আদানা

আদানা তুরস্কের একটি শহর, এটি তুরস্কের কৃষি, বাণিজ্য ও অর্থনীতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থল। আদানা সেয়হান নদীর তীরে অবস্থিত। আদানা প্রদেশের প্রশাসনিক এলাকা হল আদানা শহর। এই শহরের জনসংখ্যা ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি। জনসংখ্যার দিক থেকে আদানা তুরস্কের পঞ্চম বৃহত্তম শহর। আদানা-মেরসিন মেট্রোপলিটন এলাকার জনসংখ্যা প্রায় ২.৭৫ মিলিয়ন, এই অঞ্চল পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। মেরসিন, তারসুস আদানা এবং জেয়হান শহর এই অঞ্চলে অবস্থিত। এটি তুরস্কের চতুর্থ বৃহত্তম মেট্রোপলিটন এলাকা এবং দেশটির অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র।

আদানা
শহর
আদানার শহর
উপরে: স্টোন ব্রিজ; মধ্যে: য়াদানা ট্রেন স্টেশন;
নিম্নে: ভারদা সেতু; সাবানজি মশজিদ
আদানা
আদানার অবস্থান
স্থানাঙ্ক: ৩৭°০′ উত্তর ৩৫°১৯.২৮′ পূর্ব
রাষ্ট্র তুরস্ক
অঞ্চলভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল
প্রদেশআদানা
সরকার
  মেয়রআয়তাচ দুরাক (ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি)
  গভর্নরইলহান আতিশ
আয়তন
  মোট১৯৪৫.০০ কিমি (৭৫০.৯৭ বর্গমাইল)
উচ্চতা২৩ মিটার (৭৫ ফুট)
জনসংখ্যা (২০০৯)[1]
  মোট১৫,৫৬,২৩৮
  জনঘনত্ব৭৮০.৩৫৩/কিমি (২০২১.১০/বর্গমাইল)
সময় অঞ্চলএফইটি (ইউটিসি+৩)
পোস্ট কোড০১xxx
এলাকা কোড০৩২২
লাইসেন্স প্লেট কোড০১
ওয়েবসাইটhttp://www.adana.bel.tr

ইতিহাস

আদানার ইতিহাস প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে শুরু হয়। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে জানা যায় যে এখানে প্রাচীন প্রস্তর যুগ হতে মানুষের বসবাস ছিল। আদানার তেপেবাগ তুমুলুস এলাকায় প্রত্নতাত্বিকগণ একটি পাথরের দেওয়াল এবং শহরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। এগুলো নব্য প্রস্তর যুগে নির্মিতে হয়েছে। আদানাকে জিলজিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো শহর বলে বিবেচনা করা হয়।

সুমেরীও সভ্যতার একটি মহাকাব্যে আদানা নামের একটি অঞ্চলের খোঁজ পাওয়া যায়, এছাড়া ইরাকের প্রাচীন মহাকাব্য গিলগামেশেও আদানার উল্লেখ পাওয়া যায় তবে এ সম্বন্ধে তথ্য অত্যন্ত অযথার্থ বলে তা হতে এই শহরকে নিখুঁতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।

হিটিটি জাতির পাথরে খোদাইকৃত লেখা থেকে জানা যায় যে, কিযুওয়াতনা রাজ্যই প্রথম রাজ্য যা আদানাকে শাসন করেছে। ঐ সময়ে আদানার নাম ছিল আদানিয়া এবং এই অঞ্চলের অধিবাসীদের বলা হত দানুনা। ১১৯১-১১৮৯ খ্রিস্টপূর্বে মধ্যে হিটিটিদের সাথে দানুনাদের সংঘররষকালে পশ্চিম বিশ্ব থেকেও হামলা ও অধিক্রম শুরু হয়। এর ফলে একাধিক ছোট রাজ্য এই অঞ্চলের শাসনভার দখল করে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ফার্সিরা, ৩৩৩ শতাব্দীতে মহামতি আলেকজান্ডার এই অঞ্চলের শাসনভার দখল করে।

আদানার ইতিহাস অন্তর্নিহিতভাবে তারসুসের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাদেরকে মধ্যে প্রায় একই বৈশিষ্ট্যাবলি বিদ্যমান। এই শহর দুইটির মধ্যে দিয়ে সায়হান নদী প্রবাহমান। কালের বিবর্তনে শহর দুইটির নাম পরিবর্তিত হয়েছে। রোমান সাম্রাজ্যের সময় আদানার গুরুত্ব ছিল।

