মোবারক হোসেন খান

মোবারক হোসেন খান (২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮ – ২৪ নভেম্বর ২০১৯) একজন বাংলাদেশী সঙ্গীত গবেষক ও লেখক ছিলেন।[1] উপমহাদেশের অন্যতম এক সঙ্গীত পরিবারে তার জন্ম। স্বাধীনতা উত্তর তিনি বাংলাদেশ বেতারবাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একুশে পদক, ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ভূষিত হন এবং ২০০২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।[2]

মোবারক হোসেন খান
জন্ম(১৯৩৮-০২-২৭)২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮
মৃত্যু২৪ নভেম্বর ২০১৯(2019-11-24) (বয়স ৮১)
জাতীয়তাবাংলাদেশী
শিক্ষাইতিহাস
যেখানের শিক্ষার্থীঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পেশাপ্রোগ্রাম প্রডিউসার, সঙ্গীত গবেষক, লেখক
কার্যকাল১৯৬২-বর্তমান
উল্লেখযোগ্য কর্ম
দাম্পত্য সঙ্গীফৌজিয়া ইয়াসমিন
সন্তানরিনাত ফৌজিয়া (কন্যা)
তারিফ হায়াত খান (পুত্র)
তানিম হায়াত খান (পুত্র)
পিতা-মাতাওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ (পিতা)
উমর-উন-নেসা খানম (মাতা)
আত্মীয়আলাউদ্দিন খাঁ (চাচা)
আবেদ হোসেন খান (ভাই)
বাহাদুর হোসেন খান (ভাই)
পুরস্কারএকুশে পদক (১৯৮৬)
স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৪)
বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০০২)
ওয়েবসাইটদাপ্তরিক ওয়েবসাইট

প্রাথমিক জীবন

মোবারক হোসেন ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[3] তার পিতা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ একজন প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী এবং মাতা উমার উন-নেসা। তার চাচা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ। ছয় ভাইবোনের মধ্যে মোবারক সর্বকনিষ্ঠ। তার বড় তিন বোন আম্বিয়া, কোহিনূর, ও রাজিয়া এবং বড় দুই ভাই প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ আবেদ হোসেন খানবাহাদুর হোসেন খান[2]

পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী বড় দুই ভাই সঙ্গীতে মগ্ন। তাই তার পিতা চেয়েছিলেন তিনি যেন সঙ্গীতের পাশাপাশি পড়াশুনা করেন। এজন্য সঙ্গীতে দীক্ষা গ্রহণের পূর্বে তিনি মাইনর স্কুলে প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ গ্রহণ করেন। দেশ বিভাগের পূর্ব থেকে তার পিতার গান শিখানোর উদ্দেশ্যে কুমিল্লা জেলায় যাতায়াত ছিল এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তারা সপরিবারে সেখানে চলে যান। মোবারক সেখান কুমিল্লা জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৫২ সালে মেট্রিক পাস করেন। পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।[2]

কর্মজীবন

মোবারক হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে ২০ অক্টোবর, ১৯৬২। পরে তিনি বেতারের মহাপরিচালক হিসেবে ৩০ বছর কর্মরত ছিলেন। এসময়ে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার সঙ্গীত বিষয়ক লেখা কেউ প্রকাশের দায়িত্ব না নিতে চাইলে তা প্রকাশের দায়িত্ব নেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। লেখালেখি সূত্রে পরিচয় হন কবি আল মাহমুদের সাথে। আল মাহমুদ তখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক। তার মাধ্যমে ১৯৮০ সালে শিল্পকলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করেন তার প্রথম সঙ্গীত বিষয়ক বই সংগীত প্রসঙ্গ। বিভিন্ন পত্রিকায় তার সঙ্গীত বিষয়ক লেখা নিয়ে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় বই বাদ্যযন্ত্র প্রসঙ্গ। এরপর তিনি রচনা করেন সঙ্গীত মালিকা। এই বইটিও প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। পরবর্তীতে তিনি সঙ্গীত ও শিশু বিষয়ক ৫০টির মত গ্রন্থ রচনা করেন।[2]

