মধ্যমাঠের খেলোয়াড়
ফুটবল নামক ক্রীড়াতে মধ্যমাঠ (ইংরেজিতে "মিডফিল্ড") এমন একটি অবস্থান যেটি আক্রমণভাগ ও রক্ষণভাগের মাঝামাঝি (চিত্রে নীল রঙ দিয়ে দেখানো হয়েছে)। মধ্যমাঠের খেলায়াড় (ইংরেজিতে "মিডফিল্ডার") হচ্ছেন মধ্যমাঠে খেলা একজন খেলোয়াড় যিনি আক্রমণভাগ ও রক্ষণভাগ দুটি অংশকেই সহায়তা করেন। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে ট্যাক্লের বা বল ছিনিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে বলের নিয়ন্ত্রণ নেয়া, আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের কাছে নিয়মিত বলের যোগান দেয়া এবং সম্ভব হলে গোল করা। কোন কোন মধ্যমাঠের খেলোয়াড় অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল অবস্থানেও খেলে থাকেন এবং অনেকে আবার মধ্যমাঠ ও আক্রমণভাগের মধ্যবর্তী দেয়াল ভাঙতেও পারদর্শী। দলে প্রয়োজন অনুযায়ী মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের সংখ্যার তারতম্য হতে পারে।

অসাধারণ মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের কয়েকটি গুণাবলি থাকে যেমন: তারা ট্যাক্লিং, ড্রিব্ল, শ্যুট, পাস দেয়া প্রভৃতিতে দক্ষ। সাধারণত দলে একজন মূল মধ্যমাঠের খেলোয়াড় থাকেন যিনি বিপক্ষ দলের বর্মভেদের চেষ্টা করে সুযোগ তৈরি করেন। বাকী মধ্যমাঠের খেলোয়াড়েরা সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোল করতে চেষ্টা করেন। সাধারণত যেকোন প্রান্তে উইঙ্গার বাপার্শ্বভাগের খেলোয়াড় বা বিশেষজ্ঞ পার্শ্বীয় মধ্যমাঠের খেলোয়াড়েরা আক্রমণের দায়িত্বে থাকেন।
একজন ভাল মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের লড়াই করার ক্ষমতা থাকতে হবে ও তাকে সৃষ্টিশীলও হতে হবে। মধ্যমাঠের সাহায্য ছাড়া একজন ভাল লক্ষ্যভেদী খেলোয়াড় বা স্ট্রাইকার যেমন আক্রমণ শানাতে পারে না, তেমনি রক্ষনভাগকেও প্রতি-আক্রমণের জবাব দিতে ব্যস্ত থাকতে হয়। যেহেতু মধ্যমাঠের খেলোয়াড়েরা মাঠের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের দায়িত্বে থাকেন, সেহেতু খেলার জয়-পরাজয়ের নিয়ামক হচ্ছেন তারাই।
মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের মাঠে সবচেয়ে বেশি শক্তি খরচ করতে হয় কেননা তাদেরকে রক্ষণভাগের ডাকেও সাড়া দিতে হয় আবার আক্রমণভাগকে সহায়তা করতেও সচেষ্ট থাকতে হয়।
কেন্দ্রীয় মধ্যমাঠের খেলোয়াড়
কেন্দ্রীয় মধ্যমাঠের খেলোয়াড় বা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডাররা খেলায় বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে থাকেন। বিশেষ করে কোন আক্রমণের সূচনায় তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মাঠে তাদের অবস্থান তাদেরকে খেলার সর্ববিষয়ে নজর রাখার সুযোগ করে দেয়, এবং তাদের অঞ্চল থেকেই খেলার অধিকাংশ আক্রমণের সূচনা ঘটে। মাঠের এই অংশটিকে একটি দলের “ইঞ্জিন ঘর” হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করা হয়, কারণ বিখ্যাত দলগুলো সুদক্ষ এবং ক্ষমতাসম্পন্ন মধ্যমাঠের খেলোয়াড় ছাড়া খুব কমই সফলতা পেয়েছে।
"বাক্স-থেকে-বাক্স" মধ্যমাঠের খেলোয়াড়
