হাইপেশিয়া
হাইপেশিয়া (প্রাচীন গ্রিক ভাষায় Υπατία হুপাতিয়া) (৩৭০ - মার্চ, ৪১৫) বিখ্যাত মিশরীয় নব্য প্লেটোবাদী দার্শনিক এবং গণিতজ্ঞ। মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম উল্লেখযোগ্য গণিতজ্ঞ। তিনি সবচেয়ে প্রসিদ্ধ আলেক্সান্দ্রিয়ান প্যাগান ও ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তার সাফল্য উল্লেখ করার মতো।
হাইপেশিয়া | |
---|---|
![]() হাইপেশিয়ার একটি আনুমানিক ছবি | |
জন্ম | আনু. 350–370 |
মৃত্যু | ৪১৫[1] আলেকজান্দ্রিয়া |
যুগ | Ancient philosophy |
জীবনকাল
হাইপেশিয়ার পিতার নাম থিওন। তিনিও একজন খ্যাতিমান গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক ছিলেন এবং হাইপেশিয়াকে মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিতকরণে তার ভূমিকাই ছিল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। যাহোক ৪০০ সালের দিকে হাইপেশিয়া আলেক্সান্দ্রিয়ার নব্য প্লেটোবাদী দর্শনধারার মূল ব্যক্তিত্বে পরিণত হন এবং খ্যাতির চরম শিখরে আরোহণ করেন। তার মধ্যে অসাধারণ বাগ্মীতা, বিনয় এবং সৌন্দর্য্যের সার্থক সম্মিলন ঘটেছিল। এজন্য তিনি অসংখ্য শিক্ষার্থীর আকর্ষণ লাভ করতে সমর্থ হন। তাদের মধ্যে একজন হলেন সিরিনের সাইনেসিয়াস (Synesius) যিনি পরবর্তীতে (৪১০ খ্রিষ্টাব্দে) টলেমাইস নামক অঞ্চলের বিশপ হন। হাইপেশিয়ার কাছে সাইনেসিয়াসের লেখা কিছু চিঠি এখনও বর্তমান রয়েছে। তার কোন ছবি পাওয়া যায়নি, তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর লেখক ওসাহিত্যিকেরা তাকে সৌন্দর্য্যে দেবী এথেনের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
মৃত্যু
তার মৃত্যুর সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হলে ইতিহাসের বেশকিছু ঘটনার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সম্রাট থিওডোসিয়াস ১ ৩৮০ সালে প্যাগানবাদ এবং অরিয়ানবাদের বিরুদ্ধে একটি অসহিষ্ণুতা নীতির সূচনা ঘটান। তিনি ৩৭৯ থেকে ৩৯২ সাল পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন এবং এরপর থেকে ৩৯৫ সাল পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন। ৩৯১ সালে তিনি আলেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ থিওফিলাসের পত্রের জবাবে মিশরের ধর্মীয় সংস্থানসমূহকে ধ্বংস করে দেয়ার অনুমতি প্রদান করেন। এর পরপরই খৃস্টান জনতা সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে আলেক্সান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার এবং সারাপিস মন্দির সহ অন্যান্য প্যাগান সৌধগুলো ধ্বংস করে দেয়।
৩৯৩ সালে আইনসভার আইনের মাধ্যমে এ ধরনের স্থাপনা বিশেষ করে ইহুদী মন্দির ধ্বংসে আক্রমণাত্মক কার্যাবলির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু ৪১২ সালে আলেক্সান্দ্রিয়ার উর্ধ্বতন যাজক হিসেবে সিরিলের ক্ষমতায় আসার পর আবার সেই ধ্বংসাত্মক কাজগুলো শুরু হয়। ৪১৪ সালে আলেক্সান্দ্রিয়ায় ইহুদী বিতারণের সূচনার মাধ্যমে বিপর্যয়ের ঘনঘটা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৪১৫ সালে একদল ধর্মোন্মাদ খৃস্টান জনতার হাতে হাইপেশিয়া নিহত হন। বর্ণনামতে রথে করে ফেরার পথে উন্মত্ত জনতা তার উপর হামলা করে এবং হত্যার পর তার লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। অনেক বিশেষজ্ঞই তার মৃত্যুকে প্রাচীন আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্র আলেক্সান্দ্রিয়ার পতনের সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অবদান
গণিত