ব্যক্তিগত জীবন

মোবারক হোসেন সঙ্গীতশিল্পী ফৌজিয়া ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন। তাদের তিন সন্তান - কন্যা রিনাত ফৌজিয়া সঙ্গীতশিল্পী,[4] পুত্র তারিফ হায়াত খান স্থপতি এবং অপর পুত্র তানিম হায়াত খান।[5]

প্রকাশিত গ্রন্থাবলী

সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ

বাংলা ভাষায়
  • সংগীত প্রসঙ্গ (১৯৮০), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি
  • ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ (১৯৮১), মুক্তধারা, ঢাকা।
  • বাদ্যযন্ত্র প্রসঙ্গ (১৯৮২), বাংলা একাডেমি
  • রাগ সংগীত (১৯৮৫), বাংলা একাডেমি।
  • যন্ত্রসাধন (১৯৮৬), বাংলা একাডেমি।
  • সংগীত গুনীজন (১৯৮৬), ঢাকা: মুক্তধারা।
  • ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ ও তার পত্রাবলি (১৯৮৬), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি
  • সংগীত মালিকা (১৯৮৭), বাংলা একাডেমি
  • কণ্ঠসাধন (১৯৮৯), বাংলা একাডেমি
  • মুক্তিযুদ্ধের গান (১৯৯১), ঢাকা: শোভা প্রকাশ।
  • ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ (১৯৯৪), ঢাকা: আগামী প্রকাশনী।
  • আমি যে বাজিয়েছিলেম (১৯৯৭), একাডেমিক প্রেস এন্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি।
  • সংগীত দর্পণ (১৯৯৯), বাংলা একাডেমি
  • উচ্চাঙ্গ সংগীত (১৯৯৯), বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
  • গড়লো যারা সুরের তাজমহল (১৯৯৯), ঢাকা: মুক্তধারা।
  • সংগীতামৃত (২০০১), ঢাকা: শোভা প্রকাশ।
  • ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ : জীবন ও সাধনা (২০০৩), বাংলা একাডেমি
  • সংগীতসাধক অভিধান (২০০৩), বাংলা একাডেমি।
  • আমার সংগীত স্বজন (২০০৪), ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স।
  • গীত মঞ্জুরী (২০০৫), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি
  • নজরুল সংগীতের বিচিত্র ধারা (২০০৫), নজরুল ইনস্টিটিউট।
  • সুরের স্বরলিপি, ঢাকা: মুক্তধারা।
  • সঙ্গীত সন্দর্শন, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ।
  • নজরুল সংগীত প্রসঙ্গ, সুচয়নী পাবলিশার্স।
  • বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ সঙ্গীতজ্ঞ, সাহিত্য প্রকাশ।
ইংরেজি ভাষায়
  • Music and its study (সংগীত ও এর গবেষণা) (১৯৮৮), নয়াদিল্লী: স্টারলিং পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
  • Islamic Contribution to South Asia's Classical Music (দক্ষিণ এশিয়ার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে মুসলমানদের অবদান) (১৯৯২), নয়াদিল্লী: স্টারলিং পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
  • Ustad Alauddin Khan: The Legend in Music (ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান: সঙ্গীতের কিংবদন্তী) (২০০২), নয়াদিল্লী: স্টারলিং পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।

শিশুতোষ সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ

  • সুর লহরী (১৯৭০, পুনঃমুদ্রণ ১৯৭২), বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
  • সুরের রাজা (১৯৭৯), ঢাকা: মুক্তধারা।
  • সুর নিয়ে যার খেলা (১৯৮১), বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।
  • ছোটদের আলাউদ্দিন (১৯৮২), বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
  • সুরেলা টইটম্বুর (১৯৯৯), ঢাকা: শোভা প্রকাশ।
  • ছোটদের সারেগামা ও সংগীতবিদ্যা (২০০২), ঢাকা: আহমদ পাবলিশিং হাউজ।
  • ছোটদের সংগীত গুনীজন (২০০৪), ঢাকা: মাম্মী প্রকাশনী।

