পিথাগোরাস

সামোসের পিথাগোরাস (প্রাচীন গ্রিক: Πυθαγόρας ὁ Σάμιος Pythagoras the Samian, অথবা শুধু পিথাগোরাস; খ্রিস্টপূর্ব ৫৭২– ৪৯৭ অব্দ[1][2]) ছিলেন একজন আয়োনীয় গ্রিক দার্শনিক, গণিতবিদ এবং পিথাগোরাসবাদী ভ্রাতৃত্বের জনক যার প্রকৃতি ধর্মীয় হলেও তা এমন সব নীতির উদ্ভব ঘটিয়েছিল যা পরবর্তীতে প্লেটো এবং এরিস্টটলের মত দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছে।[3] তিনি এজিয়ান সাগরের পূর্ব উপকূল অর্থাৎ বর্তমান তুরস্কের কাছাকাছি অবস্থিত সামোস দ্বীপে জন্মেছিলেন। ধারণা করা হয় শৈশবে জ্ঞান অন্বেষণের তাগিদে মিশরসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ইতালির দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত গ্রিক কলোনি ক্রোতোনে চলে যান, এবং সেখানে একটি আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক ভ্রাতৃত্বমূলক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। তার অনুসারীরা তারই নির্ধারিত বিধি-নিষেধ মেনে চলত এবং তার দার্শনিক তত্ত্বসমূহ শিখতো। এই সম্প্রদায় ক্রোতোনের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে যা তাদের নিজেদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাড়ায়। এক সময় তাদের সভাস্থানগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং পিথাগোরাসকে বাধ্য করা হয় ক্রোতোন ছেড়ে যেতে। ধারণা করা হয় জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি দক্ষিণ ইতালিরই আরেক স্থান মেতাপোন্তুমে কাটিয়েছিলেন।

পিথাগোরাস (Πυθαγόρας)
পিথাগোরাসের আবক্ষ মূর্তি কাপিতোলিনে জাদুঘর, রোম
জন্ম৫২৭/ ৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
সামোস, তুরস্কের উপকূলবর্তী এজিয়ান সাগরের দ্বীপ
মৃত্যু৪৯৭/৪৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (৭৫ বছরের কম বয়সে)
মেতাপোন্তুম, দক্ষিণ ইতালি
যুগপ্রাচীন দর্শন
অঞ্চলপাশ্চাত্য দর্শন
ধারাপিথাগোরাসবাদ
আগ্রহঅধিবিদ্যা, সংগীত, গণিত, নীতিশাস্ত্র, রাজনীতি
অবদানমুজিকা উনিভের্সালিস, , Pythagorean tuning, পিথাগোরাসের উপপাদ্য

পিথাগোরাস কিছু লিখেননি এবং সমসাময়িক কারও রচনাতেও তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। উপরন্তু ১ম খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে তাকে বেশ অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হতে থাকে। সে সময় ভাবা হতো পিথাগোরাস একজন স্বর্গীয় স্বত্তা এবং গ্রিক দর্শনে যা কিছু সত্য (এমনকি প্লেটো এবং এরিস্টটলের অনেক পরিণত চিন্তাধারা) তার সবই তিনি শুরু করেছেন। এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে এমনকি কিছু গ্রন্থ পিথাগোরাস ও পিথাগোরাসবাদীদের নামে জাল করা হয়েছিল। তাই তার সম্পর্কে সত্যটা জানার জন্য মোটামুটি নির্ভেজাল এবং প্রাচীনতম প্রমাণগুলোর দিকে তাকাতে হবে কারণ স্পষ্টতই পরবর্তীরা তার ব্যাপারে তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছিল। বর্তমানে পিথাগোরাস প্রধাণত গণিতবিদ ও বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হলেও প্রাচীনতম প্রমাণ বলছে, তার সময় বা তার মৃত্যুর দেড় শত বছর পর প্লেটো ও এরিস্টটলের সময়ও তিনি গণিত বা বিজ্ঞানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন না। তখন তিনি পরিচিত ছিলেন, প্রথমত মৃত্যুর পর আত্মার পরিণতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যিনি ভাবতেন আত্মা অমর এবং ধারাবাহিকভাবে তার অনেকগুলো পুনর্জন্ম ঘটে, দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান বিষয়ে পণ্ডিত, তৃতীয়ত একজন ঐন্দ্রজালিক যার স্বর্ণের ঊরু আছে এবং যিনি একইসাথে দুই স্থানে থাকতে পারেন এবং চতুর্থত, একটি কঠোর জীবন ব্যবস্থা যাতে খাদ্যাভ্যাসের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং আচারানুষ্ঠান পালন ও শক্ত আত্ম-নিয়ন্ত্রয়ণের নির্দেশ আছে তার জনক হিসেবে।[4]