এ সময় তারসুস ছিল রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান মেট্রোপলিটন এলাকা। বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা পম্পেই এর আমলে আদানা জলদস্যুদের কারাগার হিসেবে ববহৃত হত। এর প্রায় কয়েক শতাব্দী পরে আদানা একটি ছোট রেল-স্টেশন হিসেবে বব্যহৃত হত। ৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির পর আদানা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ধারণা করা হয় যে রোমান সম্রাট জুলিয়ান দ্য অ্যাপোসটেটের সময়ই আদানার উন্নয়নকর্ম সাধিত হয়। বড় বড় সেতু, রাস্তা, সরকারী দালান, সেচযন্ত্র এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের ফলে আদানা এবং জিলিজিয়া এই তুরস্কের সবচেয়ে উন্নত এবং গুরুত্বপূর্ণ নগরে পরিণত হয়।

ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য

আদানা ভূমধ্যসাগরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এবং চুকোরোভা সমতলীয় অঞ্চলের প্রবেশপথ হিসেবে কাজ করে, যা ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিম বিশ্বে জিলিজিয়ান সমতলীয় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। এই বিস্তীর্ণ সমতলীয় ভূমি পৃথিবীর সর্বাধিক উর্বর অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। আদানার পশ্চিমে চুকোরোভা এবং তারসুস থেকে আগত রাস্তা আদানার তাউরাস পর্বতের সম্মুখ দিয়ে আগ্রসর হয়। রাস্তাটি বিখ্যাত জিলিজিয়ান গেটের মধ্যে দিয়ে যায়, জিলিজিয়ান গেট হল পাথুরে অঞ্চলবিশেষ। আদানা শহর সেয়হান জলাধার দিয়ে বেষ্টিত, এই জলাধারটি ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি জলবিদ্যুৎ শক্তি দ্বারা নির্মিত হয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য ছিল চুকোরোভা অঞ্চলের সমতলীয় ভূমিতে সেচ কর্মের জন্য পানি সরবরাহ করা। এই জলাধার হতে উদ্ভূত দুইটি সেচ প্রণালী শহরের কেন্দ্র দিয়ে পূর্ব হতে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়।

জলবায়ু

আদানার জলবায়ু ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর অণুরূপ। শীতকালে এখানে উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকালে শুষ্ক ও গরম আবহাওয়া বিরাজ করে। শীতকালে তাপমাত্রা ১৩° থেকে ১৫ °C এবং গ্রীষ্মকালে 34° থেকে 39 °C এর মধ্যে থাকে।

Adana-এর আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য
মাস জানু ফেব্রু মার্চ এপ্রিল মে জুন জুলাই আগস্ট সেপ্টে অক্টো নভে ডিসে বছর
উৎস: [2]

অর্থনীতি

আদানা তুরস্কের প্রথমদিকের শিল্পন্নোত শহরগুলো মধ্যে অন্যতম এবং বর্তমানে অন্যতম অর্থনৈতিকভাবে উন্নত শহর। সেয়হাম জলাধার নির্মাণ এবং কৃষিখাতে অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে ১৯৫০ থেকে পরবর্তিকালে এই অঞ্চলে কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হয়। এছাড়া যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্নয়নের ফলে বৃহৎ শিল্প-কারখানা আদানায় গড়ে ওঠে। সেবামূলক খাত, ব্যাংকিং খাতসহ অন্যান্য খাতেও এই অঞ্চল সমৃদ্ধি লাভ করে।

চুকোরোভা অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিপণন ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র আদানা। আদানায় তুলা, গম, ভুট্টো, সয়াবিন, আঙ্গুর এবং বিভিন্ন ফল বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হয়। তুরস্কের মোট উৎপাদিত শহ্য ও সয়াবিনের অর্ধেকই আদানায় উৎপাদিত হয়। এছাড়া তুরস্কের ৩৪% চীনাবাদাম এবং ২৯% কমলা আদানায় উৎপাদিত হয়।[3] কৃষিবিষয়ক অধিকাংশ বড় কোম্পানিগুলোর দপ্তর আদানায় রয়েছে।

আদানা একটি শিল্পন্নোত শহর এবং কৃষিবিষয়ক বৃহৎ শিল্প-প্রতিষ্ঠান এই শহরে রয়েছে। টেক্সটাইল এবং চামড়াজাত শিল্প আদানার উৎপাদন খাতের ২৯% গঠন করে।[4] উদ্ভিজ্জ্জ তেল এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদন শিল্পও এই শহরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উপস্থিত। ২০০৮ সালের হিসেব অণুসারে তুরস্কের সেরা ৫০০ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১ টি আদানায় অবস্থিত।[5] মোটরগাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেমসা আদানার সবচেয়ে বড় কোম্পানি যা প্রায় ২৫০০ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। কোম্পানিটি বার্ষিক ৪০০০ বাস তৈরি করে। আদানায় অবস্থিত মারসান-আদানা তুরস্কের সবচেয়ে বড় মারজারিন এবং উদ্ভিজ্জ্জ তৈল কারখানা।[6] আডভানসা ইউরোপের সবচেয়ে বড় পলিয়েস্টার নির্মাণ কারখানা যাতে প্রায় ২৬৫০ মানুষ কাজ করে।[7] আদানার শিল্প অঞ্চল, ১২২৫ হেক্টরের শিল্প এলাকায় প্রায় ৩০০ মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান অবস্থিত।

তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র আদানা। এখানে অনেক কর্পোরেট এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক সদর দপ্তর অবস্থিত। TÜYAP প্রদর্শনী এবং সমাবেশ কেন্দ্র মেলা, বাণিজ্যিক সভার আয়োজন করে। এটিই বর্তমানে চুকোরোভা অঞ্চলের বাণিজ্য বিষয়ক প্রধান সম্মেলন।[8] আদানায় পর্যটন শিল্পও সমৃদ্ধ লাভ করছে। এখানে নতুন নতুন বিলাস-বহুল হোটেল নির্মিত হচ্ছে। হিলটন এসএ, সেয়হান, চুকোরোভা সুরমেলি হোটেলগুলো আদানার পাঁচ তারকা বিশিষ্ট হোটেল। এছাড়া সেয়হান নদীর তীরে শেরাটন হোটেল নির্মানাধীন রয়েছে।[9]

ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট পত্রিকা আদানাকে ২০০৬/২০০৭ সালের ভবিষ্যতের সেরা ২৫ ইউরোপিয়ান অঞ্চল-এর অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করেছে। তুরস্কের মধ্যে কেবল কোজায়েলি এবং আদানাই এই খেতাব অর্জন করেছে, তবে কোজায়েলি অবকাঠামোর দিক থেকে আদানার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। জীবন-যাত্রার মান এবং মানব সম্পদ উন্নয়নের দিক থেকে কোজায়েলি এবং আদানা এই তালিকায় প্রায় অণুরূপ পয়েন্ট অর্জন করেছে।[10]

গণমাধ্যম

আদানার গণমাধ্যম সরকারি বা বেসরকারিভাবে চালিত হয়। ইয়েনি আদানা শহরের সবচেয়ে পুরনো পত্রিকা যেটি ১৯১৮ সালে যাত্রা শুরু করে এবং এখনও কার্যকর রয়েছে।[11] এক্সপ্রেস, টোরস, বোলগে স্থানীয় পত্রিকা যেগুলো শুধু আদানাতেই নয়, সমগ্র চুকোরোভা অঞ্চলে প্রচলিত। চুকোরোভা টিভি এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় প্রচার মাধ্যম। ক্যানাল এ, আকদেনিয টিভি, কেন্ট টিভি এখানকার অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেল। অনেক জাতীয় পত্র-পত্রিকার আঞ্চলিক সদর দপ্তর ও প্রকাশনা অফিশ আদানাতে অবস্থিত। তুরস্কের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা হুরিয়েত এই অঞ্চলের জন্য বিশেষায়িত ক্রোড়পত্র হুরিয়েত চুকোরোভা প্রকাশ করে এবং এটিই এখানকার সর্বাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা যার প্রচার সংখ্যা প্রায় ৪৮,০০০।

তথ্যসূত্র

  1. Address-based population survey 2009. Retrieved on 2010-01-25.
  2. weatherbase.com
  3. "İllere göre tarım miktarları"। Turkcebilgi.net। ২৯ এপ্রিল ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
  4. "Distribution Of Sectors in Adana"। Adana Chamber of Industry। সংগ্রহের তারিখ 2007 এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  5. "Türkiye'nin en büyük 500 sanayi kuruluşu arasına Adana'dan sadece 11 firma girdi (Turkish)"। Zaman Gazetesi। ৪ অক্টোবর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
  6. "Marsan Adana Plant"। Marsan। ৪ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
  7. "Advansa Adana Plant"। Advansa।
  8. "Adana Exhibition and Congress Center"। TÜYAP। ১৩ নভেম্বর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
  9. "Hotels in Adana"। ÇUKTOB। ১৯ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
  10. "European Regions of the Future"। Foreign Direct Investment Magazine। ১১ মার্চ ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
  11. "Yeni Adana Gazetesi (Turkish)"। ২৩ মে ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।

বহিঃসংযোগ

  1. "December 2013 address-based calculation of the Turkish Statistical Institute as presented by citypopulation.de"
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.