পাগলা কানাই

পাগলা কানাই বা কানাই শেখ (জন্ম: ১৮০৯-মৃত্যু: ১৮৮৯) আধ্যাত্নিক চিন্তা চেতনার সাধক-অসংখ্য দেহতত্ত্ব, জারি, বাউল, মারফতি, ধূয়া, মুর্শিদি গানের স্রষ্টা।

পাগলা কানাই
জন্ম
কানাই শেখ

২৫ শে ফাল্গুন ১২১৬ (৮ মার্চ ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দ)
লেবুতলা, ঝিনাইদহ মহকুমার, যশোর জেলা
মৃত্যু২৮ শে আষাঢ় ১২৯৬ (১২ জুলাই ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ)
জাতীয়তাবাংলাদেশী
পেশাবাউল
পরিচিতির কারণগীতিকবি

জীবনী

পাগলা কানাই ১৮০৯ সালে তৎকালীন যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার, বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার, লেবুতলা গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তার জীবন কেটেছে বেড়বাড়ি বোনের বাড়িতে। বাবার নাম কুড়ন শেখ, মায়ের নাম মোমেনা বিবি। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে কানাই সবার বড়। ভাইয়ের নাম উজ্জ্বল শেখ, বোন স্বরনারী। পাঠশালায় পড়াকালে তার বাবা কুড়ন শেখ মারা যান। পিতৃহারা হয়ে কানাই ভবঘুরে হয়ে যান। জীবনের তাগিদে মোমেনা বিবি কোনো উপায়ান্তর না দেখে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চেউনে ভাটপাড়া গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে কিছুদিনের মধ্যে তিনিও মারা যান। মা হারিয়ে কানাই ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ড উপজেলার বলরামপুরে ভরস মণ্ডলের বাড়িতে রাখালির কাজ নেন। বোন স্বরনারী দুই ভাইকে সেখান থেকে নিজের আশ্রয়ে শ্বশুরবাড়ি পার্শ্ববর্তী মাগুরা জেলায় বেড়াতে নিয়ে আসেন। বোনের শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো হওয়াতে কানাইয়ের গান চর্চার রাস্তা আরও সহজ হয়। কানাই বোনের বাড়ির গরুর পাল চরাতেন আর গান বাঁধতেন, তাতে সুর দিতেন।[1] ছোটবেলা থেকেই পাগলাকানাই দুরন্ত প্রকৃতির, পাগলাটে স্বভাবের এবং আধ্যাত্ম প্রেমে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। এ খেয়ালীপনার জন্যে শৈশবে স্নেহবশতঃ লোকে তার নামের সাথে "পাগলা' অভিধাটি (উপনাম) যুক্ত করে। তার কর্মকীর্তির সাথে এ পাগলা উপাধিটি অভিন্ন সূত্রে গ্রথিত হয়েছে।[2]

কর্ম জীবন

সুর দেওয়া হয়ে গেলে আপন মনে গলা ছেড়ে তা গাইতেন। অস্থির পাগল এই স্বভাবকবির কোনো জায়গায় বেশি দিন ভালো লাগত না। গরু চরানো রেখে কাজ নেন মাগুরা জেলার আঠারখাদার জমিদার চক্রবর্তী পরিবারের বেড়বাড়ির নীলকুঠিতে। দুই টাকা বেতনের সেই খালাসির চাকরি বেশি দিন করা হয়ে ওঠেনি। গানের প্রতি টানে চাকরি ছেড়ে-ছুড়ে পথে বের হন আবারও।

গরু চরাতে গিয়ে ধুয়ো জারীগান গাইতেন এবং উপস্থিত সবাই তার সঙ্গীত মুগ্ধ হয়ে শুনত। এভাবে ধুয়োজারীতে তার হাতে খড়ি হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তার কোন সঙ্গীত শিক্ষা না থাকলেও এখানকার তৎকালীন আউল-বাউল, সাধু-ফকির প্রভৃতি গুণীজনের পদচারণা সর্বোপরি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কবির আত্মার আত্ম-জিজ্ঞাসা ও আত্ম-অন্বেষণ তাকে প্রখর অধ্যাত্মজ্ঞানে পরিপূর্ণ করে তোলে। তার গানে ইসলাম ও আল্লাহর প্রিয় নবীর, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ), প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ পায়। পাগলা কানাই নিরক্ষর হলেও তার স্মৃতি ও মেধা ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তাৎক্ষনিকভাবে একের পর এক গান রচনা করতে পারতেন।[2] তিনি যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা রাজশাহী, বগুড়া প্রভৃতি স্থানে আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ গান গেয়ে বেড়াতেন।[3]