কোনগুলো পিথাগোরাসের কাজ আর কোনগুলো তার উত্তরসূরীদের কাজ তা নির্ধারণ করা বেশ কষ্টকর। তারপরও ধারণা করা হয় পিথাগোরাস বস্তু-জগৎ ও সঙ্গীতে সংখ্যার গুরুত্ব ও কার্যকারিতা বিষয়ক তত্ত্বের জনক।[3] অন্যান্য প্রাক-সক্রেটীয় দার্শনিকের মত তিনিও বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে ভেবেছিলেন কিনা এবং আসলেই তাকে গণিতবিদ বলা যায় কিনা এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে প্রাচীনতম নিদর্শন বলছে, পিথাগোরাস এমন একটি বিশ্বজগতের ধারণা দিয়েছিলেন যা নৈতিক মানদণ্ড এবং সাংখ্যিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত। প্লেটোর মহাজাগতিক পুরাণে যেসব ধারণা পাওয়া যায় তার সাথে এর বেশ মিল আছে। বিভিন্ন সংখ্যার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ পিথাগোরাসের উপপাদ্য। কিন্তু এই উপপাদ্য তিনি প্রমাণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত পিথাগোরীয় দর্শনের উত্তরসূরীরাই এর প্রকৃত প্রতিপাদক। এই উত্তরসূরীরা তাদের গুরুর বিশ্বতত্ত্বকে দিনদিন আরও বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক দিকে নিয়ে গেছে যাদের মধ্যে ফিলোলাউস এবং Archytas উল্লেখযোগ্য। পিথাগোরাস মৃত্যু-পরবর্তী আত্মার অপেক্ষাকৃত আশাবাদী একটি চিত্র দাঁড় করিয়েছিলেন এবং জীবন যাপনের এমন একটি পদ্ধতি প্রদান করেছিলেন যা দৃঢ়তা ও নিয়মানুবর্তিতার কারণে অনেককে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল।[4] বলা হয়ে থাকে তিনিই প্রথম যে নিজেকে দার্শনিক বা প্রজ্ঞার প্রেমিক হিসেবে দাবী করেছিলেন।[5]

জীবন

পিথাগোরাসের আবক্ষ মূর্তি, ভ্যাটিকান জাদুঘর

হিরোডটাস, Isocrates, এবং আরও অনেক প্রাচীন লেখকেরা একমত যে, পিথাগোরাস পূর্ব এজিয়ান সাগরের গ্রিক দ্বীপ সামোসে জন্মেছিলেন। আমরা এও জানি যে তিনি Mnesarchus-এর সন্তান ছিলেন।[6] যিনি একজন রত্ন খোঁদাইকার অথবা বণিক ছিলেন। Pythian, অ্যাপোলো এবং Aristippus-এর সাথে মিলিয়ে তার নাম রাখা হয়েছিলো পিথাগোরাস। প্রবাদ আছে, "তিনি Pythian-এর মতই সত্যবাদী ছিলেন" তাই Pythian থেকে তার নামের প্রথম অংশ Pyth পাওয়া যায় আর "বলা" অর্থে পাওয়া যায় agor। Iamblichus-এর গল্প অনুসারে Pythian দৈববাণী করেছিলেন যে পিথাগোরাসের গর্ভবতী মা অসম্ভব সুন্দর, প্রজ্ঞাবান ও মানুষের জন্য কল্যাণকর একজন সন্তান প্রসব করবে।[7] একটি পরবর্তী সূত্র জানায় যে তার মায়ের নাম ছিল Pythais[8] তার জন্মবছর সম্পর্কে বলতে গিয়ে Aristoxenus বলেন, পিথাগোরাস তার ৪০ বছর বয়সে যখন সামোস ছেড়ে যান তখন Polycrates-এর রাজত্ব, সে হিসাবে তিনি ৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে জন্মেছিলেন।[9]