সবচেয়ে বেশি সম্মুখগতিবিশিষ্ট বহুমুখী মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের বোঝাতে বাক্স-থেকে-বাক্স (বক্স-টু-বক্স) পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়। "বাক্স-থেকে-বাক্স" মধ্যমাঠের খেলোয়াড়রা রক্ষণাত্মক এবং আক্রমণাত্মক উভয় ভূমিকাই পালন করতে পারেন।[1] তারা সাধারণত বল কেড়ে নেওয়া, পাস দেওয়া, শুট করা এবং বল দখলে রাখার ব্যাপারে দক্ষ হয়ে থাকেন। এ ধরনের মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের মধ্যে ইয়াইয়া তোরে, স্টিভেন জেরার্ড, প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
পার্শ্বীয় মধ্যমাঠের খেলোয়াড়
খেলার মাঠে বামদিকের এবং ডানদিকের মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের ভূমিকা কেন্দ্রীয় মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের মতই। তবে তার মাঠের পার্শ্বরেখারর খুব নিকটে অবস্থান করে। ডানদিকের মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলেন ডেভিড বেকহ্যাম।[2] বর্তমানে ৪-৪-২ বা ৪-৪-১-১ সজ্জায় ডানদিকে, কেন্দ্রে এবং বামদিকে মধ্যমাঠের খেলোয়াড়েদের দেখা যায়।[3]
রক্ষণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড়

রক্ষণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড় (ইংরেজিতে "ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার" বা "হোল্ডিং মিডফিল্ডার") হলেন তারা, যারা দলে রক্ষণভাগকে সাহায্য করার জন্য রক্ষণভাগের সামনে অবস্থান করেন। এই বিশেষজ্ঞ মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের দায়িত্ব হচ্ছে বিপক্ষ দলের আক্রমণ প্রতিহত করা, তাদের কাছ থেকে বল ছিনিয়ে নেয়া এবং অধিকতর আক্রমণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড়কে বলের যোগান দেয়া। রক্ষণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের আরেকটি দায়িত্ব হচ্ছে বলের নিয়ন্ত্রণ আদায় করার পর আক্রমণের সূচনা করা। রক্ষণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড়রা অনেক সময় ফুল-ব্যাক বা সেন্টার-ব্যাকের দায়িত্বও পালন করেন, যখন এই অবস্থানের খেলোয়াড়রা আক্রমণভাগে যোগ দেওয়ার জন্য মাঠে উপরের দিকে চলে যান।[4] এই ধরনের মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের ৪–২–৩–১ এবং ৪–৪–২ ডায়মন্ড সজ্জা বা ফরমেশনে দেখা যায়।[5] এধরনের খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার পাশাপাশি আক্রমণের সূচনাও করেন।
চিরাচরিত প্লেমেকার
ফুটবলে একজন প্লেমেকার দলের আক্রমণাত্মক খেলার ধারা নিয়ন্ত্রণ করেন। প্লেমেকাররা সাধারণত নম্বর ১০ বা ৮ হয়ে থাকেন। একজন প্লেমেকারের সবচেয়ে ভাল গুন হল তার খেলার ধারাটিকে বুঝতে পারার ক্ষমতা। মাঠের উপযুক্ত অবস্থানে থেকে সতীর্থদের ঠিকমত বলের যোগান দেওয়াটাও তার একটি গুরুদায়িত্ব। একজন প্লেমেকারের আরও দুটি গুন হল স্বজ্ঞা এবং সৃজনশীলতা। তাদেরকে জানতে হয় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন খেলোয়াড় কোথায় অবস্থান করছেন। একজন ভাল প্লেমেকার বল নিয়ন্ত্রন এবং ড্রিবলিং-এ দূর্দান্তভাবে