঢাকা: দিব্য প্রকাশ, ২০০৮), পৃ. ৬৪।

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.