সৈয়দ আলী আহসান

সৈয়দ আলী আহসান (২৬ মার্চ ১৯২২ - ২৫ জুলাই ২০০২) বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক, কবি, সাহিত্য সমালোচক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। তিনি তার পাণ্ডিত্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। সৈয়দ আলী আহসান কৃত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের ইংরেজি অনুবাদ সরকারি ভাষান্তর হিসাবে স্বীকৃত।[1]

সৈয়দ আলী আহসান
চিত্র:সৈয়দ আলী আহসান (১৯২০-২০০২).jpg
জন্ম(১৯২০-০৩-২৬)২৬ মার্চ ১৯২০
আলোকদিয়া, মাগুরা, বাংলাদেশ
মৃত্যু২৫ জুন ২০০২(2002-06-25) (বয়স ৮২)
জাতীয়তাবাংলাদেশী

জন্ম ও কর্মজীবন

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সম্পাদক, অনুবাদক ও জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ বর্তমান মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পুরোনো ঢাকা শহরের আরমানিটোলায় অবস্থিত আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স (এসএসসি) এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে এফএ (এইচএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক (বিএ)এবং ১৯৪৪ সালে স্নাতকোত্তর (এমএ) ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতা চলে যান। সেখানেই বিয়ে করেন ৭ জুলাই, ১৯৪৬।[2] অত:পর যথাক্রমে অল ইন্ডিয়া রেডিও কলকাতা কেন্দ্রে এবং রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে কর্মসূচি নিয়ামকরূপে চাকরি করেছেন। তিনি ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ আলী আহসান করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর পরিচালক (প্রধান নির্বাহী) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।[1] এরপর পুনরায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের[3] উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুলাই তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব

১৯৭৭-৭৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও ধর্ম সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত ছিলেন। সুইডেনের নোবেল কমিটির সাহিত্য শাখার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাতীয় অধ্যাপক হিসাবে অভিষিক্ত হন এবং সে বছরই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। শেষ বয়সে দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও তিনি শিক্ষিতমহলে বেশ পরিচিত।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

১৯৭১ খ্রীস্টাব্দে সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি "চেনাকণ্ঠ" ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন।

সাহিত্যকর্ম

কবিতা সম্বন্ধে সৈয়দ আলী আহসানের ধ্যান-ধারণা সমকালীন কবিদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে তেমন একটা সাজুয্য রক্ষা করে চলেনি। যদিও তার রচনরায় রয়েছে ঐতিহ্য-চেতনা, সৌন্দর্যবোধ এবং স্বদেশপ্রীতি, যা অন্য কবিদের লেখাতেও বর্তমান।[4] কবির অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’কে সেরা সংকলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[4] ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ কাব্যগ্রন্থে প্রধানত গদ্য-কবিতা স্থান পেয়েছে, সেই গদ্য-কবিতা রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিশের কবিদের গদ্য-কবিতা থেকে পৃথক, কেন না তার কবিতায় উপমা ও শব্দ ব্যবহারে রয়েছে নতুনত্ব ও আধুনিকতা। উপমা ব্যবহারে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তার পার্থক্য এই যে জীবনানন্দে আছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপমা আর সৈয়দ আলী আহসান প্রধানত ব্যবহার করেছেন বিমূর্ত উপমা। তার উপমার কারুকাজ, স্থাপনা কৌশল সচেতন পাঠককে মুগ্ধ করে। তার ‘একশ সন্ধ্যায় বসন্ত’ কাব্য সংকলনের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘প্রার্থনা’ ও ‘আমার পূর্ববাংলা’ কবিতাদ্বয়।[4] তার কবি প্রতিভার উদাহরণ পাওয়া যায় নিম্নোক্ত চরণগুলোতে-[4]

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ

সৈয়দ আলী আহসানের প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা নিচে প্রদান করা হলো। এ ছাড়াও তিনি আরো কিছু গ্রন্থ রচনা করেন।।

কাব্যগ্রন্থ

  • অনেক আকাশ (১৯৬০),
  • একক সন্ধ্যায় বসন্ত (১৯৬২),
  • সহসা সচকিত (১৯৬৮),
  • উচ্চারণ (১৯৬৮),
  • আমার প্রতিদিনের শব্দ (১৯৭৩)
  • প্রেম যেখানে সর্বস্ব