দক্ষ হয়ে থাকেন। এছাড়া তিনি বল নিজের নিয়ন্ত্রনে রাখতেও সমর্থ হন, ফলে সতীর্থরা আক্রমণাত্মক দৌড় শুরু করতে পারেন। তখন প্লেমেকারের দায়িত্ব হয় চূড়ান্ত পাসটি করা, যা শেষপর্যন্ত গোলে পরিণত হতে পারে। ফুটবলে এটিকে বলা হয় কিলার বল বা ফাইনাল বল। তবে দাপ্তরিকভাবে এটিকে বলা হয় এসিস্ট বা সহায়তা। এই ধরনের খেলোয়াড়দের মধ্যে মেসুত ওজিল, কাকা, সিনজি কাগাবা, হুয়ান মাতা, স্যান্তি কাজোর্লা এবং মারিও গোঁতজে, রোনাল্ডিহো উল্লেখযোগ্য।[6]
ডিপ-লায়িং প্লেমেকার
কোন কোন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারগণ যেকোন অবস্থান থেকে আক্রমণ রচনা করতে পছন্দ করেন। এ ধরনের মিডফিল্ডারগণ "ডিপ-লায়িং প্লেমেকার" নামে পরিচিত। এরা খেলাকে মাঠে ছড়িয়ে দিতে এবং যেকোন অবস্থান থেকে আক্রমণের সূচনা করতে পারেন। তবে বল রক্ষায় তাদের দুর্বলতার কারনে সাধারণত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারগণ তাদের সহযোগিতা করে থাকেন। এ ধরনের খেলোয়াড়দের মধ্যে সেস ফ্যাব্রিগাস, ইভান কাম্পো, আন্দ্রে পিরলো, জাবি আলোনসো, মাইকেল এসিয়েন (যখন তিনি ঘানার হয়ে খেলেন), জাভি হার্নান্দেজ, ডেভিড পিজারো, ইউজেনিও কোরিনি, বিকাশ ধোরাসু এবং মাইকেল ক্যারিক উল্লেখযোগ্য।
ফুটবলে অবস্থানগুলোর মধ্যে এই স্থানটি বেশ নতুন। এটিকে ফুটবলের আদি স্থান সুইপারের বিবর্তন হিসেবে দেখা হয়। যদিও বলা মুশকিল কে প্রথম এই অবস্থানে খেলা শুরু করেছেন, তবে পেপ গার্দিওলা এই অবস্থানের খেলা জনপ্রিয় করেছেন বলে ধরা হয়।
আক্রমণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড়
আক্রমণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড় (ইংরেজিতে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার) এমন একজন মধ্যমাঠের খেলোয়াড় যিনি সাধারণ মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের সামনে থেকে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের বলের যোগান দেন এবং কখনও কখনও নিজেও আক্রমণ পরিচালনা করেন। একজন আক্রমণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড় চমত্কার কলাকৌশন, পাসিং এবং ড্রিবলিং এর অধিকারী হন।
তিনি সাধারণত দলের আক্রমণভাগের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। লক্ষ্যভেদী খেলোয়াড় (বা স্ট্রাইকারদের) ঠিক পেছনে কেন্দ্রীয় মধ্যমাঠ অবস্থানে খেললে তাকে “প্লেইং ইন দ্য হোল” বা “ডিপ লাইং ফরোয়ার্ড” (গভীরে অবস্থিত আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়) বলা হয়, ঐতিহ্যগতভাবে তাকে নম্বর ১০-ও বলা হয়। একজন আক্রমণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড়ের মূল দায়িত্ব হল নিজ দলের জন্য গোলের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া, এমনকি নিজেও গোল করা। ফুটবলে এই অবস্থানটিকে প্লেমেকারও বলা হয়।[7]
বর্তমান সময়ের সেরা আক্রমণাত্মক মধ্যমাঠের খেলোয়াড়দের মধ্যে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, সেস ফ্যাব্রিগাস, মেসুত ওজিল, ডেভিড সিলভা, কেভিন-প্রিন্স বোয়াতেং, ওয়েসলি স্নেইডার, সামির নাসরি, লুকা মদ্রিচ, সান্তি কাজোরলা, জ্যাক উইলশেয়ার এবং মারিও গোটজে উল্লেখযোগ্য।
