প্যারাগুয়ে

প্যারাগুয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ-মধ্যভাগে অবস্থিত একটি ভূমিবেষ্টিত রাষ্ট্র। এর সরকারি নাম প্যারাগুয়ে প্রজাতন্ত্র (স্পেনীয় ভাষায় República del Paraguay রেপুব্লিকা দেল পারাগুয়াই; গুয়ারানি ভাষায় Tetã Paraguái তেতাঁ পারাগুয়াই)। দেশটি পারাগুয়াই নদী এবং পারানা নদীর মাধ্যমে দক্ষিণের প্রতিবেশী রাষ্ট্র আর্জেন্টিনা এবং আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত। প্যারাগুয়ের রাজধানী ও বৃহত্তম শহরের নাম অ্যাসুনসিওন। ১৫৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত শহরটি পারাগুয়াই নদীর তীরে অবস্থিত দেশটির প্রধান নদীবন্দর। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে বলিভিয়া, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে ব্রাজিল এবং দক্ষিণে আর্জেন্টিনার সাথে সীমান্ত আছে।

Republic of Paraguay
República del Paraguay  (স্পেনীয়)
Tetã Paraguái
পতাকা জাতীয় মর্যাদাবাহী নকশা
নীতিবাক্য: Paz y justicia  (স্পেনীয়)
"Peace and justice"
জাতীয় সঙ্গীত: Paraguayos, República o Muerte  (স্পেনীয়)
প্যারাগুয়ের অবস্থান
রাজধানী
এবং বৃহত্তম নগরী
অ্যাসুনসিওন
২৫°১৬′ দক্ষিণ ৫৭°৪০′ পশ্চিম
সরকারি ভাষা স্পেনীয়, গুয়ারানি[1]
জাতীয়তাসূচক বিশেষণ Paraguayan
সরকার Constitutional republic
   President ফের্নান্দো লুগো
   Vice President Federico Franco
Independence from Spain
   Declared মে ১৪ ১৮১১ 
   মোট  কিমি (59th)
 বর্গ মাইল
   জল/পানি (%) ২.৩
জনসংখ্যা
   জুলাই ২০০৫ আনুমানিক ৬,১৫৮,০০০ (১০১তম)
   ঘনত্ব ১৫/কিমি (১৯২তম)
/বর্গ মাইল
মোট দেশজ উৎপাদন
(ক্রয়ক্ষমতা সমতা)
২০০৫ আনুমানিক
   মোট $28.342 billion (৯৬তম)
   মাথা পিছু $৪,৫৫৫ (১০৭তম)
জিনি সহগ (২০১৪)৫১.৭[2]
উচ্চ
মানব উন্নয়ন সূচক (২০০৪)০.৭৫৭
উচ্চ · ৯১তম
মুদ্রা Guaraní (PYG)
সময় অঞ্চল (ইউটিসি-৪)
   গ্রীষ্মকালীন (ডিএসটি)  (ইউটিসি-৩)
কলিং কোড ৫৯৫
ইন্টারনেট টিএলডি .py

পারাগুয়াই নদীটি প্যারাগুয়ে রাষ্ট্রের মাঝ বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে এবং দেশটিকে পূর্ব-পশ্চিমে দুইভাগে ভাগ করেছে। প্যারাগুয়ের বেশির ভাগ জনগণ দেশটির পূর্বভাগে, অর্থাৎ পারাগুয়াই নদীর কাছে অবস্থিত উর্বর সমভূমিগুলিতে অথবা এগুলির পূর্বে ব্রাজিল সীমান্তের কাছে অবস্থিত জঙ্গলাকীর্ণ একটি মালভূমিতে বসবাস করে; এই অঞ্চলটির নাম পারানেনা। নদীর পশ্চিম দিকে গ্রান চাকো নামের একটি বৃহৎ, শুষ্ক সমভূমি অবস্থিত, যা প্যারাগুয়ের মোট ভূখণ্ডের ৬০%-এরও বেশি গঠন করেছে। নদীর কাছাকাছি জায়গাগুলিতে গ্রান চাকো জলাভূমিময়, তবে ক্রমে পশ্চিমদিকে অগ্রসর হলে এটিতে ঝোপঝাড়-গুল্ম ও অরণ্যের দেখা মেলে। এই জনহীন প্রান্তরে বহু বিচিত্র প্রাণীর বাস; ফলে পশুপ্রেমী ও পাখীপ্রেমীরা প্রায়ই এখানে ঘুরতে আসেন। প্যারাগুয়ের জলবায়ু ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় ধরনের; তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর দেখা মেলে। পারানেনা অঞ্চলটি আর্দ্র এবং এখানে সারাবছর ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে চাকো অঞ্চলটিতে পৃথক পৃথক শুষ্ক ও আর্দ্র মৌসুম স্পষ্ট। পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় চাকো অঞ্চলে প্রায়ই বন্যা হয়।