প্রবন্ধ গ্রন্থ

  • বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ) মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সাথে (১৯৫৬)
  • কবিতার কথা (১৯৫৭)
  • কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা (১৯৬৮)
  • আধুনিক বাংলা কবিতা : শব্দের অনুষঙ্গে (১৯৭০)
  • রবীন্দ্রনাথ : কাব্য বিচারের ভূমিকা (১৯৭৩), মধুসূদন : কবিকৃতি ও কাব্যাদর্শ (১৯৭৬)
  • আধুনিক জার্মান সাহিত্য (১৯৭৬)
  • যখন কলকাতায় ছিলাম, আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ২০০৪
  • বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস মধ্যযুগ
  • শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য
  • জীবনের শিলান্যাস

সম্পাদিত গ্রন্থ

  • পদ্মাবতী (১৯৬৮),
  • মধুমালতী (১৯৭১)

অনূদিত গ্রন্থ

  • ইকবালের কবিতা (১৯৫২),
  • প্রেমের কবিতা (১৯৬০),
  • ইতিহাস (১৯৬৮)

ইসলামি গ্রন্থ

  • মহানবী
  • আল্লাহ আমার প্রভু

অন্যান্য গ্রন্থ

  • যখন সময় এলো
  • রক্তাক্ত বাংলা
  • পাণ্ডুলিপি
  • বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা
  • রজনীগন্ধা
  • চর্যাগীতিকা
  • আমাদের আত্মপরিচয় এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
  • ১৯৭৫ সাল
  • বাংলাদেশের সংস্কৃতি

কবি প্রতিভার মূল্যায়ন

সেনেগালের সাবেক প্রেসিডেন্ট, ফরাসি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি লিউপোল্ড সেডর সেংঘর ছিলেন কবি সৈয়দ আলী আহসানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।[5] সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ে লেখা তার কবিতায় তিনি বলেছিলেন :

সেংঘরের এই কথা যে যথার্থ, তার প্রমাণ আমরা পাব অন্নদাশংকর রায়ের লেখায় : “তিনি একজন সত্যিকার কবি। যেমন হৃদয়বান, তেমনি রূপদর্শী। যে ভাষায় তিনি লেখেন, তা খাঁটি বাংলা। তাঁর কবি পরিচয়ই শ্রেষ্ঠ পরিচয়।”[5]

আধুনিক উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি কলিম সাসারামী সৈয়দ আলী আহসানের ষাটতম জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন এই বলে : ‘যখন বিধাতা সাহিত্যের জন্য একটি উজ্জ্বল কেন্দ্রবিন্দুর কথা ভাবলেন, সৈয়দ আলী আহসান সাহিত্যের দিগন্তে আবির্ভূত হলেন কিরণসঞ্চারি সূর্যের মতো। এবং তখন কাব্যলোক আনন্দের সারত্সার এবং উচ্ছলতা-উত্ফুল্লে নৃত্যরত হলো। স্বর্গ থেকে ধরিত্রী পর্যন্ত উপাদান সঙ্গীতে সমৃদ্ধ হলো।’[5]

পুরস্কার ও সম্মাননা

  • বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৮),
  • দাউদ পুরস্কার (১৯৬৯ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাক্কালে প্রত্যাখ্যান),
  • শেরে বাংলা পুরস্কার [6]
  • সুফি মোতাহার হোসেন স্বর্ণপদক (১৯৭৬),
  • বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ব একুশে পদক (১৯৮২),
  • নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৫),
  • মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৫),
  • স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮৭) [6][7]
  • জাতীয় অধ্যাপকরূপে নিযুক্তি (১৯৮৯)।
  • কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর)-২০০৩

তথ্যসূত্র

  1. "বাংলাপিডিয়ায় সৈয়দ আলী আহসান"
  2. "সৈয়দ আলী আহসান : 'এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে'"। ১৩ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ অক্টোবর ২০০৯
  3. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসিদের তালিকা
  4. ড. গুলশান আরা। "বহুমাত্রিক প্রতিভা সৈয়দ আলী আহসান"। ইনকিলাব। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জুলাই ২০১৩
  5. আবদুল হাই শিকদার। "মহাপ্রাণ সৈয়দ আলী আহসান"। আমার দেশ। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ জুলাই ২০১৩
  6. "স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত সৈয়দ আলী আহসান"। ৫ মে ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ অক্টোবর ২০০৯
  7. "স্বাধীনতা দিবস পদক প্রাপ্তদের তালিকা" (PDF)। ২১ নভেম্বর ২০১১ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১২
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.