ফলস নম্বর-১০ বা ‘‘সেন্ট্রাল উইঙ্গার’’
ফলস নম্বর-১০ বা “সেন্ট্রাল উইঙ্গার”[8] আধুনিক ফুটবলে একটি নতুন ধরনের মিডফিল্ডার অবস্থান। একজন চিরাচরিত প্লেমেকার যেখানে স্ট্রাইকারের পেছনে মাঠের মাঝখানে অবস্থান কর স্ট্রাইকারকে সহায়তা করেন, সেখানে একজন ফলস নম্বর-১০ মাঠের মাঝখানে অবস্থান করে উইঙ্গার এবং ফুলব্যাক উভয়দেরকেই সহায়তা করা। ফলস নম্বর-১০ সাধারণত একজন চিরাচরিত উইঙ্গার যারা মাঠের মাঝখানে খেলে থাকেন। ফলস নম্বর-১০ এর কারণে একটি দল মাঠের মাঝখানে অধিক মিডফিল্ডারের সুবিধা পেয়ে থাকে। ম্যাথিউ ভ্যালবুয়েনা এধরনের খেলোয়াড়দের একটি উদাহরণ। অলিম্পিক মার্শেই বা ফ্রান্সের হয়ে খেলার সময় তিনি সেন্ট্রাল উইঙ্গার হিসেবে খেলেন।[9] আরেকটি ভাল উদাহরণ আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, যখন তিনি বার্সেলোনা বা স্পেনের হয়ে খেলেন। রিয়াল মাদ্রিদের জার্মান প্লেমেকার মেসুত ওজিলকেও “সেন্ট্রাল উইঙ্গার” হিসেবে গন্য করা হয়।[10] এছাড়া লিওনেল মেসিও বার্সেলোনা বা আর্জেন্টিনার হয়ে খেলার সময় কখনও কখনও এই অবস্থানে খেলে থাকেন।[11]
উইঙ্গার
আরও দেখুন
- গোলরক্ষক
- রক্ষণভাগের খেলোয়াড়
- আক্রমণভাগের খেলোয়াড়
তথ্যসূত্র
- "Box to box Bowyer"। বিবিসি (লন্ডন)। ২৯ এপ্রিল ২০০২। সংগ্রহের তারিখ ১ মার্চ ২০১৩।
- Taylor, Daniel (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০)। "Milan wrong to play David Beckham in central midfield says Sir Alex Ferguson"। দ্য গার্ডিয়ান। ইংল্যান্ড। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৩।
- "Formations guide"। বিবিসি স্পোর্ট। লন্ডন। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৩।
- Cox, Michael (৩ মার্চ ২০১০)। "Analysing Brazil's fluid system at close quarters"। zonalmarking.net। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৩।
- Cox, Michael (২৯ জুলাই ২০১০)। "Teams of the Decade #11: Valencia 2001-04"। zonalmarking.net। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১৩।
- http://dictionary.reference.com/browse/playmaker
- "Football / Soccer Positions"। Expert Football। ২১ ডিসেম্বর ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ৪ মার্চ ২০১৩।
- "Introducing…the central winger?"। Zonal Marketing। ৩ ডিসেম্বর ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মে ২০১৩।
- "Spain 1-1 France: Deschamps' formations witch results in late France dominance"। Zonal Marketing। ১৭ অক্টোবর ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মে ২০১৩।
- "Germany 2-1 Holland: German flexibility outwits the static Dutch midfield"। Zonal Marketing। ১৪ জুন ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মে ২০১৩।
- "Tactics: The 'false 10' – a clarification"। ২৬ জানুয়ারি ২০১২। ১০ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ মে ২০১৩।