এ পর্যন্ত পাগলা কানাই রচিত গানের মধ্য মাত্র শ'তিনেক সংগৃহীত হয়েছে। মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, ড, মাযহারুল ইসলাম, আবু তালিব, আমিন উদ্দিন শাহ, দুর্গাদাস লাহিড়ী, উপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্য প্রমুখ মনীষীগণ পাগলা কানাইয়ের গানের সংগ্রহ ও গবেষণা করেছেন।

শিক্ষাজীবন

গ্রামের মক্তবে তিনি কিছুদিন পড়াশোনা করলেও চঞ্চল স্বভাবের জন্যে তার লেখাপড়া বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে তার রচিত একটি গানের মধ্যেই তার স্বভাবসুলভ অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়।[4]

বাউলজীবন

তৎকালীন সময়ে কবিত্ব প্রতিভায় লালনের পরেই তার স্থান নিরূপণ করা যায়। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও আধ্যাত্নিক চেতনায় জ্ঞানান্বিত হয়ে অপরূপ সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে দোতারা হাতে ঘুরে ফিরেছেন তিনি। তার কণ্ঠের একটি গান আজও উচ্চারিত হয় মানুষের মুখে মুখে।

পাগলা কানাই ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণ অনুসারী ছিলেন এবং ইসলাম ধর্মের বিধি বিধানগুলি সঠিকভাবে মেনে চলতেন। তার বিভিন্ন গানের মধ্য দিয়ে তার এই অভিব্যক্তি পরিস্ফুটিত হয়েছে।

যশোর জেলার কেশবপুরের রসুলপুর গ্রামের নয়ন ফকিরকে তার ওস্তাদ বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এই স্বভাব কবির সর্বাপেক্ষা পদচারণা ছিল ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। পরবর্তীতে তিনি ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ফিরে পাবনা ও সিরাজগঞ্জে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। পাবনার বিখ্যাত ভাবুক কবি ফকির আলীমুদ্দীনের সাথে তার আন্তরিক সখ্যতা গড়ে ওঠে।

এ সকল অঞ্চলের বিভিন্ন আসরে গান বেঁধে বিভিন্ন ভঙ্গীতে পরিবেশন করে হাজার হাজার শ্রোতাকুলকে ঘন্টার পর ঘন্টা সম্মোহিত করে রাখতেন পাগলা কানাই। তার কন্ঠস্বর ছিল অত্যন্ত জোরালো মধুর। ৩০/৩৫ হাজার স্রোতা তার গান মাইক ছাড়াই শুনতে পেত। তার জনপ্রিয় আধ্যাত্নিক গানের কয়েকটি লাইন।[4]

পরলোক গমন

বাংলার পথে, দোতারা হাতে, গান গেয়ে ফেরা মরমী গীতিকবি পাগলা কানাই ১৮৮৯ (বাংলা ১২৯৬ সালের ২৮ আষাঢ়) সালে মৃত্যুবরণ করেন।

পাগলা কানাইয়ের চর্চা

বর্তমানে ঝিনাইদহে পাগলা কানাই "সৃতি সংরক্ষণ পরিষদ" পাগলা কানাইয়ের সৃষ্টির গবেষণা এবং প্রচারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। পাগলা কানাই সঙ্গীত একাডেমী অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও পাগলা কানাইয়ের গানের নিয়মিত চর্চা করে যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র

  1. খেয়ালি বাউল পাগলা কানাই, প্রথম আলো পত্রিকা, লেখক : ইমরান উজ-জামান, সংগ্রহের তারিখ ৩রা মার্চ ২০১২।
  2. ঝিনাইদহের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে, কবি পাগলা কানাই।
  3. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ১১৭, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  4. যশোর.ইনফো, কবি পাগলা কানাই, লেখক : কাজী শওকত শাহী, সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ২০১২।

বহিঃসংযোগ

This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.