অনুবাদ

  • আইভানহো (১৯৭৮), ঢাকা: মুক্তধারা।
  • নিসঙ্গ (১৯৭৯), বাংলা একাডেমি।
  • ক্যাপ্টেন-দুহিতা (১৯৮১), ঢাকা: মুক্তধারা।
  • শিকারীর গুহা (১৯৮১), বাংলা একাডেমি।
  • তিন তরঙ্গ (১৯৮৩), বাংলা একাডেমি।
  • আফ্রিকার নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫), ঢাকা: রূপম প্রকাশনী।
  • পৃথিবীর সেরা গল্প (১৯৮৫), ঢাকা: বিউটি বুক হাউজ।
  • নোবেল বিজয়ীদের নির্বাচিত গল্প (১৯৯১), ঢাকা: রূপম প্রকাশনী।
  • নোবেল পুলিৎজার ও ‍বুকার বিজয়ীদের শ্রেষ্ঠ গল্প, পলল প্রকাশনী।
  • শতাব্দীর সেরা গোয়েন্দা রহস্য, ঝিনুক প্রকাশ।

শিশুতোষ

  • একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, আহমদ পাবলিশিং হাউজ।
  • মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, জনতা প্রকাশ।
  • গ্রামীণ গল্প, শিকড়।
  • এশিয়ার লোককাহিনী, অয়ন প্রকাশন।
  • রবিন হুড, প্রকাশ ভবন।
  • সাগরের হাতছানি, প্রকাশ ভবন।
  • সিন্ডারেলা, জনতা প্রকাশ।
  • কুমির আর শিয়াল, জনতা প্রকাশ।
  • চরকা বুড়ি, জনতা প্রকাশ।
  • বুদ্ধির জয়, জনতা প্রকাশ।
  • উপকারের ফল, জনতা প্রকাশ।
  • সততার পুরস্কার, জনতা প্রকাশ।

উপন্যাস

  • হত্যাকারী (১৯৮৫), ঢাকা: সেবা প্রকাশনী।
  • নিহত আগন্তুক (১৯৮৭), ঢাকা: অক্ষর প্রকাশনী।

আত্মজীবনী

  • জীবন স্মৃতি (১৯৯৮), ঢাকা: আগামী প্রকাশনী।
  • আমার যুগ আমার স্মৃতি (১৯৯৯), ঢাকা: শোভা প্রকাশ।

সম্মাননা

  • শিল্পকলায় অবদানের জন্য ১৯৮৩ সালে একুশে পদক
  • সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে পেয়েছেন 'কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক'।
  • সঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার।
  • ২০০২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার।
  • অনুবাদে 'অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার'।[2]
  • ২০০৮ সালে একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়া থেকে সংবর্ধনা।[6]

মৃত্যু

মোবারক হোসেন খান ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[3][7][8]

তথ্যসূত্র

  1. চৌধুরী, তিতাস (৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩)। "মোবারক হোসেন খান: সত্য ও সুন্দরে যার বসবাস"দৈনিক যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মে ২০১৭
  2. সারওয়ার, সাবিত (৭ জানুয়ারি ২০১৪)। "মোবারক হোসেন খান: তিতাস তীরের সঙ্গীতবিশারদ"যায়যায়দিন। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মে ২০১৭
  3. "সংগীত ব্যক্তিত্ব মোবারক হোসেন খান আর নেই"প্রথম আলো। ২৪ নভেম্বর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২৪ নভেম্বর ২০১৯
  4. "Family ties: Performances by scions of the Khan family"দ্য ডেইলি স্টার। ৬ ডিসেম্বর ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মে ২০১৭
  5. "Mobarak Hossain Khan Biography"Mobarak Hossain Khan। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মে ২০১৭
  6. "একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়া কর্তৃক সম্মানিত উস্তাদ মোবারক হোসেন খান"সিডনিবাসী বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ মে ২০১৭
  7. "চলে গেলেন সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ মোবারক হোসেন"কালের কণ্ঠ। ২৪ নভেম্বর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২৪ নভেম্বর ২০১৯
  8. "মোবারক হোসেন খান আর নেই"ভোরের কাগজ। ২৪ নভেম্বর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২৪ নভেম্বর ২০১৯

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.