সিরীয় গৃহযুদ্ধ

২০১১–২০১২ এর সিরীয় অভ্যুত্থ্যান মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়ায় চলমান একটি সহিংস অভ্যুত্থান। অনেকে একে আরবের বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া সরকারবিরোধী অভ্যুত্থান তথা আরব বসন্তের অংশ হিসেবে দেখেন। ২০১১ সালের ২৬শে জানুয়ারি সিরিয়ায় শুরু হওয়া দেশব্যাপী গণ বিক্ষোভ প্রদর্শন এক সময় অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীদের দাবী ছিল রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদের পদত্যাগ, তার সরকারের ক্ষমতাচ্যুতি এবং সিরিয়া দীর্ঘ ৫ দশকের আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি (আরবি নাম: হিয্‌ব আল-বা'ত আল-আরাবি আল-ইশতিরাকি- কুত্‌র সুরিয়া) শাসনের পতন।

অভ্যুত্থান ঠেকাতে সিরীয় সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এবং তাদের বাহিনী বেশ কিছু শহর অবরোধ করে[1][2] প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, যে সৈন্যরা সাধারণ মানুষের উপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল সিরীয় সেনাবাহিনী তাদেরকে হত্যা করেছে।[3] সিরীয় সরকার দেশে সরকারি দলদ্রোহিতা অস্বীকার করেছে এবং সশস্ত্র কয়েকটি দলকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত করে।[4] ২০১১ সালের শেষদিকে বেসামরিক জনগণ ও সেনাবাহিনীর দলত্যাগী সৈন্যরা আলাদা যোদ্ধা দল গঠন করে সিরীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছে। বিদ্রোহীরা আল-জায়িশ আল-সুরিল হুর বা ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নামে একটি নামের অধীনে একত্রিত হয়ে দিনদিন আরও সংঘবদ্ধ আক্রমণ করতে থাকে। অবশ্য তাদের বেসামরিক অংশটির সংগঠিত নেতৃত্বের অভাব ছিল। অভ্যুত্থানের পেছনে কেউ কেউ বর্ণবাদের ইন্ধন আছে বলে দাবী করেছেন যদিও দু'পক্ষের কেউই তাদের কাজে বর্ণবাদের কোন ভূমিকা অস্বীকার করেছে। বিদ্রোহীদের অধিকাংশ সুন্নি মুসলিম যেখানে ক্ষমতাসীন সরকারের অধিকাংশ ব্যক্তি আলাবি (শিয়াদের একটি গোত্র) মুসলিম।[5] উল্লেখ্য সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ৭৪% সুন্নি, ১২% আলাবি এবং ১০% খ্রিস্টান।[6]

জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন উৎসের তথ্যমতে এখন পর্যন্ত ৯,১০০–১১,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে যার অধিকাংশই বিদ্রোহী দলের অন্তর্ভুক্ত, অন্যদিকে সশস্ত্র বাহিনীর নিহত হয়েছে ২,৪৭০–৩,৫০০ জন।[7][8] এর চেয়েও অনেক বেশি মানুষ আহত হয়েছে এবং কয়েক লক্ষ বিদ্রোহীকে আটক করা হয়েছে। সিরীয় সরকারের ভাষ্যমতে মৃতের সংখ্যা ৫,৭০০–৬,৪০০ যার মধ্যে ২,০০০–২,৫০০ জনই সেনাবাহিনীর, ৮০০ জনের বেশি বিদ্রোহী এবং ৩,০০০ বেসামরিক মানুষ। সরকার বিদ্রোহীদেরকে "সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল" হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।[9] জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদনে বলেছে যে ৪০০-রও বেশি শিশু নিহত হয়েছে।[10][11] সিরীয় সরকার অবশ্য এই তথ্যকে অস্বীকার করেছে এবং জাতিসংঘ বিদ্রোহীদের কাছ থেকে ভুল তথ্য পেয়েছে বলে দাবী করেছে।[12] পাশাপাশি, ৬০০-র বেশি আটক ব্যক্তি ও রাজনৈতিক বন্দি নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে।[13] ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুসারে ৪০০-র বেশি শিশু নিহত হয়েছে।[14][15] অনেক উৎস বলছে এর বাইরে আরও প্রায় ৪০০ শিশুকে কারাগারে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে।[16] সহিংসতা থেকে বাঁজতে হাজার হাজার সিরীয় শরণার্থী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী জর্ডান[17], লেবানন এবং তুরস্কে পালিয়ে গিয়েছে।[18]