স্বভাবতই আদি জীবনীকারগন খুঁজে দেখতে চেয়েছিলেন পিথাগরাসের এহেন প্রজ্ঞার উৎস। যদিও নির্ভরযোগ্য তথ্য তেমন নাই, কিন্তু পিথাগরাসের শিক্ষকদের একটা লম্বা তালিকা পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে কেউ পুরাদস্তুর গ্রীক, আবার কেউ পুরাদস্তুর মিশরীয় কিংবা পূর্বদেশীয়। তালিকায় রয়েছেন Creophylus of Samos,[10] Hermodamas of Samos,[11] বায়াস,[10] থেলেস,[10] আনাক্সিম্যান্ডার,[12] এবং Pherecydes of Syros.[13]। শোনা যায় তিনি Themistoclea নামের এক আধ্যাত্মিক সাধুর কাছে নীতিশাস্ত্রের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন। [14][15] বলা হয়, মিশরীয় দের কাছে তিনি শিখেছিলেন জ্যামিতি, ফনিশিয়ানদের কাছে পাটিগনিত, ক্যালডীয়ানদের কাছে জ্যোতির্বিজ্ঞান, মাগিয়ানদের কাছে শিখেছিলেন ধর্মতত্ব এবং জীবনযাপনের শিল্প।[16] অন্যান্য সকল শিক্ষকদের মধ্যে তার গ্রিক শিক্ষক Pherecydes এর নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যায়।

Diogenes Laertius প্রদত্ত তথ্য অনুসারে পিথাগোরাস বিপুল পরিমানে ভ্রমন করেছিলেন। জ্ঞান আহরন আর বিশেষত সূফী দলগুলোর কাছ থেকে ইশ্বরের স্বরূপ সন্ধান এর উদ্দেশ্যে তিনি মিশর, ছাড়াও আরবদেশগুলো, ফোনেশিয়া, Judaea, ব্যাবিলন, ভারতবর্ষ পর্যন্ত ভ্রমণ করেন।[17] প্লুতার্ক তার On Isis and Osiris নামক বইতে জানান, মিশর ভ্রমণ কালে পিথাগোরাস Oenuphis of Heliopolis এর কাছ থেকে মূল্যবান নির্দেশনা পান।[18] অন্যান্য প্রাচীন লেখকরাও তার মিশর ভ্রমনের কথা উল্লেখ করেছেন।[19]

মিশরীয় পুরোহিতদের কাছে পিথাগোরাস কতটুকু কি শিখেছিলেন বা আদৌও কিছু শিখেছিলেন কিনা তা বলা কঠিন। যে প্রতীকীবাদ পিথাগোরিয়ানরা আয়ত্ত্ব করেছিলেন তার সাথে মিশরের সুনির্দিষ্ট কোন যোগাযোগ খুজে পাওয়া যায় না। যে সব গোপন ধর্মীয় প্রথা পিথাগোরিয়ানগন পালন করতেন সেটা গ্রীসের ধর্মীয় মানসের ভেতরে নিজে নিজেই বিকাশিত হতে পারত, প্রাচীন মিশরীয় ঐন্দ্রজালিকতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকেই। যে দর্শন ও প্রতিষ্ঠান সমূহ পিথাগোরাস গড়ে তুলেছিলেন, সেটা সে সময়ের প্রভাবপুষ্ট যে কোন গ্রিক মনিষী সেটা সম্ভব করে তুলতে পারতেন। প্রাচীন গ্রন্থকারগণ পিথাগোরাসের ধর্মীয় এবং নন্দনতাত্ত্বিক স্বকীয়তার সাথে অর্ফিক কিংবা ক্রিটান রহস্যের[20] কিংবা Delphic oracle[21] এর সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করে গিয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র