প্যারাগুয়ের পূর্বভাগে যারা আদিতে বসতি স্থাপন করেছিল তারা ছিল গুয়ারানি গোত্রের আদিবাসী আমেরিকান। ১৬শ শতকে এখানে স্পেনীয় উপনিবেশকারীদের পদার্পণ ঘটে। বর্তমানে প্যারাগুয়েতে গুয়ারানি ও স্পেনীয় সংস্কৃতির সমবায়ে একটি মিশ্র সংস্কৃতি প্রচলিত। প্যারাগুয়ের প্রায় সবাই “মেস্‌তিসো” অর্থাৎ স্পেনীয় (তথা ইউরোপীয়) ও গুয়ারানিদের মিশ্রণে গঠিত একটি জাতি। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় প্যারাগুয়ের জনসংখ্যা অনেক সমজাতিক। গুয়ারানি ভাষাটিও টিকে আছে এবং স্পেনীয় ভাষার সাথে এটি প্যারাগুয়ের দুইটি সরকারী ভাষার একটি; ১৯৯২ সালের সংবিধানে গুয়ারানি ভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। লোকশিল্প ও লোকউৎসবগুলিতে গুয়ারানি সংস্কৃতির শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। প্যারাগুয়েবাসীরা প্রচন্ড দেশপ্রেমী এবং তারা গুয়ারানি ভাষাতে কথা বলতে গর্ববোধ করে। এই ভাষা তাদের জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম অংশ। প্যারাগুয়েই দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র দেশ যেখানে আদিবাসী আমেরিকান কোন ভাষা স্পেনীয় বা পর্তুগিজ ভাষার চেয়ে ব্যাপক আকারে কথিত হয়।

প্যারাগুয়ের সিংহভাগ জনগণ দেশের দক্ষিণাংশে বাস করে। সরকার রাজধানী আসুনসিওনকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। আসুনসিওনকে বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং দেশের অবশিষ্টাংশকে ১৭টি জেলায় ভাগ করে শাসন করা হয়। দেশটিকে একজন শক্তিশালী নির্বাহী বিভাগের নেতা নেতৃত্ব দেন, তবে তিনি একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ও বিচার বিভাগের সাথে তার কর্তৃত্ব ভাগ করে নেন। এই পুরো ব্যবস্থাটি সাম্প্রতিকতম জাতীয় সংবিধানে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্যারাগুয়ের বেশিরভাগ ভাগ লোক ক্ষেতখামার ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। প্যারাগুয়ে বিশ্বের বৃহত্তম সয়াবিন উৎপাদনকারী দেশগুলির একটি। দেশের পূর্ব সীমান্তের কাছের উর্বর অঞ্চলে আধুনিক বৈচিত্র্যায়িত কৃষি উৎপাদনের ফলে তুলনামূলকভাবে উচ্চমানের জীবন ধারণ করা সম্ভব। প্যারাগুয়ের কৃষকেরা অতীতে ছোট আয়তনের খামারে একটিমাত্র শস্য ফলাতেন। বর্তমানে সমগ্র দেশজুড়ে সমবায় খামারের সৃষ্টি হয়েছে এবং এতে কৃষকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটেছে। এ সত্ত্বেও ১৮৮০-র দশক থেকে আজ পর্যন্ত ভূমি সংস্কারের ব্যাপারটি সমাধানহীন রয়ে গেছে এবং এ কারণে ১৯৯০-র দশক থেকে ধনী-গরিবের অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। প্যারাগুয়ের বেশির ভাগ বাণিজ্য নাব্য পারাগুয়াই নদীর উপর নির্ভরশীল এবং নদীটি আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে পড়েছে। ফলে প্যারাগুয়ের বৈদেশিক নীতি মূলত আর্জেন্টিনার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল।