- তিনি শিক্ষা এবং বিজ্ঞানকে সঠিক উপমার মাধ্যমে প্রতিকায়িত করেন। তৎকালীন সময়ে এ ধরনের শিক্ষাকে প্যাগান রীতিনীতি ও সংস্কৃতির সাথে একীভূত মনে করা হত এবং এর ফলে জ্ঞানের বিকাশের পথে বাঁধার সৃষ্টি হয়, আর এ কারণেই তাকে অনেক প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়।
- সুডা লেক্সিকন নামক দশম শতাব্দীর একটি বিশ্বকোষের বর্ণনামতে তিনি কয়েকটি পুস্তকের উপর ভাষ্য রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে:
- আলেক্সান্দ্রিয়ার ডায়োফ্যান্টাস রচিত এরিথমেটিকা।
- পার্গার অযপোলোনিয়াস রচিত কনিক্স।
এই বইগুলো পরে আর পাওয়া যায়নি। তবে এরিথমেটিকা বইটির বর্ধিত আরবি সংস্করণে তার ভাষ্য সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
জ্যোতির্বিজ্ঞান
- জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক একটি সারগ্রন্থের উপর তিনি ভাষ্য রচনা করেন। অনেকের মতে এটি ছিল টলেমি রচিত আলমাজেস্ট। যেমন তার পিতা থিওনের সূত্রে জানা যায় যে, হাইপেশিয়া আলমাজেস্টের উপর তার লেখা ভাষ্যটির পুনঃপরীক্ষণ করেছিলেন।
- তার অধিকাংশ কীর্তি সম্বন্ধে যা জানা যায় তার প্রায় পুরো অংশেরই দলিল গৃহীত হয়েছে সাইনেসিয়াসের পত্রাবলী থেকে। সাইনেসিয়াস উল্লেখ করেন যে হাইপেশিয়া একটি অ্যাস্ট্রোল্যাব এবং একটি হাইড্রোস্কোপ তৈরিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। উল্লেখ্য সপ্তদশ শতাব্দীতে পিয়ের দ্য ফের্মা হাইড্রোস্কোপকে হাইড্রোমিটার নামে নামাঙ্কিত করেন। যাহোক এ থেকে বুঝা যায় যে হাইপেশিয়া নিজেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিতের চর্চায় উৎসর্গ করেছিলেন।
দর্শন
- হাইপেশিয়া দুজন বিখ্যাত নব্য প্লেটোবাদী ব্যক্তিত্বের গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক শিক্ষা ও পদ্ধতির উপর ভাষণ প্রদান করতেন। এই দুজন হলেন প্লোটিনাস (২০৫-২৭০ খৃস্টপূর্বাব্দ) যিনি নব্য প্লেটোবাদের জনক হিসেবে খ্যাত এবং ল্যাম্বলিকাস (২৫০-৩৩০ খৃস্টপূর্বাব্দ) যিনি নব্য প্লেটোবাদের সিরিয় ধারায় উদ্ভাবক।
- তার দর্শন ছিল তৎকালীন যুগের সাপেক্ষে অনেক পরিপক্ক ও বৈজ্ঞানিক এবং তার মাঝে পৌরাণিকতা ছিলনা বললেই চলে যদিও তার দর্শন সম্বন্ধে কোন সুস্পষ্ট দলিল বর্তমানে অবশিষ্ট নেই। দর্শনের ব্যাপারে তিনি আপোষহীনভাবে প্যাগান মতবাদের অনুসারী ছিলেন এবং তার এই চিন্তাধারার প্রকৃতি তৎকালীন অন্যান্য নব্য প্লেটোবাদী দর্শনধারা হতে স্বতন্ত্র ছিল।
- তার দুটি বিখ্যাত উক্তি থেকে তার দর্শনের অকাট্যতা প্রতিভাত হয়:
- তোমার চিন্তা করার অধিকার সংরক্ষণ কর। এমনকি ভুলভাবে চিন্তা করা একেবারে চিন্তা না করা থেকে উত্তম।
- কুসংস্কারকে সত্য হিসেবে শিক্ষা দেয়া একটি ভয়ংকরতম বিষয়।
তার এই সকল চিন্তাধারাই হয়তোবা সিরিলকে এতোটা উত্তেজিত করে থাকবে যে সে খৃস্টান জনতাকে এতোটা উন্মত্ত করতে সমর্থ হয়েছিল। আর এরই পরিণতিতে নিহত হতে হয় হাইপেশিয়াকে।
সহায়ক পাঠ্য
- হাইপেশিয়ার রূপ-সৌন্দর্য্য তার দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাথে একীভূত হয়ে তাকে আপূর্ব মহিমা দান করেছিল। তাই তৎকালীন যুগে এতোটা বিখ্যাত হয়েছিলেন। এর সাথে তার করুণ মৃত্যু যোগ হয়ে তাকে অমরত্ব দান করেছে। তার জীবন তাই অনেক লেখককেই উৎসাহিত করেছে। তার জীবনী নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল চার্লস কিংসলির লেখা "হাইপেশিয়া"।
সূত্র
- সাময়িকী, বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ
- এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা
আরও দেখুন
- মিশর
- আলেক্সান্দ্রিয়া
- প্যগানবাদ
- নব্য প্লেটোবাদ
- গণিতের ইতিহাস
বহিঃস্থ লিংক
- Petta, Adriano; Colavito, Antonino (২০০৯)। Hypatia, scientist of Alexandria, 8th March 415 A.D.। Lampi di stampa।