  1. "তার জন্মের তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় না। Aristoxenus-এর বক্তব্য সঠিক বলে মেনে নিলে (ap. Porph. V.P. 9) তিনি চল্লিশ বছর বয়সে Polycrates-এর স্বৈরশাসন থেকে বাঁচতে সামোস ত্যাগ করেন, আমরা ধরে নিতে পারি তিনি ৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বা তার কিছু পূর্বে জন্মেছিলেন। যদিও প্রাচীন কালে তার বয়সের বিভিন্ন হিসাব পাওয়া যায়, এ বিষয়ে সবাই একমত যে তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন এবং সম্ভবত ৭৫ থেকে ৮০ বছর বয়সে মারা যান।" William Keith Chambers Guthrie, (1978), A history of Greek philosophy, Volume 1: The earlier Presocratics and the Pythagoreans, page 173. Cambridge University Press
  2. Biographies
  3. Pythagoras, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা
  4. Huffman, Carl, "Pythagoras", The Stanford Encyclopedia of Philosophy (Fall 2011 Edition), Edward N. Zalta (ed.)
  5. Cicero, Tusculan Disputations, 5.3.8–9 = Heraclides Ponticus fr. 88 Wehrli, Diogenes Laërtius 1.12, 8.8, Iamblichus VP 58. Burkert attempted to discredit this ancient tradition, but it has been defended by C.J. De Vogel, Pythagoras and Early Pythagoreanism (1966), pp. 97–102, and C. Riedweg, Pythagoras: His Life, Teaching, And Influence (2005), p. 92.
  6. Herodotus, iv. 95, Isocrates, Busiris, 28–9; Later writers called him a Tyrrhenian or Phliasian, and gave Marmacus, or Demaratus, as the name of his father, Diogenes Laërtius, viii. 1; Porphyry, Vit. Pyth. 1, 2; Justin, xx. 4; Pausanias, ii. 13.
  7. Riedweg, Christoph (২০০৫)। Pythagoras: His Life, Teaching and Influence। Cornell University। পৃষ্ঠা 5–6, 59, 73।
  8. Apollonius of Tyana ap. Porphyry, Vit. Pyth. 2
  9. Porphyry, Vit. Pyth. 9
  10. Iamblichus, Vit. Pyth. 9
  11. Porphyry, Vit. Pyth. 2, Diogenes Laërtius, viii. 2 C. Riedweg, S. Rendall আইএসবিএন ০-৮০১৪-৭৪৫২-৩ Retrieved 2012-02-08
  12. Iamblichus, Vit. Pyth. 9; Porphyry, Vit. Pyth. 2
  13. Aristoxenus and others in Diogenes Laërtius, i. 118, 119; Cicero, de Div. i. 49
  14. Mary Ellen Waithe, Ancient women philosophers, 600 B.C.–500 A.D., p. 11
  15. Malone, John C. (৩০ জুন ২০০৯)। Psychology: Pythagoras to present। MIT Press। পৃষ্ঠা 22। আইএসবিএন 978-0-262-01296-6। সংগ্রহের তারিখ ২৫ অক্টোবর ২০১০
  16. Porphyry, Vit. Pyth. 6
  17. Diogenes Laërtius, viii. 2; Porphyry, Vit. Pyth. 11, 12; Iamblichus, Vit. Pyth. 14, etc.
  18. Plutarch, On Isis And Osiris, ch. 10.
  19. Antiphon. ap. Porphyry, Vit. Pyth. 7; Isocrates, Busiris, 28–9; Cicero, de Finibus, v. 27; Strabo, xiv.
  20. Iamblichus, Vit. Pyth. 25; Porphyry, Vit. Pyth. 17; Diogenes Laërtius, viii. 3
  21. Ariston. ap. Diogenes Laërtius, viii. 8, 21; Porphyry, Vit. Pyth. 41

অন্যান্য লিংক

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.