প্যারাগুয়েতে অনেক বড় বড় অরণ্য আছে যেগুলি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে। তবে প্যারাগুয়ের অর্থনীতির প্রাণ হল এর নদীগুলি। “পারাগুয়াই” একটি গুয়ারানি শব্দ যার অর্থ “যে নদী সাগরের জন্ম দেয়”। নদীর মাধ্যমে প্যারাগুয়ে আটলান্টিক মহাসমুদ্রের সাথে যুক্ত এবং নদীর উপরেই প্যারাগুয়ের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি অবস্থিত। এগুলির কারণে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎশক্তি রপ্তানিকারী রাষ্ট্রগুলির একটি। ব্রাজিলের দক্ষিণে প্যারাগুয়ের সাথে সীমান্তের কাছে ইতাইপু বাঁধ অবস্থিত, যেটি বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প; এটি দুইটি দেশেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।

প্যারাগুয়ে ১৮১১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। এর আগে এটি একটি স্পেনীয় উপনিবেশ ছিল। প্যারাগুয়ের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাস সংঘাতময় এবং কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন এর মূল বৈশিষ্ট্য। দেশটি দক্ষিণ আমেরিকার মহাদেশের ইতিহাসের তিনটি প্রধান যুদ্ধে দুইটিতে অংশ নেয়। প্রথমটি ছিল ১৮৬৫ সাথে শুরু হওয়া ত্রি-মৈত্রী যুদ্ধ। ঐ বছর প্যারাগুয়ে তার শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলউরুগুয়ের সাথে একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৮৭৯ সালে এই সহিংস যুদ্ধের অবসান ঘটলেও এতে প্যারাগুয়ের অর্ধেক লোকই মৃত্যবরণ করে। এছাড়াও যুদ্ধের ফলস্বরূপ প্যারাগুয়ে তার ভূ-আয়তনের এক-চতুর্থাংশ হারায়। ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত প্যারাগুয়ে বলিভিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যার নাম ছিল চাকো যুদ্ধ। ১৯৪৭ সালে দেশটিতে একটি গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ২০শ শতকের মাঝামাঝি প্যারাগুয়ে সামরিক প্রধান আলফ্রেদো স্ত্রোসনারের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠে। স্ত্রোসনার ১৯৫৪ সালে ক্ষমতা দখল করেন এবং তার সময়ে অনেক ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরশাসক এবং জার্মানির নাৎসি রাজনৈতিক দলের প্রাক্তন সদস্যরা প্যারাগুয়েতে রাজনৈতিক আশ্রয়লাভ করে। স্ত্রোসনার ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন, যে বছর একটি সামরিক অভ্যুত্থানে তার পতন ঘটে। তখন থেকে প্যারাগুয়ে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু করে। স্ত্রোসনার প্যারাগুয়ের জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও নিজমত চেপে রাখার যে সংস্কৃতি সৃষ্টি করেন, তা থেকে তারা কেবল ২১শ শতকে এসেই উত্তরণ করতে শুরু করেছে। ১৯৯৩ সালে দেশটিতে ১৯৫৪ সালের পর প্রথমবারের মত একজন বেসামরিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তবে প্যারাগুয়ে এখনও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে নিমজ্জিত। ১৯৯৯ সালে উপরাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়। এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুয়ান কার্লোস ওয়াসমোসি (১৯৯৩-১৯৯৮) এবং লুইস গোনসালেস মাকচি (১৯৯৯-২০০৩)-র বিচারে শাস্তি হয়। ২০০৮ সালে প্যারাগুয়ের কোলোরাদো পার্টি ১৯৪৭ সালের পরে প্রথমবারের মত ক্ষমতা হারায়; তার আগে এটি অবিচ্ছিন্নভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে দেশ শাসনকারী রাজনৈতিক দল ছিল। তবে ২০১৩ সালে দলটি আবার ক্ষমতায় ফেরত আসে।

ইতিহাস

রাজনীতি

প্রশাসনিক অঞ্চলসমূহ

ভূগোল

অর্থনীতি

জনসংখ্যা

সংস্কৃতি

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. Paraguay - Constitution, Article 140 About Languages, International Constitutional Law Project, ২০০৯-১২-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ 2007-12-03 এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য) (see translator's note)
  2. "Gini Index"World Bank। সংগ্রহের তারিখ ৯ নভেম্বর ২০১৬

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.