সরকার-বিরোধী গোষ্ঠীকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে নির্যাতন, অপহরণ, অবৈধভাবে মানুষকে আটক করা, বেসামরিক লোক, শাবিহা ও সৈন্য হত্যা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইরানী কয়েকজন ব্যক্তিকে অপহরণ করা হয়েছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।[19] জাতিসংঘের অনুসন্ধান কমিশন ২০১২-র ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উপস্থাপন করেছে। এতে বলা হয়েছে বেসামরিক মানুষকে ঘরছাড়া করার পেছনে বিদ্রোহীদেরও হাত রয়েছে।[20]

আরব লীগ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কোঅপারেশন কাউন্সিল ফর অ্যারাব স্টেটস অফ দ্য গাল্‌ফ (জিসিসি) এবং বেশ কিছু দেশ বিদ্রোহীদের দমনে সরকারের সহিংস পন্থা অবলম্বনকে ধিক্কার জানিয়েছে। চীনরাশিয়া সরাসরি ধিক্কার জানানো থেকে বিরত থেকেছে এই যুক্তিতে যে, তা আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সামিল হবে। অবশ্য, অধিকাংশ দেশই অন্য দেশের সিরিয়াতে সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছে।[21][22] আরব লীগ সরকারের সহিংস পথ অবলম্বনের কারণে তাদের সংস্থা থেকে সিরিয়ার সদস্যপদ বাতিল করেছে।[23] অবশ্য ২০১১-র ডিসেম্বরে লীগ সিরিয়ায় একটি পর্যবেক্ষক মিশন পাঠায় সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে। সমস্যা সমাধানের শেষ চেষ্টা হিসেবে জাতিসংঘ প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি বিশেষ এনভয় সিরিয়ায় পাঠায়, কিন্তু বাশার আল-আসাদের সাথে আলোচনার পর কোন সমঝোতা ছাড়াই আনানকে সিরিয়া ত্যাগ করতে হয়।[24][25]

তথ্যসূত্র

  1. "Syrian army tanks 'moving towards Hama'"BBC News। ৫ মে ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০১২
  2. "'Dozens killed' in Syrian border town"Al Jazeera। ১৭ মে ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১১
  3. "'Defected Syria security agent' speaks out"Al Jazeera। ৮ জুন ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ২১ জুন ২০১১
  4. "Syrian army starts crackdown in northern town"Al Jazeera। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১১
  5. Sengupta, Kim (২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। "Syria's sectarian war goes international as foreign fighters and arms pour into country"The Independent। Antakya। সংগ্রহের তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১২
  6. "Syria (05/07)"। State.gov। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১০-২৫
  7. Arab League delegates head to Syria over 'bloodbath'
  8. "Number as a civil / military"। Translate.googleusercontent.com। সংগ্রহের তারিখ ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২
  9. 2,500 security forces (15 March-12 March), 700 insurgents (15 March-13 September), 16 insurgents (25 November), 4 insurgents (12 December), 27 insurgents (26 December-20 January), ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১২-০৭-১৬ তারিখে 30 insurgents (3-5 February), 11 insurgents (1 February), 3 insurgents (29 February), 24 insurgents (1 March), 16 insurgents (10 March), 3,012 civilians (15 March-18 January), total of 6,343 reported killed
  10. "UNICEF says 400 children killed in Syria unrest"Google News। Geneva। Agence France-Presse। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১২
  11. Peralta, Eyder (৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। "Rights Group Says Syrian Security Forces Detained, Tortured Children: The Two-Way"NPR। সংগ্রহের তারিখ ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২
  12. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৬ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মার্চ ২০১২
  13. Fahim, Kareem (৫ জানুয়ারি ২০১২)। "Hundreds Tortured in Syria, Human Rights Group Says"The New York Times
  14. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২
  15. http://www.unmultimedia.org/radio/english/2012/02/unicef-says-400-children-killed-in-syria/
  16. "UNICEF says 400 children killed in Syria"The Courier-Mail। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২
  17. "Syria: Armed Opposition Groups Committing Abuses"Human Rights Watch। ২০ মার্চ ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ২০ মার্চ ২০১২
  18. "Open Letter to the Leaders of the Syrian Opposition Regarding Human Rights Abuses by Armed Opposition Members"Human Rights Watch। ২০ মার্চ ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ২০ মার্চ ২০১২
  19. http://www.bbc.co.uk/news/world-middle-east-16561493
  20. "NATO rules out Syria intervention"Al Jazeera। ১ নভেম্বর ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১২ নভেম্বর ২০১১
  21. MacFarquhar, Neil (12 Novermber 2011)। "Arab League Votes to Suspend Syria"The New York Times। সংগ্রহের তারিখ 12 November 2011 এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  22. Syria crisis: UN mission 'last chance' to avoid civil war, BBC News
  23. সমঝোতা ছাড়াই দামেস্ক ছাড়লেন কফি আনান, প্রথম আলো, ১৩ই মার্চ, ২০১২
This article is issued from Wikipedia. The text is licensed under Creative Commons - Attribution - Sharealike. Additional terms may apply for the media files.